বছর আষ্টেক আগে৷ কোথায় একটা যাওয়ার পথে হুগলীর কাছে হাইওয়ে ঘেঁষা একটা জায়গায় গাড়ি থামানো হয়েছিল৷ রুখাশুখা খটখটে দুপুর৷ সে'জায়গায় দোকানপাট বড় একটা যে ছিল তাও নয়৷ কিন্তু খিদে এতটাই প্রবল ছিল যে ভাতের হোটেল খুঁজে বের করার ধৈর্য ছিলনা৷ পাশাপাশি দু'চারটে গুমটি গোছের দোকান দেখেই দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম৷
গুমটিগুলোর মধ্যে যে'টাকে সবচেয়ে 'রিসোর্সফুল' মনে হয়েছিল, সে'টার দিকেই এগিয়ে গেলাম৷ কাছে গিয়ে দেখলাম সাংঘাতিক অলরাউন্ডার দোকান৷ চা-বিস্কুট, সিগারেট-বিড়ি, চপ-ঘুগনি, মুড়ি-পাউরুটি; সব মিলে এই অসময়ে এই বেজায়গায় বেশ সুব্যবস্থাই বলতে হবে৷ দোকানি মেসোমশাই একটা ঘটংঘটং শব্দ করে চলতে থাকা টেবিলফ্যানের দিকে পিঠে করে ঝিমুচ্ছিলেন৷ "ফ্রেশ চপ" ভাজা হবে কিনা জানতে চাওয়ায় তার মেডিটেশনে ব্যাঘাত ঘটল৷ তবে ঘুমের চেয়ে খদ্দের জরুরী। অতএব এক ঝটকায় চোখ থেকে ঘুমঘুম ভাব উড়িয়ে জানান দিলেন যে বেসনটেসন গুলে ফের চপ ভাজার ব্যবস্থা করতে সেই বিকেল৷ তবে আশ্বাস দিলেন যে স্টকের আলুরচপ মিয়ানো হলেও স্বাদে যে টপক্লাস।
খিদে পেটে অত বাছবিচার করলে চলে না৷ আর আমার এবং আমার বন্ধুর পেটের মধ্যে চলতে থাকা ছুঁচোর কীর্তনগান বোধহয় মেসোমশাইয়ের কানে পৌঁছেছিল। আমরা শুধু চপের আব্দারই করেছিলাম, উনি আমাদের একটা দরাজ সলিউশন অফার করলেন৷
"ঠাণ্ডা আলুর চপ নিয়ে দুশ্চিন্তা করবেন না। আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি"। আমরা বাক্যব্যয় না করে দোকানের বেঞ্চিতে বসলাম৷ ঝিমিয়ে থাকা মানুষটা আচমকা সাংঘাতিক তৎপর হয়ে উঠলেন৷ একটা টিনের ড্রাম থেকে শালিমারের পুরনো ছোট কৌটোয় খানিকটা মুড়ি তুলে; তা'তে পেঁয়াজ, ছোলা, লঙ্কাকুচি দিয়ে; কয়েকটা ঠাণ্ডা আলুরচপ টুকরো করে তা'তে মিশিয়ে- কড়াইতে অল্প সর্ষের তেলে ফেলে সুট করে ভেজে নিলেন৷ তারপর স্টিলের প্লেটে ঢিপি সাজিয়ে আমাদের হাতে দিলেন৷ চুঁইচুঁই খিদের সঙ্গে ম্যাজিক-মেসোমশাইয়ের আন্তরিকতা মিশে যে কী দারুণ স্বাদের সৃষ্টি হয়েছিল৷ নিমেষে প্রথম প্লেট সাফ করে আমরা দ্বিতীয় প্লেট নিয়েছিলাম৷ দ্বিতীয় প্লেট উড়িয়ে দেওয়ার আগেই মেসোমশাই প্লাস্টিকের কাপে লেবুচা এগিয়ে দিলেন৷ না চাইতেই। মুড়ি-ভরা পেটে সে চায়ের কাপে এক চুমুক দিতেই মেজাজে জেল্লা ফিরে এলো। ভদ্রলোকের সঙ্গে আরও মিনিট দশেক গল্পগুজব করে আমরা এগিয়েছিলাম৷ আমার ধারণা সে'দিন ঝোল-ভাতের থালা পেলেও সেই স্পেশ্যাল মুড়িভাজা লেভেলের তৃপ্তি জোটাতে পারতাম না৷
সে মহাভোজের বছর পাঁচেক পর ফের সে রাস্তা ধরে যাওয়ার সময় সে দোকানের সামনে দাঁড়িয়েছিলাম। তখন শেষ-বিকেলে; শাস্ত্রে সে'টাকে বলে চপলগ্ন। কড়াইভর্তি তেলে আলুর চপ আর ফুলুরি ভেসে বেড়াচ্ছে আর এক বছর কুড়ি-বাইশের চটপটে ছোকরা ঝাঁঝরি দিয়ে তাদের খেলিয়ে খেলিয়ে তোলবার তাল করছে। দোকানের আসবাবে তেমন কোনও রদবদল হয়নি৷ শুধু ঘটঘটানো টেবিল ফ্যানটা হাওয়া, বদলে একটা ছোট মিনিমিনে সিলিং ফ্যান ঝুলেছে৷ আর একদিকের দেওয়ালে একটা তেলচিটে মালা ঝোলানো ছবিতে ম্যাজিক-মেসোমশাই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে।
কড়াই থেকে তুলে আনা আগুন আলুর চপে কামড় বসিয়েও সেই পুরনো অমৃতস্বাদ পাওয়া গেলনা৷ সে দোষ অবশ্য চপের নয়৷ অন্য যে কোনও জায়গায় ও চপ পেলে দশে সাড় নয় দেওয়া যেত নিশ্চিন্তে৷
No comments:
Post a Comment