১।
- লজেন্স দেব বড়দা?
- দেবেন?
- দিয়েই দি', নাকি?
- অমন করে বলছেন যখন, দিন। আর তো তিনটে স্টেশন। লজেন্স চুষতে চুষতেই ব্যান্ডেল চলে আসবে'খন।
- মিনিমাম দু'টো লজেন্স লাগবে কিন্তু। তিনটে স্টেশন কভার করতে।
- একটা আদা দিন। আর একটা লেবু।
- ভেরি গুড। আসুন।
- থ্যাঙ্কিউ। তা, বিক্রিবাটা কেমন চলছে?
- রোববারের সন্ধ্যেটা এলেবেলেই থাকে। দেখছেন না, ফাঁকা কামরা।
- আগে কোনটা মুখে দেওয়া যায় বলুন দেখি। আদা না লেবু?
- লেবু আগে। লেবু আগে। লেবু জিভকে শানাবে কিন্তু একটা টক ভাব ফেলে রেখে যাবে। আদা সে টক-ভাব উড়িয়ে দিয়ে পালিশ দিয়ে যাবে।
- ঠিক, ঠিক। আচ্ছা লজেন্সভাই, প্যাকেটে ক'টা করে লজেন্স থাকে?
- পাঁচটা করে। দেব নাকি? একটা আদা আর একটা লেবুর প্যাকেট?
- নিশ্চয়ই।
২।
- এই যে, লজেন্সদাদা, ঘুম ভাঙল?
- আমি...আমি কোথায়...।
- ভবেন সমাদ্দারের বাড়িতে।
- আপনি ভবেন সমাদ্দার?
- আমিই।
- ব্যান্ডেল লোকালে আপনিই আমার থেকে লজেন্স কিনলেন তো...।
- দু'টো লুজ। আর দু'টো প্যাকেট।
- কিন্তু তারপর আর কিছুই মনে পড়ছে না কেন...। আচ্ছা, আপনি কি আমায় কিডন্যাপ করেছেন?
- লজেন্সদাদা, একটা জরুরী কাজের জন্য আপনাকে আমার আস্তানায় নিয়ে এসেছি।
- দেখুন, আমি গরীব হকার। আমায় এ'ভাবে ধরে-বেঁধে রেখে কিন্তু কিছুই পাবেন না। আমার সংসারে আছে বলতে এক ভাই। সে এখন ক্লাস সেভেনে পড়ে। বাপ-মা অনেকদিন আগেই গত হয়েছেন। এখন আমার কিছু হলে সে ভেসে যাবে।
- লজেন্সদাদা। একজন আপনার সঙ্গে কথা বলতে চায়।
- কে? এ'সব কী হচ্ছে!
- আপনাকে ধরে-বেঁধে রাখব বলে নিয়ে আসিনি লজেন্সদাদা। তার সঙ্গে কথা হয়ে গেলেই আপনাকে ছেড়ে দেব।
- কিন্তু কে কথা বলবে? আর তো কাউকে দেখছি না।
- আপনি তাকে দেখতে পাবেন না। তবে তার কণ্ঠস্বর শুনতে পারবেন।
৩।
- দাদা!
- কে? কে?
- আমি অনি।
- অনি, অনির গলা তো এ'রকম নয়। সে তো বাচ্চাছেলে। বারো বছর বয়স, পাতলা গলা...।
- বারো বছর আগে আমায় বয়স বারো ছিল দাদা। তারপর অনেকদিন কেটে গেছে।
- এ'সব কী যাতা কথাবার্তা হচ্ছে অ্যাঁ! কে বলুন দেখি আপনি! এই ভবেন সমাদ্দার ট্রেনে লজেন্স কেনার নাম করে আমায় খামোখা উঠিয়ে এনে এখন হয়রান করছে।
- দাদা, আমি অনিই। তোমার ভাই, তোমার অনু।
- সে এমন দামড়া হল কবে। আর তাকে আমি দেখতে পারছি না কেন। আপনারা আমায় ছেড়ে দিন। আমায় এখুনি বাড়ি ফিরতে হবে। অনু সে'খানে একা আছে। আমি গিয়ে ভাতেভাত বসালে তবে তার কপালে খাওয়া জুটবে।
- দাদা, এ'বার শান্ত হতে হবে তোমায়।
- কী পাগলামো!
- আমি তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। এক রাত্রে তুমি আচমকা আর ফিরলে না। আর কোনোদিনও ফেরোনি। ট্রেন-চাপা। ওই, আপ বর্ধমান লোকালের নীচেই।
- যতসব বাজে কথা...।
- দাদা। আমি ভেসে যাইনি। গ্রাজুয়েশন করেছি। আর গত হপ্তায় একটা কারখানায় ছোটখাটো চাকরীও জুটে গেছে। স্টোরস ডিপার্টমেন্টে। আমি ভেসে যাইনি দাদা। তোমার অনু ভেসে যায়নি।
- এ'সব কী...কেন...তুই সত্যিই অনু?
- দাদা। বাবাকে আমার মনে নেই। তুমি আমার বাপের চেয়ে কম নও। কিন্তু দাদা, এমন ট্রেনে-ট্রেনে ঘুরে বেড়িয়ে কী পাও। রাতের দিকে ফাঁকা কামরায় মানুষজন মাঝেমধ্যে তোমায় দেখতে পারে। ভয় পায়। গত বছর খানেক ধরে একটা আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। সবাই অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে দাদা। লক্ষ্মীটি।
- আমার মাথাটা কেমন...আমি কি মিথ্যে অনু?
- মিথ্যে কেন হবে? তোমার আত্মাটা ঝুটো হতে যাবে কেন। তবে আর কেন দাদা। আমিও তো দাঁড়িয়েই গেলাম। আর লজেন্স হেঁকে ট্রেনে ট্রেনে ঘুরবে কেন। ব্যান্ডেল লাইনের ট্রেনে উঠতে লোকে ভয় পাচ্ছে। এ'বার শান্ত হয়ে বসো। ভবেন সমাদ্দার নাম করা ওঝা। রেলের অফিস থেকে তাকে বহাল করে হয়েছে তোমায় পাকড়াও করতে। আর, আর আমায় ওরা সাহায্য করতে বলেছিল।
- তুই ভালো আছিস তো অনু?
- তোমার জন্য মন কেমন হয় দাদা খুব। কিন্তু তোমার মত এমন মাটির মানুষের আত্মাকে সবাই ভয় পাবে, এ ব্যাপারটা আমার বড় খারাপ লাগে।
- তাই তো। তোর মান-সম্মান নষ্ট হচ্ছে হয়ত। অনু, নিজে মরে ভূত হয়ে গেছি বলে যে দুঃখ, তুই চাকরী পেয়ে জীবনে দাঁড়িয়ে গেছিস জানতে পারে তার বহুগুণ বেশি আনন্দ পেয়েছি রে। আমার আর কোনও আকাঙ্ক্ষা রইল না। আর আমার লজেন্স বিক্রি করার নেই। এ'বারে মুক্তি।
- এই ভবেন সমাদ্দারের আস্তানা ছেড়ে আর বেরিও না। কেমন?
- এই তোকে আমি কথা দিলাম অনু। সমাদ্দার ওঝার পারমিশন ছাড়া আমি আর এক পাও নড়ব না। তুই ভালো থাকিস অনু, কেমন? এ'বার আয়। আমি সামলে নেব'খন।
৪।
- থ্যাঙ্কিউ ডক্টর সমাদ্দার। এ যে এমন শান্ত হয়ে আপনার ছত্রছায়ায় পড়ে থাকতে রাজি হবে, সে'টা আমরা ভাবিনি। রেলওয়েজের পক্ষ থেকে উই মাস্ট থ্যাঙ্ক ইউ এগেন।
- আ ভেরি কিউরিয়াস কেস, আপনাদের এই লজেন্স-বাউল।
- ওই রুটের লোকজন কিন্তু ওকে লজেন্স-খ্যাপা বলে।
- মানুষ ইনসেনসিটিভ, এ আর নতুন কী। তবে আমার কাছে ও বাউলই। লজেন্স বিক্রির প্রতি ওঁর যে ডিভোশন, সেলাম না করে উপায় নেই। মানছি, খালি বয়াম নিয়ে লজেন্স লজেন্স করে ট্রেনে ট্রেনে ঘুরে বেড়িয়ে যাত্রীদের অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। কিন্তু কোনোদিন কারুর অনিষ্ট তো করেনি। তাছাড়া, মানুষটা আগাগোড়া ভালোবাসার। আনফরচুনেটলি, সেই ভালোবাসা দিয়েই ওঁকে বেঁধে রাখতে হল। খুব অপরাধ বোধ হয় মাঝেমধ্যে।
- এ'ছাড়া তো কিছুতেই ওকে কাবু করা যাচ্ছিল না। অ্যান্ড আই এগ্রি উইথ ইউ। লোকটা পাগল...সরি...একটু অসংলগ্ন হলেও...নিপাট ভালোমানুষ। আপনার অ্যাসাইলামে স্বেচ্ছায় থাকতে না চাইলে ওকে হয়ত হাজতে পুরতে হত। কারণ ধরতে গেলেই ও বড্ড ভায়োলেন্ট হয়ে উঠত। আর রেলের অফিসার হয়ে আমাদের তো প্যাসেঞ্জার সেফটিটা ইগনোর করলে চলে না ডক্টর সমাদ্দার।
- আপনাদের সিচুয়েশনটা আমি বুঝি। চিন্তা করবেন না স্যার, ওঁর যথাযথ চিকিৎসা হবে এ'খানে। তবে ট্রমাটা বড্ড সিরিয়াস। ভাবুন, নিজের সন্তানসম ছোটভাইটিকে লাইনে কাটা পড়ে থাকতে দেখেছে। সেই মারাত্মক রিয়ালিটিকে রিফিউজ করা ছাড়া আর ওঁর সামনে কোনও পথ ছিল না। আমার খুব খারাপ লাগছে, সেই মরা ভাইকে জ্যান্ত সাজিয়ে, সেই অভিনয় করে ওকে এখানে আটকে রাখতে হল। তবে ভালোবাসা কী অদ্ভুত জিনিস দেখুন, নিজের মৃত্যুটা বিশ্বাস করে নেওয়া ওঁর কাছে অনেক সহজ, নিজের ভাইয়ের মৃত্যু মেনে নেওয়ার থেকে। এ'ব্যাপারটা বাদ দিয়ে ওকে এ'খানে আনতে পারলে ভালো হত। কিন্তু আই ওয়াজ হেল্পলেস।
- ব্যাপারটা ট্র্যাজিক। ইয়েস। তবে আই মাস্ট কঙ্গ্রাচুলেট ইউ এমন একটা মিরাকুলাস ব্যাপার ঘটাতে পারার জন্য। ওয়েল ডান ডক্টর সমাদ্দার। নাকি আপনাকে সমাদ্দার ওঝা বলে ডাকব এ'বার থেকে?
No comments:
Post a Comment