Thursday, June 16, 2022

তুচ্ছ ইতিহাস



আজকাল ইতিহাস সিলেবাসের ঠিক-ভুল উচিৎ-অনুচিত নিয়ে বেশ তোলপাড় চলছে। সে বিতর্কের মূলে রয়েছে রাজরাজড়াদের নিয়ে টানাটানি। কতটা মুসলমান বাদশাদের কথা পড়লাম, কতটা হিন্দু রাজরাজড়াদের ব্যাপারে জানলাম; সে রেশিও নিয়ে ধুন্ধুমার ব্যাপার। গুঁতোগুঁতি করে তর্ক করতে আমাদের যতটা আগ্রহ, ততটা আগ্রহ অবশ্য ইতিহাসের বই উল্টেপাল্টে দেখায় নেই। সে'টা একদিক থেকে বাঁচোয়া, ইনফরমেশন আর অবজেক্টিভিটির জ্বালায় রসালো খিস্তিখেউর নিষ্প্রভ হয়ে যায় না। যাক গে। এ'সবের মাঝে একজন চমৎকার ইতিহাস প্রিয় চরিত্রের কথা মনে পড়ে গেল; বিভূতিভূষণের অপু। অপু আইএ পাশ করে আর কলেজে ভর্তি হল না। প্রফেসররা ডেকে অপুকে বোঝাতে চাইলেন যে অপুর অনার্স পড়া উচিৎ। কিন্তু সদ্য মাতৃহারা, সহায়-সম্বলহীন অপুর তখন ক্লাস করার আগ্রহ ছিল না। নিদারুণ অভাবের মধ্যে থাকার ফলে অবশ্য ভর্তি না হওয়ার সিদ্ধান্তটা আরও সহজ হয়ে গেছিল। কিন্তু অপুর অনাগ্রহ ছিল মূলত সেই স্ট্রাকচার্ড সিস্টেমটার প্রতি, জানার ইচ্ছেটুকু পুরো দমে তাকে ঠেলে নিয়ে বেড়াচ্ছিল। আর প্রচণ্ড মুখচোরা হওয়া সত্ত্বেও নিজের পড়াশোনার ফোকাস সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না অপুর। অপুর নিজের মনের ভাষায়; "দু'বছর (বিএ'র) মিছিমিছি নষ্ট না করে, লাইব্রেরিতে তার চেয়ে অনেক বেশি পড়ে ফেলতে পারব'খন"।

অপুর ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরিতে বসে নিজের ইচ্ছেমত পড়াশোনা করার বর্ণনা 'অপরাজিত'র সামান্য কয়েকটা পাতার মধ্যেই সীমিত। কিন্তু ও'টুকু অংশ যে আমার কী প্রিয়। ডিগ্রি পাওয়ার জন্য নয়, 'কেরিয়ারে' এক্সেল' করতে হবে বলে নয়, এমন কী দু'দশজনের মাঝে দু'চারটে মজবুত কথা বলে চমকে দেওয়ার জন্যও নয়। সে গোগ্রাসে একের পর এক বই গিলেছে শুধুই জানার আগ্রহে। ওই আগ্রহে সিস্টেমের বালাই ছিল না, তবে অচেনা অজানাকে জানবার উচ্ছ্বাস ছিল ষোলো আনা। অপুর মধ্যে একটা দুর্দান্ত আত্মবিশ্বাস ছিল যে কলেজের সিলেবাসে বাঁধা পড়ার মধ্যে সার্থকতা নেই। (একটা কথা বলার লোভ সামলাতে পারছিনা। আমার সৌভাগ্য যে আমি এমন একজনকে চিনি যে কলেজের সিলেবাসকে কাঁচকলা দেখিয়ে লাইব্রেরির শেল্টারে নিজেকে সঁপে দিয়েছিল। এবং এক্সলেন্সকে পোষা বেড়ালের মত মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে পেরেছিল। ওঁর থেকে অনুমতি আদায় করে একদিন সে'সব গল্প ফলাও করে বলতে হবে। তবে এ'বার অপুতে ফেরত যাওয়া যাক)। 

