Thursday, March 24, 2022

সুমনবাবুর হুকুম



- কফি চলবে অনিলবাবু?

- না৷ থাক৷

- টাকাটা পেয়ে গেছেন আশা করি।

- হ্যাঁ।

- ভালো কথা৷ কাল গুপ্তাদের চারটে ট্রাক বর্ডার ক্রস করে ওদের করিমগঞ্জের গোডাউনের দিকে যাবে৷ বড় কনসাইনমেন্ট, হাতাতে হবে৷

- বারো পার্সেন্ট।

- দশ থেকে এক্কেবারে বারো? ট্যুয়েন্টি পার্সেন্ট জাম্প? আপনি যে আমাদেরও এক্সটর্ট করতে শুরু করলেন মশাই৷ ও'টা এগারো করুন।

- বারো৷

- আমার কথার অনারে অন্তত কিছুটা..। সাড়ে এগারো, ফাইনাল! সেটল করুন।

- শম্ভু সিংকে বলুন৷ সাড়ে সাতে ট্রাক হাতিয়ে আপনার জিম্মায় ফেলে দেবে৷ তবে ওর পুলিশের ওপর কন্ট্রোল কম৷ সে ঝক্কিটা সামাল দিতে পারবেন নিশ্চয়ই৷

- সামনে বসিয়ে কফি অফার করেছি বলে নিজেকে আমার ইকুয়াল বলে ভেবে বসবেন না অনিল৷ 

- ও মা, না! আপনি পে-মাস্টার৷ আমাদের নমস্য৷ আর শম্ভু একসময় আমারই সাগরেদ ছিল৷ ইদানীং নিজের মত করে লাইনে নেমেছে, উইথ মাই ব্লেসিংস৷ তাই ভাবলাম রেকমেন্ড করি৷ ব্যাপারটা অন্যভাবে নেবেন না সুমনবাবু৷

- আপনার থেকে আমার বয়স অনেক কম হতে পারে৷ কিন্তু আমি গুণ্ডা নই অনিলবাবু, আমি একজন ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট। বাজারে আমার একটা সুনাম আছে৷ অবশ্য দোষটা আমার বাবার৷ বেঁচে থাকতে লাই দিয়ে আপনাদের মাথায় তুলে গেছে, আর এখন সাফার করছি আমরা। যাক গে, আপনার সঙ্গে তর্ক করে সময় নষ্ট করতে চাইনা। ওই বারো পার্সেন্টই পাবেন। কিন্তু কাজে যেন ঢিল না দেখি৷আপনার ছেলেদের বলে রাখবেন৷ ট্রাকের ডিটেলস আমি পাঠিয়ে দেব৷ 

- আপনার বাবার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা একটু অন্যরকম ছিল বটে৷ সে যাকগে। সুমনবাবু,আপনি বোধ হয় আমাদের ওপর সামান্য অসন্তুষ্ট৷ তাই কি?

- ন্যাচরেলি। আপনার স্যাঙাৎ, ওই কী যেন নাম..বিমল। গতকাল সে আমার অফিসে এসে কী রুডলি কথা বলে গেল৷ আমার ইচ্ছে ছিল মেরে চামড়া গুটিয়ে নেওয়া। আমি বেশি ঝামেলায় না গিয়ে স্রেফ খানকয়েক চড়চাপড় মেরে ছেড়ে দিয়েছি। তবে অতটা লিনিয়েন্ট আমি না হলেও পারতাম। আপনার দলের ছেলে আমার সঙ্গে ও'ভাবে কথা বলতে সাহস পায় কী করে?

- সে কী! বিমল আপনার সঙ্গে মিসবিহেভ করলে?

- রীতিমত। আরে আমার শালাবাবুর একটা মেডিকাল সিক সার্টিফিকেট চাই, অফিসে জমা দিয়ে আর্জেন্ট ছুটির দরখাস্ত করতে হবে৷ আমি বিমলকে বললাম একটা ডাক্তারকে চমকে মাসতিনেকের সিক সার্টিফিকেট লিখিয়ে আনবে। এ'সব সামান্য ফাইফরমাশ খাটার  সার্ভিস যদি নাই পাই, তা'হলে এত খরচ করে গুণ্ডা পুষছি কেন। তো অথচ আপনার বিমল বলে কিনা পয়সা ছাড়া কোনও কাজ সে করবে না৷ ক্যান ইউ ইম্যাজিন?আমার মুখের ওপর সে বললে যে এমন ছিচকে কাজ সে করে না? রাস্কেলটা কি ভেবেছে কি নিজেকে? 

- নাহ্৷ কাজটা বিমল ঠিক করেনি৷ ও নিয়ে আপনি ভাববেন না। সিক সার্টিফিকেট পরশু দুপুরের মধ্যে পেয়ে যাবেন। আপনার শালার নাম আর বয়সটা লিখে দেবেন, তা'হলেই হবে। আপনার জন্য এ'টুকু আমরা করতেই পারি। 

- যাক৷ ঠিক আছে৷ আর দেখুন অনিলবাবু৷ ও'সব চ্যাংড়া ছেলেকে আমার কাছে পাঠাবেন না৷ 

- নাহ্, সিনসিয়ার এপলজিস। 

**

- হ্যালো। সুমনস্যার, আমি ফ্যাক্টরি থেকে বলছি। তাপস। খানিকক্ষণ আগে হয়েছে কী..। 

- পঞ্জিকা খুলে বসতে হবে না৷ ট্রাক ঢুকেছে?

- আধঘণ্টা আগে। 

- মালপত্র? 

- সব আছে৷ যেমন খবর ছিল।

- গুড৷ নাহ্, অনিল গুণ্ডার এলেম আছে৷ আগাম বারো পার্সেন্ট নেওয়াটা গায়ে লেগেছিল বটে, তবে কাজকর্ম এত স্মুদলি এক্সেকিউট করে যে পুষিয়ে যায়..।

- ইয়ে, স্যার..অন্য একটা জরুরী খবর দিতে আপনাকে ফোন করা..।

- আবার কী? গুপ্তারা আরও ট্রাক আনাচ্ছে?

- না স্যার৷ ব্যাপারটা একটু সিরিয়াস৷ একটা ট্রাকে..একটা ট্রাকে মালের মধ্যে...হয়েছে কী...।

- তাপস৷ ভ্যানতারা ছাড়ো।

- একটা ট্রাকে আপনার শালাকে পাওয়া গেছে...আনকনশাস..পা দু'টো বিচ্ছিরি ভাবে থেঁতলানো৷ মুখেও চোট আছে। আর বড্ড ব্লাডলস হয়েছে। আমরা ইমিডিয়েটলি এম্বুলেন্স ডেকেছি..এখনও এসে পৌঁছয়নি। আশপাশ থেকে একজন ডাক্তারকেও ধরে এনে দেখানো হয়েছে৷ ডাক্তার দেখে বললেন ইমিডিয়েটলি অ্যাডমিট করতে হবে৷ অন্তত মাসতিনেক হাসপাতালের ধাক্কা..।

শুটিংয়ে ফেলুদা আর আমাদের আকাশকুসুম



ছোটবেলায় পড়া প্রিয় অ্যাডভেঞ্চার বইয়ের ইলাস্ট্রেশন রিক্রিয়েট করার প্রসেসটা নির্ঘাৎ দারুণ জমজমাট৷ ব্যাপারটায় ঠিক কী কী ঘটে? 

সেটে সবার হাতে ফেলুদার বইয়ের সেই ছবি আঁকা পাতাটা ঘোরাঘুরি করে? 

নির্দেশক অভিনেতা অভিনেত্রী এবং সমস্ত কলাকুশলীরা কি নিজেদের কাজ সাইডে রেখে বইয়ের ছবিতে লালমোহনের বসার অ্যাঙ্গেল আর সেটের লালমোহনের বসার ভঙ্গি মিলল কিনা তা নিয়ে মারাত্মক তর্ক জুড়ে বসেন? 

সেটের ফেলুদাকে কি পাইকারি হারে জ্ঞান শুনে অতিষ্ঠ হয়ে পড়তে হয়? 

অকুস্থলে উপস্থিত প্রতিটা মানুষই কি ভেবে বসেন না যে " আহ্, আমিই যদি ফেলুদার সেই একপেশে ক্যারিস্মাটা নিজে গিয়ে ডেমোন্সট্রেট করে দিতে পারতাম"!

আর সেটের 'এক্সট্রা' বা ব্যাকগ্রাউন্ডে থাকা সংলাপহীন জুনিয়র অভিনেতারাও কি বইয়ে আঁকা ছবিতে নিজের খুঁজে হদ্দ হন? এই যেমন এ'খানে বইয়ের আঁকায় এক দম্পতি (তাদের দাম্পত্য নেহাতই আমার  কল্পনার ফসল) খানিকদূরে হেঁটে যাচ্ছেন। আবার সেটের ছবির আবছা ব্যাকগ্রাউন্ডে সে দম্পতি দূরের সোফায় বসে। সোফায় বসে কি তাদের মনের মধ্যে খতরনাক হ্যাঁচোড়প্যাঁচোড় শুরু হয়েছে "প্রিসাইস রোলে" নিজেদের ফেলতে না পেরে?

দিনের শেষে ফাইনাল আউটপুট দেখে মানুষজন কি নিজেদের হাত কামড়ে ওঠেন খুচখাচ 'তফাৎ স্পট' করে? "এ কী ভাই, নুনের ডিবেগুলো ফ্রেমে নেই কেন? কে সরিয়েছে? কোর্ট মার্শাল, রাইট নাউ"! 

আর, এর ফলে কি একসেট মানুষ নতুন করে ফেলুদা পড়তে শুরু করেন? 

কে জানে!

প্রিয় বইয়ের আঁকা ছবি শুটিং ফ্লোরে রিক্রিয়েট হওয়ার ব্যাপারটা রীতিমত টিকিট কেটে দেখা যায়৷ কিন্তু তা যখন সম্ভব নয়, তখন "আরিব্বাস" বলে বুকের ছ্যাঁত চেপে "দার্জিলিং জমজমাট" বইটা তাক থেকে নামানো ছাড়া আর বিশেষ কোনও উপায় থাকে না।

প্রতিবাদের হিসেব

- খবরটা শুনেছ সৌরভদা?

- শুনেছি৷ 

- গা শিউরে উঠছে।

- ব্যাপারটা বেশ আননার্ভিং তো বটেই।

- ক্লাবের ছেলেমেয়েদের ডাকব? আজ সন্ধ্যের দিকে একটা মিটিং করে যদি..।

- হঠাৎ মিটিং কীসের শুভ?

- আজকের এই পলিটিকাল নৃশংসতার বিরুদ্ধে একটা প্রটেস্ট তো হওয়া দরকার৷ এতবড় একটা ঘটনা ঘটে গেল অথচ সবাই নিশ্চুপ৷ রাস্তাঘাটে তেমন কাউকে সোচ্চার হতেও দেখা যাচ্ছে না৷ কিন্তু তুমি যদি সবাইকে গাইড করো, ইন্সপায়্যার করো; তা'হলে সবাই বুকে বল পাবে৷ সাহস করে রাস্তায় নামবে৷ তুমিই তো কতবার আমাদের টেনে নিয়ে গেছ সৌরভদা৷  তুমি পাশে ছিলে বলেই আমরা..।

- এই তোদের একটা বিচ্ছিরি রোগ শুভ৷ সব কিছুতেই পলিটিকাল লাফালাফি৷ এ'বার থাম দেখি৷ আর মন্টুকে বল একটু চা-মুড়ির ব্যবস্থা করতে৷ বড্ড খিদে পেয়েছে৷ 

- এ'টার রাজনৈতিক প্রটেস্ট হওয়া উচিৎ নয়?

- না৷ উচিৎ নয়৷

- কী বলছ সৌরভদা, ইউক্রেনের ব্যাপারেও আমরা পথে নেমেছি৷ আর নিজেদের পাড়ার ব্যাপারটাকে পাত্তা দেব না? অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকব?

- সে'টাই করা দরকার৷ পুটিন আমাদের ক্লাবের ফান্ডে টাকা ঢালেনা৷ পুটিন আমাদের ক্লাবের জিম বানানোর জন্য টাকা দেবে না৷ নতুন টিটিবোর্ডগুলো রাশিয়া থেকে আসবে না। কিন্তু এমএলএ শ্যামল দত্ত ক্লাবকে রসেবশে রাখবে৷ এই  ছুটকোছাটকা ব্যাপার নিয়ে আমরা প্রটেস্ট-ট্রটেস্ট করলে শ্যামলদা একটু এমব্যারেসড হতে পারে৷ 

- ছুটকোছাটকা? তুমি এ'ভাবে বলবে সৌরভদা? এত বড় একটা পলিটিকাল ক্রাইম! এর কোনও প্রতিবাদ হবে না?

- শুভ, নিজের ভালো বুঝতে পারাটাও পলিটিক্স৷ আর সে জন্যেই, সব ব্যাপারে ছিঁচকাঁদুনে হয়ে রাজনীতি টেনে আনিস না৷ এখন এ'সব বাজে কথা ছেড়ে মন্টুকে বল চট করে চা-মুড়ি-চপ দিয়ে যাবে৷  সে'সব খেয়েদেয়ে ক্যারম পেটানো যাবে'খন৷ 

Saturday, March 12, 2022

অপড়ুয়ার বইমেলা



আরে! কাল বইমেলা শেষ৷ ফেসবুক ট্যুইটারের প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই, অজস্র 'বইমেলার সেল্ফি'র বদান্যতায় এদ্দূরে বসেও সে মেলার গমগম দিব্যি উপভোগ করলাম৷ 

চেনামানুষের হাতে অচেনা বই৷
অচেনা মানুষের হাতে চেনা বই৷
খাবারের স্টলে হুমড়ি খেয়ে পড়া বইপ্রেমি৷
আড়ালে থাকা ছোট স্টলের কাউন্টারে বসা দোকানির দমে না যাওয়া হাসি৷
বড় প্রকাশনার সামনে উৎসাহী লাইন।
নতুন প্রকাশকদের ঘিরে আশাবাদী মানুষের উচ্ছ্বাস।
আর সমস্ত কিছুর ওপর রয়েছে বড়দের হাত ধরে ঘুরঘুর করা ছোট্ট ছেলেমেয়েরা৷
আসলে, বইয়ের জমায়েত মানেই লাইব্রেরির নিঝুম নয়, চশমা ডাঁটি চেবানো গম্ভীর আলোচনা নয়; বই উৎসবও বটে। 


মেলা আলো করা এত মানুষের মধ্যে সবাই কি বইয়ের পোকা? নিশ্চয়ই নয়৷ কিন্তু কী এসে যায় তা'তে৷ স্রেফ বই পড়ে কে কবে নিখুঁত মানুষ হয়েছে, বই পড়ার নেশা না থাকাতেই বা কার ভালোমানুষি নষ্ট হয়েছে৷ আর বইয়ের পড়ার সময় বা সুযোগ; সবার সমান নয় মোটেও৷ কাজেই, বইহুল্লোড় পাঠক-পাঠিকাদের মনোপলি নয় মোটেও৷ 

এই ধরুন, বই-নিরেট কোনও মানুষ বইমেলার কোনও স্টলে ঢুকে টুক করে একটা বই হাতে নিয়ে দু'প্যারাগ্রাফ পড়লেন৷ সে পড়া জলে গেল ভেবেছেন? আদৌ না৷

অপাঠক-প্রেমিক তার একনিষ্ঠ-পাঠিকা-প্রেমিকার কেনা অজস্র বইয়ের অর্ধেকভার কাঁধে নিয়ে বইমেলার  সাতপাক ঘুরলে আর ধুলো খেয়ে হদ্দ হলে। তা কি সাহিত্যের বাইরে? নেভার!

খবরের কাগজের বাইরে একটা শব্দও না পড়া কোনও বাবা পাশের অচেনা মানুষটার কাছে সাজেশন চাইছেন নিজের স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়ের জন্য কোন গল্পের বইগুলো কিনলে তারা সাগ্রহে পড়বে৷ সেই গায়ে পড়া বইপ্রশ্নের গুরুত্ব কোনও গুরুগম্ভীর লিটফেস্ট প্যানেল ডিসকাশনের তুলনায় খেলো? হতেই পারেনা।

কিছুতেই দু'পাতার বেশি পড়ার ধৈর্য কুলিয়ে উঠতে না পারা কেউ 'এ'বারে ঠিক পড়বই' মার্কা দুঃসাহস নিয়ে মাইনের অনেকটা ঘ্যাচাং করে উড়িয়ে দিলেন  বইমেলার হুজুগে গা ভাসিয়ে৷ হয়ত সেই বইগুলোও পড়া হবে না৷ তা বলে সে দুঃসাহসটুকু কি এক্কেবারেই ফেলনা? অবশ্যই না৷ 

গপগপিয়ে বইগেলা মানুষরাই বই নিয়ে শেষ কথা বলবেন না৷ বইমেলার আনন্দোৎসব সে ভরসাটুকু জোগায় বটে।

**

ইয়ে। বিজ্ঞাপনটা ঠেকিয়ে রাখা গেল না৷ এ'বার বইমেলায় আমার যাওয়াটাওয়া হল না৷ তবে ওই মেলারই এক কোণে, পত্রভারতীর স্টলে আমার লেখা খানদুই বই রয়েছে৷ 'বংপেন-৭৫' আর 'বংপেন-আরও ৭৫'। নেড়েচেড়ে দেখতে পারেন, বেশ মজবুত; ডেঁপো ভাইবোন বা হাড়জ্বালানো ইয়ারদোস্তকে শায়েস্তা করতে হলে ও বইয়ের একটা গুঁতোই যথেষ্ট৷

Thursday, March 10, 2022

দারোগা আর টিকিট-চেকার



- টিকিট দেখি৷

- হুম?

- টিকিট৷ টিকিট দেখি৷

- আপনি আমায় দেখতে পারছেন?

- মানে?

- আপনি আমায় দেখতে পারছেন?

- ইয়ার্কি হচ্ছে? টিকিট দেখি৷

- খোলসা করে বলুন তো মশাই, আপনি টিকিট চেকার না তান্ত্রিক?

- রাতের ট্রেনে ফাঁকা কামরা দেখে উঠে ভেবেছেন টিকিট ফাঁকি দেবেন? বিজন চট্টরাজকে ফাঁকি দেবেন? টিকিট না থাকলে সোজা ফাইন বের করুন৷ 

- বিজনবাবু, মড়ার আবার টিকিট লাগে নাকি৷

- বটে? বেশ! সামনেই সাঁতরাগাছি৷ রেলপুলিশের থানায় ডিনার সারবেন৷ চলুন।

- আরে৷ আমি তো ভূত৷ অশরীরী৷ ভেসে বেড়াই৷ এই এখন এই ট্রেনে, পরক্ষণেই হয়ত আমাজনের জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছি৷

- অমন সুবিধেবাদি পাগল কম দেখিনি৷ চলুন, স্টেশনে ঢুকছে ট্রেন৷ থানায় ঢুকিয়ে তারপর আমি এগোব৷

**

- আরে ধুর মশাই৷ আর একবার "আমি ভূত আমি ভূত" ডায়লগ শুনলেই থার্ড ডিগ্রী দেব৷

- আরে দারোগাদাদা! নাহ্৷ আপনি সত্যিই বড় আলাভোলা মানুষ৷ আরে ভূতকে থার্ড ডিগ্রী দিলে লোক হাসবে যে৷ 

- উফ! রাতবিরেতে এই চট্টরাজ কী খ্যাপা মাল গছিয়ে দিয়ে গেল মাইরি। এই আপনি বেরোন দেখি৷ খবরদার যেন আপনাকে এই পুলিশ চৌকির আশেপাশে আর আপনাকে না দেখি৷

- আমায় তো দেখতে পাওয়ার কথাই নয়৷ তবে হ্যাঁ, ট্রেনে কাটা পড়েছি হপ্তাখানেকের বেশি হয়নি তো৷ তাই বোধহয় এখনও কম্পলিটলি ফর্মলেস হইনি৷ সে যাকগে, দিন কয়েক যাক৷ এখন তো আর অফিস যাওয়ার তাড়াও নেই, বাড়ি ফেরার ব্যস্ততাও নেই৷ ধীরসুস্থে যা হয় হবে, অখণ্ড অবসর বলে কথা।

- ধন্যি মশাই আপনি৷ বেশ৷ তাই হোক৷ তা ভূতদাদা, আপনার বাড়ি কোথায়? আই মীন, জ্যান্ত থাকতে কোথায় নিবাস ছিল আপনার?

- এই এ'এলাকাতেই। স্টেশনরোড থেকে রিক্সা করে বড়জোর দশ মিনিট লাগত৷ সতেরো বাই তিন, মধু দত্ত লেন৷ 

- চলুন৷ আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিই৷ 

- এই বুদ্ধি নিয়ে আপনি চোরছ্যাঁচড়দের ম্যানেজ কী'ভাবে করেন দারোগাবাবু? আরে আমি মারা গেছি৷ ডেড৷ গন৷ ইহজাগতিক মায়া ত্যাগ করেছি৷ আমি কী করব বাড়ি ফিরে? শেষে বাড়ির লোকজনদের হন্ট করে শশব্যস্ত করে তুলি আর কী৷

- চোপ! অনেক হয়েছে! আর একটাও কথা নয়৷ হাবিলদার৷ এ যন্তরটিকে জিপে নিয়ে তোলো, এখুনি! 

- আহা, বেশ তো৷ তা হাবিলদারদাদা, পকেটে লোহাটোহার টুকরো রাখবেন কিছু, কেমন? নয়ত ভূতের ইনফ্লুয়েন্সে ক্ষতিটতি হয়ে যেতে পারে৷ 

**

- খোকা, তুই নির্ঘাৎ প্ল্যানচেট শিখেছিস, তাই না? সে জন্যেই বাড়িতে ঢুকতে পারলাম৷ 

- বাবা, মাইরি৷ এই পাগলামিটা এ'বার ছাড়ো। তুমি দিব্যি জলজ্যান্ত মানুষ। খামোখাই লোকজনের হাড় জ্বালিয়ে বেড়াচ্ছ৷ পাড়াপ্রতিবেশি এখন আমাদের নিয়ে হাসাহাসি করছে৷ এ'বার ভিতরে যাও৷ মা চিন্তা করে পাগল হয়ে গেছে৷

- এই দ্যাখো৷ তুইও বোকা বনে গেলি নাকি৷ আরে শোন, গত হপ্তাতেই কাটা পড়েছি, মাইরি৷ এই, জিজ্ঞেস কর দারোগাবাবুকে.. কী দারোগাবাবু, তাই না? আমি টোট্যালি ইনট্যাঞ্জিবল এখন৷ তোদের জগত থেকে অনেক দূরে চলে গেছি৷ এ তো শুধু মাঝেমধ্যে ঘুরে যাওয়া। মায়ার টান, এট সেটেরা এট সেটেরা।

- উফফ! অসহ্য৷ 

- এই দেখো! আরে দারোগাবাবু, আপনিই একবার বুঝিয়ে বলুন না খোকাকে৷ আরে ও দারোগাবাবু, এ কী! চললেন কোথায়? ও মা, দাঁড়ান! এই দ্যাখো, চলে গেলো। 

**

- ভাই চট্টরাজ, কাল তুমি যে কোন পাগলকে গছিয়ে দিয়ে গেলে..উফ!

- আসলে কী জানো দারোগা, সে ব্যাটা পাগল কিনা তা নিয়ে আমার সন্দেহ হচ্ছিল৷ মনে হচ্ছিল স্রেফ টিকিট ফাঁকি দেওয়ার জন্যই..।

- ওরে বাবা, না না৷ প্রথমে আমিও তাই ভেবেছিলাম৷ তারপর সে যা নাকানিচোবানি খাওয়ালে..বাপ রে বাপ। শেষে তাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে গিয়ে আর এক বিপত্তি। 

- তুমি ওকে বাড়ি ছাড়তে গেছিলে?

- হিউম্যানিট্যারিয়ান ইয়ে আর কী৷ কিন্তু গিয়ে আর এক সমস্যা৷ 

- কী'রকম?

- থানায় বসে একটানা অসংলগ্ন কথাবার্তা বলছিল৷ তাই একরকম বাধ্য হয়েই আমি ভাবলাম, যাই, বাড়ির ভিতর লোকজনের কাছে ভদ্রলোককে পৌঁছে দিয়ে আসি৷ ও মা, গিয়ে দেখি সে বাড়ি ফাঁকা। ঘরের সদর দরজাও খোলা ছিল৷ ঢোকার পর ভদ্রলোক দেওয়ালে ঝোলানো এক অল্প বয়েসী ছেলের ছবির দিকে তাকিয়ে দিব্যি গল্পগুজব আরম্ভ করলে৷ সেই একই প্রলাপ, সে নিজে নাকি ভূত৷ আর হাবভাব এমন যেন ছবির ছেলেটা তার সঙ্গে দিব্যি গল্প জুড়েছে৷

- বলো কী হে দারোগা৷

- তবে আর বলছি কী! আমি অবশ্য হসপিটালে খবর দিয়েছি৷ ভদ্রলোককে বাইরে ফেলে রাখাটা সেফ হচ্ছে না৷ তা ইয়ে চট্টরাজ, কাল ঘটনাচক্রে গুগল ঘেঁটে একটা অদ্ভুত রোগের নাম জানলাম৷ আসলে ভদ্রলোকের খ্যাপাটেপনা নিয়ে খোঁজখবর করতে গেছিলাম আর কী৷ ব্যামোটার নাম হল কটার্ড ডিলিউসন।

- কটার্ড..?

- ডিলিউসন৷ এ রোগে মানুষ ভাবে..ইয়ে..তারা আর বেঁচে নেই। এ ভদ্রলোকের রোগ সে'টাই কিনা জানা নেই..।

- ভাগ্যিস কাল ওই ফাঁকা ট্রেন টিকিট চেক করতে উঠেছিলাম। ভদ্রলোকের এ'বার একটা হিল্লে হবে আশা করি। আহা রে...ইশ!

নাচ মেড ইজি

নাচতে নামলেই উঠোনটাকে বিশ্রীভাবে বাঁকা মনে হয়? হাঁটু ভাইব্রেট করে? গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়? দুশ্চিন্তা ত্যাগ করুন, গোপন ফর্মুলায় ভরসা রেখে নেমে পড়ুন ডান্স ফ্লোরে।

শুধু স্পীকারের গানবাজনাকে পাত্তা না দিয়ে মনে মনে গুনগুন চালিয়ে যানঃ
"ঢ্যাংকুরাকুরন্যাকুরন্যাকুরঢ্যাংঢ্যাঢ্যাঢ্যাংনাককুনাকুর"।

ব্যাস! দেখবেন হাত-পা নিজেদের মত এলোপাথাড়ি দুলছে৷ 

আর আপনি ভাসছেন৷ 

ভাসছেন৷ 
ভাসছেন৷ 
ভাসছেন।

Monday, March 7, 2022

মনু আর মাস্টারজ্যেঠুর ফন্দি



- এই যে৷ মাস্টারজ্যেঠু৷ চট করে মুড়ি মেখে আনো দেখি৷ আমি হাত-পা ধুয়ে আসি৷ তারপর জমিয়ে গপ্প করা যাবে৷ 

- আরে৷ বলা নেই কওয়া নেই বাড়ি এসে হুজ্জুতি করলেই হল নাকি মনু। তোর এ'সব অন্যায় আবদার আর চলবে না।  আমি নিরিবিলি পছন্দ করি৷ বুড়োমানুষ, সন্ধেবেলার এই সময়টা একটু বই পড়ে গান শুনে কাটাই৷ এই তুই মাঝেমধ্যেই দুমদাম করে উড়ে এসে জুড়ে বসবি, সে'টা কিছুতেই বরদাস্ত করা যায়না। 

- আরে চটছ কেন৷ আচ্ছা আমিই না হয় মেখে নেব৷ বলি আমের আচারটা আছে কি মাস্টারজ্যেঠু? একটু তেল দিয়ে কষে মাখতে পারলে...।

- আচার নেই৷ মুড়ি নেই৷ চানাচুর নেই৷ কিস্যু নেই। বেরো দেখি তুই।

- তা'হলে আর কী৷ অগত্যা, আপাতত  চা বিস্কুট৷ রাতে ভাতেভাত৷

- আজ রাতে আমার উপোস৷

- তা'হলে একার জন্যই বসিয়ে নেব। ও তোমায় ভাবতে হবেনা জ্যেঠু। 

- আচ্ছা জ্বালাতন। এমন গায়ে পড়ে কী পাস মনু?

- তোমার এই লোনলিনেস আমায় ভাবায় মাস্টার জ্যাঠা৷ ছেলেবেলায় তোমার কাছে এলসিএম জিসিএম শিখেছি৷ এই নিরেট মাথায় ঠেলেঠুলে বিভিন্ন কনসেপ্ট ঢুকিয়েছ। সামান্য গ্র‍্যাটিচিউড না থাকলে চলবে কেন? তাই, চলে আসি। 

- আদ্দামড়ার গদগদে গপ্প শুনলে গা জ্বলে যায়৷ যাক গে। গিজার চালিয়ে দিচ্ছি৷ দশ মিনিট পর বাথরুমে ঢোক৷ মুড়িফুড়ি নেই। রেডিমেড চালভাজার প্যাকেট আছে, দ্যাখ ওই রান্নাঘরের তাকে রাখা আছে৷ আর সেদ্ধভাতফাত আমি খেতে পারবনা৷ লুচি ভেজে নেওয়া যাবে৷আলু তুই ভাজবি মনু। বলে রাখলাম। 

- জো হুকুম। তা, মাস্টারজ্যাঠা। আজ কেন এলাম, সে'টা নিশ্চয়ই তোমার বুঝতে বাকি নেই৷ 

- কাগজে বেরিয়ে গেছে ইতিমধ্যে? 

- দৈনিক যুগের হাওয়া, তিন নম্বর পাতায় জ্বলজ্বল করছে৷ উত্তরপাড়ার হালুয়া ব্যবসায়ী মনু সামন্ত ফের কিডন্যাপড৷ 

- র‍্যানসমের কথা কিছু লেখা নেই?

- সে খবর জেনারেট করতেই তো তোমার কাছে আসা।

- ফের হুমকি দিয়ে টাকা আদায় করতে হবে?

- ফের। তবে বুড়ি বেশ গালিবল, বুঝলে৷  নয়ত এত কাঁচা প্লট সহজেই ঘেটে ঘ ত। আর হ্যাঁ, মাসি হাড় কিপটে হতে পারে, কিন্তু ভাইপোকে সে সত্যিই ভালোবাসে। 

- এ'বার কত চাইতে হবে?

- সত্তর হাজার দরকার৷ তুমি ওই আশিই চেয়ে নাও৷ একটু ডিসপোজেবল ক্যাশ হাতে থাকা ভালো।

- আজ থাক৷ কাল শনিবার, কালই বরং তোর মাসির সঙ্গে কনট্যাক্ট করব৷

- মাস্টারজ্যাঠা, পাঁচ হাজার কিন্তু এ'বার তোমায় রাখতেই হবে৷ লুচির ফিজ৷

- পিঠের চামড়া তুলে নেব রাস্কেল৷ সাধনার জন্য টাকা নেব?

**

- এসেছ লালি? শুনতে পারছ কি?

- হুঁ।

- আজ আসতে বড় দেরী হল তোমার৷

- কী করি বলো মাস্টারদাদা৷ বাতাসে এত ধুলোবালি, স্ট্রিটলাইটের আলো৷ আজকাল সে'সব ভেদ করে সাড়া দিতে কষ্ট হয়৷ তা, মনু এসেছে নাকি গো?

- এসেছে৷ ব্যাটাকে ভরপেট লুচি খাইয়ে ঘুম পাড়িয়েছি৷ সে খেতেও পারে বটে, দেড় ডজন লুচি হেলায় উড়য়ে দিল।

- বালাইষাট মাস্টারদাদা৷ ওর খাওয়ার দিকে অন্তত তুমি নজর দিওনা। বছর পঁচিশের জোয়ান ছোকরা৷ এ বয়সে ওর ইট-লোহা হজম করে ফেলা উচিৎ। 

- কী যে ভালো লাগে মনুর ঘুমিয়ে থাকা মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে৷ চোখে জল আসে জানো লালি৷ তাই ভাবলাম, তোমায় এখনই ডাকি৷ আচ্ছা লালি, মনু তোমায় বেশি গালিবল ভাবে, জানো৷ তবে ওর ভালোবাসায় কমতি নেই। 

- ভাবুক গিয়ে। তা বলে আমার প্রাণেধরা মাণিকটাকে তো টাকার অভাবে শুকোতে দিতে পারিনা৷ আর একসঙ্গে সবটাকাও ওর হাতে তুলে দিতে ভয় লাগে৷ যা ভুলোমন, সব টাকা ভাসিয়ে দিয়ে পথে বসবে৷ তাই ও' দরকার মত আছিলা সাজিয়ে নিক, আমিও যতটুকু দরকার ততটুকুই আমার গোপন কুঠুরি থেকে বের করে এনে দেব। যদ্দিন পারি৷ আর টাকা ফুরোলে আমিও ফুরোব।

- এই শুধু তোমার জন্য এই অঙ্কের মাস্টারকে তান্ত্রিক সাজতে হয় লালি৷ মহাযন্ত্রণা৷ মনু ভাবে আমি ইচ্ছেমত ভূত নামাতে পারি৷ এ'দিকে তুমি ছাড়া কোনও ভূত আমায় পাত্তা দেয় না৷ হেহ্। 

- মাস্টারদাদা, বলেই দাও না ওকে৷ যে তুমিই ওর বাপ৷ স্রেফ ভাগ্যের ফেরে ও আজ তোমার সঙ্গে নেই৷ 

- সময় থাকতে ওর কদর করিনি।  তোমার হাতে তুলে দিয়ে সরে পড়েছিলাম৷ লাইক আ ডিসগাস্টিং কাওয়ার্ড৷ আজ কোন অধিকারে ওর মনের ভিতরটায় গোলমাল পাকাবো আমি লালি? তবে ইয়ে, তুমিই বা কদ্দিন এমন যক্ষের মত ওই অতগুলো ক্যাশটাকা আগলে বসে থাকবে।

- মনু যদ্দিন এমনই আলাভোলা আছে, ওর ব্যবসা তো দাঁড়াবে না। কাজেই অল্প অল্প করেই টাকাটা দিয়ে ওকে টিকিয়ে রাখতে হবে৷ যদ্দিন পারি আর কী, আমি আর তুমি মিলে৷ ও কিডন্যাপ হওয়ার নাটক করে মাসির ভূতকে ঠকিয়ে টাকা বাগানোর চেষ্টা করবে৷ আর তুমি প্ল্যানচেটে আমায় হুকুম করবে, লাও পয়সা। যদ্দিন তদ্দিন৷ তবে ওকে নিয়ে হতাশ হতে মন চায়না৷ একদিন ও ঠিক দাঁড়াবে দশজনের মধ্যে একজন হয়ে, চারদিক আলো করে। 

- তুমি আমায় ক্ষমা করতে পেরেছ লালি?

- তুমি আমার একাবোকা মনুকে মাঝেমধ্যে ডেকে মুড়িমাখা খাওয়াও৷ লুচি ভেজে দাও৷ ওর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে কেঁদে ফেলো৷ তোমার যে সাতখুন মাফ গো মাস্টারদাদা।

বোমা



- বড়দা!

- কী ব্যাপার সুমন, এত নার্ভাস কেন?

- ইয়ে, এই যে। পার্সেল।

- বলিস কী! এই মাত্র এলো?

- এই মাত্তর।

- দাঁড়া৷ নার্ভাস হোস না৷

- নার্ভাস হব না? এ পার্সেল যে অনিলদারই পাঠানো তা নিয়ে কোনও সন্দেহই নেই৷

- তা অবশ্য নেই..। কিন্ত..।

- কিন্তু আবার কী..। গতকালই হুমকি দিয়েছিল না..আমাদের উড়িয়ে দেবে? আজকেই উড়ো পার্সেল৷ আর ইয়ে, বাক্সের গায়ে কান লাগিয়ে দেখো৷ খুব সূক্ষ্ম একটা শব্দ আছে৷

- দেখি..।

- শুনলে?

- টিক টিক টিক৷ সাংঘাতিক৷ 

- ফাটল বলে।

- তুই শালা এ'টা নিয়ে ঘরে ঢুকলি কেন?

- কী করবটা কী! ছুঁড়ে ফেলবটাই বা কোথায়?

- পুলিশ ডাকব? বম্ব স্কোয়্যাড?

- আমরা অনিলদার রাইভাল গ্যাং৷ নেকুপুষুসুন্টুনিমুন্টুনি পাবলিক নই৷ পুলিশ এ আড্ডায় এলে আরও বড় ক্ষতি৷ এ'খানে যা মালপত্তর, মিনিমাম বত্রিশবার ফাঁসি হবে।

- অনিলের বোমায় উড়ে যাওয়ার চেয়ে পুলিশের ফাঁস ভালো৷ 

- বড়দা৷ পার্সেল নিয়ে আসা মেসেঞ্জারটিকে পাকড়াও করতে পেরেছি৷

- মেসেঞ্জার?

- দরজার সামনে বোমা পার্সেলটা রেখে দিয়ে কেটে পড়ার তাল করছিল৷ ক্যাঁক করে ধরেছি৷

- বলিস কী৷ 

- বোমা রাখতে কে এসেছিল জানো? ওই বোবা হুলো।

- বোবা হুলো? ও তো আমাদের স্পাই ছিল৷ মাসে মাসে মাইনে দিতাম যে অনিলদার গ্যাংয়ের খবর আমাদের চালান করার জন্য৷ 

- দু'দিকেরই খাচ্ছিল রাস্কেলটা৷ কিন্তু আমাদেরই বিট্রে করল৷ অনিলদার বোমা নিজে বয়ে আনল৷ 

- শোন সুমন৷ এক কাজ করি৷ এ পার্সেল এখানে রেখে, বোবাহুলোকে বগলদাবা করে আমরা কেটে পড়ি বরং৷ 

- বাহ্৷ এ পার্সেলের বোমা ফেটে তারপর সব জিনিসপত্র নষ্ট হয়ে যাবে তো৷ অন্তত দু'শো কোটির মাল এ আড্ডায় রয়েছে বড়দা৷ 

- আরে আপনি বাঁচলে বাপের নাম৷ আর তাছাড়া,  এত টাকার মাল অনিলদার দলের হাতে অন্তত পড়বে না৷ সে'টা একটা বাঁচোয়া।  

- ওই হুলোটাকেও ফেলে যাই না৷ বোমায় সে ব্যাটাও উড়ে যাক৷

- না। ওকে দরকার৷ পরে অনিলদার সঙ্গে বোঝাপড়ায় সুবিধে হবে৷ আর সময় নষ্ট নয়৷ বাক্সটা এখানেই থাক৷ আমি গাড়ি বের করছি৷ তুই ওই হুলো ব্যাটাকে বস্তায় পুরে নিয়ে আয়৷ জলদি সুমন, বাক্সের টিকটিক আওয়াজটা বেড়েছে মনে হয়৷

***

- অনিলদা৷ গোটা বাড়ি তন্নতন্ন করে দেখেছি৷ কেউ নেই৷

- মালপত্র? 

- সবই আছে৷ দেড়শো কোটির মাল, কম সে কম৷ বেশিও হতে পারে৷ 

- সব ভালো করে দেখে নিয়েছিস তো অপু?

- হ্যাঁ। সুমন আর বড়দা কেটে পড়েছে নির্ঘাৎ৷ তবে ইয়ে অনিলদা, হুলোকেও বোধ হয় নিয়ে গেছে উঠিয়ে৷ হুলোকে কোথাও দেখছি না৷

- গুড।

- গুড? হুলো আমাদের ভালো হ্যান্ড ছিল৷ 

- ইনএফিশিয়েন্সি বরদাস্ত করা যায় রে অপু৷ চোরাগোপ্তা বাটপারি নয়৷ হুলো মানুষটা বেশ গোলমেলে৷

- বম্ব পার্সেলটা ভিতরের ঘরে থেকে নিয়ে এসেছি৷ এই যে। ডিঅ্যাক্টিভেট করে ফেলি?

- বম্ব পার্সেল? 

- বোবাহুলোকে দিয়ে যে'টা পাঠালে অনিলদা। ডিটোনেটরটা কোথায় বলো। সে'টাও দরকার।

- ও বাক্সে বোমা নেই অপু৷ নিশ্চিন্তে খুলে দেখ৷

- সে কী! বোমা নেই এ'তে?

- খুলে দেখ না৷ 

- বেশ...এ কী৷ এ তো তোমার সেই আদ্দিকালের দম দেওয়া অ্যালার্ম ঘড়ি৷ 

- আমার বড় প্রিয়৷ ফিরে পেয়ে নিশ্চিন্ত হলাম। 

- ওহ, তুমি বোমা পাঠাওনি? আমি ভাবলাম..।

- বড়দা আর সুমনের গ্যাং আজকাল বড্ড বাড়াবাড়ি শুরু করেছিল৷ ওদের না সরালে চলছিল না৷ আমাদের লাইনেও তো মার্কেট শেয়ার বলে একটা ব্যাপার আছে নাকি৷ 

- কিছুই বুঝছি না অনিলদা।

- বোমা পাঠিয়েছি৷ ডিটোনেটও করেছি৷ বড়দা আর সুমন দু'জনেই এতক্ষণে শতটুকরো হয়ে মাটিতে মিশে গেছে৷ নির্ঘাৎ৷ বাক্সে বোমা রাখিনি, নয়ত এত টাকার চোরাইমাল হাতে না এসে উড়ে যেত৷ বোবাহুলোকে দিয়ে আমি পার্সেল বোমা পাঠাইনি রে৷ পার্সেল দিয়ে বোবাহুলো-বোমা পাঠাতে হল, ফর বেস্ট রেজাল্টস যাকে বলে। যাকগে, ঘড়িটা আমার অফিসে পৌঁছে দিস, কেমন?

আমার নরম মন

১।

দেখুন মশাই। আমি বড় জোর বারচারেক 'ধুর্বা* বলেছি৷ কয়েকবার 'ঢ্যা*না' বলেছি৷ খানকয়েক বোকা**'ও যে বলিনি তা নয়। তবে, খিস্তি দিইনি৷ বাজে কথায় কান দেবেন না! শুনে রাখুন; খিস্তি আমি দিইনি৷ দিতেই পারিনা।

২।

আরে! সে মিথ্যেবাদী রাস্কেলের কী দুঃসাহস!  বলে কিনা আমি নাকি পোস্টকার্ডে খিস্তি লিখে পাঠিয়েছি! ডাহা মিথ্যে মশাই৷ ডাহা মিথ্যে! এক্কেবারে আড়াই কিলো সাইজের গুল৷ আমার সাদা মনে কাদা নেই মাইরি, স্রেফ দু'তিনটে ইনল্যান্ড লেটার পাঠিয়েছিলাম কিছু গালাগাল লিখে৷ সেই তিলকে তাল করা? এত বিষ মনে?

৩।

আরে, শুনুন৷ শুনুন। আমি মানুষটা একটু মাইডিয়ার গোছের, বুঝলেন। তা একদিন আমি 'এসো বাবুসোনা' বলে কোলাকুলি করতে গেলাম! ও মা! ব্যাটার কী মাতব্বরি ভাবুন; কোলাকুলি রিফিউজ করে সে কিনা আমায় হাইফাইভ অফার করলে? কী মারাত্মক ইনসাল্ট! কী ইনসেনসিটিভ জুতোপেটা! আমি ওর নামে মামলা করব! ওর ভিটেয় ঘুঘু চরাব! এই বলে রাখলাম! দ্যাখ শালা কত ধানে কত চাল!

নিখুঁত




- কাজ হয়ে গেছে অনিলদা৷ 

- বডি?

- সাফ৷

- সাফ হলেই ভালো। দু'দিন পর কাগজে কোনও ময়লা খবরটবর যেন না দেখি।

- একটা কেসে সামান্য ভুলচুক হয়ে গেছিল..তা'নিয়ে বারবার খোঁটা দেবে?

- সামান্য ভুল৷ সামান্য ভুলের কনসিকুয়েন্স বোঝার বয়স তো তোর হয়েছে অর্ণব৷ 

- আসলে কী জানো অনিলদা, সে'বার হল কী..।

- পার্ফেকশনে বিশ্বাস না থাকলে এ লাইনে এত বছর টিকে থাকতে পারতাম না। আর তুই হাজারটা কাজ নিখুঁতভাবে করলেও,  এই একটা ভুলের জন্যই তোর হান্ড্রেড পার্সেন্ট স্ট্রাইক রেট আর রইলনা। ইট উইল নেভার বি আ কম্পলিট হান্ড্রেড পার্সেন্ট।

- অত অবিশ্বাস থাকলে, আমায় দলে রেখেছ কেন অনিলদা?

- বিশ্বাস করলে তোকে ছেড়ে দেওয়াটা সহজ হত অর্ণব।

- তোমার কথাবার্তা সবসময় বোঝাও যায় না..।

- টাকাটা রাখ। আর কাল রাতের দিকে উইনস্টন ক্লাবে আসিস৷ 

- ক্লাবে?

- বাইরে অপেক্ষা করিস৷ একটা গাড়ি তোকে পিক করে নেবে সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ৷ আধঘণ্টা আগে ডিটেলস পেয়ে যাবি৷

- রিভলভার সঙ্গে রাখব?

- তোকে ইন্স্যুরেন্স তো বেচতে ডাকছি না৷ ও'টা ছাড়া আসবিই বা কেন। 

- টার্গেট?

- সুকুমার হালদার। ক্লাব থেকে বেরোবে ডিনার সেরে। ওর ড্রাইভারকে হাত করা আছে৷ মিনিটে তিনেকের একটা উইন্ডো পাবি৷ 

- সুকুমার..সুকুমার হালদার..। পুলিশের বড়কর্তা সুকুমার হালদার? 

- হুম৷

- ওর সঙ্গে খান দুই কনস্টেবল তো থাকবেই..।

- মিনিট তিনেকের উইন্ডো পাবি৷ বললাম তো। সে দায়িত্ব আমার।

- একটু বেশি রিস্ক হয়ে যাচ্ছে না অনিলদা?

- ভুলচুক করছিস৷ নার্ভাস হচ্ছিস৷ আজকাল নতুন টিউশনির ব্যাচ ধরেছিস নাকি?

- শোনো অনিলদা..। হালদার তো আর ওই আগরওয়াল বা দত্তর মত এলেবেলে টার্গেট নয়৷ 

- তোর ফিজ তিনগুণ৷ 

- যদি কাজটা না নিই?

- টিউশনিগুলোও আর করা হবে না তোর৷ তুই মাস্টার নোস অর্ণব।

- তুমি হুমকি দিচ্ছ অনিলদা?

- অর্ণব৷ হুমকি আদানপ্রদান হয় সমানে-সমানে৷ বিটউইন ইকুয়ালস৷ আমি তোর সঙ্গে ট্র‍্যান্সপ্যারেন্টলি ইনফর্মেশন শেয়ার করছি৷ তুই কাজটা করবি? 

- গাড়ি পাঠিও৷ কাল উইনস্টন ক্লাবে পৌঁছে যাব। 

- চিয়ার আপ অর্ণব৷ কাল কড়কড়ে টাকাগুলো পকেটে ঢুকলে দেখবি নার্ভাসনেস ফুসমন্তর। আর হ্যাঁ, পুরো টাকাটাই আগাম দেব৷ ওই গাড়িতেই রাখা থাকবে, পিছনের সীটে, একটা চামড়ার পাউচে৷ 

**

- হ্যালো, অনিলদা? 

- বলো।

- কাজ হয়ে গেছে৷ 

- গুড৷ ভেরি গুড৷

- টাকাটা?

- একটা চামড়ার পাউচ দেখতে পারছ? টার্গেট যে গাড়িতে, সে'টার ব্যাকসীটেই থাকা উচিৎ৷

- উম..দেখি..এই যে..আছে৷ 

- খুলে দেখো।

- আরে, এ তো অনেক বেশি..।

- পাক্কা তিনগুণ। পকেটস্থ করে ফেলো৷ 

- কিন্তু এই সামান্য কাজের জন্য এতগুলো টাকা..।

- তুমি এদ্দিন আমার হয়ে কাজ করছ সুকুমার৷ অজস্র কাজ সেরেছ; লাশ সরিয়ে দেওয়ায় কোনওদিনও গোলমাল হয়নি৷ অথচ ওই টিউশনি মাস্টার কী হ্যাপাটাই না দিলে সে'বার৷ তোমারই হেল্প নিতে হল স্ক্যান্ডালটা ধামাচাপা দিতে৷ ব্যাপারটা ঠিক অভিপ্রেত নয়৷

- ওহ, এও আমাদের দলেই ছিল?

- কী জানো মিস্টার সুকুমার হালদার, পার্ফেকশন ছাড়া আমার ব্যবসা অচল৷ কাজেই পেস্টকন্ট্রোল না করলে চলছিল না৷ আর তোমার ফিজের ওপর বাড়তি টাকাটা ধরে নাও বোনাস, ফর মেন্টেনিং আ হান্ড্রেড পার্সেন্ট রেকর্ড৷ তাছাড়া অত জমজমাট এলাকায় তিন মিনিটের মধ্যে গোটা ব্যাপারটা সেরে ফেলা সহজ নয়৷ যাকগে, তোমার হাতের কাজ ভালো; বডিটার খবর কাগজে পড়তে হবে না, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত৷

Wednesday, March 2, 2022

লেবুজল



- আচ্ছা অভ্র, আপনি কবিতা পড়েন?

- ক..কবিতা? পোয়েট্রি?

- ভূতের নাম শুনলেন? নাকি ভল্ডেমর্ট?

- ভূত বা ভল্ডেমর্ট শুনলে ঠিক গলা শুকিয়ে যায়না, হাতের তালু ঘামতে শুরু করেনা, হাড়-কাঁপানো পরীক্ষার হলের গন্ধ নাকে আসে না, সামান্য লেবুজলের জন্য মন আঁকুপাঁকু করে না, জুনের দুপুরে কলকাতায় বসে গায়ে শাল জড়াতে ইচ্ছে করে না৷ কিন্তু কবিতা পড়লে হয়। বুঝতেই পারছেন, আদা-কাঁচকলা ইকুয়েশনে রয়েছে আমার মাথা আর কবিতা৷ 

- চীনেবাদামের ভাঙা খোসার সঙ্গে আপনার তুলনা চলতে পারে৷

- কী জানেন রুবি, কবিতার লাইনগুলো কেমন কপালে গোঁত্তা খেয়ে ছিটকে যায়। গদ্যফদ্য দিব্যি সুটসাট ব্রেনে ঢুকে জাঁকিয়ে বসে পড়ে৷ কিন্তু পদ্য হলেই মগজের ইলেক্ট্রিক ফেন্সে শক খেয়ে এলোমেলো হয়ে যায়।

- একটা গোটা জীবন কবিতা অ্যাপ্রিশিয়েট না করে কাটিয়ে দেবেন?

- রুবি, আমি কিন্তু চেষ্টা করেছি অনেক৷ বিশ্বাস করুন৷ গ্যাঁটের পয়সা খরচ করে প্রচুর বইও কিনেছি একসময়৷ সে'গুলোকে সে'গুলোকে কোস্টার হিসেবে ব্যবহার করি৷ 

- আপনি ক্রিমিনাল অভ্র। 

- কবিতার বইকে ডিসরেস্পেক্ট করেছি বলে? 

- না৷ নিজের কবিতা বোঝার ক্ষমতাটাকে অগ্রাহ্য করছেন বলে।

- যাহ শালা৷ ওহ, সরি৷ আই মীন...।

- নিজেকেই বরং কড়াভাবে শালা বলে একটা মজবুত গাঁট্টা মারুন অভ্র। 

- আমি শালা কবিতা বুঝি?

- কবিতা পড়ে আপনার গলা শুকোয়, হাতের তালু ঘামে, ছেলেবেলার পরীক্ষার হলের সুবাস নাকে আসে, বুকভরা হাঁসফাঁস টের পান লেবুজলের জন্য, জুন মাসের গরম উড়িয়ে দিয়ে গা-কাঁপুনি টের পান৷ এ সমস্তই কবিতা অ্যাবজর্ব করে  ফেলতে পারার সিম্পটম৷ ওই ইলেক্ট্রিক ফেন্স আপনার মনের ভাঁওতা৷ আপনি এস্কেপিস্ট অভ্র৷ 

- এই যে, আপনার কফি শেষ হয়েছে? তা'হলে এ'বার ওঠা যাক৷

- আপনি এস্কেপিস্ট?  অভ্র?

***

রুবির ট্যাক্সিটা চোখের আড়াল হওয়ার পরেও খানিকক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলেন অভ্র৷ অটোওলা ধমক না দিলে হয়ত আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকত৷ এই রুবি মেয়েটা ভারী অদ্ভুত৷ গত বছর দেড়েকে অন্তত আড়াইশো কাপ কফি খাওয়া হয়ে গেছে একসঙ্গে। অথচ এদ্দিনেও সম্পর্কটাকে 'আপনি' থেকে 'তুমি'তে টেনে তোলা গেলনা। 

রুবি যে ঠিক কী চায়, সেটা বুঝে ওঠার আশাই ছেড়ে দিয়েছে অভ্র৷ শুধু কেমন একটা বিচ্ছিরি মায়া, আর খানিকটা স্নেহ৷ তাছাড়া ওই যে, রেস্টুরেন্টের টেবিলের ওপর রাখা নুনের ডিবেটা টেনে নিতে গিয়ে নিজের আঙুলের ডগায় রুবির আঙুলের স্পর্শ৷ ব্যাপারটা ঈষৎ গোলমেলে। রুবির ট্যাক্সি এতক্ষণে নির্ঘাৎ দেড়দুই কিলোমিটার দূরে, তবু আঙুলের ডগার ছ্যাঁতটা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না৷ 

"যাহ্ শালা", অস্ফুটে বলে উঠল অভ্র৷ পকেট থেকে রুমাল বের করতে হল হাতের ঘাম মুছতে৷ অথচ এই চিটচিটে গরমের মধ্যেও যেন একটা কনকন গায়ে এসে ঠেকছে৷ কী আশ্চর্য!  নাহ্, বেশ বিরক্তই বোধ করছিল সে৷ দু'কাপ কফি খেয়েছে আধঘণ্টা আগেই, তবুও যেন গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে৷ সামনের ফুটপাথে একটা লেবু জলের দোকান দেখতে পেয়ে সামান্য স্বস্তি পেল অভ্র৷ এ'বার মিনিমাম দু'গেলাস ঢকঢক করে না খেলেই নয়৷