রাতের দিকে ঘাটটা বেশ নিরিবিলি৷ কে বলবে যে এ'খানেই দিনেরবেলা একটা ছোটোখাটো মেলা বসে যায় প্রতিদিন৷ পাশেই সুপ্রাচীন মন্দির, লোকে বলে বড় জাগ্রত এ'খানে অধিষ্ঠিত দেবী। এককালে নরবলি হত, এখন শুধু প্রতি অমাবস্যায় পাঁঠাবলি হয়৷ প্রতিদিন ভোরবেলা থেকে ঘাট ভরে যায় মানুষে, ভক্তরা এ'খানে এসেই স্নানটান করে৷ দোকানপাটও রয়েছে বেশ কিছু, পুজোসামগ্রী থেকে কচুরিমিষ্টির দোকান, এমন কি ভাতের হোটেলও আছে দু'চারটে৷ কিছু নৌকাও থাকে, অল্প ভাড়ায় দিব্যি আধঘণ্টা নদীর বুকে ঘুরে আসা যায়। অন্ধকার হলেই অবশ্য সব শুনশান; শুধু হরেনের চায়ের দোকান খোলা থাকে৷
মিহিরবাবু ভক্তও নন, ট্যুরিস্টও নন৷ কাজেই দিনেরবেলা এ'অঞ্চলটা এড়িয়ে চলেন। সন্ধ্যের পরেই অবশ্য তাঁর এ'দিকে আসাটা জরুরী। হরেনের সঙ্গে দু'হাত তাস খেলে বাঁধানো ঘাটে একটা জুতসই জায়গা বেছে নিয়ে খানিকক্ষণ বসে থাকেন৷ খানিকক্ষণ নদীর হাওয়া খাওয়া আর গুনগুন করে মুকেশের গান গাওয়া৷ রাত আটটার পর দোকান বন্ধ করে ঘাটের দিকে এগিয়ে এসে হাঁক পাড়েন হরেন, "ওঠো মিহিরদা, রাত হল"৷
ঘাড় ঘুরিয়ে মিহিরবাবু বলবেন, "ঝাঁপ নামিয়েছিস'? এরপর উত্তরের অপেক্ষা না করেই উঠে আসবেন৷
এরপর ঘাটে দাঁড়িয়েই খানিকক্ষণ খেজুরে গপ্প চালান দু'জনে৷ এরপর গল্পের সুতো কাটতে না দিয়ে দু'জনে হেঁটে ফেরেন।
এ নিয়ম পালটায় না৷
মিহিরবাবু রোজ রাতে নদীর দিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন৷ বুকের ভিতরের হিমশীতল ওঠানামাগুলোকে শত চেষ্টা করেও দাবিতে রাখতে পারেন না ভদ্রলোক৷ মুকেশের গানের সুরেও বুকের ধড়ফড়ানি থামে না৷ হরেনকে ঠকাতে মন চায় না, কিন্তু আজ পর্যন্ত অন্য কোনও উপায় খুঁজে পাননি ভদ্রলোক৷
মাঝেমধ্যে মনে হয় পুলিশের কাছে গিয়ে সমস্তটাই জানিয়ে দেবেন৷ তারপর যা হয় হবে৷ কিন্তু পরক্ষণেই ব্যাপারটা অনেকেত কানেই গোলমেলে ঠেকবে৷ তাছাড়া তিনি পথ থেকে সরে গেলেই আবার খুনখারাপি শুরু হবে৷ এই রক্তবীজের দলকে থামানো সহজ নয়, একমাত্র তিনিই পারেন এদের ঘোল খাইয়ে শান্ত রাখতে৷ মিহিরবাবু এক বড় অদ্ভুত বংশের মানুষ৷ তিনি নিজে বিয়েথা করেননি, তাঁর ভেবে ভালো লাগে যে তাঁর পর আর এই বংশের পাপ কাউকে বয়ে বেড়াতে হবেনা৷ কেউ না জানুক, মিহিরবাবু জানেন যে এ মন্দিরের নরবলি এখনও বন্ধ হয়নি৷ বছরে তেরোটা নরবলি না দেওয়া হলে নাকি দেবী পুজো গ্রহণ করেন না। অন্তত যে পুরোহিত বংশের শরিকদের একছত্র অধিকার আজও বহাল আছে, তাদের মত তেমনই৷ আর মিহিরবাবুরা বংশানুক্রমেই সে পুরোহিত বংশের ঋণে বাঁধা পড়ে৷ এই বিশ্রী কাজটাও বংশানুক্রমেই মিহিরবাবুর কাঁধে এসে চেপেছে৷ নয় পুরুষ ধরে এ মন্দিরের নরবলি দেন দিয়েছে মিহিরবাবুরই বংশের পুরুষরা। গত একশোবছর ধরে অবশ্য মন্দির প্রাঙ্গণে আর বলি হয়না, কিন্তু মিহিরবাবুর বাপ-দাদুদের দায়িত্ব ছিল বছরে অন্তত তেরোবার মানুষ খুন করে তাজা রক্ত মন্দিরে নিয়ে যাওয়া৷ মিহিরবাবুর কাজটাও পালটায়নি, তাঁর স্কুলমাস্টারির কাজটা স্রেফ দেখনাই।
এ পাপের বোঝা হালকা করার উপায় খুঁজে পেয়েছেন মিহিরবাবু। তাঁর শেষ শিকার হরেন৷ বয়সে সামান্য ছোট হলেও হরেন তার ছেলেবেলার বন্ধু। আজ থেকে বছর দশেক আগে একবার, সুবিধেমত শিকার না পেয়ে অস্থির হয়ে উঠেছিলেন মিহিরবাবু। সময়মত মন্দিরে রক্ত পৌঁছে দিতে না পারলে পুরোহিতের বংশরা তাঁর ঘটিবাটি কেড়ে নেবে, গুমখুনও করতে পারে। কাজেই একরকম বাধ্য হয়েই রাতের বেলা বাড়ি ফেরার মুখে খুন করতে হয়েছিল অসহায় হরেনকে৷ ভাগ্যিস হরেনের পরিবার-পরিজন বলতে কেউই ছিল না, কাউকে বিধবা হতে হয়নি, কোনও শিশু পিতৃহারা হয়নি৷
এই হরেনই ভাগ্য খুলে দিয়েছিল মিহিরবাবুর৷ আসলে খুন হয়েও কিছুতেই নিজের মৃত্যুটাকে পাত্তা দেয়নি হরেন৷ আজও সে নিয়মতি নিজের চায়ের দোকানে এসে বসে। কিছুতেই টের পায়না যে কোনও খদ্দেরই তার দোকানমুখো হয়না, কেউ তাঁকে দেখতেই পারেনা৷ শুধু সন্ধ্যের পর মিহিরবাবু তাঁর দোকানে এসে বসে; তাস পেটায় আর গল্প করে। সবচেয়ে বড় কথা, এখনও হরেনের গলায় ছুরি বসালে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোয়৷ কী আশ্চর্য! কাজেই বছরে তেরোবার তাঁর গলায় ছুরি বসিয়েই নিজের দায়িত্ব সেরে ফেলতে পারেন মিহিরবাবু। সে রক্ত এতটাই তাজা যে পুরোহিতরাও সন্দেহ করেনি কোনওদিন৷
কিন্তু প্রতিবার খুন হওয়ার মুখে মিহিরবাবু বিশ্বাসঘাতকতায় বিধ্বস্ত হয়ে পড়েন হরেন। আর প্রতিবারই পরের দিন সকালে সমস্ত ভুলে গিয়ে চায়ের দোকানের পরিত্যক্ত গুমটিটায় এসে উদয় হন তিনি। আর তারপর হাসিমুখে সন্ধ্যেবেলা মিহিরবাবুর সঙ্গে তাস খেলতে বসা।
বহু খুনের অপরাধ থেকে মিহিরবাবুকে মুক্তি দিয়েছেন হরেন৷ তাই আজও সাহস করে সত্যি কথাটা মিহিরবাবু তাঁকে বলে উঠতে পারেননি৷ অবশ্য হরেনকে তিনি সত্যিই স্নেহ করেন, তাঁর প্রতি মিহিরবাবু কৃতজ্ঞতার শেষ নেই৷
আজও, হরেনের "ওঠো মিহিরদা, রাত হল" ডাক শুনে সস্নেহে ঘুরে তাকিয়েছিলেন তিনি৷ উঠে হরেনের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে পকেটে হাত দিয়ে শোধন করা ছুরিটার হাতলে হাত বুলিয়েও নিয়েছিলেন তিনি৷ বছরের তেরো নম্বর খুনটা এ'বার সেরে ফেলতে হবে৷ আজ অমাবস্যা৷
No comments:
Post a Comment