অপু দুপুর দু'টো থেকে সন্ধ্যে সাতটা পর্যন্ত লাইব্রেরীতে বসে পড়ত। রোজ। একটা ছোটখাটো অল্প মাইনের চাকরী যে'টা জোগাড় করেছিল সে'খানে ছিল রাতের শিফটে কাজ। বেলায় দেরী করে ঘুম থেকে উঠে সে ছুটত লাইব্রেরীর দিকে। এই যে নির্বিচার পড়াশোনা, তার অনেকটা জুড়েই ছিল ইতিহাস। কিন্তু সে ইতিহাস অপু যত পড়ছে, তত তার মনের মধ্যে একটা অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। বারবার তার মনে হয়েছে এই যে রাজরাজড়ার হিসেবকিতেব, সে'টুকুই কি সম্পূর্ণ ইতিহাস? ইতিহাসের এসেন্স কি সে'টুকুই? না না, বিভূতিভূষণ কোট করে খামোখা নতুন তর্কে পড়তে চাইনা মোটেও। ইতিহাস যে রাজাগজাদের ফোকাসে রেখেই গড়ে উঠবে, সে'টাই স্বাভাবিক। এবং লজিকাল। ভালোয় মন্দয় মিশিয়ে ইতিহাসের প্রাইম মুভার যে সে রাজাগজারাই। কিন্তু অপুর মনের মধ্যে যে উৎসুক রোম্যান্টিক মানুষটা রয়েছে, সে যে শুধু মাইলস্টোনের জাঁতাকলে আটকা পড়বে না, তা বলাই বাহুল্য। অপুর হয়ে বিভূতিবাবু বলছেন, "মানুষের সত্যকারের ইতিহাস কোথায় লেখা আছে? জগতের বড় ঐতিহাসিকদের অনেকেই যুদ্ধ-বিগ্রহ ও রাজনৈতিক বিপ্লবের ঝাঁঝে; সম্রাট, সম্রাজ্ঞী, মন্ত্রীদের সোনালি পোশাকের জাঁকজমকে; দরিদ্র গৃহস্থের কথা ভুলিয়া গিয়াছেন। পথের ধারের আমগাছে তাহাদের পুটুলিবাঁধা ছাতু কবে ফুরাইয়া গেল, সন্ধ্যায় ঘোড়ার হাট হইতে ঘোড়া কিনিয়া আনিয়া পল্লীর মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকের ছেলে তাহার মায়ের মনে কোথায় আনন্দের ঢেউ তুলিয়াছিল - ছ'হাজার বৎসরের ইতিহাসে সে'সব কথা লেখা নাই।...কেবল মাঝেমাঝে এখানে ওখানে ঐতিহাসিকদের লেখার পাতায় সম্মিলিত সৈন্যব্যূহের এই আড়ালটা সরিয়া যায়, সারি বাঁধা বর্শার অরণ্যের ফাঁকে দূর অতীতের এক ক্ষুদ্র গৃহস্থের ছোট বাড়ি নজরে আসে। অজ্ঞাতনামা কোন লেখকের জীবন-কথা, কি কালের স্রোতে কূলে-লাগা এক টুকরো পত্র, প্রাচীন মিশরের কোন্‌ কৃষক পুত্রকে শস্য কাটিবার কী আয়োজন করিয়ে লিখিয়াছিল, - বহু হাজার বছর পর তাহাদের টুকরো ভূগর্ভে প্রোথিত মৃণ্ময়-পাত্রের মত দিনের আলোয় বাহির হইয়া আসে। কিন্তু আরও ঘনিষ্ঠ ধরণের, আরও তুচ্ছ জিনিসের ইতিহাস চায় সে। মানুষের বুকের কথা সে জানাতে চায়। আজ যাহা তুচ্ছ, হাজার বছর পরে তা মহাসম্পদ। ভবিষ্যতের সত্যকার ইতিহাস হইবে এই কাহিনী, মানুষের মনের ইতিহাস, তার প্রাণের ইতিহাস"। 

