সকালের ঝকঝকে নীল আকাশ, ফুরফুরে শরতের হাওয়া। একটা জরাজীর্ণ চারতলা স্কুলবাড়ি। ছেলেপিলের দল নেই, বোঝাই যায় ছুটির দিন। তা বলে হইচইয়ের অভাব নেই। অন্তত জনা চল্লিশ লোক মিলে স্কুলবাড়ি আর তার সামনের মাঠটাকে সরগরম করে রেখেছে। চার-পাঁচজন মিলে মাঠের পশ্চিম কোণে স্টেজ বাঁধছে। আর সাত-আটজন বাবু-গোছের লোকজন তাদের "হ্যান করো, ত্যান করো, জলদি জলদি করো" বলে তাড়া লাগিয়ে চলেছে। বাবুরা অবশ্য ভুলেও কাজে হাত লাগাচ্ছে না, পাছে কাজ সময়মত শেষ হয়ে যায়। একটা ঢাউস ফ্লেক্স ব্যানার টানাটানি করে দু'জন লোক হন্যে হচ্ছে, আর একজন মাতব্বর কন্ট্রাক্টর গোছের লোক তাদের ওপর তম্বি করে চলেছে। জনা-দশেক লোক স্টেজের সামনে ভাড়া করা প্লাস্টিকের চেয়ার সাজাতে ব্যস্ত। আর যথারীতি অন্য আর এক বাবুদের দল বিভিন্ন জরুরী ইন্সট্রাকশন দিয়ে ক্রমাগত তাদের কাজে ব্যাঘাত ঘটিয়ে চলেছে।
কিন্তু এই সমস্ত গোলমালকে বিন্দু মাত্র পাত্তা না দিয়ে এক বছর তিরিশের যুবক স্কুলের স্যাঁতস্যাঁতে বারান্দায় একটা ক্লাসরুম থেকে বের করে আনা নিচু বেঞ্চের ওপর বসে একটা মচমচে টেবিলের ওপর ঝুঁকে কিছু কাগজপত্তর মনোযোগ দিয়ে দেখছে। ওঁর নাম অনুপ চ্যাটার্জী, পরনে চেক ফুলশার্ট, কালো প্যান্ট, ঝাঁচকচকে পালিশ মারা কালো জুতো। অনুপের পাশে দাঁড়িয়ে একজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক; উসকোখুসকো চুল, ময়লা হাফশার্টের পকেটে আধ-ঝোলা সস্তা সানগ্লাস, ঢলা প্যান্ট - যে'টাকে পাজামা বলে চালালেও আপত্তি করা উচিৎ নয়। হিসেব কষতে কষতে হঠাৎ সামান্য বিষম খেলেন সেই ধোপদুরস্ত যুবকটি। কাগজ থেকে মুখ তুলে সেই দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে জিজ্ঞেস করলেন;
- সামন্তবাবু,তিনশো চেয়ার দিয়েছেন কেন? আড়াইশোটা বলা ছিল!
- আসলে এত বড় ইভেন্ট। পঞ্চাশটা চেয়ার এক্সট্রা লাগতেই পারে।
- কাজের কন্ট্রাক্ট নিয়েছেন। কথামত জিনিস সাপ্লাই করবেন, সরে পড়বেন। মাথা খাটিয়ে পঞ্চাশটা বেশি চেয়ার দিতে কে বলেছে?
- আসলে আমি ভাবলাম...।
- সাপ্লাই করাটা আপনার কাজ। ভাবার কাজটা আমার। বিল থেকে পঞ্চাশটা চেয়ারের টাকা বাদ যাবে।
- না মানে, ব্যাপারটা ভেবে দেখুন....।
- খাবারের প্যাকেটগুলো কতক্ষণে আসবে?
- এই, আধঘণ্টার মধ্যেই চলে আসবে। আমার ম্যানেজার কমল নিজে হালদারপাড়ার দোকান থেকে ম্যাটাডোরে করে তুলে আনছে। এই খানিকক্ষণ আগেই ফোনে কথা হয়েছে।
- দেখবেন, বাড়তি শ'খানেক প্যাকেট আনিয়ে বসবেন না নিজের মাথা খাটিয়ে।
- আজ্ঞে না। ওই, এগজ্যাক্ট নাম্বারই আসছে।
- স্টেজ বাঁধা, ব্যানার, ফেস্টুন, ভিআইপি আপ্যায়ন, মাইক, জেনারেটর, পাবলিকের জন্য খাবারের প্যাকেট, ভলেন্টিয়ার, মানপত্র, উত্তরীয়...উঁ...প্লাস এইগুলো...উম...।
- হিসেবে কোনও ভুল নেই স্যার।
- যাকগে, শুনুন। বড়সাহেব আর একঘণ্টার মধ্যে এসে পৌঁছচ্ছেন। ওঁর সঙ্গে আর জনাচারেক সিনিয়র অফিসার আসবেন। কাজেই মিনিমাম খানচারেক গাড়ি থাকবে। সে'গুলোর পার্কিং আর ড্রাইভারদের খাওয়াদাওয়া নিয়ে যেন আমায় ভাবতে না হয়...। আর তাছাড়া কলকাতা থেকে কুড়িজন মত রিপোর্টার আসবেন। তাদের যত্নআত্তির ব্যাপারটা আমিই দেখব। কিন্তু আপনি নিজে থাকবেন আমাকে অ্যাসিস্ট করতে।
- আরে সে'সবের জন্য তো আমরা আছি...।
- ভালোই তো কামাচ্ছেন এই ইভেন্টটা থেকে।
- শুধু তো ইনকামের জন্য নয় স্যার। আপনাদের কোম্পানি আমাদের গাঁয়ের স্কুলে এতগুলো টাকা দেবেন। সে টাকা দিয়ে ছেলেমেয়েদের জন্য নতুন বেঞ্চি টেবিল ব্ল্যাকবোর্ড কেনা হবে। কত বড় উপকার বলুন।
- সে গাঁয়ের মানুষ হয়ে নিজের কন্ট্র্যাক্টরির টাকা থেকে বাড়তি কিছু ডিসকাউন্ট দিতে পারতেন তো।
- হে হে হে স্যার। আমরা সাধারণ ব্যবসায়ী। আপনাদের মত বড় কোম্পানি কর্পোরেট সোশ্যাল কাজকর্ম সারতে গ্রামে-গঞ্জে আসছেন। এতে তো আমাদের রুরাল ইকনমিরও ফায়দা, বলুন।
- বাব্বাহ্, গপ্প তো ভালোই জানেন। কিন্তু বলে রাখলাম, পঞ্চাশটা এক্সেস চেয়ারের টাকা আপনার বিল থেকে কেটে নেব।
- বেশ তো। বেশ তো।
- হ্যাঁ, আড়াই লাখটাকার বিল হাঁকছেন। সে'খান থেকে হাজারখানেক এলো কী গেলো তা নিয়ে আপনার ভাবার কথা নয়। শুনুন, আমি একটা সিগারেট খেয়ে আসছি। আপনি ততক্ষণে আমাদের ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থাটা সেরে ফেলুন দেখি। লোকজন এসে পড়ার আগে সে ব্যাপারটা মিটে যাক।
**
স্কুলের পাশেই কেষ্টবাড়ি ঝিল। জায়গাটা নিরিবিলি, মনোরম। সে ঝিলের এককোণে বাঁধানো কয়েকটা সিঁড়ি। সে সিঁড়িতে বসে সিগারেটটা ধরালে অনুপ চ্যাটার্জী। ভারী মিঠে হাওয়া বইছে, চোখেমুখে সে হাওয়া লাগায় চোখ লেগে আসে। কাল রাত্রে যে লজে রাত কাটাতে হয়েছে সে'খানে মশার কামড়ের চোটে অর্ধেক রাত পায়চারী করে কাটাতে হয়েছে। ঝিমুনিটা ভাঙল একটা মিহি কণ্ঠস্বরে; "আপনিই কলকাতার হিউউইট কোম্পানির সিনিয়র অফিসার"?
অনুপ ঘুরে তাকিয়ে দেখলেন এক বছর পঞ্চাশের লোক, পরনে হাফ পাঞ্জাবী আর পাজামা। সৌম্য চেহারা, মুখে স্মিত হাসি। উঠে দাঁড়ালেন অনুপ।
- আমিই হিউউইট কোম্পানির সিনিয়র অফিসার, অনুপ চ্যাটার্জী। আপনাকে তো ঠিক...।
- নমস্কার। আমি সমর মণ্ডল। দীননাথ ঠাকুর জুনিয়র হাই, যে'খানে আপনারা কিছু অনুদান দিতে সম্মত হয়েছেন, ও'খানে আমি অঙ্ক শেখাই।
- নমস্কার। বলুন।
- আমি জানি এমন দুম করে কিছু বলে বসাটা সমীচীন নয়। তবে আপনি ইয়ং কর্পোরেট লীডার। হয়ত ফর্ম্যালিটির তেমন প্রয়োজন নেই।
- বলুন না।
- আপনারা স্কুলে একলাখ টাকা দিচ্ছেন বেঞ্চি-ডেস্ক এই'সব কেনার জন্য। তা'তে আমাদের অনেক উপকার হবে। শুধু...।
- শুধু?
- আমাদের একটা লাইব্রেরী আছে, জানেন। রিসোর্সফুল নয়। সামান্য কয়েকটা বই। বেশিরভাগই ডোনেটেড। বেশিরভাগই পুরনো এডিশনের টেক্সটবুক। লাইব্রেরী নামেই আর কী। ছেলেপিলেরা বড় একটা ঘেঁষে না ও'দিকে। অবশ্য, যাবেই বা কেন। ওদের অ্যাট্রাক্ট করার মত ভালো কোনও গল্পের বইটই তো নেই। রঙিন এনসাইক্লোপিডিয়া গোছের কিছু বই হলেও না হয়...।
- ওহ আই সী।
- মিস্টার চ্যাটার্জী, আমরা কয়েকজন মিলে মাঝেমধ্যে চেষ্টা করি বটে এ বই সে বই জোগাড় করে আনার। কিন্তু তাতে আর কতটা হয় বলুন। আপনাদের তরফ থেকে যদি লাইব্রেরির জন্য একটা কর্পোরেট ডোনেশন পাওয়া যেত...।
- বেশ তো। একটা অ্যাপ্লিকেশন যদি স্কুলের থেকে দেওয়া হয়, তা'হলে আমাদের পরের বছরের বাজেট থেকে কিছু করা যায় কিনা, সে'টা না হয় আমরা কনসিডার করে দেখব...।
- না না, লাইব্রেরীর জন্য লাখটাকার দরকার নেই। হাজার কুড়ি হলেই অনেক জরুরী বই আমরা কিনে ফেলতে পারি...।
- টাকার পরিমাণ যাই হোক, রিলিজ করার প্রসেসটা তো একই। তাছাড়া এই ধরণের কাজে গোটা টাকাটাই আসে আমাদের কর্পোরেট সোশ্যাল রেস্পন্সিবিলিটির ফান্ড থেকে। সে'টা তো লিমিটেড।
- চ্যাটার্জীবাবু, একটু দেখুন না। এই যে এক গাঁ মানুষকে শিঙাড়া, মিষ্টি, কেক খাওয়াচ্ছেন; তার বদলে যদি...। বা এই যে অনুষ্ঠান করছেন, তার এত খাইখরচ...স্পেশ্যাল গেস্ট, মিডিয়া...। সে'সব থেকেই যদি সামান্য কিছু সরিয়ে...।
- সেই খরচ পি-আর ফান্ড থেকে আসে। সে ব্যাপারটা আলাদা।
- আজ্ঞে?
- সে খরচ আলাদা। কোম্পানি একটা স্কুলকে অনুদান দিচ্ছে, সে'টার পাবলিসিটি করতে হবে না?
- ওহ, তাই তো।
- মণ্ডলবাবু। আমি আসি। অনেক কাজ পড়ে রয়েছে। আর, পারলে একটা অ্যাপ্লিকেশন দিন না কলকাতায় এসে। আপনাদের লাইব্রেরী ফান্ডের জন্য। আমি রেকমেন্ড করে দেব'খন।
No comments:
Post a Comment