আমি (এবং আমরা অনেকে) খাবারদাবার নিয়েই লিখি এত লিখি কেন? কারণ আমি (এবং সম্ভবত আমরা অনেকে) লিখিয়ে নই। যা নিয়ে গালগল্প করি, যে ভাষায় হে-হে-হো-হো গুলতানি চালাই; সে'গুলো টুকেবুকে রাখা ছাড়া আমার গতি নেই। আর আমার বেশির ভাগ চিন্তাভাবনা-গপ্প জুড়েই খাওয়াদাওয়া। অথচ আমি আর যাই হোক, খাদ্য-বিশারদ নই। খাওয়ার ইতিহাস সম্বন্ধে আগ্রহ থাকলেও আমি আদৌ তেমন ওয়াকিবহাল নই। সবচেয়ে বড় কথা, আমার খাওয়াদাওয়ার রুটিন শুধু সাদামাটা নয়, রীতিমত একঘেয়ে। আমার ভালোবাসার ঘ্যানঘ্যান শুধুমাত্র ওই পাঁচ-সাতটা পদের মধ্যেই ঘুরপাক খায়। এই বিরিয়ানি নিয়ে আহ্লাদ আর ওই রোল নিয়ে লম্ফঝম্প, এই ইলিশের দাম নিয়ে হাহাকার আর মাংস কষা নিয়ে রোমান্স। আমার সবচেয়ে বড় সমস্যা হল; যা কিছু একবার ভালো লেগেছে, সে গণ্ডীর বাইরে আর পা রাখতে ইচ্ছে করে না। চাইনিজ দোকানে গেলে ওই চাউমিন আর চিলি চিকেনের বাইরে ভাবতে পারিনা। ঘ্যামস্য-ঘ্যাম জায়গার মোমো ম্যাটম্যাটে লাগে, এ'দিকে মনের মধ্যে শুধু ওই অল্পবয়সের রবীন্দ্রসদন মেট্রোর কাছে দাঁড়িয়ে প্লাস্টিকের প্লেট-বাটিতে মোমো আর জোলো স্যুপের কথা ভেবে হাহাকার। সাহেবি-শখে কেনা কনভেকশন ওভেন-ফোভেন জলে পড়ে আছে; আমার শুধু ফিরে ফিরে যাওয়া ওই কড়াইয়ে কষানো মুর্গিতে বা সর্ষের তেলেভাজা ডিমের মামলেটে। ইউটিউব ঘেঁটে খুঁজে পাওয়া দুরন্ত সব হাইওয়ের দোকান খুঁজে হানা দিচ্ছি। কয়েকশো মাইল পাড়ি দিয়ে সে'খানে পৌঁছে খুঁজছি কি? রুটি, ডিম-তরকা আর বিটনুন-চাটমশলা ছড়ানো কাঁচা পেঁয়াজের স্যালাড। ইয়ালম্বা দুরন্ত তন্দুরি মেনু; অথচ আমার দৌড় ওই রুমালি রুটির পাশে চিকেন তন্দুরি। নতুন কিছু, রুটিনের বাইরে কিছু, এক্সটিক কিছু; ভালো কি লাগে না? আলবাত লাগে। তবে যে ভালো লাগায় ধৈর্য বড় কম।
সেই একঘেয়ে খাবারদাবার নিয়ে এত মারাত্মক গদগদ হয়ে দিস্তে দিস্তে বাজে লেখা জমানোর কী মানে?