এই যে ইতিহাসের আড়ালে থাকা তুচ্ছ মুহূর্তদের নিবিড়ভাবে জানার লোভ, এ'টা কিন্তু কিছুতেই অপুর একার হতে পারে না। ঐতিহাসিকদের দোষ দিইনা, সমস্ত হরিদাস পালের গল্প বই বা স্টোনট্যাবলেটে বা প্যাপাইরাসে সাজিয়ে রাখা সম্ভব নয়। কিন্তু ওই 'খামোখা তুচ্ছের প্রতি আগ্রহে'র জন্যেই সুনীলবাবুর লেখা অর্ধেক জীবন আমার এত প্রিয়। অথচ মূল ইতিহাসের বই নিংড়ে সেই সাদামাটা মানুষের সাদামাটা গল্প বের করে আনা চাট্টিখানি কথা নয়। যে কোনও ইতিহাসের বই হাতড়ালেই দেখব যে রাজারাজড়া, রাজনীতি আর ধর্ম - এই কনসেন্ট্রিক সার্কলগুলোর মধ্যে ঘুরপাক খাওয়া ছাড়া গতি নেই। অবশ্য সে'ইতিহাসও সাংঘাতিক ভাবে গ্রিপিং। এবং জরুরী। তবে তা'তে ওই 'তুচ্ছকে জানার ঝোঁক' কমে না। এবং স্রেফ লাইব্রেরীতে বসে সে ইতিহাসের নাগাল পাওয়া অসম্ভব। সবচেয়ে বড় কথা, এই যে এক একটা সময়ের সাদামাটা মানুষদের আটপৌরে একঘেয়ে গতানুগতিক জীবনধারা, সে'টাকে রেকর্ড করে রাখতে গেলে তো সাহিত্যের ভাষা আর বইয়ের ডিসিপ্লিনে কাজ হবে না। হরিদাস পালের বায়োগ্রাফার আবুল-ফজল হলে চলবে কেন? হরিদাসের উঠোনে পাতা মাদুরের ওপর ভেজা গামছা, তার খোকা কাদায় ল্যাপ্টালেপ্টি করে খেলা করছে। তার বৌ এমনভাবে শাক ভাজছে যে তা দিয়ে ভাত মাখলে নবাবের হেঁসেলের পোলাও হার মানাবে। ধারালো ভাষা বা কাব্যের চাতুরী হরিদাস পালের সেই তুচ্ছ ইতিহাস ক্যাপচার করবে কী করে? 

আর এ'টা ভেবেই একটা অদ্ভুত ব্যাপার মনে হলে। ইউটিউবের জমানায়, এ যুগের হরিদাস পালদের তুচ্ছ ইতিহাস সাহিত্যে বা সিলেবাসে স্থান না পেলেও হারিয়ে যাবে না। আমাদের এ যুগের ইতিহাস স্রেফ ওই প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী, যুদ্ধ, মিসাইলে আটকে থাকবে না। এলেবেলে যারা, যাদের জীবনগুলো এক্কেবারে স্কেল মেপে এবং ম্যাদামারা স্টাইলে চলে; তাদের দস্তাবেজও থেকে যাবে। উদাহরণ হিসেবে আমাদের অতি সহজ-সরল ফুড-ভ্লগগুলোই দেখুন। পাড়ার ইয়ারদোস্ত বা 'জুনিয়র' ছেলেমেয়েদের দল হাতে মোবাইল ক্যামেরা আর ইয়ারফোন নিয়ে বেরিয়ে পড়ছে। কেউ রানাঘাটের অনামা ভাতের হোটেলে বসে মাংসের ঝোল অর্ডার দিচ্ছে, এবং উপরি হিসেবে সে হোটেলের ম্যানেজার দাদার সঙ্গে জোর গপ্প জুড়ে ফেলছে। অথবা কেউ হরিদ্বারে পৌঁছে কোনও কচুরিওলার লম্বা ইন্টারভিউ রেকর্ড করছে। এই ভ্লগার, এই ভাতের হোটেলের ম্যানেজার, এই কচুরিওলা; এদের তো ইতিহাসের বইতে স্থান নেই। তবু এদের গল্প রয়ে যাচ্ছে অনন্তকালের পকেটে। মার্ক উইন্স সম্প্রতি বাংলাদেশ গেছিলেন, সে সাহেবের চোখ দিয়ে আমি চিনলাম সে দেশের এক চাকমা পরিবারকে। তাদের আমার চেনার কথা ছিল না। পাকিস্তানি ফুড ভ্লগার জিয়া তবারক ছিলেন তাই গুজরানওলার গুরুনানকপুরা স্ট্রিটের লস্যিবানিয়ে দাদা বা আরও কত সরলসিধে মানুষকে চিনে রাখি। 

আমার একটা  হঠকারী থিওরি হল, অপুর মত মানুষ পারত এই ইউটিউব নিংড়ে অতিপাতি মানুষের তুচ্ছ ইতিহাসে নিজেকে ডুবিয়ে দিতে। আমরা অপূর্ব নই। তার রোম্যান্সের নাগাল পাওয়া আমাদের কম্ম নয়। কিন্তু আমরা সে তুচ্ছ ইতিহাসে ডুবতে না পারে, গোড়ালি ডোবানোর চেষ্টা করতেই পারি।

No comments: