পনেরো বছর আগে, ঠিক আজকের দিনে (১৯শে মে, ২০০৭) বংপেনের প্রথম 'পোস্ট' 'পাবলিশ' হয়েছিল৷ লেখালিখির মানুষ নই আদৌ, আগ্রহ ছিল ব্লগ ব্যাপারটাকে বোঝার৷ অমন টপ করে নিজের ওয়েবসাইট খুলে বসা যায়৷ যা খুশি লেখা যায়, ছবি আপলোড করা যায়৷ ব্যাপারটা রীতিমতো থ্রিলিং মনে হয়েছিল৷ তখন আমি সামার ইনটার্নশিপ করতে কলকাতায়৷ মাস দুয়েকের জন্য সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটের পুরনো মেসবাড়িতে ফিরে গেছি৷ সেই সময়ই এই আগ্রহটা দানা বাঁধে আর সূর্য সেন স্ট্রিটের একটা সাইবার ক্যাফেতে বসে ব্লগারে রেজিস্টার করি৷ প্রথমে ভেবেছিলাম ইংরেজিতে লিখব৷ পরীক্ষার খাতার বাইরে একদমই বাংলায় লেখার অভ্যাস ছিল না৷ ওই যে বললাম, উদ্দেশ্য ছিল ব্লগ ব্যাপারটাকে বোঝার৷ ব্লগের বিষয় কী হবে, সে'খানে কী থাকবে; সে'সব ভাবনা নেহাতই অপ্রয়োজনীয় ছিল৷
বাংলা ব্লগের সংখ্যা তখন নেহাতই হাতে গোনা৷ কিন্তু তদ্দিনে অনেকেই ইংরেজিতে ব্লগ লিখতে শুরু করেছেন৷ আর সে'সব লেখা খুঁজেপেতে পড়তে বেশ লাগছিল৷ মিডিয়ামটা যে ছাপার থেকে একটু স্বতন্ত্র, পাঠক হিসেবে সে'টা বুঝতে অসুবিধে হয়নি৷ তখনও আমরা ফেসবুক ট্যুইটার দেখিনি, ছিল সবেধন নীলমণি অর্কুট। অর্কুটের স্ক্র্যাপ ব্যাপারটা খুবই ব্যক্তিগত ছিল; ওয়ান-টু-ওয়ান প্রসেস৷ ব্লগ তা নয়৷ সে'খানে বহু মানুষ নিজের চিন্তা,ভাবনা, লেখালিখি সাজিয়ে নিজের মনের মত জার্নাল তৈরি করছেন৷ সে ব্যাপারটা যতটা ব্যক্তিগত, ততটাই খোলামেলা৷ যাদের প্রাক-ফেসবুক-ইন্টারনেট-যুগের স্মৃতি ফিকে হয়ে এসেছে (বা ছোটরা যারা সে সময়টা দেখেইনি), তারা সেই প্রথম ব্লগ দেখার 'উরিব্বাস' অনুভূতিটা ঠিক ধরতে পারবেন না৷
আমার চিরকালই ধারণা ছিল অলিখিয়ে মানুষদের নিজের লেখা ফলাও করে লোক হাসানো উচিৎ নয়৷ কিন্তু ইন্টারনেট একটা অদ্ভুত স্পেস দিল নির্লজ্জ হওয়ার৷ খারাপ লিখি, বেশ করি; কারুর কপালে বন্দুক রেখে তো পড়তে বলছি না৷ লিখেই দেখিনা৷
আমি সবচেয়ে মজা পেয়েছিলাম নিজের ব্লগকে নিজের মত সাজাতে পারার ব্যাপারটায়৷ বরাবরই আমার হাতের লেখা ভয়াবহ৷ গভীর প্রেমে পড়েও নিজের হাতে চিঠি লেখার দুঃসাহস কোনওদিন হয়নি৷ কিন্তু ব্লগে সে দুশ্চিন্তা নেই। লেখার বিষয় কাগের ঠ্যাং হোক, লেখার কোয়ালিটি বগের ঠ্যাং হোক; আমি মনের মত ফন্ট বেছে নিতে পারি৷ ইচ্ছে মত মাস্টহেড ঠিক করা যায় (বহুদিন একটা কাকের ছবি আমার ব্লগের মাথায় ছিল, কেন সে ছবি বেছে নিয়েছিলাম তা আজ আর মনে নেই)৷ ব্লগের রংচঙও ইচ্ছে মত বদলে নেওয়াই যায়৷ গোটা প্রসেসটা যে কী ভালো লেগেছিল৷ তাই ভাবলাম ব্লগ একটা খুলেই ফেলি৷ নিজে লিখব, নিজেই পড়ব, আর নিজেই নিজের ব্লগকে ক্রমাগত কাস্টোমাইজ করে যাব। ক্লাস ইলেভেনে উঠে প্রথমবার রোডর্যাশ কম্পিউটার গেমটা খেলে যে আনন্দ পেয়েছিলাম, ব্লগ আবিষ্কারেও সম্ভবত আমি সে আনন্দই পেয়েছি।
তা, ব্লগ শুরু হলো গুগলের ব্লগারে। অন্য কোনও প্ল্যাটফর্ম চিনতামও না৷ কী মনে করে ঠিক করলাম ইংরেজিতে নয়, বাংলাতেই লিখব৷ তবে রোমান হরফে৷ তখনও অভ্র সম্বন্ধে সচেতন হইনি৷ আর বাংলা ওয়ার্ডে লেখার চেয়ে ডালভাতের সঙ্গে স্টোনচিপস ভাজা চেবানোও সহজ মনে হত৷ কাজেই একটা গোলমেলে বাংরেজি মার্কা শুরু৷ সেই পাঁচমেশালি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই বোধহয় বংপেন নামটা বেছে নেওয়া৷ বছরখানেক পর শুরু করি অভ্রতে বাংলা লেখা।
আর পাঁচটা মানুষের মত আমারও মনের মধ্যে অনেক হুজুগ আসে, আবার ফাঁকতালে কেটেও পড়ে৷ আর সত্যি বলতে কী; হাল ছাড়ার ব্যাপারে আমার জুড়ি মেলা ভার৷ তা'ছাড়া কত মধ্যবিত্ত ভয় আর লজ্জা মনের মধ্যে আছে৷ কোনও কিছু করতে নেমেই মনে হয়ে, "এহ হে, লোকে হাসবে"। বা "কী দরকার, এ দিয়ে আখেরে কিছু হবে কী", এমন কতশত ভয়৷ এমনি'ভাবেই কত শখ ভেসে যায়৷ এহেন মানুষ হয়ে, একটা কথা ভাবতে কিন্তু বেশ ভালো লাগে; যে এদ্দিনেও ব্লগটা ছেড়ে দিইনি৷ বংপেন ডট নেট৷ ও'টা সত্যিই আমার "এলাকা"৷ লোক হাসানোর ভয়ে গুটিয়ে যাওয়া সে'খানে নেই৷ সবচেয়ে বড় কথা, ওই একটা ব্যাপারে আমি আজও 'রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট' ভেবে নার্ভাস হইনা৷ বাথরুমের গান আর ব্লগের লেখা, এ'দুটো ব্যাপারে পিছপা হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এই স্পেস শুধুই আমার৷ নিজের ব্লগে (ফেসবুক পেজ নয়, আদত ব্লগটা) আমি নিয়মিত (রোজ) ঢুঁ মারি৷ পড়ি, পুরনো ভুল শুধরে নিই, ছবি পাল্টাই, ফন্ট এ'দিক ও'দিক করি, ট্যাগগুলো ঝালিয়ে নিই৷ এই গোটা প্রসেসটা আমার মনের ঝুলবারান্দা, আত্মার বিরিয়ানি৷ আর একবার বলি, বড় ভালো লাগে এই ভেবে যে এমন একটা জায়গা খুঁজে পেয়েছি যে'খানে ইচ্ছেমত কেরদানি ফলানো যায়৷ জায়গাটা ডিজিটাল কিন্তু ছোঁয়াও যায়৷
একটা ব্যাপার না জুড়লেই নয়৷ লিখতে লিখতে হাজার রকমের দোষ বেরিয়ে এসেছে, সে'গুলো অত্যন্ত সহৃদয়ভাবে ধরিয়ে দিয়েছেন এবং শুধরে দিয়েছেন মানুষজন৷ বংপেনের পাঠকরাই মোটামুটি ঠুকেঠাকে চালিয়ে দিয়েছেন এই ব্লগটাকে৷ বানান শুধরে দেওয়া, টাইপো দাগিয়ে দেওয়া, লেখার ভুল ধরিয়ে দেওয়া; সবচেয়ে বড় কথা, পিঠ চাপড়ে দেওয়া৷ তাঁদের যোগানো দুঃসাহসের ভরসাতেই মনে হয়েছে, আর একটু লেখাই যায়৷ বংপেনের সূত্রে, এই পনেরো বছরে কত কিছু শিখেছি৷ কত ভালো বই, সিনেমা, খাবারদাবারের সাজেশনে সমৃদ্ধ হয়েছি৷ সবচেয়ে বড় কথা, ঢিমেতালে হলেও আমার মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসাটা ক্রমশ বেড়েছে৷ এই যে নিয়মিত বাংলা লিখছি, সে অভ্যাসটাও তৈরি হয়েছে স্রেফ এই বংপেন ছিল বলে। কৃতজ্ঞতা প্রসঙ্গে একটা জরুরী কথা না বললেই নয়৷ বংপেন ব্লগটা না থাকলে কিছু জরুরী বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগই হত না৷
বংপেন আদৌ কোনও জার্নাল নয়৷ তবে ব্লগের প্রতিটা লেখার সঙ্গেই কোনও না কোনও স্মৃতি জুড়ে আছে৷ হয়ত কোনও পরিচিত মানুষের কথা বলার স্টাইল, কোনও সুপরিচিত জায়গার গন্ধ, কোনও প্রিয় সিনেমার সিচুয়েশন, কোনও হঠাৎ মনে পড়া ঠাট্টা বা মনখারাপ৷ কাজেই কতশত খাজা লেখাও স্রেফ সেই নিজের রকমারি স্মৃতির সঙ্গে আবছা যোগাযোগের জন্য আমার কাছে জরুরী হয়ে রয়ে গেছে৷ আজকাল একটা ইচ্ছে জোরালো হচ্ছে; আমার ছেলে বড় হয়ে বাপের আগডুম-বাগডুম লেখাগুলো পড়বে আর সে'সব লেখায় সেঁধিয়ে থাকা স্মৃতিগুলো ডিকোড করে আনন্দ পাবে৷ হয়ত মাঝেমধ্যে মুচকি হাসবেও।
No comments:
Post a Comment