Sunday, June 19, 2022

বাবা আর ফিশ

আট কার্ডের খেলাটাকে আমরা 'ফিশ' বলি৷ তিন কার্ডের 'রানিং লাইসেন্স'৷ আমরাই আমাদের বিসিসিআই, কাজেই ইচ্ছেমত ঘরোয়া ইনোভেশন জুড়ে দেওয়া যায়৷ এই যেমন লাইসেন্স না হলে 'জোকার' দেখা যাবেনা, ইত্যাদি৷ ফেসবুকে লিখে সে'সব 'নুয়ান্স' বোঝানো সম্ভব নয়৷ দশ দানের পর যার পয়েন্ট সবথেকে কম, সে জিতবে৷ 

খেলতে বসে রেগেটেগে লাভ নেই৷ তবে 'ব্যান্টার' টীকাটিপ্পনী ছাড়া 'ফিশ' খেলার থেকে সুইচ অফ করা টিভির দিকে তাকিয়ে থাকা ভালো৷ এই হচ্ছে আমাদের থিওরি৷

এ খেলায় একদানে একজনকে ম্যাক্সিমাম আশি পয়েন্ট খাওয়ানো যেতে পারে৷ কিন্তু সে ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি, খানিকটা ওই এক ওভারে ছত্রিশ রান করার মত৷ কিন্তু যতক্ষণ একটা 'ম্যাথেম্যাটিকাল পসিবিলিটি' আছে, কয়েক কিলো পয়েন্টে পিছিয়ে গেলেও বাবা হাল ছাড়বে না৷ লজিক একটাই, "বলা তো যায় না, হলেও হয়ে যেতে পারে৷ আর না হলেই বা ক্ষতি কী, দু'দান দেখি"৷ 

আর সামান্য একটু জমি পেলে যে কোনও জায়গাতেই খেলতে বসে যাওয়া যেতে পারে৷ ডাইনিং টেবিল, সোফা, ট্রেনের বার্থ, পার্কের বেঞ্চি৷ হয়ত সময় খুব কম আছে, দশ দান খেলা সম্ভব নয়৷ তখনও বাবার ওই সহজ ফর্মুলা, "বলা তো যায় না, হলেও হয়ে যেতে পারে৷ আর না হলেই বা ক্ষতি কী, দু'দানই খেলব না হয়"৷ 




এই ছবিটা বারোটে (হিমাচল) তোলা। ২০১৫।


চালশে আর ফার্স্টইয়ারি



সুমনবাবুর চালশে গানটা প্রথম শুনেছি কৈশোরে৷ আমার অন্যতম প্রিয় 'সুমনের গান'। আজও এ গানটা আমার কৈশোরের গান। কলেজের গান৷ হাইস্কুলে থাকতে বাড়ির ফিলিপ্স টেপরেকর্ডারে এ গান বাজত। পরে কলকাতার মেসে বসে সস্তায় কেনা এফএম রেডিওতে সে গান মাঝেমধ্যেই শোনা যেত৷ সে বয়সে, গানটা গুনগুন শুরু করলেই আশেপাশের চালশেদের প্রতি অস্ফুট "আহা, উঁহু"-ভাব টের পেতাম৷ একটা প্রবল সিমপ্যাথি। 

মনে হত, "আহা রে, কত গুঁতোগাঁতা খেয়ে এ বয়সে এসে পৌঁছেছেন৷ মাঝবয়সী খিটমিটগুলোয় না জানি তাদের কতশত স্ট্রাগল আড়াল হয়ে যাচ্ছে"।  ফার্স্টইয়ারি মেজাজের সিংহাসনে বসে ভাবতাম, "আফটার অল, এই বাবা-জ্যাঠা-কাকা-মামাদের তো ইয়ুথটাই গন৷ লোহা চিবিয়ে হজম করার দম আর নেই৷ বেনিয়মে বন্ধুদের হুল্লোড় নেই। সোমবার বিকেলের কলেজ স্কোয়্যারের ঘটিগরম নেই৷ প্রেমের চিঠি নিয়ে ফলাও করে মেস-বৈঠক বসানোর সুযোগ নেই৷ বাজে গল্পে রাতকাবার করার ধক নেই৷ পুজোয় লম্বা ছুটি নেই৷ এদের আর আছেটা কী। আহা রে, এ'দের জীবনটাই তো ফিনিশ হয়ে গেছে৷ পড়ে আছে শুধু গাদাগুচ্ছের রেস্পন্সিবিলিটি"। ব্যাস, এইসব ভাবনাকে আরও একটু উস্কে দিত সুমনের এই গান৷

এ'বারে একটা অদ্ভুত ব্যাপার হল, আজও এই গানটা আমি সেই ফার্সইয়ারি ছেলেবেলার কান ছাড়া শুনতে পারিনা৷ এমন অনেক গানই রয়েছে অবশ্য, যে'গুলো শিল্পী, সুর, কথার ওপরে গিয়ে স্মৃতি-ফসিল হয়ে রয়ে গেছে৷ কে সুমন, কীসের দামী লিরিক্স, কীসেরই বা মনকেমনের সুর- চালশের গানে সেই ক্লাস টুয়েলভ বা কলেজের বিকেল-রাত্রির গন্ধ লেগে৷ সেই গন্ধই সে গানের আইডেন্টিটি। এ'সব গান একটু মন দিয়ে শুনলে এখনও ক্যালকুলাসের ভয়টা বুকের মধ্যে ছ্যাঁতছ্যাঁতিয়ে উঠবে বোধ হয়৷ যাক গে, এই চালশের গান শুনলে এখনও ওই ফার্স্টইয়ারি একটা কণ্ঠস্বর ভারী মিহি স্বরে আহা উঁহু করে বলে, "আহা রে, যাদের বয়স চল্লিশ পেরোল তাদের কী দুঃখ গো৷ প্রভিডেন্ট ফান্ড নিয়ে চিন্তা করেই দিন গুজরান করতে হয়, কলেজ ফেস্টের খোঁজখবর আর তাদের নিরেট জীবনে দাগ কাটে না৷ জোড়া রোল খাওয়ার বদলে তারা একটা ভেজিটেবল চপ ইন্সটলমেন্টে খায়৷ ইশ৷ আর এরা বেপরোয়া বিরিয়ানিতে রইল না, সুবোধ স্যান্ডুইচে এসে ঠেকেছে৷ দলবেঁধে দীঘা যাবে কী, গ্রুপ ইন্সুরেন্স ছাড়া আর কোনও ভাবনায় এদের স্বস্তি নেই৷  এদের জন্য কী মনকেমন গো"। 

সমস্যা হল, সে সিমপ্যাথির বেলুনে সুট করে চুপসে দেয় অন্য একটা গাম্বাট কণ্ঠস্বর, " ওরে আমার কচি খোকা এলেন হে৷ এ'সব ভাবনা হাউই নিয়ে পড়ে থাকলে হবে? অম্বলের ওষুধ কি তোমার গ্র‍্যান্ডফাদার খাবে"? অমনি, বুকের মধ্যে বরফঝড়।   এই গান যে আর 'ওদের' জন্য লেখা নয়। এ গান এখন ডাইরেক্ট আমার এবং আমাদের৷ আমি আর এ গানের অডিয়েন্স নই, সাবজেক্ট৷ আমি আর "আজকে যে.."র দলে নেই৷ সুট করে "কালকে সে.." টীমে এসে দু'দণ্ড জিরিয়ে নিচ্ছি৷ চল্লিশ আসছে, ছোটবেলার সুমন দিয়ে তাকে ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছে না কিছুতেই৷

Thursday, June 16, 2022

তুচ্ছ ইতিহাস



আজকাল ইতিহাস সিলেবাসের ঠিক-ভুল উচিৎ-অনুচিত নিয়ে বেশ তোলপাড় চলছে। সে বিতর্কের মূলে রয়েছে রাজরাজড়াদের নিয়ে টানাটানি। কতটা মুসলমান বাদশাদের কথা পড়লাম, কতটা হিন্দু রাজরাজড়াদের ব্যাপারে জানলাম; সে রেশিও নিয়ে ধুন্ধুমার ব্যাপার। গুঁতোগুঁতি করে তর্ক করতে আমাদের যতটা আগ্রহ, ততটা আগ্রহ অবশ্য ইতিহাসের বই উল্টেপাল্টে দেখায় নেই। সে'টা একদিক থেকে বাঁচোয়া, ইনফরমেশন আর অবজেক্টিভিটির জ্বালায় রসালো খিস্তিখেউর নিষ্প্রভ হয়ে যায় না। যাক গে। এ'সবের মাঝে একজন চমৎকার ইতিহাস প্রিয় চরিত্রের কথা মনে পড়ে গেল; বিভূতিভূষণের অপু। অপু আইএ পাশ করে আর কলেজে ভর্তি হল না। প্রফেসররা ডেকে অপুকে বোঝাতে চাইলেন যে অপুর অনার্স পড়া উচিৎ। কিন্তু সদ্য মাতৃহারা, সহায়-সম্বলহীন অপুর তখন ক্লাস করার আগ্রহ ছিল না। নিদারুণ অভাবের মধ্যে থাকার ফলে অবশ্য ভর্তি না হওয়ার সিদ্ধান্তটা আরও সহজ হয়ে গেছিল। কিন্তু অপুর অনাগ্রহ ছিল মূলত সেই স্ট্রাকচার্ড সিস্টেমটার প্রতি, জানার ইচ্ছেটুকু পুরো দমে তাকে ঠেলে নিয়ে বেড়াচ্ছিল। আর প্রচণ্ড মুখচোরা হওয়া সত্ত্বেও নিজের পড়াশোনার ফোকাস সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না অপুর। অপুর নিজের মনের ভাষায়; "দু'বছর (বিএ'র) মিছিমিছি নষ্ট না করে, লাইব্রেরিতে তার চেয়ে অনেক বেশি পড়ে ফেলতে পারব'খন"।

অপুর ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরিতে বসে নিজের ইচ্ছেমত পড়াশোনা করার বর্ণনা 'অপরাজিত'র সামান্য কয়েকটা পাতার মধ্যেই সীমিত। কিন্তু ও'টুকু অংশ যে আমার কী প্রিয়। ডিগ্রি পাওয়ার জন্য নয়, 'কেরিয়ারে' এক্সেল' করতে হবে বলে নয়, এমন কী দু'দশজনের মাঝে দু'চারটে মজবুত কথা বলে চমকে দেওয়ার জন্যও নয়। সে গোগ্রাসে একের পর এক বই গিলেছে শুধুই জানার আগ্রহে। ওই আগ্রহে সিস্টেমের বালাই ছিল না, তবে অচেনা অজানাকে জানবার উচ্ছ্বাস ছিল ষোলো আনা। অপুর মধ্যে একটা দুর্দান্ত আত্মবিশ্বাস ছিল যে কলেজের সিলেবাসে বাঁধা পড়ার মধ্যে সার্থকতা নেই। (একটা কথা বলার লোভ সামলাতে পারছিনা। আমার সৌভাগ্য যে আমি এমন একজনকে চিনি যে কলেজের সিলেবাসকে কাঁচকলা দেখিয়ে লাইব্রেরির শেল্টারে নিজেকে সঁপে দিয়েছিল। এবং এক্সলেন্সকে পোষা বেড়ালের মত মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে পেরেছিল। ওঁর থেকে অনুমতি আদায় করে একদিন সে'সব গল্প ফলাও করে বলতে হবে। তবে এ'বার অপুতে ফেরত যাওয়া যাক)। 

