Saturday, February 25, 2023

কবিতা কাহারে বলে, গান কাহারে বলে



মগজ ব্যাপারটা যে কী ধুরন্ধর চিজ। আর আমার মত গাম্বাট মানুষের মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য আমাদের নিজেদের মাথাই যথেষ্ট।

আমার বুকশেলফে, কোনও অজানা কারণে কয়েকটা কবিতার বই আছে। কলকাতার কম্বলদের মতই, সে'সব বইদের সচরাচর ঘাঁটানো হয়না। আবার কলকাতার মানুষের মতই, আজ হঠাৎ উথলে ওঠা হুজুগের বশে সে'সব কম্বল...থুড়ি বইদের তাক থেকে নামালাম। উল্টেপাল্টে দেখেটেখে, ধুলোটুলো ঝেড়ে তাকের বই তাকে ফেরত যাবে, তেমনটাই হওয়ার কথা। কী মনে করে দু'একটা কবিতা পড়ার চেষ্টা করলাম। খানিকটা শক্তি, খানিকটা সুনীল, খানিকটা শঙ্খ। নিজের ওপর গর্ব হচ্ছিল, কবিতা পড়ছি ভেবে। আরে, কবিতা মানে গানই তো, সুরটাকে নিজের মত মনে মনে বসিয়ে নিলেই অ্যাপ্রিশিয়েশন ব্যাপারটা তরতরিয়ে বইবে। 

যা হোক, সে'সব কবিতার বইয়ের ফাঁকে একটা বই ছিল রবিস্যারের শ্রেষ্ঠ কবিতার। সে'গুলো বেছে নিয়েছেন সুনীল গাঙ্গুলি স্বয়ং। বইয়ের শুরুতে একটা চমৎকার মুখবন্ধ লিখেছেন সুনীল; শিরোনাম - "রবীন্দ্রনাথ এবং আধুনিক কবিতা"। কবিতা বুঝিনা, তায় আবার আধুনিক। রবীন্দ্রনাথ বুঝি, সে'কথা বলার দুঃসাহসও নেই। তবে বাংলা ভাষাটা যেহেতু খানিকটা বুঝি, তাই মুগ্ধ হয়ে পড়াটা ঠেকায় কে।

তা সেই বইয়ের দ্বিতীয় কবিতা একটা গান; সখী, ভাবনা কাহারে বলে। অনেকের মতই, এ গানটা আমার মুখস্থ; কমা, ফুলস্টপ, হাঁচি, বিষম সহ। আমার গলায় সুর নেই, প্রাণে কবিতা নেই; অথচ এ গান গাইতে গিয়ে হোঁচট খাওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই। কাজেই, কবিতা হিসেবে এই গানটা বইয়ের পাতায় ছাপা আছে দেখে প্রথমেই মনে হল; এ পড়ে হবেটা কী, পুরোটাই কণ্ঠস্থ তো। চোখ বুজলেই এ গান কানে-বুকে বেজে উঠবে; মায়ের গলায়, শ্রাবণী সেনের গলায়। সে গান আবার বইতে পড়তে যাব কেন?

তবু। মানুষ হয়ে জন্মেছি যখন, হিসেবের বাইরে পা না রাখলে চলবে কেন? শুরু করলাম পড়া। এ'খানেই সেই মগজের চমক। আমি যা লিখছি তা হয়ত গোটাটাই অযৌক্তিক; তবে যুক্তিবাজ হলে কী আর ব্লগ লিখে লিঙ্ক শেয়ার করে মানুষজনকে জ্বালিয়ে মারি। কাজেই লিখেই রাখি। কী অদ্ভুত, মুখস্থ একটা গান; সে'টাকে যখন সাদা কাগজের ওপর কালো ছাপা অক্ষরে পড়ছি; কানের বদলে চোখ অ্যাক্টিভেট হচ্ছে, চেনা সুর আবছা হয়ে একটা অন্য রিদম আবিষ্কার করছি এ লাইন থেকে ও লাইনে যাওয়ার সময়। এ গানের সুরের ম্যাজিক বর্ণনা করার দুঃসাহস আমার নেই। কিন্তু কবিতাটা পড়তে গিয়ে, সে সুর সরে গিয়ে যে'টা পড়ে রইল; সে'টাকেও একটা অন্য জাতের জাদু হিসেবে মগজ চিনে নিল। প্রতিটা শব্দই পূর্বপরিচিত, অথচ পড়তে গিয়ে দেখলাম তারা সক্কলে অন্য মেজাজে উঠে দাঁড়ালে। গানের মানে পালটে গেল না, তবু সে কবিতাটা গানের থেকে আলাদা হয়ে ধরে দিল যেন। সে লেখা সুরের সঙ্গে মিলে একটা জলতরঙ্গ সৃষ্টি করেছে বটে, কিন্তু কথাগুলো সুরের কাঁধে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে নেই। সুর বাদেও তাদের অস্তিত্ব জোরালো; জমজমাট।

একটা নতুন কবিতা পড়ে ফেলল মগজ। বহুবার শোনা গানটার সঙ্গে যাকে গুলিয়ে ফেললে চলবে না কিছুতেই। ভাগ্যিস সুনীলবাবু এ গানকে "রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ কবিতা"র বইয়ের প্রথম দিকেই চালান করেছেন। নয়ত টের পেতাম কী করে সুরের পরিচয়টাই কবিতার জন্য শেষ কথা নয়? আর আমাদের মত গদ্য-গাম্বাটদেরও কবিতার জগতে স্থান আছে, সে'টাকেও ক্লেম করতে হবে তো।

No comments: