রোজ অফিস থেকে ফেরার পথে শ্যামলের দোকানে দাঁড়িয়ে এককাপ চা আর দু'টো বিস্কুট খাই৷ অফিস না থাকলেও সন্ধ্যের এই সময়টা এ'দিকে ঢুঁ মেরে যাই৷ কোনও যে ইয়ারদোস্তদের আড্ডার টানে আসি তাও নয়। আমি একা মানুষ, বেশি গল্পগুজবে সবিশেষ স্বস্তিও পাই না৷
শ্যামলের চা আহামরি না হলেও সে'টার মধ্যের কড়া ব্যাপারটা আমার পছন্দ, আর ওই অস্পষ্ট একটা কয়লামাখানো সুবাসটাও বেশ৷ আমার মতই, শ্যামলও বেশি কথার মানুষ নয়৷ তবে আমি অলস, শ্যামল কর্মঠ; সারাক্ষণ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে৷ চায়ের সসপ্যান বসাচ্ছে, মামলেট ভাজছে, হিসেব লিখছে, খদ্দেরের খেজুর সামাল দিচ্ছে - নিঃশব্দে, হাসিমুখে। এক মুহূর্তের জন্যও সে জিরোচ্ছে না৷
চায়ে চুমুক দিতে দিতে আমি শ্যামলের দোকানের উলটো দিকের পেল্লায় আধভাঙ্গা বাড়িটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে থাকি৷ প্রতিদিন, বহুবছর ধরে এ' নিয়মে আমি অভ্যস্ত৷ ব্যাপারটা অনেকটা সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকার মত৷ বাড়িটা গায়ে একটা মার্বেল ফলক আছে; সে'টাও খানিকটা ভাঙা৷ তা'তে লেখা "স্থাপিত ঃ ১৮৬-"। ফলকের খানিকটা খসে পড়ায় শেষ সংখ্যাটা বোঝা যায় না৷ তবে ওই, অন্তত দেড়শো বছরেরও বেশি পুরনো৷ ফলকের পাশেই একটা বোর্ড লাগানো, সে'টা কর্পোরেশজ থেকে টাঙিয়ে গেছেঃ "বিপজ্জনক বাড়ি! সাবধান! নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখুন"৷ সেই বোর্ডটার বয়সও অন্তত বছর কুড়ি তো হবেই, রঙ চটেছে, টিন গেছে তুবড়ে৷ কী একটা বিশ্রী মামলার পাকে পড়ে থাকায় ও বাড়ি ভেঙে ফেলার ব্যবস্থাও হয়নি৷
বছর চল্লিশ আগে দুই যুযুধান পরিবার এখানে বাস করত। দিনের বেলা আদালতে গিয়ে দুই পরিবারের বাবুরা বচসা চালাতেন নিজেদের উকিল লেলিয়ে দিয়ে। দুপুরে গৃহিণীরা ঝগড়া জমাতেন ছাতে৷ সন্ধ্যেবেলা বাড়ির উঠোনে দুই পরিবারের বখাটে ছেলেপিলেরা অশ্রাব্য ভাষায় সে ঝগড়া টেনে নিয়ে যেত, মাঝেমধ্যে ব্যপারটা হাতাহাতি পর্যন্ত গড়াত৷ আর মাঝেরাত্রে, উঠোনে মাদুর পেতে দুই পরিবারের মাথা, অশীতিপর দু'ই বৃদ্ধ একসঙ্গে বসে নেশাভাং করতেন আর দাবা খেলতেন৷
এ'সব অবশ্য সবই আমার শোনা গল্প৷ চাকরির সুবাদে আমি এ পাড়ায় এসেছি বছর দশেক হল৷ আমি বাড়িটার দিকে তাকিয়ে বিভিন্ন শব্দ শোনার চেষ্টা করি৷ কতরকমের কণ্ঠস্বর, কান্না, ঝগড়া, আদর, উৎসবের কলরোল৷ ব্যাপারটা অনেকটা সমুদ্রের ঢেউ গোনার মত আরামদায়ক৷ মাঝেমধ্যে মনে হয়, এই বিশাল বাড়িটা যেন পাড়ার কারুরই আর চোখে পড়েনা৷ খানিকটা আমারই মত। চায়ের দাম আদায় না করতে হলে কি শ্যামলও আমায় দেখতে পেত? রাস্তায় যাতায়াতের পথে কেউই বাড়িটার দিকে তাকিয়েও দেখেনা বোধ হয়৷ অমন পাহাড়প্রমাণ একটা উপস্থিতিকেও অগ্রাহ্য করা যায় তা'হলে৷
কিন্তু আমি কিন্তু দেখি বাড়িটাকে। রোজ৷ অবাক হয়ে৷ মনে হয়, ভাগ্যিস মামলাটা মিটমাট হয়নি৷ নয়তো কবেই ফ্ল্যাটবাড়ি উঠে যেত৷ অবশ্য ফ্ল্যাটবাড়িকে গালমন্দ করার মানুষ আমি নই, আমার নিজের আস্তানাটুকুও একটি ঘুপচি ফ্ল্যাটই৷ কিন্তু এই বিপজ্জনক বাড়িটা গায়েব না হলেই ভালো৷
প্রথম দিকে, যখন আমি পাড়ায় নতুন এসেছিলাম, এই শ্যামলের দোকানেই মাঝেমধ্যে কেউ কেউ যেচে আলাপ জমাতে আসতেন৷ ওই গতানুগতিক সব প্রশ্ন, "পাড়ায় নতুন নাকি", "কোন বাড়িতে উঠেছেন", " কী করা হয়" বা "ম্যারেড তো"। আমি ঠিক সে'সব আগ্রহ সামাল দিতে পারতাম না।
ভাঙাচোরা বাড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মাঝেমধ্যেই মনে হয়, আমিও যদি গলায় অমনই একটা জমকালো বোর্ড টাঙিয়ে রাখতে পারতাম;
"বিপজ্জনক! সাবধান! নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখুন"।
No comments:
Post a Comment