অপু দুপুর দু'টো থেকে সন্ধ্যে সাতটা পর্যন্ত লাইব্রেরীতে বসে পড়ত। রোজ। একটা ছোটখাটো অল্প মাইনের চাকরী যে'টা জোগাড় করেছিল সে'খানে ছিল রাতের শিফটে কাজ। বেলায় দেরী করে ঘুম থেকে উঠে সে ছুটত লাইব্রেরীর দিকে। এই যে নির্বিচার পড়াশোনা, তার অনেকটা জুড়েই ছিল ইতিহাস। কিন্তু সে ইতিহাস অপু যত পড়ছে, তত তার মনের মধ্যে একটা অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। বারবার তার মনে হয়েছে এই যে রাজরাজড়ার হিসেবকিতেব, সে'টুকুই কি সম্পূর্ণ ইতিহাস? ইতিহাসের এসেন্স কি সে'টুকুই? না না, বিভূতিভূষণ কোট করে খামোখা নতুন তর্কে পড়তে চাইনা মোটেও। ইতিহাস যে রাজাগজাদের ফোকাসে রেখেই গড়ে উঠবে, সে'টাই স্বাভাবিক। এবং লজিকাল। ভালোয় মন্দয় মিশিয়ে ইতিহাসের প্রাইম মুভার যে সে রাজাগজারাই। কিন্তু অপুর মনের মধ্যে যে উৎসুক রোম্যান্টিক মানুষটা রয়েছে, সে যে শুধু মাইলস্টোনের জাঁতাকলে আটকা পড়বে না, তা বলাই বাহুল্য। অপুর হয়ে বিভূতিবাবু বলছেন, "মানুষের সত্যকারের ইতিহাস কোথায় লেখা আছে? জগতের বড় ঐতিহাসিকদের অনেকেই যুদ্ধ-বিগ্রহ ও রাজনৈতিক বিপ্লবের ঝাঁঝে; সম্রাট, সম্রাজ্ঞী, মন্ত্রীদের সোনালি পোশাকের জাঁকজমকে; দরিদ্র গৃহস্থের কথা ভুলিয়া গিয়াছেন। পথের ধারের আমগাছে তাহাদের পুটুলিবাঁধা ছাতু কবে ফুরাইয়া গেল, সন্ধ্যায় ঘোড়ার হাট হইতে ঘোড়া কিনিয়া আনিয়া পল্লীর মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকের ছেলে তাহার মায়ের মনে কোথায় আনন্দের ঢেউ তুলিয়াছিল - ছ'হাজার বৎসরের ইতিহাসে সে'সব কথা লেখা নাই।...কেবল মাঝেমাঝে এখানে ওখানে ঐতিহাসিকদের লেখার পাতায় সম্মিলিত সৈন্যব্যূহের এই আড়ালটা সরিয়া যায়, সারি বাঁধা বর্শার অরণ্যের ফাঁকে দূর অতীতের এক ক্ষুদ্র গৃহস্থের ছোট বাড়ি নজরে আসে। অজ্ঞাতনামা কোন লেখকের জীবন-কথা, কি কালের স্রোতে কূলে-লাগা এক টুকরো পত্র, প্রাচীন মিশরের কোন্‌ কৃষক পুত্রকে শস্য কাটিবার কী আয়োজন করিয়ে লিখিয়াছিল, - বহু হাজার বছর পর তাহাদের টুকরো ভূগর্ভে প্রোথিত মৃণ্ময়-পাত্রের মত দিনের আলোয় বাহির হইয়া আসে। কিন্তু আরও ঘনিষ্ঠ ধরণের, আরও তুচ্ছ জিনিসের ইতিহাস চায় সে। মানুষের বুকের কথা সে জানাতে চায়। আজ যাহা তুচ্ছ, হাজার বছর পরে তা মহাসম্পদ। ভবিষ্যতের সত্যকার ইতিহাস হইবে এই কাহিনী, মানুষের মনের ইতিহাস, তার প্রাণের ইতিহাস"। 

এই যে ইতিহাসের আড়ালে থাকা তুচ্ছ মুহূর্তদের নিবিড়ভাবে জানার লোভ, এ'টা কিন্তু কিছুতেই অপুর একার হতে পারে না। ঐতিহাসিকদের দোষ দিইনা, সমস্ত হরিদাস পালের গল্প বই বা স্টোনট্যাবলেটে বা প্যাপাইরাসে সাজিয়ে রাখা সম্ভব নয়। কিন্তু ওই 'খামোখা তুচ্ছের প্রতি আগ্রহে'র জন্যেই সুনীলবাবুর লেখা অর্ধেক জীবন আমার এত প্রিয়। অথচ মূল ইতিহাসের বই নিংড়ে সেই সাদামাটা মানুষের সাদামাটা গল্প বের করে আনা চাট্টিখানি কথা নয়। যে কোনও ইতিহাসের বই হাতড়ালেই দেখব যে রাজারাজড়া, রাজনীতি আর ধর্ম - এই কনসেন্ট্রিক সার্কলগুলোর মধ্যে ঘুরপাক খাওয়া ছাড়া গতি নেই। অবশ্য সে'ইতিহাসও সাংঘাতিক ভাবে গ্রিপিং। এবং জরুরী। তবে তা'তে ওই 'তুচ্ছকে জানার ঝোঁক' কমে না। এবং স্রেফ লাইব্রেরীতে বসে সে ইতিহাসের নাগাল পাওয়া অসম্ভব। সবচেয়ে বড় কথা, এই যে এক একটা সময়ের সাদামাটা মানুষদের আটপৌরে একঘেয়ে গতানুগতিক জীবনধারা, সে'টাকে রেকর্ড করে রাখতে গেলে তো সাহিত্যের ভাষা আর বইয়ের ডিসিপ্লিনে কাজ হবে না। হরিদাস পালের বায়োগ্রাফার আবুল-ফজল হলে চলবে কেন? হরিদাসের উঠোনে পাতা মাদুরের ওপর ভেজা গামছা, তার খোকা কাদায় ল্যাপ্টালেপ্টি করে খেলা করছে। তার বৌ এমনভাবে শাক ভাজছে যে তা দিয়ে ভাত মাখলে নবাবের হেঁসেলের পোলাও হার মানাবে। ধারালো ভাষা বা কাব্যের চাতুরী হরিদাস পালের সেই তুচ্ছ ইতিহাস ক্যাপচার করবে কী করে? 

আর এ'টা ভেবেই একটা অদ্ভুত ব্যাপার মনে হলে। ইউটিউবের জমানায়, এ যুগের হরিদাস পালদের তুচ্ছ ইতিহাস সাহিত্যে বা সিলেবাসে স্থান না পেলেও হারিয়ে যাবে না। আমাদের এ যুগের ইতিহাস স্রেফ ওই প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী, যুদ্ধ, মিসাইলে আটকে থাকবে না। এলেবেলে যারা, যাদের জীবনগুলো এক্কেবারে স্কেল মেপে এবং ম্যাদামারা স্টাইলে চলে; তাদের দস্তাবেজও থেকে যাবে। উদাহরণ হিসেবে আমাদের অতি সহজ-সরল ফুড-ভ্লগগুলোই দেখুন। পাড়ার ইয়ারদোস্ত বা 'জুনিয়র' ছেলেমেয়েদের দল হাতে মোবাইল ক্যামেরা আর ইয়ারফোন নিয়ে বেরিয়ে পড়ছে। কেউ রানাঘাটের অনামা ভাতের হোটেলে বসে মাংসের ঝোল অর্ডার দিচ্ছে, এবং উপরি হিসেবে সে হোটেলের ম্যানেজার দাদার সঙ্গে জোর গপ্প জুড়ে ফেলছে। অথবা কেউ হরিদ্বারে পৌঁছে কোনও কচুরিওলার লম্বা ইন্টারভিউ রেকর্ড করছে। এই ভ্লগার, এই ভাতের হোটেলের ম্যানেজার, এই কচুরিওলা; এদের তো ইতিহাসের বইতে স্থান নেই। তবু এদের গল্প রয়ে যাচ্ছে অনন্তকালের পকেটে। মার্ক উইন্স সম্প্রতি বাংলাদেশ গেছিলেন, সে সাহেবের চোখ দিয়ে আমি চিনলাম সে দেশের এক চাকমা পরিবারকে। তাদের আমার চেনার কথা ছিল না। পাকিস্তানি ফুড ভ্লগার জিয়া তবারক ছিলেন তাই গুজরানওলার গুরুনানকপুরা স্ট্রিটের লস্যিবানিয়ে দাদা বা আরও কত সরলসিধে মানুষকে চিনে রাখি। 

আমার একটা  হঠকারী থিওরি হল, অপুর মত মানুষ পারত এই ইউটিউব নিংড়ে অতিপাতি মানুষের তুচ্ছ ইতিহাসে নিজেকে ডুবিয়ে দিতে। আমরা অপূর্ব নই। তার রোম্যান্সের নাগাল পাওয়া আমাদের কম্ম নয়। কিন্তু আমরা সে তুচ্ছ ইতিহাসে ডুবতে না পারে, গোড়ালি ডোবানোর চেষ্টা করতেই পারি।

অ-তিতকুটের আকুতি



কী হতে চাই না? তিতকুটে। 

সবসময় খিটখিট করব না। যা অপছন্দ তাই পড়ে/দেখে/শুনে নিজের ভিতরটাকে মুগুরপেটা করব না। 

এ'টা হল না, ও'টা হল না; এ'সব দুঃখ যাওয়ার নয়। তবে শুধু সেই দুঃখটা আমায় ডিফাইন করবে না।

মোটাদাগের একঘেয়ে কাজগুলোকে 'বেফালতু' বলে গোঁসা করে বসে থাকব না। বরং কোনও আনন্দ ফর্মুলায় সে'গুলোকে বেঁধে নিয়ে নিশ্চিন্তে থাকব।

"অমুক দাও, তমুক দাও" বলে হাজাররকমের ঘ্যানঘ্যান চালিয়ে যাচ্ছি, সে'সব এই বেলা কমিয়ে ফেলতে হবে। 

মাল্টি-টাস্কিংয়ের ফাঁদে পা দেবনা।  ব্রেনের মধ্যে সার্কাসের তাঁবু বসানোর দরকার নেই।

কলার টেনে জ্ঞান দেওয়ার লোভ ঠেকিয়ে রাখতেই হবে। আর কলার টানা যত জ্ঞান, সে'গুলোকে হেসে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সৎ সাহস তৈরি করতে হবে।

আর? 

আর, ভালো গল্প শোনার সুযোগ পেলেই ড্যাবড্যাবে চোখে বসে যাব।

চেনা-মানুষদের মাঝেমধ্যে ফোন করব। অদরকারে ফোন করব। (এখন করি না)।

কিছু ভালো লাগলে ভালো বলব। জোর গলায় বলব। আন্তরিকভাবে বলব।  পারলে লিখে জানাব। কিন্তু বাহবা জানানোর সুযোগ মিস করা চলবে না।

রোজ কিছু সহজ টার্গেট খুঁজে নেব। একেবারে জলবৎ-লেভেলের। সে'টা দু'পাতা কমিক্স পড়ার হতে পারে। আধ মাইল হাঁটা হতে পারে। নতুন দোকানের রোল খাওয়ারও হতে পারে। দিনের শুরুর টার্গেট বেশ দুলকি চালে রাতের অ্যাচিভমেন্ট হয়ে পড়বে। নিজেকে ইমপ্রেস করে বলতে হবে, "ভালো করেছ, আরও ভালো করতে হবে"।

সময়মত"সরি" বলতে হবে। ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে নয়, ইন্তুকিন্তু জুড়ে দিয়ে নয়, "আসলে কী হয়েছিল..." গোছের ভূমিকা ফেঁদে নয়। বিপদ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে বলে নয়। মনকেমনের কড়াইয়ে, "এহ, আর করব না মাইরি"-লজ্জার ডুবো তেলে ফ্রাই করে তুলে আনা যে "সরি"; সে'টা দরকার। সেই হাইক্লাস সরি সময়মত ডেলিভার করতে হবে। 

মোটের ওপর, তিতকুটে হওয়া চলবে না। কিছুতেই চলবে না।

ডায়োজিনিস আর আলেকজান্ডার



বড় শখ জানেন। বড় সাধ। 

একদিন, ডায়োজিনিসের মত ঘ্যাম নিয়ে আমি লেতকে পড়ে থাকব। চারদিকে বিস্তর হৈহল্লা, তুমুল ফুর্তি, আনন্দের বন্যা। এ ওকে জড়িয়ে ধরছে, ও একে হাই-ফাইভ অফার করছে, টেবিল কাঁপানো আড্ডা বসেছে। ও'দিকে ডায়োজিনিস-ঘ্যামে, আমি সোফায় হাত পা ছড়িয়ে আধশোয়া।  মুখে গুনগুন, তৃপ্তিতে বুজে আসা চোখ। যাবতীয় চিৎকার চ্যাঁচামেচি গলাগলি আবদার আমার গায়ে বাউন্স করে ফিরে যাচ্ছে। বন্ধুরা গপ্প ফাঁদতে আসবে, আমি বলব "রোককে ভায়া রোককে। মেডিটেশন মোডে রয়েছি"। পড়শিরা গসিপ করতে আসবে, আমি আঙুলের ইশারায় বলে দেব, "বাদ মে আইয়ে জনাব"। সবাই সেই ডায়োজিনিস-আমিকে দেখে বলবে "কী জিনিস রে ভাই"। 

