আমরা যারা ক্রিকেট-হুজুগিস্ট, তাদের চোখ দিয়ে খেলাটাকে বিশ্লেষণ করতে চাওয়া আর শালপাতার দোনায় ইলিশের ঝোলভাত খাওয়া একই ব্যাপার। আমাদের ক্রিকেট-আড্ডায় ক্রিকেটটাই ভেসে যায় বিকট হ্যা-হ্যা-হো-হো অথবা অযথা গলাবাজিতে; তবে সেই ভেসে যাওয়াটা বোধ হয় নেহাৎ অক্রিকেটিয় নয়৷ ক্রিকেট গ্যালারির 'লক্ষ্মী' হল এই হুজুগিস্টরাই (নিজেদের গান নিজেরাই গাইব, তা'তে আর আশ্চর্য কী)। তাদের পাগলামিতেই মেক্সিকান ওয়েভ উত্তাল হয়, স্টেডিয়ামের গেটের বাইরে শস্তা জার্সির হাজারে হাজারে বিক্রি হয়, আধমাইল দূরে দাঁড়ানো প্লেয়ারদের দিকে তাকিয়ে এমনভাবে চেল্লামেল্লি জুড়ে দেওয়া হয় যেন সে কোহলি-রোহিত নয়; পাড়ার বাপ্পাদা, আমাদের ডাক শুনলেই এগিয়ে এসে সিগারেটের কাউন্টার দেবে বা চা-মামলেট কিনে খাওয়াবে৷
যা হোক, সেই ক্রিকেট-হুজুগিস্ট-অ্যাসোসিশিয়েনের অন্যতম সভ্য হিসেবে আজ গেছিলাম ফিরোজ শাহ কোটলায়, ভারত-অস্ট্রেলিয়া সেকেন্ড টেস্টের দ্বিতীয় দিনের খেলা দেখতে৷ একটামাত্র টিকিট জুটেছিল, কাজেই পরিব্রাজকের মত একাই সক্কাল-সক্কাল পৌঁছে গেলাম৷ কোভিডের পর এই প্রথম মাঠে যাওয়ার সুযোগ, একা-দোকা ভাবলে চলবে কেন? তিন নম্বর গেট দিয়ে ঢোকার কথা। ঢোকার মুখে প্রতিবার যা করি, এ'বারও করলাম৷ জার্সি দরদাম; কখনও কিনি, কখনও কিনি না৷ কিন্তু জার্সি বিক্রিবাটা যে'খানে হচ্ছে, সে'খানে গিয়ে খানিকক্ষণ না দাঁড়ালেই নয়৷ আজ খানিক্ষণ বেশ কয়েকটা জার্সি কেনাকাটির জটলায় দাঁড়িয়ে মনে হল কোহলির পর, সবচেয়ে বেশি চাহিদা হল সূর্যকুমারের জার্সির। তারপর রোহিত এবং ধোনি৷ যা হোক, আমি খোকার জন্য সুভ্যেনির হিসেবে একটা জার্সি কিনে নিয়ে মাঠে ঢুকে পড়লাম।
ভিটামিন-ডি-য়ের হয়ে বেশ জোরালো সওয়াল রাখে ফিরোজ শাহ কাটলা৷ বেশির ভাগ দর্শকদের মাথার ওপর ছাত নেই৷ তবে আমি যে অঞ্চলে ছিলাম, সে'খান থেকে পিচের ভ্যিউ চমৎকার। কাজেই খুঁতখুঁত ছিল না মনে৷ ইনিংস শুরুর মিনিট কুড়ি আগেই পৌঁছে গেছি৷ এ মাঠে এই আমার প্রথমবার, তাই সবার আগে টয়লেটের খোঁজটা নিয়ে রাখা দরকার। ইডেনের মতই; সে ব্যবস্থা আর যাই হোক, ঝাঁচকচকে নয়৷ তবে ব্যবহারযোগ্য৷ এরপর গেলাম খাওয়ার জলের ব্যবস্থা দেখতে৷ দুর্ভাগা দেশের ক্রিকেট দর্শক আমরা, ব্যাগ-জলের বোতল ইত্যাদি নিয়ে ঢোকা বারণ (সে দায়ভার অবশ্য আমাদেরই)৷ কাজেই স্টেডিয়ামের ভিতর জলের ব্যবস্থাটা ভালো মত জেনে না রাখলে সমস্যার পড়তে হবে। আমি যে'খানে ছিলাম, সে'খানে কাগজের গেলাসে জল বিক্রি হচ্ছিল, দশ টাকার এক গেলাস৷ ইয়ে, এক বিক্রেতা অবশ্য আধো-গোপন ব্যবস্থাপনায় জলের বোতলও বিক্রি করছিলেন, কুড়ি টাকার বোতল পঞ্চাশে৷ কিন্তু বার বার সীট ছেড়ে উঠে গিয়ে এক গেলাস জল কিনে খেতে হলে ক্রিকেটটা জলে যাবে৷ অগত্যা সেই বোতলই কিনতে হল। খাবারদাবারের মধ্যে আমাদের এলাকায় ছিল তেল চুপচুপে ঠাণ্ডা কচুরি ও শিঙাড়া, রাজমা বা ছোলেসহ ভাত, রকমারি চিপ্স, পপকর্ন, আর কোল্ডড্রিঙ্কস৷ খান চারেক স্টল, তারা মোটামুটি হিমশিম খাচ্ছে। ও'সব বিস্বাদ আইটেমগুলোরও যে কী চাহিদা মাঠের মধ্যে; ক্যাপ্টিভ অডিয়েন্স, তাদের পেটে খিদে, গলায় তেষ্টা, প্রাণে ক্রিকেট৷ এই অদরকারী ক্যাপ্টিভ অডিয়েন্সের জন্য বিসিসিআই যদি একটু মায়াদয়া বাড়াত, তবে বর্তে যেত কত হাজার হাজার ক্রিকেট হুজুগিস্ট৷ তারা সকলে ক্রিকেট বোদ্ধা নয়, অথচ এই অব্যবস্থা অগ্রাহ্য করে দিনের পর দিন তারা মাঠ ভরিয়ে দিচ্ছে, "ইন্ডিয়া ইন্ডিয়া" বলে চিল্লিয়ে কানঝালাপালা করে দিচ্ছে৷ ভালোবাসার যে কী টান। সামান্য পানীয় জলের আশ্বাস, পরিষ্কার খাবারদাবারের ব্যবস্থা, সাফসুতরো বাথরুম আর ছ'সাত ঘণ্টা বসার জন্য আরামদায়ক ব্যবস্থা; এগুলো ব্যবস্থা করা কি খুবই কষ্টকর? কে জানে! হয়ত আমাদেরই দাবীর শেষ নেই। কিন্তু ভারতীয় বোর্ড যেহেতু ব্যবসাটা ভালো বোঝে (এ'টা তীর্যক মন্তব্য নয়, আন্তরিক সেলুট), কাস্টোমার ডিলাইট নিয়ে তাদের কি কোনও মাথাব্যথা থাকবে না? বিশেষত, যখন হোর্ডিংয়ের কদর্যতায় স্টেডিয়ামগুলো দুর্গাপুজোয় কলকাতার রাস্তাঘাটকেও দশ গোল দেবে। না হয় আরও দু'চারটে ব্যানার-ফেস্টুন বাড়লো, কিন্তু দু'দণ্ড আয়েস করে যেন মানুষ খেলাটাকে উপভোগ করতে পারে৷
যা হোক, এ'সব অদরকারী গপ্প থাক৷ হুজুগে ফেরত আসি৷ তবে ইয়ে, ক্রিকেট নিয়ে লিখতে বসিনি৷ গ্যালারির হয়েই লিখছি৷ টিভির ক্রিকেট টেলিকাস্ট দুরন্ত (এবং অপরিহার্য) কারণ ক্রিকেটে অ্যানালিটিকাল অ্যাপ্রিশিয়েশনের প্রচুর সুযোগ রয়েছে, আর আর সে'টার আইডিয়াল মিডিয়াম হচ্ছে টেলিভিশন (বা যে কোনও স্ক্রিন)। তা'হলে মাঠের ম্যাজিক কোথায়? শুধুই গ্যালারির আবেদনে? হই-হল্লা ফুর্তিতে? হুজুগের চোখ দিয়েই বলি, ক্রিকেটও আছে তো৷ ব্যাটার যখন নিখুঁত টাইমিংয়ে মিডঅনের দিকে বল ঠেলে দিয়ে এক রান নিচ্ছেন, টেলিভিশনের অত্যাধুনিক টেকনলোজিও কিন্তু দর্শকের কাছে মাঠে-শুনতে পাওয়া বল-ব্যাটে-পড়ার ঠকাস্ জাদু-শব্দের ইকো পৌঁছে দিতে পারছে না৷ অর্থাৎ বাড়ির সোফায় বসা 'আমি'র কাছে যে'টা স্রেফ 'রোহিত এক রান নিয়ে স্ট্রাইক রোটেট করল' মার্কা নিরামিষ একটা ব্যাপার, মাঠে বসা 'আমি'টি কিন্তু প্রায় লাফিয়ে উঠছি "কী মারাত্মক কন্ট্রোল রেখে খেললো, কী মাপা টাইমিং" বলে৷ আমার পাশের হাজার হাজার মানুষও প্রতিটা ছোটখাটো ঘটনায় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছেন, সেই উচ্ছ্বাস আমায় স্পর্শ করছে, উজ্জীবিত করছে, ইন্সপায়্যার করছে। আবারও বলি, মাঠে বসে ব্যাট-বলের (বা স্টাম্পে-বলের) যে খটাস শব্দ, সে ম্যাজিক টিভিতে ট্রান্সফার করা বোধ হয় সম্ভব নয়৷
আর একটা ব্যাপার৷ রান জমে ওঠার ব্যাপারটা মাঠে বসে যেন আরও একটু গভীর ভাবে অনুভব করা যায়৷ সে'খানে বিজ্ঞাপন বিরতি নেই, পাশের ঘর থেকে হেঁটে আসা নেই, চ্যানেল পালটানো নেই, রেগে টিভি বন্ধ করে দেওয়াও নেই। আছে শুধু ক্রিকেটের অমোঘ সব সংখ্যা। কয়েক হাজার মানুষ সেই সংখ্যাগুলোকে এস্কেপ করতে পারছেন না৷ এই যেমন আজ। অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ইনিংসের রান ২৬৩৷ আজ গোটা দিন এই সংখ্যাটাই মনের মধ্যে ঘুরপাক খেয়েছে৷ একটানা হিসেব করে চলেছি 'ডেফিসিট' আর কত৷ বাড়িতে খেলা দেখতে বসেও তাইই করি, কিন্তু মাঠের উত্তাপের সঙ্গে তুলনা চলে না৷ আজ খেলা দেখে এলাম, আগামী হপ্তাখানেক মনের মধ্যে এই ২৬৩ সংখ্যাটা ভাইব্রেট করে চলবে। এখানে ওভার শেষে বিজ্ঞাপন হচ্ছে না, আছে শুধু ঢাউস স্কোরবোর্ড। মেক্সিকান ওয়েভের ভিড় থেকে উঁকি মেরে দেখছি; স্কোরবোর্ড৷ লাঞ্চ কেনার সময়ও চোখ চলে যাচ্ছে স্কোরবোর্ডের দিকে। প্রতিটা রান যেন ইলিশের দামে কেনা হচ্ছে, বিশেষত কোহলি আউট হওয়ার পর থেকে। প্রায় প্রতিটা রান, প্রতিটা উইকেট এক একটা গল্পের মত মনের মধ্যে সেঁধিয়ে যাচ্ছে। হাতের ফিটনেস ওয়াচ স্পষ্ট বুঝিয়ে দিচ্ছে যে হার্টরেট এক্কেবারে চালিয়ে খেলছে, বাড়ির ড্রয়িংরুমে বসে এই ম্যাচটাই যদি দেখতাম, ধুকপুকানিটা এমন জমাট বাঁধত না৷ অশ্বিন আর অক্ষরের (অক্সর লিখব?) পার্টনারশিপ যখন একশো ছুঁল, মনে হল গোটা দিন বাগানের মাটি কোপানোর পর এ'বার চারাগাছ লাগানোর সময় এসেছে৷ কাজেই হা-হা শব্দে লাফালাফি যে শুরু করবই, এ'তে আর আশ্চর্য কী। কারণ স্টেডিয়ামে থাকা মানে, আমিও যে ওই স্কোরবোর্ডেরই অংশ। স্কোরবোর্ডে গ্যালারির উপস্থিতি নামহীন হতে পারে, তবে অদরকারী নয় কোনও মতেই। তা, এই গ্যালারির খ্যাপাটে মানুষজনদের কথা কি বিসিসিআই আর একটু দরদ দিয়ে ভাববে না? ভাবলে তেমন ক্ষতি হবে না কিন্তু, মাইরি।