- দেবুদা।
- আরে কথাবার্তা পরে হবে৷ শ্যামলের পরেই তোকে স্টেজে উঠতে হবে৷ এদ্দিন সাধ্যসাধনা করে তবে তোর কবিতা পড়ার জন্য পাঁচ মিনিটের স্লট আদায় করতে পেরেছি৷ সামান্য দেরী হলে আর তোকে অ্যাকোমোডেট করবে না।
- হোয়াট? তুই খেপেছিস? তোকে পড়তেই হবে৷ অডিয়েন্সে দীপকদা, সুমিত হাজরা আর অরুন্ধতীর মত কেউকেটারা বসে আছে৷ আমি নিশ্চিত একবার তোর মুখে তোর লেখা শুনলে হাজারো বড় অপরচুনিটি আসবে৷ সুমন, ক্যুইক৷
- আহ্, দেবুদা৷ আমার কবিতা পাচ্ছে না৷
- হোয়াট! কবিতা কি ইয়ে নাকি৷
- আমার আচমকা মনে হচ্ছে..।
- তুই অফিস কামাই করে কবি সম্মেলনে এলি, এখন বলছিস পড়বি না কবিতা! ইয়ার্কি নাকি!
- এক কথা বারবার জিজ্ঞেস করছ কেন৷ আমার আচমকা মনে হচ্ছে কবিতা পড়ার কোনও দরকার নেই৷ ইন ফ্যাক্ট, অফিস কামাই করেছি বলে বেশ একটা রিগ্রেট হচ্ছে।
- তোর শরীর ঠিক আছে সুমন?
- তুমি বোধ হয় জিজ্ঞেস করতে চাইছ আমার মাথা ঠিক আছে কিনা৷ তা'হলে বলব এদ্দিন পর মাথাটা ঠিক হয়েছে৷ হঠাৎ বুঝতে পারছি যে চোখের সামনে থেকে একটা পর্দা সরে গেল৷
- কী'সব আগডুম-বাগডুম বলছিস! আর ইউ আউট অফ ইওর মাইন্ড?
- মাথা তোমাদের বিগড়েছে৷ কী পাও এ'সব কবিতা-কবিতা করে শহর মাথায় তুলে? কে পড়ে তোমার ছাপানো লিটল ম্যাগাজিন? তোমাদের কবিতা সবটুকুই তো ফেক আর ফাঁপা। এ পড়ে ওর পিঠ চাপড়াচ্ছে, ও পড়ে এর পিঠ চুলকে দিচ্ছে।
- বড্ড বাড়াবাড়ি হচ্ছে কিন্তু সুমন।
- আমিও বলিহারি৷ ইঞ্জিনিয়ারিং করে এত ভালো একটা চাকরিতে ঢুকে মাথায় যে কী ভূত চাপল..দিনের পর দিন অফিস কামাই করে আমি ভস্মে ঘি ঢালছি।
- সুমন শোন..যাস না..।
- দেখো দেবুদা৷ তোমাদের এই ম্যাগাজিন রইল কি গেল তা'তে কারুর কিছু এসে যায়না৷ ওই দীপক, সুমিত, অরুন্ধতীরা তাও এর ওর পা চেটে নিজেদের একটা স্টেটাস আর সরকারি পেট্রোনেজ বাগিয়ে নিয়েছে। তোমার আছেটা কী? অপ্রিয় সত্যটাও বলে রাখা ভালো৷ তুমি একজন পাতি রেলের ক্লার্ক৷ ঘরের খেয়ে বোনের মোষ তাড়িয়ে কবিতা সম্মেলন করাটাই তোমার জন্য একটা অ্যাচিভমেন্ট। কিন্তু আমার সামনে একটা প্রমিসিং কেরিয়ার আছে৷
- তুই আমায় যত গাল দেওয়ার দে৷ কিন্তু তা বলে, হুট করে লেখালিখি ছেড়ে দিবি?
- পোয়েট্রি ইজ ডেড টু মি৷ এখন যা লেখার সে'টা লিঙ্কডইনেই হবে৷ আসি৷
- স্রেফ আধঘণ্টার মধ্যে এমন কী হল..।
- বোধদয়৷ যাকগে৷ আমি আসি৷ আর প্লীজ আমায় ফোন কোরো না।
****
- নন্দিনী৷ হোয়াট অ্যান অনার টু মিট ইউ৷ আমি সুমন৷ সুমন দত্ত।
- ডমিনিক অ্যান্ড গ্লস্টার্সের সি-ই-ও৷ ম্যাগাজিন কভারের বাইরে আপনাকে দেখতে পাওয়াটা তো আমারই সৌভাগ্য মিস্টার দত্ত।
- প্লীজ৷ আমায় এমব্যারাস করবেন না৷ আর, একটা রিকুয়েস্ট৷ সুমন বলেই ডাকবেন।
- এই ধরণের কর্পোরেট জমায়েতে আমাদের মত কবিদের খাপ খাইয়ে নেওয়াটা খুব একটা সহজ নয়..। ইন ফ্যাক্ট, ইনভিটেশনটা পেয়ে আমি নিজেই খুব অবাক হয়েছিলাম..। আপনাদের পার্টি মানেই তো খানাপিনার সঙ্গে গানবাজনা। আধুনিক কবিতারও যে কর্পোরেট মহলে ডিমান্ড আছে..।
- সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে আপনার কবিতা শুনেছে নন্দিনী৷
- আর আপনি?
- টু বি অনেস্ট উইথ ইউ, আমার কবিতা সম্বন্ধে কোনও ইন্টারেস্টই নেই৷ অন্তত যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলি। কিন্তু আজ আপনার কবিতা শুনে অনেকদিন পর থমকে দাঁড়ালাম, জানেন৷ মনে হল..।
- মনে হল?
- মনে হল দু'দণ্ড জিরিয়ে নিই। কদ্দিন পর হঠাৎ পুরনো পাড়ার কথা মনে পড়ল, জানেন। পুকুরপাড়ে বসে আমি আর তপন ফুটবলের গল্প করতাম। সে'সব বিকেলগুলোর গন্ধ হঠাৎ নাকে ফিরে এলো৷ মায়ের চুলে বিলি কেটে দেওয়া মনে পড়ল৷ বাবার প্রিয় খদ্দরের পাঞ্জাবিটা গালে ঠেকলে যে ভালোলাগা খসখসটা টের পেতাম, সে'টা যেন আবার গালে ফিরে এলো৷ মানে, হঠাৎ এই অফিসপার্টির থেকে যে ছিটকে গেলাম৷ স্রেফ আপনার কবিতা শুনে।
- সুমনবাবু, আর যাই হোক, আপনার মধ্যে কবিতার অভাব নেই।
- হেহ্৷ এককালে হয়ত আমার মধ্যে ছিঁটেফোঁটা কবিতা ছিল৷ তবে এখন আর..। সে যাকগে৷ ইয়ে, একটা থ্যাঙ্ক ইউ বলি৷ আপনার কবিতার মতই, আপনার কথাবার্তা খুবই কম্ফর্টিং৷
- সুমনবাবু, আমি পার্টির ইনভিটেশনটা কেন এক্সেপ্ট করেছি জানেন? আমি এ'সব জায়গা পারতপক্ষে এড়িয়ে চলি কিন্তু৷
- কেন? ইনভিটেশন এক্সেপ্ট করলেন কেন?
- আপনার সঙ্গে দেখা করব বলে৷
- এক্সকিউজ মি? আপনি আমায় চিনতেন?
- ওই, বিজনেস ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ দেখে চেনা নয়৷ আমি আপনাকে সত্যিই চিনি৷
- হেঁয়ালি হয়ে যাচ্ছে নন্দিনী৷
- সুমনবাবু, যদি বলি এর আগেও আমাদের দেখা হয়েছে? আপনার মনে নেই, থাকার কথাও নয়৷ কিন্তু..আমার স্পষ্ট মনে আছে৷
- কবে বলুন তো?
- আমি অবশ্য এই কর্পোরেট জগত কাঁপানো সুমন দত্তর সঙ্গে দেখা করিনি৷
- সে কী৷ তার বাইরে আমার কোনও পরিচয় আছে নাকি?
- আজ থেকে বছর বারো আগে, দেবুদার অর্গানাইজ করা কবিসম্মলেনের স্টজের পিছনে কয়েক সেকেন্ডের জন্য আপনাকে দেখি। অবাক হয়ে৷ মুগ্ধ হয়ে৷ আপনার লেখার যে আমি কী ভক্ত ছিলাম..।
- আমি..আমি যে কী বলব..। ওই দিনটা আমার জন্য একটা..।
- টার্নিং পয়েন্ট? জানি।
- কী জানেন?
- সুমনবাবু। আমি এই পার্টিতে এসেছি আপনার সঙ্গে দেখা করে নিজের দোষ স্বীকার করব বলে।
- আপনার কবিতার ভাষা এত প্রাঞ্জল নন্দিনী৷ কিন্তু আপনি এখন যে কী বলছেন, আমার কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না।
- আপনি ভুডুইজমে বিশ্বাস করেন? তুকতাক?
- কবিতা তো তুকতাকই।
- আমি আমার স্বীকারোক্তি আপনাকে জানিয়ে গেলাম৷ বিশ্বাস, অবিশ্বাস আপনার হাতে৷ আমি আপনাকে ঈর্ষা করতাম৷ ভীষণ৷ কী'ভাবে সে তুকতাক তন্ত্রমন্ত্রের খোঁজ পেয়েছি, সে ব্যাপারে ঢুকে লাভ নেই৷ তবে আপনার থেকে কবিতা শুষে নেওয়ার বিদ্যে আমার ছিল৷ আপনি স্টেজের পিছনে যখন নার্ভাস হয়ে পায়চারি করছিলেন, তখনই আপনার পাশ ঘেঁষে চলে যাই। ওই কয়েক সেকেন্ডেই ঘটে যায় ব্যাপারটা।
- ইউ মীন, আপনি আমার থেকে কবিতা শুষে নিয়েছেন? হিপনোটিজিম প্লাস ব্রেনড্রেন?
- আপনি হেসে উড়িয়ে দিতেই পারেন৷ তবে, ওই যে বললাম। বিশ্বাস অবিশ্বাস আপনার হাতে। কিন্তু ওই দিনটা যে টার্নিং পয়েন্ট ছিল, সে'টা স্বীকার করছেন তো?
- অস্বীকার করি কী করে।
- আমার জন্যও৷ সে'দিন রাত থেকেই আমার একটা নতুন কবিজন্ম হল৷ ঝরঝরিয়ে লিখতে থাকলাম, অবিকল আপনার স্টাইলে৷ আপনারই মত ভাব আর ভাষার দখলসহ। আপনি কবিতা ছেড়ে চলে গেলেন, আর কবিতা আমায় টেনে নিল। একপ্রকার চুরিই বলতে পারেন। তবে নাম, স্টেটাস; সবই পেলাম আপনারই গুণে ভর দিয়ে।
- নন্দিনী৷ যে কবিতাগুলো আজ আপনি পড়লেন, সে'গুলো কি শুধুই ভাষার খেল? না৷ ওই লেখাগুলোর মধ্যে যে অপরিসীম ভালোবাসা, তা তো মিথ্যে হতে পারেনা৷ আপনার স্বীকারোক্তি আপনারই থাক৷ আমি কিন্তু এ মুহূর্তে আপনার গুণমুগ্ধ ভক্ত ছাড়া আর কেউই নই। আজ এতবছর পর, আপনি হঠাৎ কবিতার প্রতি ভালোবাসাটা ফিরিয়ে দিলেন৷ কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা আমার নেই। সে হিসেবে আজকের দিনটাও একটা টার্নিং পয়েন্ট৷ একটা ইউরেকা-বোধ হচ্ছে, কবিতা লেখার ইচ্ছেটা ফেরত এসেছে মনে হয়৷ আচ্ছা, কয়েক মিনিটের জন্য আপনার কলমটা পেতে পারি? আপনার জন্য ক'টা লাইন না লিখলেই নয়।
নন্দিনী কাঁপা হাতে নিজের কলমটা সুমনের দিকে এগিয়ে দিলেন৷ টেবিলের ওপর রাখা একটা ন্যাপকিন নিজের দিকে টেনে নিয়ে তার ওপরই তরতরিয়ে লিখতে শুরু করলেন সুমন; কবিতা৷ নন্দিনীর চোখ ঝাপসা হয়ে এলো, কৃতজ্ঞতায়। তার সঙ্গে একটা পাহাড়প্রমাণ দুঃখ চেপে ধরছিল। সে জানে যে সুমনের কবিতা লেখা শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই তার কবিজন্মের ইতি৷
নন্দিনীর আর কোনওদিনও কবিতা লেখা হবে না।
No comments:
Post a Comment