এমন সময় ঘ্যাম-শিরোমণি সম্রাট-শ্রেষ্ঠ শ্রী শ্রী আলেকজান্ডার উত্তমকুমারিও হাসি হেসে আমার সোফার দিকে এগিয়ে আসবেন। মেজপিসে যে মেজাজে বৃষ্টির দিনে ফুলুরি খাওয়ান, আলেকজান্ডারবাবু তার চেয়েও সহজে বখশিশ বিলিয়ে বেড়ানো মানুষ। রাজ্য চাইলে রাজ্য, রাজকন্যে চাইলে রাজকন্যে। তুষ্ট করতে পারলেই হল। আলেকজান্ডারবাবুকে এগিয়ে আসতে দেখে বন্ধুরা ভাববে, এ'বার এই ডায়োজিনিস ব্যাটার ঘ্যাম-ঘুম ভাঙবেই। প্রতিবেশীরা চিল্লিয়ে উঠবে, "এ'বারে বাবুটি সোফা ছেড়ে উঠবেই। আলেকজান্ডারের ঝিলিক দেখে যাবে গলে। এ'টা দাও ও'টা দাও বলে মারাত্মক দাঁও মারার তাল করবেই"।

গ্রেটস্য গ্রেট আলেকজান্ডার এসে দাঁড়াবেন সোফার সামনে। বিশ্বজয় করা আওয়াজ দিয়ে চমকাতে চাইবেন, "এই যে ব্রাদার, হিয়ার আই অ্যাম। কী চাই? মুখ ফুটে যাই চাইবে, পাবে। মাইরি। কী চাই, অ্যাঁ? কেরিয়ার পালটে দেওয়া সুযোগ? না লটারিতে পাওয়া মিক্সার গ্রাইন্ডার? নাকি পরশপাথর,? না গানের গলা? না মার্গো সাবানের সুপারসেভার প্যাক? নোবেল প্রাইজ চাই? তাও হবে। নাকি ভোটে জিততে মন চাইছে"? এ'সব প্রশ্ন ভাসিয়ে দিয়ে, নিজের আদ্দির পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়াবেন আলেকজান্ডার। একটা সিগারেট ধরিয়ে নিখুঁত রিং ছাড়তে ছাড়তে আমায় করুণা দৃষ্টি দিয়ে জরীপ করবেন। শিস দিয়ে ধরবেন সলিল চৌধুরী। 

তারপর ফের বলে উঠবেন, 
"ভাই ডায়োজিনিস, লজ্জা কীসের। এই তো বাম্পার সুযোগ। মন খুলে চেয়ে নাও দেখি। তোমার ন্যাতানো হাবভাব আমার পছন্দ হয়েছে। হৈহল্লায় হাঁপিয়ে উঠছিলাম কিনা। তাই বলছি। চিন্তার কিস্যু নেই। চেয়ে ফেলো। মনঃপ্রাণ খুলে"। 

সোফা-মগ্ন আমি ঘাড়ের অ্যাঙ্গেল সামান্য পালটে নিয়ে আলেকজান্ডারের দেবতার মত মত উজ্জ্বল চেহারাটার দিকে তাকাব। বলব, "চেয়ে ফেলব? চেয়ে ফেলব কী"?

সিগারেটে একটা মোক্ষম টান দিয়ে আলেকজান্ডার বলবেন "চেয়েই দেখো না। আলেকজান্ডারের কথা হেরফের হলে পৃথিবী রসাতলে যাবে"। এরপর পকেট থেকে একটা পান বের করে মুখে দেবেন, জর্দার মনমাতানো সুবাসে ঘর মাতোয়ারা হবে। 

আবারও বলব, "ভেবেই দেখুন, পরে আবার রিফিউজ করবেন না যেন"।

আলেকদাদার আশ্বাস; "আহ্‌। বললাম তো ডায়োজিনিস ভাইটি। চাও। ডিম্যান্ড করো। ক্যুইক"। 

এ'বার আমার পালা হাইভোল্টেজ উত্তম-হাসিতে নিজেকে মুড়ে নেওয়ার। ডায়োজিনিস-কেতায় আমি বলে উঠবো, "স্যার, ডিমান্ডটা ফেলবেন না প্লীজ। ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় বাতির স্যুইচটা বন্ধ করে যাবেন। ইলেকট্রিকের বাতি আমেজে একটু খোঁচা দিচ্ছে বটে। আর পারলে তার আগে ওই ফ্রিজ থেকে একটা জলের বোতল  বের করে আমার হাতের কাছে দিয়ে যান। এ'বেলাটা তা'হলে আর না উঠলেও হবে। দ্যাট ইজ অল"। এই বলে আমি গা আরও খানিকটা এলিয়ে নিয়ে ফের চোখ বুজব। 

তালেবর আলেকজান্ডার ততক্ষণে থ। পান চিবুনো থেমে গেছে। এ যেন দক্ষিণপাড়ার বালক সঙ্ঘ ক্লাবের ক্যারমখোরদের কাছে তার সৈন্যদল ইনিংস ডিফীট খেয়েছে। দু'একবার আমতা আমতা করে কিছু বলতে যাবেন। কিন্তু সম্রাটের মুখ দিয়ে টু-শব্দটি বেরোবে না। খানিকক্ষণ অসহায় ভাবে ঘরের মধ্যে পায়চারী করে, ফ্রিজ থেকে জলের বোতল বের করে আমার সোফার পাশে রেখে রণেভঙ্গ দেবেন রাজাধিরাজ। আমার প্রতি অন্তত বাহাত্তরটা সেলাম ঠুকবেন, তবে মনে মনে। রুম থেকে বেরোনোর আগে স্যুইচ বোর্ডে হাত রেখে আর একবার আমার দিকে তাকিয়ে সেই বিশ্বজয়ী বলবেন, " আলেকজান্ডার হয়ে ছাই করলামটা কী! এমন নির্লোভ হতে পারলাম না কেন?আমি ডায়োজিনিস হতে পারলাম না কেন"?

বড় শখ জানেন। বড় সাধ; জীবনে একটিবার অন্তত এমন ডায়োজিনিস-ঘ্যাম নিয়ে জীবনের কোনও একটি আলেকজান্ডারিও বখশিশের অফার উড়িয়ে দেব। একটিবার অন্তত সে ঘ্যাম যেন স্পর্শ করতে পারি।

(আলেকজান্ডার-ডায়োজিনিসের মোলাকাতের ওপর যে উইকিপিডিয়া এন্ট্রি, সে'টার লিঙ্ক কমেন্ট সেকশনে দেওয়া রইল। আগ্রহীরা পড়ে দেখতে পারেন)

বুলেট দস্তিদারের গ্রেপ্তারি



ভীষণ নার্ভাস লাগছে। ভীষণ। এমন একটা বিপদে যে পড়তে হবে সে'টা ভাবিনি। এখন বেলা সোয়া বারোটা। সকাল দশটা থেকে অন্তত বারো গেলাস জল খেয়েছি তবু তেষ্টা কমার নাম নেই। এ'দিকে পেট ফুলে ঢোল, গা গুলিয়ে উঠছে, অন্তত বার সাতেক বাথরুম ছুটতে হয়েছে। হাবিলদার গোলক বটব্যাল মাঝেমধ্যেই ক্রিকেট স্কোর ঘোষণা করে হাড় জ্বালাচ্ছে। আমি মরছি নিজের জ্বালায়, ও পড়ে রয়েছে অস্ট্রেলিয়ার ফলোঅন নিয়ে, ধুরছাই। 

তান্ত্রিক অনুপ দত্ত থানায় ঢুকলে বেলা পৌনে একটা নাগাদ। দাঁত বের করে বললে, "সরি দারোগাবাবু, ঘণ্টাখানেক দেরী হয়ে গেল। আসলে এর আগের অ্যাপয়েন্টমেন্টের আত্মাটা মহা ঢিট। খেলিয়ে কাজ ম্যানেজ করতে গিয়ে বেলা হয়ে গেল"।  

মেজাজ চড়ে ছিল, দিলাম ধমক; "অনুপ, থানা থেকে আর্জেন্ট কাজে আপনাকে ডাকা হয়েছে। আপনি আমায় অন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেখাচ্ছেন? আপনি জানেন ব্যাপারটা কতটা সিরিয়াস"?

অনুপ দত্তের হাসি মিইয়ে গেল না। চেয়ার টেনে বসে বললে, "তেনারা কি আর পুলিশ-দারোগাকে ডরায় বলুন। নিজেদের মর্জির মালিক। তাঁদের তো আর পদে পদে ওপরঅলাকে কৈফিয়ত দিতে হয় না। যাক গে, এত বেলা পর্যন্ত পেটে কিছু পড়েনি। দু'টো চা নিমকির ব্যবস্থা করুন দেখি"। 

অনন্তকে ডেকে চা-ভাজাভুজি দিতে বললাম। সে'সব টেবিলে না আসা পর্যন্ত অনুপ দত্তকে কাজের কথায় টানা গেল না। চারটে পেঁয়াজি আর দু'টো আলুর চপ সাবাড় করে, চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে অনুপ অবশেষে উৎসুক চোখে আমার দিকে তাকালে। 

আমি সোজাসুজিই বললাম, "ভারী ফ্যাসাদে পড়েছি অনুপ"। 

"নয়ত আর অনুপ দত্তকে ডাকবেন কেন বলুন। আমি তো আর কাশ্মীরি শালওলা নই যে শীতের দুপুরে ডেকে নিয়ে শখের দরদাম করবেন। নিন, কেসটা খুলে বলুন দেখি"। 

"বুলেট দস্তিদারকে চিনতে"?

"নতুনপাড়া সুপারস্টার্স ক্লাবের এক্স-সেক্রেটারি? সে'তো এ পাড়ার শারুক্কান ছিল মশাই। কী কেত ছিল। পাড়ার ফক্কর ছেলেছোকরারা বুলেটদা বলতে অজ্ঞান। চাঁদা তুলতে, বেপাড়ায় গিয়ে রঙবাজি করতে, মড়া পোড়াতে, হাসপাতালে রাত জাগতে; বুলেটের জুড়ি মেলা ভার ছিল। মোটরবাইক অ্যাক্সিডেন্টটা সত্যিই আনফরচুনেট দারোগাবাবু। ও ছেলে বেঁচেবর্তে থাকলে পাড়ার নাম উজ্জ্বল করত। তা, ইয়ে, ওঁর আত্মাকে নামাতে হবে নাকি"?  

"হবে। আর্জেন্ট"। 

"সে কী! কেন"? 

"এমএলএ গগন সান্যালের জন্য"।

"এই সেরেছে। গগন সান্যালের হঠাৎ বুলেটের ভূতের দরকার পড়ল কেন"?

"তুমি কি কিছুই শোনোনি"? 

"আমি সাধক মানুষ। লোকের গালগল্পে তেমন মন দিইনা। বলুন না দারগোবাবু, কী ব্যাপার"? 

"আর বলো কেন অনুপ। হপ্তা-দুই আগে, এক শনিবার  সন্ধের পর। গগন সান্যাল নিজের বাড়িতে কী একটা পুজোফুজো দিয়ে গোটা পাড়াজুড়ে গুজিয়া বিলি করে বেড়াচ্ছিল। তা মিথ্যে বলব না, গগন সান্যালের সে এমন হামবড়া ভাব যেন সবার হাতে আড়াই কিলো সাইজের ইলিশ তুলে দিচ্ছে। দিচ্ছিস তো পাতিয়া গুজিয়া, তার জন্য একটা বড় তাসাপার্টি, নাচের দল আরও কত কী। নেহাত এমএলএ মানুষ, লোকে ভয়ভক্তি করে, তাই বড় একটা কিছু বলছিল না। গোল বাঁধল গুজিয়া প্যারেড নতুনপাড়া সুপারস্টার্স ক্লাবঘরের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময়। পাড়ার লোক অবাক হয়ে দেখল গগন সান্যালের চোখ ঠিকরে বেরোচ্ছে, হাত পা বেসামাল ভাবে নড়াচড়া শুরু করেছে। তারপর কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই গগন সান্যাল দু'কান চেপে চেল্লামেল্লি শুরু করেছে "শুয়ার বুলেটটাকে কেউ থামতে বল। থামতে বল"। 

"এত কিছু ঘটে গেল? আমি মাইরি বেশির ভাগ সময়ই সাধনায় মগ্ন থাকি কিনা। তাই জানতেই পারলাম না। তা, গগন সান্যালকে কি বুলেট দস্তিদার পাকড়াও করেছিল"? 

"ঠিক পাকড়াও নয়। সে মুহূর্ত থেকে নাকি একটানা গগন সান্যাল নিজের কানে বুলেটের কণ্ঠস্বরে বিচ্ছিরি সব খোঁটা শুনে চলেছে। আর সে সমস্ত খোঁটার সঙ্গে থাকছে একটা মর্মান্তিক নাম; গুজিয়া গগনা। আর এ'খবরটা কী'ভাবে যে রাষ্ট্র হয়ে গেল। এখন পাড়ার সবাই গগন সান্যালকে গুজিয়া গগনা বলে ডাকছে।  প্রথমদিকে শুধু অপোনেন্টরাই আড়ালে-আবডালে বলে বেড়াচ্ছিল। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই ব্যাপারটা দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ল। সে'দিন একটা মিছিলেও নাকি পার্টিরই একজন ওয়ার্কার বলে ফেলেছে, আমাদের নেতা গুজিয়া গগনাকে ভোট দিন, ভোট দিন। উত্তেজনার বশে বিরিয়ানির প্যাকেট ঘুষ খাওয়া পাবলিক চিল্লিয়ে ফেলছে গুজিয়া গগনার জন্য আমরা বুকের রক্ত দিতে পারি। গতকাল পাড়ার শিল্ড ফাইনালে কমেন্ট্রি করতে গিয়ে প্রফেসর ভোম্বল চাটুজ্জে অ্যানাউন্স করলে, "এ'বারে, বিজয়ী দলের হাতে ট্রফি তুলে দেওয়ার জন্য আমি মঞ্চে আসতে অনুরোধ করছি, মাননীয় এমএলএ মহাশয় গুজিয়া গগনাকে! এমন কী ভদ্রলোকের তিন বছরের নাতিও নাকি আধো আধো সুরে বলছে "আম্মার দাদ্দু গুজ্জিয়া গগন্না"। আর এ'সব শুনে গুজিয়া গগনা, থুড়ি, গগন সান্যাল এক্কেবারে ফায়্যার"।

"কেসটা মর্মান্তিকই বটে। কিন্তু দারোগাবাবু, আমায় কী করতে হবে"?

"গুজিয়া গগনার দাবী...আরে ছি ছি...ছি ছি...আই মীন, গগনবাবু কড়া হুকুম...বুলেট দস্তিদারের ভূতকে নামিয়ে অ্যারেস্ট করতে হবে"। 

"ওই বুলেট দস্তিদার মহা বিটকেল ছেলে। ওকে ঘাঁটানো কি ঠিক হবে দারোগাবাবু"?

"শোনো অনুপ, ও'সব বাহানা আমি শুনছি না। এ বয়সে এসে সাসপেন্ড হতে পারব না। যে করে হোক তুমি বুলেট দস্তিদারের ভূতকে রাজি করাও হাজতবাস করতে। ওঁর যা যা ফেসিলিটি চাই, সে ব্যবস্থা আমি করে দেব। কিন্তু ওকে একবার জেলে পুরতেই হবে ভাই অনুপ। আমি না শুনছি না। নয়ত এই গুজিয়া গগনা...আরে ধের ছাই...নিজের জিভ কেটে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে...শালা ট্রেটার টাং...আই মীন...নয়ত গগন সান্যাল আমার জীবনটা দেবে চটকে"। 

*** 

আমি দারোগা মানুষ। আমার বাড়িতে সময়ে অসময়ে ফোন আসবেই। ও'তে আমি ভেবড়ে যাইনা। কিন্তু এই ভোরবেলা ফোন তুলে গুজিয়া গগনা...থুড়ি...গগন সান্যালের ফোন শুনে সামান্য চমকাতে হল। ওঁর সেক্রেটারিকে দিয়ে ফোন করাননি, নিজে ডায়াল করেছেন। মনে হল থ্যাঙ্কিউ জানাতে ফোন করেছেন। 

বিগলিত সুরে বললাম, "গুডমর্নিং স্যার। গুড নিউজটা কাল রাতেই আপনার সেক্রেটারিকে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। আশা করি পেয়েছেন"। 

"পেয়েছি। বুলেটের আত্মাকে কে নামালে"?

"আজ্ঞে, অনুপ। ভারী ট্যালেন্টেড তান্ত্রিক। ইয়ং কিন্তু এফিশিয়েন্ট। একদিন আপনার অফিসে নিয়ে এসে আলাপ করিয়ে দেব। ভারী মাই ডিয়ার ছেলে"।

"বুলেটের আত্মাকে তোমরা জেলে পুরেছ"? 

"একদম। হিউম্যান হিস্ট্রিতে এই প্রথম একজন ভূতকে অ্যারেস্ট করা হল। আপনি ইতিহাসের পাতায় একজন মহানায়ক হয়ে থেকে গেলেন স্যার"। 

"মহানায়ক"?

"আজ্ঞে। কংগ্রাচুলেশনস স্যার"। 

"দারোগা, তোমার আর ওই অনুপ তান্ত্রিককে আমি জ্যান্ত কবর দেব"। 

"আ...আজ্ঞে"?

"তোমাদের চামড়া গুটিয়ে নেব"। 

"কী...কিন্তু...শুনুন..."!

"আজকের কাগজের হেডলাইন দেখেছ"? 

"ক...কোন কাগজ"? 

"যে কোনও কাগজের প্রথম পাতা খুলে দেখ। আমি বরং তোমার সাসপেন্সনের ব্যবস্থা করি গিয়ে"। 

ফোন রেখেই ছুটে গেলাম বসার ঘরে। কাগজ খুলে প্রথম পাতাটা টেবিলে ছড়িয়ে দিলাম। হতবাক হয়ে দেখলাম সেই কাগজ আলো করা হেডলাইনঃ

"ভূতকে হাজতে পুরে গিনেস বুকে নাম তুললেন বাংলার গর্ব গুজিয়া গগনা"!

গুড়ুম



১।

খুব রাগ হলে ভাস্কর পায়চারি করেন। অফিসের কিউবিকল থেকে উঠে পায়চারী করাটা ঠিক শোভনীয় নয়, লোকে বাঁকা চোখে দেখবে। তা'ছাড়া বিস্তর কাজও বাকি আছে। কাজেই চেয়ারে বসেই একটা মৃদু দুলুনির  মাধ্যমে নিজের রাগটাকে ম্যানেজ দিতে হল। অবশ্য রেগে গেলে টাইপিং স্পীড বেড়ে যায় ভাস্করের। তা'বলে অ্যাকিউরেসি কমে না। সে'টা একটা ভালো জিনিস।

আপাতত রাগটা হয়েছে অভীক সামন্তর ওপর; ভদ্রলোক ভাস্করের বস। বয়সে ভাস্করের চেয়ে বছর দশেক ছোটই হবে। ভাস্করের মতে অত্যন্ত স্মার্ট ছেলে, তার ওপর চনমনে। কর্পোরেট জগতে আলো করে থাকার সমস্ত গুণই আছে। কিন্তু বয়স কম, মাঝেমধ্যেই উত্তেজিত হয়ে পড়ে। আর তখনই গোল পাকায়। এই যেমন খানিকক্ষণ আগে সে ভাস্করের ওপর বিস্তর চ্যাঁচামেচি করলে। রেগে গেলে আবার চোস্ত ইংরেজিতে ধমক কষায় অভীক। ভাস্করের তৈরি করা একটা রিপোর্টে সামান্য ভুল রয়ে গেছিল। ব্যাপারটা সামান্যই। অভীক মাথা ঠাণ্ডা রাখতেই পারত, এই ভুল সামাল দেওয়া কোনও বড় ব্যাপার নয়। কিন্তু ওই, রগচটা মানুষ। যা নয় তাই বলে অন্তত মিনিট কুড়ি তম্বি করলে, আর পাঁচটা সহকর্মীর সামনেই। ভাস্কর একবার ভেবেছিলেন কড়া উত্তর দেবেন। সময়মত প্রমোশন পেলে এখন তাঁর অভীকের ওপরেই গ্যাঁট হয়ে বসে থাকার কথা। কিন্তু কপাল জিনিসটা বড় নির্মম। তা'ছাড়া প্রমোশন সময়মত না হলেও, এ ডিপার্টমেন্ট এখনও ভাস্কর ছাড়া অন্ধ, এ কথা অভীক ভালো মত জানে। সামান্য একটা ভুলের জন্য এই বাড়াবাড়ির কোনও মানেই হয়। কিন্তু হাজার রকম উত্তর মনের মধ্যে নাড়াচাড়া করেও মুখ ফুটে বলা হল না। নিজের নোটবুকে খসখস করে পেন চালিয়ে গেলেন, লেখার ভান করে। ও'দিকে অভীক টেবিল চাপড়ে বিস্তর কথা শুনিয়ে গেল। চ্যাঁচামেচি থামলে চুপচাপ অভীকের চেম্বার থেকে বেরিয়ে নিজের কিউবিকেলে এসে আড়াই মিনিট  গুম হয়ে বসেছিল ভাস্কর। তারপর শুরু হল দুলুনি আর খটরখটর টাইপিং। 

খানিকক্ষণ আগে মুরারি চা দিতে এসেছিল, মুরারির দেঁতো হাসি দেখে অকারণেই ভাস্করের রাগটা চড়াত করে আরও খানিকটা বেড়ে গেল যেন। ভেবেছিলেন চিৎকার করে বলবেন, "আমি কাজ করছি। তা'তে অত হাসির কী আছে"? কিন্তু ওই, মুরারি বেচারির ওপর অকারণ খিটখিট করার কোনও মানেই হয়না। কোনোক্রমে সামাল দিয়ে ভাস্কর বলেছিলেন, "আজ লিকার চা থাক। ভালো করে কফি করে আনো দেখি। ব্ল্যাক নয়"।

২। 

হাওড়া স্টেশনের সাত নম্বর প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকার সময় এক ভদ্রলোক অকারণেই পা মাড়িয়ে দিলে। ভাস্করের মনে হচ্ছিল ঠাস করে একটা চড় মারতে। আদৌ তেমন ভিড় নেই যে তাঁর পায়ের ওপর এসে পড়তে হবে।  পা মাড়ানো ভদ্রলোক অবশ্য মাথা ঘুরিয়ে একটা বিগলিত সরি বললেন। ভাস্কর ভাবলেন গলা উঁচু করে বলবেন, "আচ্ছা ক্যালাস লোক তো মশাই আপনি। সিভিক সেন্সের এতই অভাব"? কিন্তু কী মুস্কিল, মুখ দিয়ে বেরোল, "আরে সরির কী আছে। স্টেশনে, বাস-স্ট্যান্ডে এ'সব হামেশাই হচ্ছে তো। আপনি তো আর ইচ্ছে করে করেননি। রিল্যাক্স, ইট ইজ ওকে"। 

আজ কপাল ভালো ট্রেনের বসার জায়গা জুটেছিল। নিজের রাগরাগ ভাবটা ভিতর থেকে বড় ট্রাবল দিচ্ছিল ভাস্করবাবুকে। ইচ্ছে হল আদা লজেন্স খাওয়ার, ও'তে মন খানিকটা ঠাণ্ডা হতে পারে।  সেই মত এক প্যাকেট কিনলেন। দশটাকায় পাঁচটার প্যাকেট। কুড়ি টাকার নোট এগিয়ে দিলেন, ফেরত পেলেন একটা দশটাকার নোট আর লজেন্সের প্যাকেট। কিন্তু পকেটে রাখতে গিয়ে টের পেলেন দশটাকার নোটটা অর্ধেক ছেঁড়া। জুতোতে ইচ্ছে করছিল লজেন্সওলাটাকে যে ইতিমধ্যে ট্রেনের ভিড় ঠেলে এগিয়ে গিয়ে অন্য কাস্টোমারের সামনে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আওয়াজ দিতে গিয়েও দিলেন না। কী হবে ঝামেলা বাড়িয়ে। কচি বয়সের ছোকরা। তা'ছাড়া দশটাকাই তো, ওকেও তো কোনও কাস্টোমারই গছিয়ে দিয়ে সরে পড়েছে। যাক গে। লজেন্সে কনসেন্ট্রেট করলেন ভাস্কর। কিন্তু মনমেজাজটা সত্যিই গোলমেলে অবস্থায় ছিল, লজেন্সের স্বাদটা ঠিক উপভোগ করতে পারলেন না। 

৩। 

অফিসের ব্যাগট্যাগ রেখে বাথরুমের দিকে এগোতে যাবেন ভাস্কর, এমন সময় চন্দ্রাণী জিজ্ঞেস করল, "বাজার করে ফিরবে বলেছিলে যে"। 

থমকে দাঁড়ালেন ভাস্কর। বললেন, "বাজার করেছি তো। হাওড়াতেই। আধকিলো পটল, আধকিলো ঢ্যাঁড়স, এক আঁটি পালং, এককিলো বেগুন, অল্প বিটগাজর। খানিকটা পেঁয়াজ। একশো গ্রাম কাঁচালঙ্কা। ঠিক যেমন বলে দিয়েছিলে"।

"সবজি কিনলে তো সে'গুলো গেল কই"? চন্দ্রাণী আকাশ থেকে পড়লে। 

"থলেতে রেখেছি। অবভিয়াসলি"। গলা মিইয়ে এলো ভাস্করের। 

"আর থলেটা কই"?

"বর্ধমান লোকালের ইঞ্জিনের দিক থেকে চার নম্বর কামরার ওপরের একটা বাঙ্কে। এতক্ষণে বোধহয় চুঁচুঁরা ছাড়িয়ে এগিয়ে গেছে। ওরা অনেকদূর যাবে"।

চন্দ্রাণীর ক্লান্ত মুখটা দেখে বড় কষ্ট হল ভাস্করের। কথা না বাড়িয়ে গামছা কাঁধে সোজা বাথরুমে ঢুকলেন তিনি। ফ্ল্যাটবাড়ির ঘুপচি বাথরুম। সেই স্বল্প পরিসরেই ভাস্কর পায়চারী করলেন খানিকক্ষণ। পায়চারীর স্পীড বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর রাগ খানিকটা কমে আসছিল বটে। এমন সময় একটা আছাড় খেতে হল।  ভাস্করের চোখের সামনের আলোটুকু সাফ হয়ে পড়ে রইল বিকট অন্ধকার। 

৪।

জ্ঞান যখন ভাঙল তখন ভাস্কর সাদা ধবধবে বিছানায় শুয়ে। চারপাশে দেওয়ালের রঙ সাদা। সমস্তকিছুই সাদা, এতই সাদা চারপাশটা যে চোখে ধাঁধা লাগে। শরীরে ব্যথাবেদনা কিছু আছে বলে তো মনে হল না। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলেন ভাস্কর। চন্দ্রাণী আশেপাশে নেই। কোনও নার্স ডাক্তারও নজরে পড়ল না। শুধু এক হাফ শার্ট পরা ভদ্রলোক একটা চেয়ারে গা এলিয়ে একটা নোটবুকে কিছু লিখছিলেন। 

ভাস্কর সামান্য কাশলেন। চেয়ারে বসা ভদ্রলোক মুখ তুলে তাকালেন। এক মাথা টাক, একটা পেল্লায় গোঁফ,আর এমন ঢুলুঢুলু চোখ ভাস্কর আগে দেখেছেন বলে মনে পড়ল না। কিন্তু ভদ্রলোক নেশা যে করেননি সে'টা ওর গলার স্বর শুনেই বোঝা গেল। 

"এই যে ভাস্করবাবু। উঠে গেছেন? ভেরি গুড"। 

"এ'টা কোন নার্সিং হোম"?

"আবার সেই এক প্রশ্ন। আরে, এ'টা হসপিটাল নয়। গুড়ুম সেন্টার। 

"কী সেন্টার"?

"গুড়ুম সেন্টার। তা, এখন কেমন বোধ করছেন"?

"একটু পিপাসা পাচ্ছে বোধ হয়। তবে আর কোনও অসোয়াস্তি তো বোধ করছি না। ইয়ে, আপনাকে তো ঠিক..."। 

"ও। আমি হদ্বুইচ। আমিই আপনার গাইড। চলুন"। 

"কীসের গাইড"?

"চলুন না। ফের বুঝিয়ে বলছি'খন। টাইম ওয়েস্ট করলে হবে না। আসুন। উঠে আসুন"। 

৫। 

হদ্বুইচ ভাস্করকে একটা গুমোট ঘরে নিয়ে এলে। এ ঘরে আবার এক বিন্দুও সাদা নেই। চারপাশে আবছা অন্ধকার, ঘোলাটে একটা হলুদ আলো সে অন্ধকারকে আরও বিশ্রী করে তুলছে। চোখ সওয়াতে সময় লাগছিল ভাস্করের। ও'দিকে ঘরে ঢুকেই হদ্বুইচ জোর গলায় বললেন,"নিন ভাস্করবাবু, কাজ সেরে ফেলুন। ক্যুইক"।

চোখ কুঁচকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর ভাস্করবাবু টের পেলেন যে তাঁর সামনে খান পাঁচেক পেল্লায় কাঠের চেয়ার পাতা আছে। আর সে চেয়ারে বসা মানুষগুলোকে দেখে তাঁর চোখ কপালে উঠল। তাঁরা প্রত্যেকেই পিছমোড়া করে বাঁধা। আর প্রত্যেকেই যেন রণক্লান্ত, মাথা নুইয়ে বসে। একটা চেয়ারে অভীক সামন্ত, একটা চেয়ারে মুরারি, তিন নম্বর চেয়ারে ট্রেনের লজেন্সওলা। চার নম্বর চেয়ারে বসে আছেন হাওড়া স্টেশনের সেই পা মাড়ানো ভদ্রলোক। আর শেষ চেয়ারে বসে যে ঝিমোচ্ছে,সে ভদ্রলোক নির্ঘাত ভাস্কর নিজেই। কী সাংঘাতিক। ড্যাবড্যাবে চোখে নিজের সামনে বসে থাকা নিজেকে দেখছিল ভাস্কর। এমন সময় হদ্বুইচ একটা গলার স্বর উঁচু করে বললেন, "নিন, কাজ সেরে ফেলুন চটজলদি"। 

"কী কাজ"? আকাশ থেকে পড়লেন পাশে দাঁড়ানো ভাস্কর। 

"উফ, রোজ রোজ এই একই কথা বোঝাতে আমার ভালো লাগে না", হদ্বুইচ যেন প্রায় অভিমানের সঙ্গে বললেন। 

আর তক্ষুনি মনের মধ্যে আদত ব্যাপারটা ঝড়ের গতিতে স্পষ্ট হয়ে উঠল। এই গুড়ুম সেন্টারে যে মাঝেমধ্যেই ঘুরে যান যে ভাস্কর। হেসে ফেললেন তিনি। 

"কী অন্যায় বলুন দেখি হদ্বুইচ । তোমার এই গুড়ুম সেন্টারে বারবার আসি অথচ প্রতিবারই ভুলে মেরে দিই"। 

"আপনি ভারি ইয়ে মশাই। যাকগে, এ'দের ওপর জমানো রাগ সব ঝেড়ে বের করুন দেখি। ক্যুইক। চড়থাপ্পড় দু'একটা চালাতে ইচ্ছে করলে রেয়াত করবেন না"। 

"হদ্বুইচ, তুমি তো জানো। সে আমার দ্বারা হওয়ার নয়"। 

"আরে ধুর মশাই। রাগ নিয়ে কিপটেমো করতে নেই"।

"আমি আসি হদ্বুইচ । তুমি তো জানো, এ কাজ আমি করব না। কেন যে খামোখা আমায় এই গুড়ুম সেন্টারে ধরে আনো বারবার"। 

"এ'সব আমার সহ্য হয়না একদম। আরে বাবা, রাগ কি ফিক্সড ডিপোজিট নাকি যে ভাঙানোর ব্যাপারে এত ইয়ে। দিন না এ ব্যাটাদের ধরে দু'ঘা। দিন না। আপনি চাইলে এনে দিচ্ছি একগাছা বিছুটি"। 

"হদ্বুইচ, অভীকের কাল বিবাহবার্ষিকী। ছুটি চেয়েছিল দু'দিনের, ওপরওলা নাকচ করে দিয়েছে। হাইয়ার রোল, হাইয়ার রেস্পন্সিবিলিটি, এই বয়সে। নট ইজি। নট ইজি। ওই মুরারিকে যে দেখছ, ওর নিজের বাপ-মা মরা ভাইপো ভাইঝিকে সন্তান-স্নেহে বড় করছে। নিজের ছেলেমেয়েদের পাশাপাশি, একইরকম যত্নে। কতই বা মাইনে পায় বলো, অথচ মুখের হাসিটা যাওয়ার নয়। ওই যে পা মাড়ানো ভদ্রলোক, ওর কাঁধের ঝোলাটার ওজন দেখেছ?নির্ঘাত লোহাটোহা বয়ে রোজ ডেলিপ্যাসেঞ্জারি করছে। বাপ রে বাপ! অথচ আমি লারেলাপ্পা একটা ব্রিফকেস আর সবজির ব্যাগ ব্যালেন্স করতে গিয়ে ব্যাগ ভুলে মেরে দিলাম। এ'দিকে এই ভদ্রলোক কী ওজনটাই না বইছেন। অথচ বয়সে আমার বড়দার চেয়েও বড়। নিশ্চিত। গুরুজন লোক পা মাড়িয়ে সরিও বলেছেন। আর কত চাই বলো। তারপর, এই লজেন্সওলাকে দেখ হদ্বুইচ, ওর বয়স কত হবে বলো বড়জোড় ষোলো? ওর মাধ্যমিক দেওয়ার কথা। সিলেবাসে ডুবে থাকার কথা। সে কিনে ধেড়েদের কাছে ঘুরে ঘুরে লজেন্স বিক্রি করছে। আর ওই যে। ওই শেষ চেয়ারে বসে, আমি। দ্যাখো ভাই। লোকটা আর যাই হোক বদ নয়। মায়ামমতা আছে। অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করতে পারে, অন্তত মাঝেমধ্যে। সে ভদ্রলোক সবজির ব্যাগ ট্রেনে ফেলে আসতে পারে কিন্তু ব্যাটা নিজের সংসারটাকে বড্ড ভালোবাসে। এ'বার এদের রিলিজ করে দাও দেখি। আর আমাকেও তো যেতে হয় হদ্বুইচ। চন্দ্রাণী ওয়েট করছে যে"।

Sunday, June 5, 2022

সাইকেলজিক

শেষে এক জ্যাঠতুতো দাদা ঠেলেঠুলে কোনওক্রমে শিখিয়ে ছেড়েছিল৷

কিন্তু দাদা হলে যা হয় আর কী। সামান্য ফুর্তির সুযোগ না থাকলে সে মহৎ কাজ করবে কেন? দু'চাকার ওপর ব্যালেন্সটা সবে খানিকটা ধরেছি। খোলা মাঠে টলমলিয়ে সাইকেলসহ এগিয়ে গেছি খানিকটা৷ অমনি সে দাদা চেঁচিয়ে বললে,  "দারুণ, ব্রাভো৷ এক্কেবারে হিরোর মত চালাচ্ছিস৷ এ'বারে শোন ভাই, আসল মজা টের পেতে হলে হ্যান্ডেল থেকে দু'হাত সরিয়ে প্যাডেলের স্পীড বাড়িয়ে দে৷ তারপর চুলের মধ্যে আঙুল চালাতে চালাতে, স্টাইল মেরে শিস দিতে দিতে চালা৷ দ্যাখ ঘ্যাম কাকে বলে"।

যদিও শিস দিতে পারতাম না (এখনও চেষ্টা করলে ওই পার্সেলমাউথ ফ্যাসফ্যাসের বেশি কিছু বেরোবে না)৷ কিন্তু আমার চেয়ে অনেক বড় সেই দাদা আমায় হিরো বলেছে৷ সে'টা কদর না করলে চলবে কেন?

তখন যদিও মাথার চুলে কদমছাঁটে মুড়িয়ে কাটা৷ সে চুলে আঙুল চালানো অসম্ভব৷ তবু৷ অমন মোটরবাইক চালাতে পারা, সিগারেটের প্যাকেট পকেটে নিয়ে ঘোদা দাদা আমায় হিরো বলেছে৷ সে সম্মান তো ফেলনা নয়৷ 

কাজেই হিরোর মত ঘ্যামপ্রকাশ করতে হল। ইন্সট্রাকশন কানে আসা মাত্রই প্যাডেলে জোর দিয়ে হ্যান্ডেল থেকে হাত সরিয়ে নিলাম৷ আর সে অবাধ্য সাইকেলও নির্দ্বিধায় আমায় সরিয়ে দিলে৷ বলা ভালো, উড়িয়ে দিলে৷ মুখ দিয়ে উত্তম মার্কা শিসের বদলে একটা মারাত্মক নবদ্বীপ মার্কা আর্তনাদ বেরোল; ' বাবা গো'! আমি দু'বার বাউন্স খেয়ে চিৎপাত। হাঁটুফাঁটু কনুইটনুই ছড়েটড়ে একাকার কাণ্ড৷ বাপের ভাগ্যি হাড়গোড় ভাঙেনি৷ ও'দিকে সেই ট্রেটার হারকিউলিস সাইকেলটাও ফ্ল্যাট আমার ঠ্যাঙের ওপর৷ 

দাদাও মাটিতে লুটোপুটি, তবে পেট চেপে, হাসির চোটে৷ সেই থেকে বাড়াবাড়ি রকমের হেল্পফুল দাদাদের দেখলে একটু সমঝে চলাটাই আমি সমীচীন বলে মনে করি৷

গুপীর জামাইষষ্ঠী



সতেরো দিন পুরনো আনন্দবাজারটা ঘেঁটে নতুন খবর বের করার চেষ্টা করছিলেন মন্মথ হালদার। অকারণে রোজ রোজ কাগজ কিনে টাকা জলে দেওয়ার লোক তিনি নন। একবার কাগজ কিনে সে'টাই ধীরেসুস্থে হপ্তাতিনেক পড়ে থাকেন তিনি। জরুরী খবরগুলো বারচারেক পড়তে হয় রপ্ত করতে। ক্রসওয়ার্ড পাজলের ক্লুগুলো দিনে তিনটের বেশি নয়, নয়ত মগজকে অকারণ চাপ দেওয়া হয়। এমন সময় বিপিন এসে কনসেনট্রেশন দিল নষ্ট করে। সেই একই বাতিক ছেলেটার; নেই। আজ চিনি নেই। কাল তেল নেই। পরশু কাপড় কাচার সাবান নেই। শুধু নেই নেই আর নেই। মহাখচ্চর একটা কাজের লোক জুটেছে কপালে। কিন্তু বিপিনকে ছাড়া গতিই বা কী। মন্মথ হালদারের বাড়িতে বিপিন ছাড়া কেউ কোনোদিন টিকবে না, সে কথা মন্মথবাবু নিজেও জানেন।

"টীব্যাগ শেষ", সদর্পে ঘোষণা করল বিপিন।

খবরের কাগজটা সরিয়ে রেখে পকেটে রাখা নোটবইটা বের করে খানিকক্ষণ পাতা উলটেপালটে দেখলেন। মনে মনে খানিকক্ষণ হিসেব কষলেন। ভুরু কুঁচকে গেল ভদ্রলোকের, "বিপনে, হিসেব মত টীব্যাগের স্টক আরও আট দিন চলার কথা। শেষ হল কী করে সাততাড়াতাড়ি"?

"দেখুন কাকা, ওই আপনার মত এক টীব্যাগ ডুবিয়ে দু'বার করে চা খেতে পারব না। এক কাপে একটা টীব্যাগ না হলে আমার চলবে না"। 

"ওরে আমার লাটসাহেব এলেন রে। চলবে না। অত যদি নবাবী থাকে তা'হলে দিনে দু'বারের বদলে এককাপ চা খাবিগে যা"। 

"ও'সব পারব না। দু'কাপ চা মাস্ট। নয়ত গা ম্যাজম্যাজ করে। আর সন্ধের পর এককাপ কফি। কড়া করে"। 

"শালা রাস্কেল। তুই আমার বাজার করার পয়সা মেরে কফি খাচ্ছিস"?

"বাজে কথা বলবেন না। পয়সা কতই বা আর দেন বাজার করার। ও'দিয়ে ঝরতিপড়তি মাল ছাড়া কিছু জোটে নাকি। নিজের স্যালারি থেকে নিজের কফি আনি"।

"কুকিং গ্যাসটা তো আমার যায় রে হতভাগা। উফ, এরা আমায় পথে বসিয়ে ছাড়বে"। 

"তিনকুলে তো কেউ নেই। যা মালকড়ি এরপর তো চোদ্দভূতে লুটে নেবে। এ'বার একটু ভোগটোগ করুন না কাকা"।

"দূর হ। তোর জ্ঞান আমার না শুনলেও চলবে। চায়ের ব্যাগ শেষ হয়ে গেছে যাক। নেক্সট লট কেনার ডিউ ডেট মাসের বাইশ তারিখে। এখনও ঢের দেরী। তদ্দিন এ'বাড়িতে চা বন্ধ"। 

"ভালো কথা, আমি তা'হলে নিজের চাপাতার ব্যবস্থা করে নি'গে। দেখবেন, তখন আবার আমার থেকে দিনে এককাপ ধার চাইবেন না"। 

"তুই আমায় চায়ের খোঁটা দিচ্ছিস রে ব্যাটা? জানিস আমার জ্যাঠামশাইয় এক গোরার দার্জিলিং টী-এস্টেট থেকে ডাইরেক্ট চা-পাতা আনাত"?

"এই এক রোগ দেখছি মাইরি আজকাল। পৃথ্বীরাজ দারুণ যুদ্ধ করতেন তাই আমি চাকরী না করে পাড়ার রকে বসে গুটখা খাব আর শিস্‌ দিয়ে বলব মেরা ভারত মহান। লে হালুয়া। আপনার জ্যাঠা দার্জিলিং থেকে চা আনাতেন আর আপনি সকালের এঁটো টীব্যাগ চুবিয়ে বিকেলের চা খান। এই দুয়ে কীসের তুলনা? ধুর"। 

"বেরিয়ে যা আমার সামনে থেকে। আমার টাকায় খাবি, আমার টাকায় পরবি। আর আমায় স্ক্যান্ডালাইজ করবি"? মন্মথ আর দু'কথা শোনাতে যাচ্ছিলেন। এমন সময় রিক্সার প্যাঁপোরপোঁ শুনে দু'জনেই ঘুরে গেটের দিকে তাকালে। 

রিক্সা থেকে যে নামলে তাকে দেখে মন্মথর মুখ আরও খানিকটা ভেটকে গেল। 

কিন্তু বিপিনের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, সে চিৎকার করে উঠল, "আরে, গুপীদা"! এই বলে বিপিন ছুটে এগিয়ে গেল অতিথির দিকে। তার দু'হাতে ভারি দু'টো ব্যাগ আর পিঠে একটা ঢাউস ব্যাকপ্যাক। হাতের দু'টো ব্যাগ বিপিনের দিকে এগিয়ে দিল গুপী। 

"কদ্দিন পর এলে এ'বার গুপীদা", বিপিনের আনন্দ আর ধরছিল না। 

"কেমন আছিস বিপনে"? বিপিনের পিঠ চাপড়ে জিজ্ঞেস করলে গুপী। 

"কোনোক্রমে আছি। চাটনিতে বেশি চিনি দেওয়ার জন্য আমায় কৈফিয়ত দিতে হয়। আমার আবার থাকা"। 

তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন মন্মথ, "তুই কত বড় ট্রেটার রে বিপনে? একটা স্ট্রেঞ্জারের কাছে গেরস্তের নিন্দে করতে তো লজ্জা করে না"?

মন্মথর কথাটা না শোনার ভান করে বিপিন গুপীকে শুধল, "হ্যাঁ গো গুপীদা, কী কী আনলে এ'বার"?

বারান্দার মোড়ায় বসে জুতোর ফিতে খুলতে খুলতে গুপী বললে, "একটা ব্যাগে আছে পাঁঠার মাংস, পাবদা, মৌরলা, দেশী মুর্গী আর হাঁসের ডিম। বুঝলি। আর অন্যটায় হিমসাগর, লিচু, আর সন্দেশের বাক্স"। 

"দই আনোনি"? সাগ্রহে খোঁজ নিল বিপিন। 

"মিত্তিরের দোকানে দাঁড়িয়েছিলাম শুধু তোর দইপ্রেম মনে করে। দু'কিলো এনেছি। এককিলো তোকেই সাফ করতে হবে কিন্তু"। 

প্রায় লাফিয়ে উঠল বিপিন। তারপর জিজ্ঞেস করল, "গুপীদা, বাড়িতে চা নেই। কফি খাবে"?

"খাবো। তবে ব্ল্যাক"। 

"হোয়াইট চাইলেও জুটত না। এ বাড়িতে দুধ ঢোকে না। বড় খরচ কিনা তা'তে", একটু বাঁকা সুরেই জানান দিলে বিপিন। 

"এখুনি বেরো রাস্কেল, বেরো তুই হারামজাদা", টেবিল চাপড়ে চিৎকার শুরু করলেন মন্মথ। কিন্তু সে চিৎকার থামাতে হল। গুপী এসে ঢিপ করে প্রণাম করেছে। 

একটু বিরক্তির সুরেই মন্মথ বললেন, "এ'ভাবে না বলে কয়ে দুমদাম এসে পড়াটা আমি মোটেও পছন্দ করিনা"। 

গুপী এ'সবে নার্ভাস হয় না। সপাটে বললে, "দুম করে কী। আজ তো আসার কথাই ছিল"।

"আজ? আজ কী ব্যাপার? কই, আজ তো তোমার আসার কোনও কথা ছিল না"? 

"আপনার মাথাটাথা গেছে। আজকের দিনটা  ভুলে মেরে দিয়েছেন তো"? 

"আজ কী"?

"যাব্বাবা। আজ জামাইষষ্ঠী। এমন দিনে শ্বশুরবাড়ি ঢুঁ মারব না"?

"এ'টা মোটেও তোমার শ্বশুরবাড়ি নয়"। 

"নাহ্‌, আপনার মাথাটা সত্যিই গেছে। এই বিপনে, তিন কাপ কফি করিস। শ্বশুরমশাইয়ের মাথার ব্যালেন্স ভালো ঠেকছে না"। 

"তোমার এই গায়ে পড়া অসভ্যতা আমার বরদাস্ত হয় না গুপী"।

"যাকগে, শুনুন। আমার সময় নষ্ট করলে চলবে না। আড়াই ঘণ্টা ধরে বাজার করেছি। বিপনের হাতে ছেড়ে দিলে সেই দায়সারা ঝোলভাতই গিলতে হবে। আমি ওপরের বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে সোজা রান্নাঘরে যাচ্ছি। মৌরলার একটা নতুন রেসিপি শিখে এসেছি মেজপিসির থেকে। আপনাকে জাস্ট চমকে দেব শ্বশুরমশাই"। 

"দ্যাখো। এত বছর ধরে তোমায় বলে চলেছি। আজ আবারও বলছি। তুমি আমায় শ্বশুরমশাই ডাকবে না। গা জ্বলে যায়"। 

"ও হ্যাঁ, আপনার জন্য ভালো চা পাতা এনেছি। গোপালধারা। আপনার মাস দুয়েক চলে যাবে"। 

"আমার কোনও কথা কি তোমার কানে যাচ্ছে না গুপী"? 

"শুনুন, আমায় হেঁসেলে ঢুকতে হবে। দাঁড়িয়ে বকবক করলে চলবে না। ফ্রেশ হয়ে আসছি"। 


****

দুপুর দু'টো নাগাদ বিপিন মন্মথকে ডেকে খাওয়ার ঘরে নিয়ে গেল। গুপী খাবারদাবার বেড়ে রেডি রেখেছিল। ব্যাজারমুখেই চেয়ার টেনে নিয়েছিল মন্মথ। কিন্তু গুপীর রান্নার সামনে বসে মুখ ব্যাজার রাখা সম্ভব নয়। 

মিনিট দশেক চুপচাপ খাওয়াদাওয়ার পর মন্মথ জিজ্ঞেস করেই ফেলল, "বিকেলের ট্রেনেই ফিরছ তো"?

মাংসের হাড় চিবুতে চিবুতে সে প্রশ্নকে উড়িয়ে দিল গুপী, "রাতে হালকা রেখেছি ব্যাপারটাকে, বুঝলেন শ্বশুরমশাই। জামাইষষ্ঠীর লাঞ্চটা বেশ ভারী হল কিনা। ওই সোনামুগডাল, বেগুন ভাজা, আলু পোস্ত, ডিমের ডালনা, আর রাবড়ি। এ বয়সে দু'বেলাই নালেঝোলে খাওয়া আপনার চলবে না"। 

কথা না বাড়িয়ে খাওয়ায় মন দিলেন মন্মথ। গুপী গোঁয়ারগোবিন্দ হতে পারে, কিন্তু ওর রান্নার হাতটা সত্যিই বড় ভালো। 

***

রাত দু'টো নাগাদ ঘর থেকে বেরিয়ে ফ্রিজ খুলে একটা সন্দেশ মুখে দিয়েছিল গুপী। তখনই খেয়াল করল ব্যালকনিতে রাখা ইজিচেয়ারে মন্মথ বসে। 

"কী ব্যাপার শ্বশুরমশাই, ঘুমোননি"?

"ইনসমনিয়া ব্যাপারটা ইদানীং শুরু হয়েছে"। 

"ওহ্‌"। 

"তুমি ঘুমোওনি দেখছি"।

"ঘুমের মধ্যেই আমার মাঝেমধ্যে সন্দেশ পায়, তাই উঠতে হল"।

"এ'সব করে কী পাও গুপী"?

"কী'সব করে"? 

"কেন আস এ বাড়িতে বারবার"?

"আমার শ্বশুরবাড়ি। অবভিয়াস ক্লেম আছে"। 

"সুমিকে তুমি বিয়ে করনি"। 

"সুযোগটা পেলাম কই বলুন। তবে আমি কিন্তু ক্লাস টুয়েলভ থেকেই আপনাকে শ্বশুর বলেই চিনি। বিয়ের জন্য আটকে থাকতে হয়নি"। 

"কেন আস বারবার? কেন? সুমিই যখন থাকল না...তুমি কেন আস"?

"সুমির জন্যই আসি। ও না থাক, আমরা দু'জন তো আছি বলুন। আমরা যদ্দিন, তদ্দিন"। 

"তোমাদের বিয়ে হয়নি গুপী। আমার প্রতি তোমার কোনও দায় নেই"। 

"দায়? ও'সব ফালতু কথা ছাড়ুন। বিপনে ঠিকই বলে, আপনি মহাখিটকেল বুড়ো"।

"বিপনে আমার নামে এ'সব বলে"?

"আমি তো তাও অশ্রাব্য অংশগুলো চেপে গেলাম"।

"আমি কালই ওকে পুলিশে দেব"। 

"দেবেন'খন। শুধু দোহাই আপনাকে, এক টীব্যাগ দিয়ে দিনে দু'বার চা খেতে বলবেন না"। 

"ওহ্‌। ও তোমায় সে কম্পেলনও করেছে"।

"বিপিনের সঙ্গে আমার রোজ কথা হয়। ফোনে"। 

"সে আমার অজানা নেই"। 

"শ্বশুরমশাই, কিছু বলবেন"?

"তোমার ওই এনজিও আর ইস্কুলটা কেমন চলছে"? 

"মন্দ না"। 

"গুপী"। 

"বলুন।  

"গতমাসে সমর এসেছিল"।

"ওই, সুমির উকিলকাকু"?

"হ্যাঁ। আমার টাকাপয়সা যে'টুকু আছে, আর এই বাড়িটা। তোমার ওই এনজিওর নামে উইল করে দেওয়া গেছে। ভেবো না তোমায় এক পয়সাও দিয়েছি। শুধু সুমির নামে যদি একটা স্কলারশিপ আর একটা হোম তৈরি করা যায়...আমার তার ক'দিন"। 

"সে হবে নিশ্চয়ই"। 

"তুমি ঠিকই পারবে। সে নিয়ে আমার দুশ্চিন্তা নেই। তবে আমার একটা রিকুয়েস্ট ছিল"। 

"এনিথিং। বলুন না"। 

"আমি না থাকলে তুমি বিপনেটাকে দেখো কিন্তু। ও তোমায় খুব রেস্পেক্ট করে। আর ওর মুখেই বড় বড় কথা। আমি না থাকলে ওর ভেসে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা আছে"। 

"ন্যাওটা কিন্তু আপনারও"।

"তাও ঠিক। নয়ত কি আর এঁটো টীব্যাগ হজম করে পড়ে থাকে"?

"সন্দেশ খাবেন শ্বশুরমশাই? লাঞ্চে তো রিফিউজ করলেন। এখন আনি দু'পিস? হাইকোয়ালিটি কিন্তু। আমি অ্যাসিওর করছি"। 

Thursday, June 2, 2022

ভাণু সমগ্র



ভানুবাবুর লেখালিখিগুলো(ওঁর নিজের লেখালিখি আর ওঁর সম্বন্ধে অন্যদের লেখালিখি) জড়ো করে একটা দুর্দান্ত কাজ করেছে পত্রভারতী। এই ভানু সমগ্রের অর্ধেক জুড়ে রয়েছে ভদ্রলোকের একটা জমজমাট আত্মকথা, বইয়ের মূল আকর্ষণ সে'টাই।
বড় শিল্পীদের আত্মকথা অনেকক্ষেত্রেই "গোস্ট রিটেন" হয়। তাতে মহাভারত অশুদ্ধ হয়না বোধ হয়। কিন্তু ভানুবাবুর লেখার সোজাসাপটা স্টাইল,তাঁর কপিবুক ধারালো উইট এবং রসালো
আড্ডার যে মেজাজ প্রায় প্রতিটি লাইনে রয়েছে; তা'তে মনে হয় এ জিনিস এক্কেবারে "রাইট আউট অফ হর্সেস মাউথ" না হলেই নয়। সাহিত্যের নিয়মকানুন রুচির তোয়াক্কা তেমন করেননি। গোটাটাই একটা দিলখোলা গপ্পগুজব, ওঁর সেই "একপেশে স্টাইলে"। পাঠক হিসেবে বরাবরই মনে হয়ে ভালো আত্মকথায় স্রেফ "আমি,আমি,আমি" থাকলে সমস্তটাই মাটি। আমার অমুক, আমার তমুকে আটকা পড়ে বহু সম্ভাবনাময় বায়োগ্রাফি ভেসে গেছে। ভারতীয় ক্রিকেট তারকাদের কিছু জীবনে সে ব্যাপারে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। কিন্তু ভানুবাবুর এই ছোটখাটো লেখার ক্ষেত্রে আর যাই হোক সে অভিযোগ আনা যায় না। ভদ্রলোক নিজের জীবনের একটা ফ্লো দিব্যি সাজিয়েছেন বটে। তবে তাঁর লেখায় দুর্দান্তভাবে স্পষ্ট হয়েছে সে সময়ের বাংলা সিনেমা জগতের বেশ কিছু জরুরী ব্যক্তিত্ব। সে'সময়ের বাংলা সিনেমার (বিশেষত বিয়ন্ড-সত্যজিৎ জগতের) লেজেন্ডদের বিষয়ে লেখালিখি ঠিক সহজলভ্য নয়। ভানুবাবুর এই গল্পগাছা সে আগ্রহকে খোঁচা দেয় বইকি। মাঝেমধ্যে সিনেমার বাইরেও গিয়ে পড়েছেন ভানু। তাঁর বর্ণময় জীবন তুলে ধরতে গিয়ে উঠে এসেছে দেশভাগ, কলকাতা, রাজনীতি আর আরও কত কী।
লেখাটা পড়তে গিয়ে বারবার মনে হইয়েছে বাংলা সিনেমার সে'যুগের মানুষজন সম্বন্ধে আমরা (অন্তত আমি) কত কম জানি। সিনেমার স্ক্রিনের বাইরেও তাঁদের সরেস উপস্থিতি, ব্যক্তিত্ব, রকমারি বাতিক; এ'সব আর এ'যুগের মানুষের দৃষ্টিগোচর হল কই। এই যেমন ক্যামেরা বা স্টেজের আড়ালেও ছবি বিশ্বাসের যে কী সাংঘাতিক একটা দুনিয়া-কাঁপানো স্টাইল ছিল! ছবিবাবুকে নিয়ে একটা পেল্লায় বই লেখা উচিৎ, তরতরে ঝরঝরে ভাষায়। সে কাজটা কে করবেন আমার জানা নেই। অভিনেতা ছবি বিশ্বাস সকলের অত্যন্ত শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। তবে ভানু খোলসা করেছেন ওঁর ব্যক্তিগত স্টাইল আর হিউমরের দিকটা। আমার চোখে সে'টাই এ বইয়ের অন্যতম হাইপয়েন্ট। এই যেমন ধরুন স্টেজে সহঅভিনেতাদের কী'ভাবে ভড়কে দিতেন ছবিবাবু? বিকাশবাবুকে 'বেগুনপোড়া'র সঙ্গে তুলনা করেছিলেন কেন? উত্তমকুমারকেই বা ছবিবাবু ঠিক কী'ভাবে ইন্সপ্যায়ার করেছিলেন? আর নিজের জমিদার মেজাজের ঘ্যাম কী'ভাবে 'ক্যারি' করতেন ভদ্রলোক? প্রাণখুলে লিখেছেন ভানুবাবু। তবে শুধু ছবি বিশ্বাস নয়। উত্তমের ফোকাস, সাবিত্রীর দুর্দান্ত প্রতিভা, বিকাশ রায়ের ইন্টেলিজেন্স, পাহাড়ি সান্যালের সারল্য; এমন আরও কত মানুষ সম্বন্ধে কত কিছু। তবে শুধু প্রশংসায় আটকে যাওয়ার মানুষ তো ভানু নন। কড়া কথা এবং অভিযোগগুলোও চেপে রাখার প্রয়োজন মনে করেননি।
সেই সময়ের কমার্শিয়াল বাংলা সিনেমা জগতের পরিবেশ, রাজনীতি, আর সম্পর্কগুলো সম্বন্ধে বেশ সোজাসাপটা ভাষায় লিখেছেন ভদ্রলোক। সে'দিক থেকে এ লেখা যাকে বলে বেশ জরুরী দলিল। সবচেয়ে বড় কথা, অভিনয় আর কমেডি সম্বন্ধে কিছু জরুরী অবজার্ভেশন শেয়ার করেছেন তিনি। রবি ঘোষও নিজের জীবনীতে অভিনয়ের টেকনিকালিটি নিয়ে মনোগ্রাহী স্টাইলে বেশ কিছু জরুরী কথা লিখেছেন। ভানুবাবুর লেখার মধ্যেও একই প্যাশন। রবিবাবু যেন একটু বেশি সেরেব্রাল,ভানু খানিকটা প্র্যাক্টিকাল। বাংলা সিনেমার অতিরিক্ত কান্না-প্রীতিতে দু'জনেই বিরক্ত এবং হতাশ। আর সিনেমায় রিলিফের খাতিরে কমেডির অপব্যবহারে দু'জনেই মর্মাহত।
ভানুবাবুর কেরিয়ার কার্ভটা বড্ড সিনেম্যাটিক। কমেডিতে আসর কাঁপানোর পাশাপাশি সিনেমার হিরো হয়েও বিভিন্ন সিনেমা হিট করিয়েছেন। বেশ নেতাগোছের মানুষ। সাঙ্ঘাতিক উইট এবং রসবোধ। সেই উইট ছাপিয়েই তিনি আবার দামাল, দুর্দান্ত। ঠাস ঠাস করে কড়া কথা শোনাতে পারেন। খানিকটা বেপরোয়া (নইলে অন্যদের ব্যাপারে অমন কামান দাগা সম্ভব নয়। নিজের ছেলেকেও রেয়াত করেননি অবশ্য)। সেই বেপরোয়া বিচ্ছু ভদ্রলোকই একটা সময় এসে নিজেকে ভাঁড় হিসবে সিনেমায় দাঁড় করাতে বাধ্য হয়েছেন; বারবার। ওই, প্রেম,ট্র্যাজেডি এ'সবের ফাঁকে দর্শকদের কমিক রিলীফ যোগাতে হবে। কমেডিয়ান এসে উঁচু মাত্রায় কিছু চুটকি মাঠে ফেলবেন। ওঁর মত ধারালো অভিনেতাকেও সেই টেমপ্লেটের বশ্যতা স্বীকার করতে হয়েছিল। আবার একটা বয়সের পর সে'সুযোগগুলোযও হারিয়ে যেতে শুরু করেছিল। রাগ, বিরক্তি, অভিমান আর সর্বোপরি টাকার অভাব; সব মিলে বাধ্য হয়ে এগোলেন যাত্রাকে এক্সপ্লোর করতে। কিন্তু জাত শিল্পীদের ব্যাপারটাই আলাদা। আমরা কর্পোরেটে একটা বুলি খুব কপচাই; যাই করো, এক্সেলেন্স থেকে ফোকাস সরলে চলবে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমরা বলি এক্সেলেন্স আর বানাই গাম্বাট পাওয়ারপয়েন্ট। ভানুবাবু তো কর্পোরেট স্টুজ নন, শিল্পি। যাত্রাতে লোক মাতালেন। আর্টফর্মটাকে ভালোবাসলেন। সিনেমাতেও দুর্দান্ত কিছু কামব্যাক পারফর্ম্যান্স দিলেন। কিন্তু কমেডিয়ান তকমাটা আর ঝেড়ে ফেলতে পারলেন না। এই যে দুর্দান্ত একটা কার্ভ, যে'টা শুধুই 'রাইজিং' নয়, ভানুবাবুর প্রাণখোলা লেখার গুণে সে'টা একটা চমৎকার নভেল হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজের বিরক্তির ওপর সাহিত্যের পালিশ চালাননি ভদ্রলোক, সে'টাই এই লেখার বড় ব্যাপার।
উত্তমের গালে চুমু খেতেন ভানু, সৌমিত্রর প্রতি তাঁর অগাধ শ্রদ্ধা- নিজের গার্জেন বলে মনে করতেন, সত্যজিৎকে সম্মান করতেন আবার সামান্য় অভিমানও পুষে রেখেছিলেন। ও'দিকে গুপী গাইন বাঘা বাইন রিলিজের সময় উত্তম আর ভানু একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছিলেন। অবাক কাণ্ড, সত্যজিতের সিনেমায় চান্স না পাওয়া ভানু কিন্তু ছিলেন সত্যজিতেরই দলে। নিশ্চিন্তে থাকুন; এ'গুলো স্পয়লার নয়, খোঁচা। এইসব ইনফর্মেশনগুলো আড়ালে যে'সব রিয়েললাইফ গল্প লুকিয়ে আছে, সে'গুলোকে টেনে বের করে আনতে হলে এ লেখা পড়া ছাড়া উপায় নেই। বাংলা-সিনেমার ভক্তদের জন্য সে'সব অ্যানেকডোটের মূল্য অপরিসীম। তবে সেই সিনেমার জগতের পরিচয়টাই ভানুবাবুর বায়োডেটার শেষ কথা নয়। ওঁর শিক্ষকদের একটা ফর্দ করলে তাজ্জব বনে যেতে হয়। দীনেশ গুপ্ত থেকে সত্যেন বসু হয়ে আর কত দুর্দান্ত সব মানুষ। আর সবচেয়ে বড় কথা, দেশভাগের জ্বালাযন্ত্রণা তাঁর কমেডির সঙ্গে মিলেমিশে গেছিল।
ভানুবাবুকে নিয়ে একটা জবরদস্ত বায়পিক কে বানাবেন? স্নেহ-ভালোবাসা-ট্র্যাজেডি; মশলাপাতির তো অভাব নেই। শুভস্য শীঘ্রম!

ভোলার দাওয়াই



বড় কঠিন সময়৷ মানে, এই চল্লিশ-হল-বলে বয়সটা। মানুষজনের প্রতি নিষ্ফল রাগ বেড়েছে অথচ রাগপ্রকাশ করার সাহস কমেছে৷ মিডলাইফ ক্রাইসিসের কেমিক্যাল ইকুয়েশন বোধ হয় এ'টাই। তবে মাঝেমধ্যে মনকে শান্ত করতে বিভিন্ন দুঃসাহসী সিচুয়েশন কল্পনায় সাজিয়ে নিই৷
এই যেমন কখনও ভাবি ব্রেনের সুইটস্পট থেকে স্মার্ট সারকাজম তুলে এনে কোনও বাটপারকে চুপ করিয়ে দিচ্ছি৷ (আদতে অবশ্য স্মিত হেসে মাথা নেড়ে কথার পিঠে তাল দিয়ে যাওয়া ছাড়া কিছুই করার থাকে না)।
অথবা, হয়ত ভাবছি যে প্রচণ্ড ধারালো সব যুক্তি আর ইন্টলেকচুয়াল গাম্ভীর্য দিয়ে তর্কবাগীশদের জাস্ট শুইয়ে দিচ্ছি৷ তারপর রণেভঙ্গ দিয়ে সে'সব ডিবেট-ব্র্যাডম্যানরা আমায় স্যালুট ঠুকছে৷ (আদতে হয়ত বলতে হচ্ছে, "মার্ভেলাস কথা বলেছেন মশাই৷ এক্কেবারে একঘর)৷
কিন্তু আমার সবচেয়ে প্রিয় কাল্পনিক প্রত্যুত্তরে থাকে একটা ষাঁড়৷ সেই যমালয়ে জীবন্ত মানুষের ভোলা। যখন জ্ঞানগর্ভ কথার গদা দিয়ে কেউ এলোপাথাড়ি ঠোকাঠুকি করে চলে, মনে মনে ভাবি সেই ভোলা আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে৷ আর আমি আচমকা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ষাঁড়টাকে ইন্সট্রাক্ট করছি, "গুঁতো ভোলা, গুঁতো"!

অমল দারোগা আর ফুল



"শুঁকে দ্যাখ", অমল দারোগা বেশ গম্ভীরভাবেই বললেন৷
আমি অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে রিফিউজ করলাম। একজন নিষ্ঠাবান পকেটমার হয়ে দারোগার হাতের অচেনা ফুল শুঁকে দেখাটা সমীচীন হবে না৷ পুলিশের পেটে পেটে হাজার রকমের বদ মতলব ঘুরে বেড়ায়৷ গম্ভীর হয়ে বললাম,
"আমার ফুলে অ্যালার্জি আছে"।
"তোরই লোকসান", অমল দারোগা চুকচুক করে বললেন৷
"লোকসান কেন"?
"এই ফুল আগে দেখেছিস"?
" না দেখার কী আছে৷ ওই৷ গোলাপ জবা কুমড়ো কিছু একটা হবে"।
"শাটাপ৷ পকেট মারছিস তার পাপ অল্পই৷ পলিটিক্সে তো নামিসনি৷ কিন্তু এই পিকিউলিয়ার ফুলকে তুই জবা বলছি? ধর্মে সইবে"?
ভরদুপুরে বাইশ বাই বি বাস থেকে সাত নম্বর পকেট কাটার সময় ধরা পড়েছিলাম৷ কতবার বললাম পাবলিককে, এন্তার চড়থাপ্পড় কষিয়ে ছেড়ে দিন৷ আমার থানা পর্যন্ত যাওয়ার সময় নেই৷ খেটে খাওয়া মানুষ, থানায় এসে রিল্যাক্স করলে চলবে কেন? আগের দিনের মানুষ অত নেকু ছিল না, কথায় কথায় পুলিশ পুলিশ করে হন্যে হত না৷ হাতের সুখ করে একটা অন-দি-স্পট ফয়সালা করে মিটিয়ে নিত। কিন্তু ইয়ং জেনারেশন অত্যন্ত লালুভুলু৷ সোজা পুলিশের কাছে নিয়ে এলে৷ তাও এক্কেবারে অমল দারোগার থানায়৷ কোনও মানে হয়? দু'রাত্তির জেলের লপসি খেতে আপত্তি নেই৷ কিন্তু এখন এ'ভদ্রলোকের খোশগল্প থেকে গা বাঁচাবো কী করে? এর আগেও দেখেছি, ডায়েরি লেখার নাম নেই৷ থার্ড ডিগ্রি দেওয়ার আগ্রহ নেই৷ লকাপে পোরার ব্যাপার মহাআলিস্যি৷ শুধুই বাজে গল্প। আজ পড়েছে কী এক ফালতু ফুল নিয়ে৷
বাধ্য হয়ে একটু গলা উঁচু করে বললাম, " স্যার, একটু লাঠিপেটা করে ছেড়ে দিন না। সাতটা বাইশের লোকালটা হ্যাইভ্যালু মার্কেট৷ ও'টা ছাড়তে চাইছি না"।
"আরে হরেন৷ তোর সব কথাতেই খালি ছটফট৷ এ'জন্যেই স্রেফ মোটামুটি লেভেলের ভালো পকেটমার হয়েই রয়ে গেলি৷ লেজেন্ডারি পিকপকেট আর হতে পারলি না৷ ফুলটা শুঁকে দ্যাখ। আমি তোর শত্তুর নই"।
বাধ্য হয়ে সেই অচেনা ফুলটার কাছে নাক নিয়ে গেলাম।
কী আশ্চর্য! ডাল-ভাতের গন্ধ এলো নাকে৷ ঠিক যেন কেউ পেঁয়াজ দেওয়া মুসুরডাল দিয়ে বাঁশকাঠি চালের ভাত মেখেছে, সামান্য লেবুও কচলে নিয়েছে। আর এস সঙ্গে মিশে যাছে ডিমসেদ্ধর গন্ধ। কোনও ভুল নেই, এ কম্বিনেশন আমার সুপরিচিত।
" কী! কেমন বুঝছিস হরেন"?
"কী অদ্ভুত দারোগাবাবু! ঠিক যেন, ঠিক যেন..."।
"ডাল, ভাত, ডিমসেদ্ধ৷ তাই তো"?
"নির্ঘাৎ। এ ফুল আপনি কোথায় পেলেন? আর সবাইকে আড়াল করে আমার মত চোরছ্যাঁচড়কে দেখাচ্ছেন কেন"?
" কারণ হরেন৷ ইউ আর আ গুড বয়৷ আগডুমবাগডুম কথাকে চট করে উড়িয়ে দিসনা৷ আর তদুপরি তুই হাড়বজ্জাত পকেটমার৷ লোকে তোর কথায় পাত্তা দেবেনা৷ তাই নিশ্চিন্তে বলা যায়৷ দু'দিন আগে বৌকে বলতে গেছিলাম এ'কথা৷ আমার ফোরটুয়েন্টি বলে এমন খেইমেই করে উঠল যে চেপে গেলাম৷ অডাসিটি ভাব, দারোগাকে ফোরটুয়েন্টি বলছে"।
আমি একটু নরম হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, "এই ডালভাত ফুলের কথা বৌদিকে বলে খামোখা ঝামেলা বাড়ালেন৷ যাকগে৷ আপনি নিজের লোক৷ তাই বলেই দিই৷ এদ্দিন পকেটমারি করছি৷ মানিব্যাগের গন্ধ ছাড়া মনে তেমন কিছুই দাগ কাটে না৷ কিন্তু এমন বিটকেল কেস আগে শুনেছি বলে তো মনে পড়ছে না"।
" বিটকেল৷ মিস্টিরিয়াস। গতকাল ছিল আচার তেলে মুড়ি মাখার সুবাস৷ পরশু ছিল ঘি দিয়ে মাখা আলুসেদ্ধ আর পাঁপড়ভাজা৷ এ'দিকে ডাক্তারের তড়পানিতে আমার কপালে স্টু আর স্যালাড ছাড়া কিচ্ছুটি বরাদ্দ নেই৷ এ'সব গন্ধে যে আমার প্রাণপাত হওয়ার অবস্থা৷ আমার যে বড় লোভ হরেন৷ এ ফুল ব্যাটাচ্ছেলে আমায় এমন ক্রিমিনালের মত তাড়া করেছে কেন কে জানে"।
"কী কাণ্ড। তা এই মারাত্মক ফুল আপনি পাচ্ছেন কোথা থেকে"?
"সে'টাই তো সবচেয়ে বেশি ডেঞ্জারাস রে৷ আমি এ ফুল পাই না৷ এ ফুল আমায় পায়৷ আমার ইউনিফর্মের বুকপকেটে রোজ একটা করে ফুল উদয় হয় বুঝলি। ওই দুপুরনাগাদ। এই ফুলটা যেমন৷ রোজ একই ফুল। একই রঙ, একই সাইজ। শুধু গন্ধটা রোজই আলাদা। কিন্তু রোজই মনোরম। আর রাত হলেই শুকিয়ে ঝুরঝুরে হয়ে ধুলো হয়ে যাচ্ছে"।
" তা দারোগাবাবু, এই ভূতুড়ে ফুলটুল শোঁকালেন। গপ্পগুজব করলেন৷ এ'বারে এক কাপ চা খাওয়ান দেখি৷ গলাটা শুকিয়ে কাঠ"।
"খাওয়াব৷ কিন্তু খবরদার বাইরে গিয়ে কাউকে বলবি না যে অমল দারোগা তোকে ডেকে আদর করে চা বিস্কুট খাইয়েছে৷ আমার একটা রেপুটেশন আছে দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী দারোগা বলে৷ পকেটমার এসে আমার সামনে খেজুর করে যাবে, সেই গপ্প ছড়ালে চলবে না"।
হেসে হাত কচলে বললাম, "চায়ের সঙ্গে আবার বিস্কুট কেন৷ চট করে একটা মামলেট ভেজে আনতে বলুন না৷ ফস করে খেয়ে আবার কাজে বেরোই"।
" সে বলে দিচ্ছি৷ কিন্তু তুই আমার প্রবলেমটাকে সিরিয়াসলি নিলি না হরেন"৷ দারোগাবাবু নরম সুরে অভিযোগ জানিয়ে ক্রিং ক্রিং করে বেল বাজিয়ে নিজের আর্দালিকে ডাকলেন।
**
- আজ কী এঁকেছিস বুবলু?
- ফুল৷
- আবার ফুল?
- আবার। এই দ্যাখো বাবা।
- রোজ এই একই ফুল এঁকে কী আনন্দ পাস বল দেখি৷
- আমার ভালো লাগে৷
- এই ফুলটার নাম দিয়েছিস একটা?
- খাবার ফুল।
- সে কী৷ এমন বিটকেল নাম কেন?
- রোজ মা খাইয়ে দেওয়ার সময় আঁকি৷ তাই৷
- বড় অদ্ভুত অভ্যাস করেছিস৷ তা আজ কী খেলি দুপুরে?
- ডাল৷ ভাত৷ আর ডিমসেদ্ধ।