ভীষণ নার্ভাস লাগছে। ভীষণ। এমন একটা বিপদে যে পড়তে হবে সে'টা ভাবিনি। এখন বেলা সোয়া বারোটা। সকাল দশটা থেকে অন্তত বারো গেলাস জল খেয়েছি তবু তেষ্টা কমার নাম নেই। এ'দিকে পেট ফুলে ঢোল, গা গুলিয়ে উঠছে, অন্তত বার সাতেক বাথরুম ছুটতে হয়েছে। হাবিলদার গোলক বটব্যাল মাঝেমধ্যেই ক্রিকেট স্কোর ঘোষণা করে হাড় জ্বালাচ্ছে। আমি মরছি নিজের জ্বালায়, ও পড়ে রয়েছে অস্ট্রেলিয়ার ফলোঅন নিয়ে, ধুরছাই।
তান্ত্রিক অনুপ দত্ত থানায় ঢুকলে বেলা পৌনে একটা নাগাদ। দাঁত বের করে বললে, "সরি দারোগাবাবু, ঘণ্টাখানেক দেরী হয়ে গেল। আসলে এর আগের অ্যাপয়েন্টমেন্টের আত্মাটা মহা ঢিট। খেলিয়ে কাজ ম্যানেজ করতে গিয়ে বেলা হয়ে গেল"।
মেজাজ চড়ে ছিল, দিলাম ধমক; "অনুপ, থানা থেকে আর্জেন্ট কাজে আপনাকে ডাকা হয়েছে। আপনি আমায় অন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেখাচ্ছেন? আপনি জানেন ব্যাপারটা কতটা সিরিয়াস"?
অনুপ দত্তের হাসি মিইয়ে গেল না। চেয়ার টেনে বসে বললে, "তেনারা কি আর পুলিশ-দারোগাকে ডরায় বলুন। নিজেদের মর্জির মালিক। তাঁদের তো আর পদে পদে ওপরঅলাকে কৈফিয়ত দিতে হয় না। যাক গে, এত বেলা পর্যন্ত পেটে কিছু পড়েনি। দু'টো চা নিমকির ব্যবস্থা করুন দেখি"।
অনন্তকে ডেকে চা-ভাজাভুজি দিতে বললাম। সে'সব টেবিলে না আসা পর্যন্ত অনুপ দত্তকে কাজের কথায় টানা গেল না। চারটে পেঁয়াজি আর দু'টো আলুর চপ সাবাড় করে, চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে অনুপ অবশেষে উৎসুক চোখে আমার দিকে তাকালে।
আমি সোজাসুজিই বললাম, "ভারী ফ্যাসাদে পড়েছি অনুপ"।
"নয়ত আর অনুপ দত্তকে ডাকবেন কেন বলুন। আমি তো আর কাশ্মীরি শালওলা নই যে শীতের দুপুরে ডেকে নিয়ে শখের দরদাম করবেন। নিন, কেসটা খুলে বলুন দেখি"।
"বুলেট দস্তিদারকে চিনতে"?
"নতুনপাড়া সুপারস্টার্স ক্লাবের এক্স-সেক্রেটারি? সে'তো এ পাড়ার শারুক্কান ছিল মশাই। কী কেত ছিল। পাড়ার ফক্কর ছেলেছোকরারা বুলেটদা বলতে অজ্ঞান। চাঁদা তুলতে, বেপাড়ায় গিয়ে রঙবাজি করতে, মড়া পোড়াতে, হাসপাতালে রাত জাগতে; বুলেটের জুড়ি মেলা ভার ছিল। মোটরবাইক অ্যাক্সিডেন্টটা সত্যিই আনফরচুনেট দারোগাবাবু। ও ছেলে বেঁচেবর্তে থাকলে পাড়ার নাম উজ্জ্বল করত। তা, ইয়ে, ওঁর আত্মাকে নামাতে হবে নাকি"?
"হবে। আর্জেন্ট"।
"সে কী! কেন"?
"এমএলএ গগন সান্যালের জন্য"।
"এই সেরেছে। গগন সান্যালের হঠাৎ বুলেটের ভূতের দরকার পড়ল কেন"?
"তুমি কি কিছুই শোনোনি"?
"আমি সাধক মানুষ। লোকের গালগল্পে তেমন মন দিইনা। বলুন না দারগোবাবু, কী ব্যাপার"?
"আর বলো কেন অনুপ। হপ্তা-দুই আগে, এক শনিবার সন্ধের পর। গগন সান্যাল নিজের বাড়িতে কী একটা পুজোফুজো দিয়ে গোটা পাড়াজুড়ে গুজিয়া বিলি করে বেড়াচ্ছিল। তা মিথ্যে বলব না, গগন সান্যালের সে এমন হামবড়া ভাব যেন সবার হাতে আড়াই কিলো সাইজের ইলিশ তুলে দিচ্ছে। দিচ্ছিস তো পাতিয়া গুজিয়া, তার জন্য একটা বড় তাসাপার্টি, নাচের দল আরও কত কী। নেহাত এমএলএ মানুষ, লোকে ভয়ভক্তি করে, তাই বড় একটা কিছু বলছিল না। গোল বাঁধল গুজিয়া প্যারেড নতুনপাড়া সুপারস্টার্স ক্লাবঘরের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময়। পাড়ার লোক অবাক হয়ে দেখল গগন সান্যালের চোখ ঠিকরে বেরোচ্ছে, হাত পা বেসামাল ভাবে নড়াচড়া শুরু করেছে। তারপর কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই গগন সান্যাল দু'কান চেপে চেল্লামেল্লি শুরু করেছে "শুয়ার বুলেটটাকে কেউ থামতে বল। থামতে বল"।
"এত কিছু ঘটে গেল? আমি মাইরি বেশির ভাগ সময়ই সাধনায় মগ্ন থাকি কিনা। তাই জানতেই পারলাম না। তা, গগন সান্যালকে কি বুলেট দস্তিদার পাকড়াও করেছিল"?
"ঠিক পাকড়াও নয়। সে মুহূর্ত থেকে নাকি একটানা গগন সান্যাল নিজের কানে বুলেটের কণ্ঠস্বরে বিচ্ছিরি সব খোঁটা শুনে চলেছে। আর সে সমস্ত খোঁটার সঙ্গে থাকছে একটা মর্মান্তিক নাম; গুজিয়া গগনা। আর এ'খবরটা কী'ভাবে যে রাষ্ট্র হয়ে গেল। এখন পাড়ার সবাই গগন সান্যালকে গুজিয়া গগনা বলে ডাকছে। প্রথমদিকে শুধু অপোনেন্টরাই আড়ালে-আবডালে বলে বেড়াচ্ছিল। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই ব্যাপারটা দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ল। সে'দিন একটা মিছিলেও নাকি পার্টিরই একজন ওয়ার্কার বলে ফেলেছে, আমাদের নেতা গুজিয়া গগনাকে ভোট দিন, ভোট দিন। উত্তেজনার বশে বিরিয়ানির প্যাকেট ঘুষ খাওয়া পাবলিক চিল্লিয়ে ফেলছে গুজিয়া গগনার জন্য আমরা বুকের রক্ত দিতে পারি। গতকাল পাড়ার শিল্ড ফাইনালে কমেন্ট্রি করতে গিয়ে প্রফেসর ভোম্বল চাটুজ্জে অ্যানাউন্স করলে, "এ'বারে, বিজয়ী দলের হাতে ট্রফি তুলে দেওয়ার জন্য আমি মঞ্চে আসতে অনুরোধ করছি, মাননীয় এমএলএ মহাশয় গুজিয়া গগনাকে! এমন কী ভদ্রলোকের তিন বছরের নাতিও নাকি আধো আধো সুরে বলছে "আম্মার দাদ্দু গুজ্জিয়া গগন্না"। আর এ'সব শুনে গুজিয়া গগনা, থুড়ি, গগন সান্যাল এক্কেবারে ফায়্যার"।
"কেসটা মর্মান্তিকই বটে। কিন্তু দারোগাবাবু, আমায় কী করতে হবে"?
"গুজিয়া গগনার দাবী...আরে ছি ছি...ছি ছি...আই মীন, গগনবাবু কড়া হুকুম...বুলেট দস্তিদারের ভূতকে নামিয়ে অ্যারেস্ট করতে হবে"।
"ওই বুলেট দস্তিদার মহা বিটকেল ছেলে। ওকে ঘাঁটানো কি ঠিক হবে দারোগাবাবু"?
"শোনো অনুপ, ও'সব বাহানা আমি শুনছি না। এ বয়সে এসে সাসপেন্ড হতে পারব না। যে করে হোক তুমি বুলেট দস্তিদারের ভূতকে রাজি করাও হাজতবাস করতে। ওঁর যা যা ফেসিলিটি চাই, সে ব্যবস্থা আমি করে দেব। কিন্তু ওকে একবার জেলে পুরতেই হবে ভাই অনুপ। আমি না শুনছি না। নয়ত এই গুজিয়া গগনা...আরে ধের ছাই...নিজের জিভ কেটে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে...শালা ট্রেটার টাং...আই মীন...নয়ত গগন সান্যাল আমার জীবনটা দেবে চটকে"।
***
আমি দারোগা মানুষ। আমার বাড়িতে সময়ে অসময়ে ফোন আসবেই। ও'তে আমি ভেবড়ে যাইনা। কিন্তু এই ভোরবেলা ফোন তুলে গুজিয়া গগনা...থুড়ি...গগন সান্যালের ফোন শুনে সামান্য চমকাতে হল। ওঁর সেক্রেটারিকে দিয়ে ফোন করাননি, নিজে ডায়াল করেছেন। মনে হল থ্যাঙ্কিউ জানাতে ফোন করেছেন।
বিগলিত সুরে বললাম, "গুডমর্নিং স্যার। গুড নিউজটা কাল রাতেই আপনার সেক্রেটারিকে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। আশা করি পেয়েছেন"।
"পেয়েছি। বুলেটের আত্মাকে কে নামালে"?
"আজ্ঞে, অনুপ। ভারী ট্যালেন্টেড তান্ত্রিক। ইয়ং কিন্তু এফিশিয়েন্ট। একদিন আপনার অফিসে নিয়ে এসে আলাপ করিয়ে দেব। ভারী মাই ডিয়ার ছেলে"।
"বুলেটের আত্মাকে তোমরা জেলে পুরেছ"?
"একদম। হিউম্যান হিস্ট্রিতে এই প্রথম একজন ভূতকে অ্যারেস্ট করা হল। আপনি ইতিহাসের পাতায় একজন মহানায়ক হয়ে থেকে গেলেন স্যার"।
"মহানায়ক"?
"আজ্ঞে। কংগ্রাচুলেশনস স্যার"।
"দারোগা, তোমার আর ওই অনুপ তান্ত্রিককে আমি জ্যান্ত কবর দেব"।
"আ...আজ্ঞে"?
"তোমাদের চামড়া গুটিয়ে নেব"।
"কী...কিন্তু...শুনুন..."!
"আজকের কাগজের হেডলাইন দেখেছ"?
"ক...কোন কাগজ"?
"যে কোনও কাগজের প্রথম পাতা খুলে দেখ। আমি বরং তোমার সাসপেন্সনের ব্যবস্থা করি গিয়ে"।
ফোন রেখেই ছুটে গেলাম বসার ঘরে। কাগজ খুলে প্রথম পাতাটা টেবিলে ছড়িয়ে দিলাম। হতবাক হয়ে দেখলাম সেই কাগজ আলো করা হেডলাইনঃ
"ভূতকে হাজতে পুরে গিনেস বুকে নাম তুললেন বাংলার গর্ব গুজিয়া গগনা"!
No comments:
Post a Comment