আমি অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে রিফিউজ করলাম। একজন নিষ্ঠাবান পকেটমার হয়ে দারোগার হাতের অচেনা ফুল শুঁকে দেখাটা সমীচীন হবে না৷ পুলিশের পেটে পেটে হাজার রকমের বদ মতলব ঘুরে বেড়ায়৷ গম্ভীর হয়ে বললাম,
"আমার ফুলে অ্যালার্জি আছে"।
"তোরই লোকসান", অমল দারোগা চুকচুক করে বললেন৷
"লোকসান কেন"?
"এই ফুল আগে দেখেছিস"?
" না দেখার কী আছে৷ ওই৷ গোলাপ জবা কুমড়ো কিছু একটা হবে"।
"শাটাপ৷ পকেট মারছিস তার পাপ অল্পই৷ পলিটিক্সে তো নামিসনি৷ কিন্তু এই পিকিউলিয়ার ফুলকে তুই জবা বলছি? ধর্মে সইবে"?
ভরদুপুরে বাইশ বাই বি বাস থেকে সাত নম্বর পকেট কাটার সময় ধরা পড়েছিলাম৷ কতবার বললাম পাবলিককে, এন্তার চড়থাপ্পড় কষিয়ে ছেড়ে দিন৷ আমার থানা পর্যন্ত যাওয়ার সময় নেই৷ খেটে খাওয়া মানুষ, থানায় এসে রিল্যাক্স করলে চলবে কেন? আগের দিনের মানুষ অত নেকু ছিল না, কথায় কথায় পুলিশ পুলিশ করে হন্যে হত না৷ হাতের সুখ করে একটা অন-দি-স্পট ফয়সালা করে মিটিয়ে নিত। কিন্তু ইয়ং জেনারেশন অত্যন্ত লালুভুলু৷ সোজা পুলিশের কাছে নিয়ে এলে৷ তাও এক্কেবারে অমল দারোগার থানায়৷ কোনও মানে হয়? দু'রাত্তির জেলের লপসি খেতে আপত্তি নেই৷ কিন্তু এখন এ'ভদ্রলোকের খোশগল্প থেকে গা বাঁচাবো কী করে? এর আগেও দেখেছি, ডায়েরি লেখার নাম নেই৷ থার্ড ডিগ্রি দেওয়ার আগ্রহ নেই৷ লকাপে পোরার ব্যাপার মহাআলিস্যি৷ শুধুই বাজে গল্প। আজ পড়েছে কী এক ফালতু ফুল নিয়ে৷
বাধ্য হয়ে একটু গলা উঁচু করে বললাম, " স্যার, একটু লাঠিপেটা করে ছেড়ে দিন না। সাতটা বাইশের লোকালটা হ্যাইভ্যালু মার্কেট৷ ও'টা ছাড়তে চাইছি না"।
"আরে হরেন৷ তোর সব কথাতেই খালি ছটফট৷ এ'জন্যেই স্রেফ মোটামুটি লেভেলের ভালো পকেটমার হয়েই রয়ে গেলি৷ লেজেন্ডারি পিকপকেট আর হতে পারলি না৷ ফুলটা শুঁকে দ্যাখ। আমি তোর শত্তুর নই"।
বাধ্য হয়ে সেই অচেনা ফুলটার কাছে নাক নিয়ে গেলাম।
কী আশ্চর্য! ডাল-ভাতের গন্ধ এলো নাকে৷ ঠিক যেন কেউ পেঁয়াজ দেওয়া মুসুরডাল দিয়ে বাঁশকাঠি চালের ভাত মেখেছে, সামান্য লেবুও কচলে নিয়েছে। আর এস সঙ্গে মিশে যাছে ডিমসেদ্ধর গন্ধ। কোনও ভুল নেই, এ কম্বিনেশন আমার সুপরিচিত।
" কী! কেমন বুঝছিস হরেন"?
"কী অদ্ভুত দারোগাবাবু! ঠিক যেন, ঠিক যেন..."।
"ডাল, ভাত, ডিমসেদ্ধ৷ তাই তো"?
"নির্ঘাৎ। এ ফুল আপনি কোথায় পেলেন? আর সবাইকে আড়াল করে আমার মত চোরছ্যাঁচড়কে দেখাচ্ছেন কেন"?
" কারণ হরেন৷ ইউ আর আ গুড বয়৷ আগডুমবাগডুম কথাকে চট করে উড়িয়ে দিসনা৷ আর তদুপরি তুই হাড়বজ্জাত পকেটমার৷ লোকে তোর কথায় পাত্তা দেবেনা৷ তাই নিশ্চিন্তে বলা যায়৷ দু'দিন আগে বৌকে বলতে গেছিলাম এ'কথা৷ আমার ফোরটুয়েন্টি বলে এমন খেইমেই করে উঠল যে চেপে গেলাম৷ অডাসিটি ভাব, দারোগাকে ফোরটুয়েন্টি বলছে"।
আমি একটু নরম হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, "এই ডালভাত ফুলের কথা বৌদিকে বলে খামোখা ঝামেলা বাড়ালেন৷ যাকগে৷ আপনি নিজের লোক৷ তাই বলেই দিই৷ এদ্দিন পকেটমারি করছি৷ মানিব্যাগের গন্ধ ছাড়া মনে তেমন কিছুই দাগ কাটে না৷ কিন্তু এমন বিটকেল কেস আগে শুনেছি বলে তো মনে পড়ছে না"।
" বিটকেল৷ মিস্টিরিয়াস। গতকাল ছিল আচার তেলে মুড়ি মাখার সুবাস৷ পরশু ছিল ঘি দিয়ে মাখা আলুসেদ্ধ আর পাঁপড়ভাজা৷ এ'দিকে ডাক্তারের তড়পানিতে আমার কপালে স্টু আর স্যালাড ছাড়া কিচ্ছুটি বরাদ্দ নেই৷ এ'সব গন্ধে যে আমার প্রাণপাত হওয়ার অবস্থা৷ আমার যে বড় লোভ হরেন৷ এ ফুল ব্যাটাচ্ছেলে আমায় এমন ক্রিমিনালের মত তাড়া করেছে কেন কে জানে"।
"কী কাণ্ড। তা এই মারাত্মক ফুল আপনি পাচ্ছেন কোথা থেকে"?
"সে'টাই তো সবচেয়ে বেশি ডেঞ্জারাস রে৷ আমি এ ফুল পাই না৷ এ ফুল আমায় পায়৷ আমার ইউনিফর্মের বুকপকেটে রোজ একটা করে ফুল উদয় হয় বুঝলি। ওই দুপুরনাগাদ। এই ফুলটা যেমন৷ রোজ একই ফুল। একই রঙ, একই সাইজ। শুধু গন্ধটা রোজই আলাদা। কিন্তু রোজই মনোরম। আর রাত হলেই শুকিয়ে ঝুরঝুরে হয়ে ধুলো হয়ে যাচ্ছে"।
" তা দারোগাবাবু, এই ভূতুড়ে ফুলটুল শোঁকালেন। গপ্পগুজব করলেন৷ এ'বারে এক কাপ চা খাওয়ান দেখি৷ গলাটা শুকিয়ে কাঠ"।
"খাওয়াব৷ কিন্তু খবরদার বাইরে গিয়ে কাউকে বলবি না যে অমল দারোগা তোকে ডেকে আদর করে চা বিস্কুট খাইয়েছে৷ আমার একটা রেপুটেশন আছে দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী দারোগা বলে৷ পকেটমার এসে আমার সামনে খেজুর করে যাবে, সেই গপ্প ছড়ালে চলবে না"।
হেসে হাত কচলে বললাম, "চায়ের সঙ্গে আবার বিস্কুট কেন৷ চট করে একটা মামলেট ভেজে আনতে বলুন না৷ ফস করে খেয়ে আবার কাজে বেরোই"।
" সে বলে দিচ্ছি৷ কিন্তু তুই আমার প্রবলেমটাকে সিরিয়াসলি নিলি না হরেন"৷ দারোগাবাবু নরম সুরে অভিযোগ জানিয়ে ক্রিং ক্রিং করে বেল বাজিয়ে নিজের আর্দালিকে ডাকলেন।
**
- আজ কী এঁকেছিস বুবলু?
- ফুল৷
- আবার ফুল?
- আবার। এই দ্যাখো বাবা।
- রোজ এই একই ফুল এঁকে কী আনন্দ পাস বল দেখি৷
- আমার ভালো লাগে৷
- এই ফুলটার নাম দিয়েছিস একটা?
- খাবার ফুল।
- সে কী৷ এমন বিটকেল নাম কেন?
- রোজ মা খাইয়ে দেওয়ার সময় আঁকি৷ তাই৷
- বড় অদ্ভুত অভ্যাস করেছিস৷ তা আজ কী খেলি দুপুরে?
- ডাল৷ ভাত৷ আর ডিমসেদ্ধ।
No comments:
Post a Comment