বলি। ও লেখা তো খাবারদাবার নিয়ে আদৌ লেখা নয়। ও'গুলো হচ্ছে সুখদুঃখের ফর্দ। ধরুন কলেজের প্রথম দিন। কলকাতা শহরে সেই প্রথম একা; বৌবাজার থেকে হিন্দু হস্টেল হেঁটে যাওয়ার পথে, মেডিকাল কলেজের উলটো দিকে দাঁড়িয়ে একটা ডিমপাউরুটি কিনে খেয়েছিলাম। একা। মফস্বলের ছেলে সেই প্রথম কলকাতার বুকে দাঁড়িয়ে নিজের পকেট থেকে বের করা বাবার টাকায় সেই মহার্ঘ ডিমরুটি কিনে খেয়েছিল। কলকাতা শহরে নেওয়া ওটাই সম্ভবত আমার প্রথম 'ডিসিশন'। তখন সঙ্গে মোবাইল থাকত না, থাকলে জবরদস্ত ছবি তুলে রাখতাম। তখন ব্লগফ্লগও ছিল না। থাকলে সে ডিম-রুটি নিয়ে অন্তত হাজার শব্দ লিখে রাখতাম (যে'ভাবে ন্যাংচাদা কাঁচকলাকে নিয়ে পদ্যটদ্য করেছিল আর কী)। লেখায় ডিমরুটি থাকত বটে, কিন্তু তার আড়ালে থাকত আমার কলকাতাকে চেনার বুক-ঢিপঢিপ, সদ্য বাড়ি ছেড়ে আসার মনখারাপ আর হঠাৎ লায়েক হয়ে ওঠার এক মারকাটারি অনুভূতি। এমন ভাবেই; কত বিরিয়ানি-বিষয়ক লাফালাফি আদতে শুধুই পুরনো আড্ডা-বন্ধু ফেলে আসার মনকেমন। কত চাউমিনের স্টল নিয়ে লেখা থিসিস আদতে শুধুই ছোটবেলার স্মৃতি ঠিকঠাক ভাবে সাজিয়ে লিখতে না পারার অক্ষমতা। কত মাংসকষার সুবাস আদতে শুধুই গতানুগতিক সংসার আঁকড়ে পড়ে থাকার তৃপ্তিটুকুর ব্যাখ্যা।
আর, এই যেমন আজ।
অফিসের মন কষাকষি। প্রবল বিরক্তি। "সব গ্যালো বুঝি" মধ্যবিত্ত দুশ্চিন্তার গ্রাফে আচমকা স্পাইক। আচমকা কলার টেনে ধরা প্রবল ক্লান্তি। সুট করে মনে হয়, "ধ্যাচ্ছাই, কোনও কিছুই কিছু নয়। সব গাঁজা"। শরীর নয়ডায় পড়ে অথচ মন হিমালয়ে গিয়ে লেতকে পড়ে। এমন সময় দেখা গেল ডিনার টেবিলে দুপুরের ডাল, মাইক্রোওয়েভে গরম করা। ঢিপি করা পছন্দসই চালের গরম ভাত, পাশে একজোড়া ভালোমানুষ টাইপের বেগুনভাজা। আর সদ্য চাটু থেকে নামানো; সর্ষের তেলে ভাজা; জোড়া ডিমের একটা সুরসিক পাত-আলো-করা নরম মামলেট। ব্যাস, হিমালয় ত্যাগ করে মনে ছুট্টে ফেরত এলো বডিতে; তুলসী চক্কোত্তির কণ্ঠস্বর বেজে উঠল বুকের ভিতর - "আরে হল হল, আর কত। এইত্তো আমি। এসেছি তো। এ'বারে দেখো, সব সামাল দেওয়া যাবে'খন। কেমন? কই গো, এ'বার গামছা আর সর্ষের তেলের বাটিটা দাও দেখি। দু'মগ জল ঢেলে আসি"। কাজেই মামলেট-ভাতের ছবি-গল্প খাওয়ার গল্প তো নয়, ও গল্প একান্তই আমার। সে গল্প লেখায় ফেলনা হলেও, আমার জন্য অমূল্য। ব্লগের খাবারদাবার নিয়ে যত লেখা; অতটুকুই আমার আড়াল থেকে মুচকি হাসা বায়োগ্রাফি। বাকি সমস্তই দ্য গ্রেট বাতেলা এক্সারসাইজ।
No comments:
Post a Comment