Thursday, February 16, 2023

ইউফোরিয়া



~~খিলখিলাতি হ্যায় উয়ো নদীয়া, নদীয়া মে হ্যায় এক নইয়া~~

জমজমাট সূর্যকুণ্ডের মেলা (সুরজকুণ্ড্‌ বলা উচিৎ নাকি?)। অফিসের পর সন্ধেবেলা বিস্তর ট্র্যাফিক ঠেলে সে মেলায় গেছি রকমারি জিনিসপত্র দেখতে, খাবারদাবারের দোকানগুলোয় পেট ভরাতে, আর সর্বোপরি ভিড়ে নাকানিচোবানি খেতে। মেলায় গিয়ে মানুষে যা করে আর কী। ও মা, গিয়ে শুনি সে'খানে পলাশ সেন গান গাইবেন, ইউফোরিয়ার শো শুরু হবে খোলা অ্যাম্পিথিয়েটারে, অবাধ প্রবেশ। "ধুম পিচক ধুম" ফেনোমেনাটা একসময় মজ্জায় এসে মিশেছিল। নিজেকে সঙ্গীত-বোদ্ধা বলে লোক হাসানোর মানে হয়না। তবে গানের প্রতি ভালোবাসায় খানিকটা অবুঝ না হলেও চলে না বোধ হয়। আমার ডানা গজানোর বয়সে সেই গান আবিষ্কার করি। এখনও মনে আছে, আমাদের স্কুলের একটা অনুষ্ঠানে আমার কিছু ক্লাসমেট সে গান গেয়ে আসর জমিয়ে দিয়েছিল। সে বয়সে প্রথম প্রেমের হুহু, সেই হুহুর সঙ্গে যে'সব গান এসে মিশে গেছিল, তাদের মধ্যে এই ধুম-পিচক-ধুম অন্যতম। এ অভিজ্ঞতা আদৌ অভিনব নয়, আমার বয়সী অনেকেই এ ব্যাপারটা ধরতে পারবেন। চন্দননগরের অলিগলি দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছি দুই বন্ধু, আর দু'জনে বিশ্রী বেসুরো গলায় চিল্লিয়ে গাইছি 'মায়েরি' বা 'ক্যায়সে ভুলেগি মেরা নাম'। স্বস্তির ব্যাপার হল যে নিজের বেসুর নিজের কানে বাজে না। যা হোক, এহেন ইউফোরিয়ার গানের আসর, সে নিশির ডাক উপেক্ষা করি কী করে। কাজেই আমরা দ্যাবা-দেবী সেই খোলা মঞ্চের সামনে চলে গেলাম। ভিড় সত্ত্বেও জায়গা বাগিয়ে নিতে অসুবিধে হল না।




~~কেহতা হ্যায় যো কহে জমানা, তেরা মেরা পেয়ার পুরানা~~

আমাদের আশেপাশে যারা বসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগের বয়সই মনে হল আমাদের চেয়ে হয়ে বেশি খানিকটা কম অথবা বেশ খানিকটা বেশি। মোদ্দা কথা টীম 'নাইনটিজ'কে মাইনরিটিই মনে হল। যা হোক, একসময় স্টেজে একটা স্ফুলিঙ্গের মত উদয় হলেন পলাশ সেন, অকারণ সময় নষ্ট না করে গান ধরলেন। অমনি সেই ছোটবেলার গন্ধ-দৃশ্যগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠল। তেমনটাই তো হওয়ার কথা ছিল। ওই সূরজকুণ্ডের হৈহল্লার মধ্যে কেউ বাংলার মফস্বলের বিকেল আর টিউশনি-ফেরত সাইকেলের ক্যাঁচরম্যাচর মিশিয়ে দিল যেন। আমরাও দিব্যি গালে হাত রাখে শুনতে আরম্ভ করেছিলাম। আচমকা মেজাজের সুতো ছিঁড়ে দিলেন পলাশ সেন নিজেই, বললেন "এই যে দাদা-বোনেরা, আপনারা কি গা এলিয়ে শুয়ে বসে গান শুনতে এসেছেন নাকি? রামোহ্‌ রামোহ্‌! আরে আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়ান দিকি। লম্ফঝম্প করতে হবে তো। আমি তো আর ভজন-গজল গাইতে আসিনি, চেল্লাতে এসেছি। কাজেই নেহাত আর্থ্রাইটিসের ঝামেলা না থাকলে, দাঁড়িয়ে পড়ুন, গর্জে উঠুন"। কী বলি, আমি ছাই গানটান বুঝি না। আমার ছেলেবেলার হিরো আওয়াজ দিচ্ছে, আমি সেলাম ঠুকবো; আমার কাছে ও'টাই হল গিয়ে মূল এন্টারটেইনমেন্ট। কাজেই ডাক্তার সেনের দাবীমত নির্দ্বিধায় সেই বাঁধানো সিমেন্টের বসার জায়গা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। দাঁড়িয়ে টের পেলাম, ইতিউতি দু'চারজন দাঁড়িয়েছেন বড়জোর, পাবলিকের গড়িমসি তখনও কাটেনি। মনেমনে চিৎকার করে উঠলাম, "এ কী! ক্লাসরুমের মধ্যে স্যার দাঁড়াতে বলেছেন! এর পরেও বসে থাকাটা কেমন বেয়াদপি"! যাকগে, সে বেরসিকদের পাত্তা না দিয়ে বেখাপ্পা ভাবে পলাশবাবুর গানের তালে ড্যাংড্যাং করে দু'হাত হাওয়ায় ছুঁড়তে শুরু করলাম।




~~যতন করে রাখিব তোরে মোর বুকের মধ্যে মাঝি রে~~

পলাশ সেন ধরলেন "ধুম পিচক ধুম"। আমরা যারা 'নব্বুইয়ের মাল' সে এলাকায় ছিলাম, তাঁরা সবাই খ্যাপা বাউলের মত দুলে চলেছি। আমরা সংখ্যালঘু হতে পারি, মধ্যবয়সী ভারে সামান্য ন্যুব্জ হতে পারি। তা বলে ইউফোরিয়ার গানে বিসর্জন-নাচের মোডে ঢুকে যাব না? আরে! পলাশ সেন চেঁচিয়ে বলছেন "আ রে মেরি ধড়কন আ রে"। এ ডাক শুনে কে না লাফিয়ে থাকতে পারে? অবাক হয়ে দেখলাম অনেকেই পারেন। পলাশ সেনও মহাঢিঁট মানুষ দেখলাম। বেশিরভাগ জনতা চেয়ার ছেড়ে দাঁড়াবেন না, পলাশবাবুও তাঁদের স্বস্তি দেবেন না। খুব হিসেব কষে, 'ধুম পিচক ধুম' গানের শেষে সামান্য ব্যাকফুটে গেলেন পলাশবাবু। ততক্ষণে ভদ্রলোকের রোখ চেপে গেছিল বোধ হয়। আচমকা একের পর এক নতুন হিট গান গাওয়া শুরু করলেন, ধরলেন হিট সব পাঞ্জাবি গান; এমন কি "কালা চশমা"ও বাদ গেল না। মাইরি, অমন মারাত্মক লাফঝাঁপ করে গেয়ে যাচ্ছিলেন ভদ্রলোক, অথচ গলায় ক্লান্তি নেই, সুরে দুলকির অভাব নেই। এই অ-ইউফোরিও ডিস্কোঝড়ে গলল পাথর। জমে উঠল আসর, মানুষজন সত্যিই মেতে উঠল, জমে উঠল গানের মেলা।


~~ Crescendo /krɪˈʃɛndəʊ/
the highest point reached in a progressive increase of intensity ~~

এরপরেই তুরুপের তাসটা বের করে আনলেন পলাশবাবু; ধারালো জাদুতে শ'পাঁচেক মানুষের পায়ের তলা থেকে কার্পেট উড়িয়ে দিলেন। গাইতে শুরু করলেন "মায়েরি"। আর এমন গাইলেন, যে স্রেফ ওই একটা গান শোনার জন্য শ'খানেক মাইল পথ হেঁটে যাওয়াই যায়। আর সে গানটাই গোটা সন্ধেটাকে অন্য স্তরে নিয়ে চলে গেল, সে'খান থেকে আর ফিরে তাকানোর উপায় নেই। গা ভাসিয়ে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। পরের একটা ঘণ্টা পলাশবাবু যদি খবরের কাগজ পড়েও শোনাতেন, তা'হলে সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনে যেত। সবচেয়ে বড় কথা, ঠিক ওই মায়েরি পার্ফর্ম্যান্স থেকে নব্বুই-অনব্বুইয়ের তফাৎটা ধুয়ে-মুছে গেল। দর্শকাসনের প্রতিটা মানুষ তখন ইউফোরিয়ার সামনে নতজানু, এবং খানিকটা 'ইউফোরিক'ও বটে। আর সে গান শুনলে যেমনটা হওয়ার কথা আর কী, পলাশবাবুর গলার দাপট আর সে সুরের মায়া টেনে নিয়ে গেল কৈশোরের প্রেমে। এবং ভেবে অবাক হলাম, সেই ছেলেবেলার প্রেম আর ভালোবাসার মানুষে আটকে নেই। পাড়ার চেনা গলির ল্যাম্পপোস্টের গায়ে হেলান দেওয়া হিরো ইম্প্যাক্ট সাইকেল, চেনা চায়ের দোকানের বেঞ্চি, পিঠে ঝোলানো পড়ার বইয়ের ব্যাগের মধ্যে রাখা টেনিসবল; সমস্তই বড় অনাবিলভাবে ফেরত এলো। পলাশ সেন ততক্ষণে শ্রোতাদের মনঃপ্রাণ দখল করে ফেলেছেন। আর নব্বুই ব্র্যান্ডের আমরা যেক'টি প্রডাক্ট ইতিউতি ছড়িয়ে ছিলাম, তাঁরা সবাই অন্যান্য মুগ্ধ শ্রোতাদের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে চলেছি, "কেমন দিলাম"? আসলে, আমরাই তো তখন ইউফোরিয়া।

No comments: