১।
চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল। তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে'টা আছে, সে'টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড়। এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত। তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে। কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা। সে মাংস নিয়ে ফিরছে। হোক না মোটে আড়াই'শ গ্রাম, তবু, কচি পাঁঠা বলে কথা। সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে। তোফা! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল।
গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল। ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে। দু'একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা। ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ। বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ। খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি।
খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের। সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে। গানের ফুর্তিতে সে আর টের পেলেনা যে একজোড়া বিটকেল লোক সত্যিই তার পিছন পিছন ঘুরে বেড়াচ্ছে।
২।
রবীন্দ্রনাথ আকাশকুসুম ভাবতে ভালোবাসে। কল্পনায় সে দেখেছিল উনুনের ওপর মাংসের কড়াই, তার সামনে উবু হয়ে বসে বউ। বউয়ের মুখে মিঠে হাসি, চোখে ভালোবাসা। বাতাসে পেঁয়াজ রসুনে গরমমসলায় মাংস ভাজা ভাজা হওয়ার গন্ধ। এমনটাই তো হওয়ার কথা। কিন্তু বউটা দিন দিন যাচ্ছেতাই হয়ে যাচ্ছে। অত বড় একটা ব্যাপারটাকে সে পাত্তাই দিল না। বাড়ি পৌঁছনোর পর থেকে বউয়ের গজরগজর শুরু হয়েছে। মাংস ধোয়া হয়ে গেল, নুন হলুদে মাখা হয়ে গেল। তবু গজরগজর থামবার নাম নেই।
গজরগজর কী নিয়ে? ওই, অভিযোগের ফর্দ। বাড়ির চাল সারাই না করলে বিপদ, দু'ফোঁটা বৃষ্টিতেও নাকি পথে বসতে হবে। কথাটা মিথ্যে নয়। তা বলে এমন মুখচোপা করে বলার কী আছে? এরপর নাকি খোকার নতুন একজোড়া জামা প্যান্ট না কিনলেই নয়। যা আছে তা পরে ভদ্র-বাড়িতে ঘুরতে যাওয়া যায় না। এ কথাটাও মিথ্যে নয়। কিন্তু বউয়ের মুখের কী তেজ। বাপ রে বাপ! এর সঙ্গে আরও কত ঘ্যানঘ্যান। এ'টা নেই, ও'টা নেই; শুধু নেই নেই নেই আর নেই। উফ! হাড় জ্বালিয়ে খেলে। এমন ভাবে মাংসের ঝোল খাওয়ার থেকে যে ফলিডল খাওয়া ভালো তা রবীন্দ্রনাথ বেশ জানে। তবু বউয়ের ওপর কথা বলতে সাহস পায়না। বউয়ের দাবী, পয়লা বোশেখের আগেই ঘরের যাবতীয় অভাব মিটিয়ে ফেলতেই হবে।
আরে! রবীন্দ্রনাথ কি মিলের বড়বাবু না ইলামবাজারের কন্ট্রাক্টর? টাকা কি গাছে ঝুলছে নাকি! তার পোশাকি পরিচয় ছোলাভাজা বিক্রেতা কাম বাউল। কিন্তু আদতে রবীন্দ্রনাথ পকেটমার, তবে সে পরিচয়টা সে খুব একটা ফলাও করে না। দুপুরের দিকে বোলপুরের বাজারে ঘুরে ঘুরে ছোলাভাজা বিক্রি করে। মিথ্যে বলে লাভ নেই, তার হাতের ছোলা মাখার স্বাদ বেশ টানটান। বিকেলের দিকে ছোলাভাজার ঝুড়ি সাইড করে একটা গেরুয়া গায়ে চাপিয়ে আর একখানা দোতারা হাতে নিয়ে যায় টুরিস্ট স্পটগুলোতে। বিশেষত বিশ্বভারতীর আশেপাশে ছুটির দিনগুলোতে দিব্যি ভিড় জমে। সে'খানে ঘুরে ঘুরে গান শুনিয়ে ভালোই আয় হয়। রবীন্দ্রনাথের গলায় সুর নেই ছিটেফোঁটাও। কিন্তু টুরিস্ট বাবু-বিবিরা সুরের পরোয়া করেনা। গায়ে গেরুয়া আর হাতে দোতারা দেখলেই তাদের তৃপ্তি। তাঁরা গান শুনতে চায় না, ক্যামেরায় ছবি তুলতে চায়। আর এইসব হৈহল্লার ফাঁকে পকেট কাটে রবীন্দ্রনাথ। চোর-লাইনে রবীন্দ্রনাথের পকেটকাটা হাতের সুনাম আছে। কিন্তু এত পৈতৃক ধারদেনার দায় তার কাঁধে, যে অভাব আর কাটতে চায় না।
বউ যে সব বোঝে না তা নয়। কিন্তু মাঝেমধ্যে যে কী হয়। গেরস্থালীর অভাব-অভিযোগগুলো নিয়ে দক্ষযজ্ঞ লেগে যায়। রবীন্দ্রনাথ ভেবেছিল হয়ত এই আড়াইশ গ্রাম মাংস দিয়ে বউকে দিন-কয়েক ঠাণ্ডা রাখা যাবে। কিন্তু ফল হল উলটো।
একটা সময়ের পর বউয়ের মুখ ঝামটা আর সহ্য করতে পারল না রবীন্দ্রনাথ। এমনিতে সেই মিউমিউ করা মানুষ। সাতচড়ে রা কাড়ে না। কিন্তু সে'দিন হঠাৎ মাথাটা গেল ঘুরে।
হুট করে দাঁড়িয়ে বললে,
"অনেক হয়েছে বউ, শুনে রাখ। এক কাঁড়ি টাকা জোগাড় করে তবে আমি ফিরব। ওই মাংস এ'বার তুই একাই গেল"।
রবীন্দ্রনাথের এহেন মেজাজ দেখে বউ সামান্য থতমত খেলে। তা দেখে রবীন্দ্রনাথের সাহস গেল বেড়ে। সে ঠিক করলে যে বাড়ি থেকে রাগ দেখিয়ে বেরিয়ে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
৩।
বাড়ি থেকে রাতের বেলা রাগ দেখিয়ে বেরিয়ে এসে বউয়ের পিলে চমকানো তো হলো। কিন্তু এক কাঁড়ি টাকার ব্যবস্থা হবে কী করে? বউয়ের কথাগুলো তো মিথ্যে নয়। বাড়িটার বড়ই দুর্দশা। টাকাপয়সার এত অভাব। বড়লোক না হলে সোয়াস্তি নেই। যাকগে।
হাজার-গণ্ডা কথা চিন্তা করতে করতে মাইল দুয়েক পথ হেঁটে ফেললে রবীন্দ্রনাথ। নতুনবাজার পেরিয়ে ছোটপুলটার ওপর উঠতেই ফের রবীন্দ্রনাথের মনে হল কেউ যেন তার পিছু নিয়েছে। রাত গভীর। যদিও রবীন্দ্রনাথ নিজেও বিশেষ সুবিধের লোক নয়, পকেটে একটা লকলকে ব্লেডও রয়েছে। তবে বুকটা একটু ছ্যাঁত করে উঠল। কে লেগেছে পিছনে?
আচমকা রবীন্দ্রনাথের মনে হল বাড়ি থেকে এমন হুট করে বেরিয়ে আসাটা ঠিক হয়নি। আর এতক্ষণে মাংসের কড়াই নিশ্চয়ই নামিয়ে ফেলেছে বউ। ছোটপুলের মধ্যিখান থেকেই রবীন্দ্রনাথ ঘুরে দাঁড়াল। আর তখনই, দু'জন পেল্লায় লোক ঝাঁপিয়ে পড়ল রবীন্দ্রনাথের ওপর।
৪।
- তুই তো রবীন্দ্রনাথ।
- আজ্ঞে।
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর?
- আজ্ঞে।
- রস কম নয়। বোলপুর কাঁপানো পকেটমার, তার নাম আবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
- আজ্ঞে।
- আমায় চিনিস?
- আজ্ঞে, চোরছ্যাঁচড় মানুষ হয়ে আপনাকে চিনব না? আপনি হরি মোহান্ত। ইলামবাজার অঞ্চলের নমস্য জোচ্চোর। আমার বড় পিসেমশায় আপনার দাদামশায়ের ডাকাত দলে কাজ করতেন। তা মোহান্তবাবু, আমার মত পাতি পকেটমার বাউলকে ধরে আনার কী দরকার। খামোখা আপনার মাইনে করা দু'টো লোক আমার পিছন পিছন ঘুরে দিন নষ্ট করল। আপনি ডাক দিলেই আমি ছুটে আসতাম।
- তোমার কপাল ভাবো রবীন্দ্রনাথ। হরি মোহান্ত ইলামবাজার থেকে বোলপুর ছুটে এসেছে তোমার সঙ্গে দেখা করতে।
- এ আমার পরম সৌভাগ্য কর্তা। বলুন না, কী সেবা করব আপনার।
- সেবা? সে কী হে। তুমি তো আমার ভৃত্য নও। আমি তোমায় পার্টনার করতে এসেছি।
- পকেটকাটা রবীন্দ্রনাথ হবে হরি মোহান্তর পার্টনার? লজ্জা দেবেন না কর্তা। লজ্জা দেবেন না।
- বাজে কথা বলার লোক তো আমি নই বাবা রবীন্দ্রনাথ। শোনো, একটা ছোট কাজ তোমায় করে দিতে হবে। না শুনছি না।
- হুকুম করুন না।
- আজ রাত দু'টো পর। আমার ছেলেপিলেরা তোমায় বিশ্বভারতীর মিউজিয়ামের বারান্দায় ছেড়ে দিয়ে আসবে।
- ও মা। সে কী। কেন? অতরাত্রে সে'খানে গিয়ে কী হবে? ঢুকতে দেবেই বা কেন?
- সে দায়িত্ব আমার। তোমায় ভাবতে হবে না। আমি জানি যে পকেটমার রবীন্দ্রনাথ শুধু পকেট কাটতেই সিদ্ধহস্ত নয়। আশেপাশের তিনটে জেলায় তোমার মত তালা কাটতে কেউ পারে না। আমার লোক তোমার সে'খানে পৌঁছে দেবে, আর তুমি পাবে পনেরো মিনিট সময়। আমরা যে'টা চাইছি, সে'টা পেতে অন্তত সাতখানা তাল খুলতে হবে। আর অত অল্প সময়ের মধ্যে, একা তুমিই এ'কাজ করতে হবে রবীন্দ্রনাথ।
- হে হে হে...আজ্ঞে, শিল্পের জন্য আমি যাকে বলে...ওই যে যাত্রার ডায়লগে শুনেছিলাম...নিবেদিত প্রাণ...এ'ছাড়া আমাদের আর কীই বা আছে বলুন কর্তা...। তা মিউজিয়ামের থেকে কী হাতাতে হবে?
- সোনার মেডেল। আমার সাগরেদ ছাতু তোমায় বুঝিয়ে দেবে।
- আর কর্তা, আমি কী পাব?
- তোমার ভাগ আমি নগদে দেব, বুঝলে। সে মেডেলে যা সোনা আছে, তার অর্ধেক সোনার দাম। ধারবাকি নয়, হাতে হাত মিটিয়ে দেব। কী বাবা রবীন্দ্রনাথ? মনে ধরেছে?
৫।
হাতে সোনার মেডেলটা নিয়ে মুচকি হাসলে রবীন্দ্রনাথ। সে ছোলাভাজা বেচা পকেটকাটা গবেট হতে পারে, কিন্তু ঘাসে মুখ দিয়ে চলে না। সে জানে এ'টা নোবেল। এ নোবেলে তার নয় বটে, অথচ তারই নামের। আহা, বেশ ওজন আছে গো। অন্তত দু'শো গ্রাম তো হবেই। সোনা ভরি কত করে আজকাল কে জানে। অবশ্য রবীন্দ্রনাথ বেশ জানে যে এ জিনিসের দামের হিসেব শুধু ওজন দিয়ে চলে না। সে যাক গে, মোহান্তর সঙ্গে যা কথা হয়েছে তার খেলাপ করা চলে না। একটা শিস দিয়ে মোহান্তর চ্যালা ছাতুকে জানান দিল কাজ হয়ে গেছে। যাকগে, সোনার দাম অর্ধেক আদায় করতে পারলেও দিব্যি বাড়ির চালটা সারিয়ে নেওয়া যাবে বোশেখ পড়ার আগেই। খোকার দু'জোড়া জামার সঙ্গে বউয়ের একটা ছাপার শাড়ি আর নিজের জন্য দু'প্যাকেট সিগারেটও কেনা যেতে পারে। মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে উঠলো রবীন্দ্রনাথের।
৬।
কোপাইয়ের ধারের জলাজঙ্গল।
নিঝুম রাত।
সোনার মেডেলটা মোহান্তর হাতে তুলে দিতেই রবীন্দ্রনাথ দু'টো ব্যাপার টের পেল। প্রথমত মোহান্তর দু'চোখে একটা বিচ্ছিরি ঝিলিক খেলে গেল যেন। আর দ্বিতীয়ত, মোহান্তর মুখের সেই অমায়িক হাসিটা মিলিয়ে একটা ধারালো ভাব চলে এলো।
নোবেলটা উল্টেপাল্টে দেখে নিজের পকেটে চালান করল মোহান্ত। তারপর রবীন্দ্রনাথের দিকে তাকিয়ে বলল;
- নাহ্। তোমার এলেম আছে রবীন্দ্রনাথ। চুরিচামারিতে নোবেল থাকলে তোমার প্রতিপত্তি কেউ আটকাতে পারত না।
- কর্তা। এ'বার টাকা পয়সার ব্যাপারটা যদি...।
- ও হ্যাঁ। তাই তো। আমি আবার মাগনায় কাজ করানো মোটেও পছন্দ করি না। এই নে।
বলে দু'টো একশো টাকার নোট রবীন্দ্রনাথের দিকে এগিয়ে দিল মোহান্ত।
- এ'টা কেমন হল কর্তা? কথা ছিল অর্ধেক বখরার। এ'খন দু'শো টাকা ধরাচ্ছ? এ'টা কি রিক্সাভাড়া নাকি?
- রিক্সা টানতেও মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয় বাবা রবীন্দ্রনাথ। আর তুমি তো বড়জোর কয়েকটা তালা ভেঙেছ। ধুর ধুর। আমি ভেবে দেখলাম বুঝলে, এর বেশি তোমায় দিলে লাই দেওয়া হবে। ধর্মে সইবে না। আর টাকা লক্ষ্মী, তার অপচয় করতে নেই।
এ'বার সোজা গিয়ে মোহান্তর পা জড়িয়ে ধরল রবীন্দ্রনাথ। সে জানে যে ঝগড়াঝাঁটিতে গিয়ে লাভ নেই। টাকাগুলোর খুব দরকার তার। নয়ত এমন বড় দাঁও মারার করার লোক সে নয়।
- অন্তত হাজার দশেক টাকা দাও কর্তা। গরীবের পেটে লাথি মেরো না।
কিন্তু সেই লাথিটাই মারল মোহান্ত। ছাতুও এসে দু'তিনটে গুঁতো চালালে। তারপর তার কানের কাছে ঝুঁকে মোহান্ত বলল,
"বাড়াবাড়ি কোরো না রবীন্দ্রনাথ। ছাতুর হাতে আবার চাকু আছে, মাথা গরম ছোকরা। কী না কী করে দেবে। দুশো টাকা দিলাম। মিষ্টি কিনে খাও, ছেলে-বৌকে খাওয়াও। কেমন? আমি আসি"।
৭।
মোহান্ত আর ছাতু চলে যাওয়ার পরেও খানিকক্ষণ ওই ঝোপঝাড়ের পাশেই শুয়েছিল রবীন্দ্রনাথ। তলপেটে লাথি খাওয়ার পর একটা চিনচিন শুরু হয়েছিল। সে'টা একটু মিইয়ে আসতেই চাবুকে মত উঠে দাঁড়ালো রবীন্দ্রনাথ। তার মুখে তখন জ্বলজ্বলে হাসি।
আচমকা নিজের ঢলা আধ-ছেঁড়া প্যান্টের হিপ-পকেটে হাত দিয়ে একটা সোনার মেডেল বের করে আনল রবীন্দ্রনাথকে। সে'টার দিকে তাকিয়ে মিচকি হেসে বলে উঠলো,
"হুঁ হুঁ বাওয়া মোহান্ত, লেখক রবীন্দ্রনাথকে ফাঁকি দিতে পারো। কিন্তু পকেটমার রবীন্দ্রনাথকে ফাঁকি দেবে ভেবেছ"?
নোবেলটা ফের পকেটে রেখে দ্রুত পায়ে এগোল রবীন্দ্রনাথ। ক'দিন গা ঢাকা দিতে হবে, খানিকক্ষণ পর যখন মোহান্ত টের পাবে যে পকেটে মেডেল নেই, নিশ্চয়ই সন্দেহ করবে। চটপট গায়েব হয়ে গিয়ে ক'দিনের জন্য গা-ঢাকা দিতে হবে।
এমন সময়, একটা খ্যানখ্যানে কণ্ঠস্বর শুনে ভেবড়ে গেল রবীন্দ্রনাথ।
"এই যে ভায়া। প্রাণে খুউব ফুর্তি দেখছি, লটারি পেয়েছ নাকি"?
রবীন্দ্রনাথ দু'টো ঢোক গিয়ে একটু শরীরটাকে ঝাঁকিয়ে নিলো। এ জঙ্গলে এই রাতবিরেতে আশেপাশে কারুর থাকার কথা নয়। দু'চারবার উঠবস করে মনটাকে তরতাজা করে নিলো সে।
"তুমি ভুল শোনোনি ভাই। তবে ঘাবড়ে যেওনা। আমি কিন্তু তোমার অমন চাঁদপানা মুখের হাসি দেখে বড়ই ফুর্তি পেয়েছি"।
সামান্য ধাতস্থ হয়ে ব্যাপারটা স্পষ্ট হল। রবীন্দ্রনাথ চেয়ে দেখলে সামনের এক পেল্লায় গাছের পেল্লায় ডাল থেকে পেল্লায় একটা জোড়া ঠ্যাং দোল খাচ্ছে। কথা যে সেই বলছে তা'তে সন্দেহ নেই। আর বাবাজীটি যে ভূত, তাও স্পষ্ট।
তবে সে নিজে পকেটমার, খামোখা ভূতকে পাত্তা দিতে যাবে কেন?
ভূতকে একটু কড়কে দেওয়াটাই সমীচীন মনে করল রবীন্দ্রনাথ।
- তুমি ভূত?
- বেঁচেবর্তে নেই বটে। কাজেই ভূত বলতেই পারো। তবে আজকাল একটু কমিক্স পড়ার দিকে মন গেছে। আমি নিজেকে চলমান অশরীরী বলে ভাবতেই ভালোবাসি। তবে সে'সব জেনে তোমার কাজ নেই। তা ইয়ে, এমন দুম করে উদয় হয়ে তোমার ঘাবড়ে দিইনি তো?
- ঠাট্টা করছেন স্যার ? আমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর! আশেপাশের চারটে থানা আমার কাজেকম্মে তটস্থ। আমি পাব ভয় ? তাও ভূতে? ছোহ্। কোমরে চারটে মাদুলি, আর হাতে তিনটে। ভূতফূতে পরোয়া করিনা।
- তুমি রবীন্দ্রনাথ? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর?
- রবীন্দ্রনাথ। তবে সেই কোবতে লেখা মাল নই স্যার। আমার কাজের ধার বেশি।
- তুমি কী কর রবীন্দ্রনাথ ?
- আপনাকে অবিশ্বাস করবার কোনও কারণ দেখছি। আপনার মধ্যে একটা নরম ইয়েও আছে। গাছের ডাল থেকে ঝোলা আপনার ওই ঠ্যাং দুটো দেখেই কেমন বুকের মধ্যে খলবল করেছে। তাই বলতে বিশেষ লজ্জা নেই। ইয়ে, আমি পকেটমার। আজিমগঞ্জ লাইনে সব থানার বড়বাবু আমায় এক ডাকে চেনেন রবিন পকেট-কাটা বলে। মার্কেটে আমার একটা ইয়ে আছে বৈকি।
- তা রবীন্দ্রনাথ, তোমার পদবী কি সত্যিই ঠাকুর ?
- আজ্ঞে আমার দাদু পাবনার মধু ডাকাতের দলে পাচক ছিলেন। তাঁকে মধু ডাকাত আদর করে ডাকতেন গুপী ঠাকুর। সেই থেকে দাদু নিজের পৈতৃক পদবী পাত্র থেকে ঠাকুর করে নেন। রবীন্দ্রনাথ নামটা অবিশ্যি, বুঝলেন কি না ভূত বাবু, আমার মায়ের দেওয়া।
- বুঝলাম।
- তা এই অসময়ে অজায়গায় এমন বেকায়দা ফুর্তির কারণ?
- আর বলেন কেন। এক দল উজবুক হুজ্জতি করে ধরে আনলে। বললে আমায় সুযোগ করে দেবে তাঁরা শান্তিনিকেতন থেকে সোনার নোবেল হাত সাফাই করার। আধাআধি বখরা। কাজটা অবিশ্যি আমায় ছাড়া অন্য কাউকে দিয়ে হত না। এ তো আর গা জোয়ারি ডাকাতি নয়, অতি সূক্ষ্ম হাতের কাজ। মিউজিয়াম থেকে নোবেল চুরি। তা ভগবানের দয়ায় বলতে নেই, আঙুলের ডগায় মাখন নিয়েই আমি জন্মেছি। নোবেল হাতিয়ে নিলাম। ও তো আমার বাঁ হাতের খেল। এক্কেবারে মখমল লেভেলে কাজ সারলাম বুঝলেন।
- বাহ্। বাহ্। তুমি সত্যিই গুণীমানুষ হে।
- আজ্ঞে, তা বলতে পারেন, গুরুজনদের আশীর্বাদ। যা বলছিলাম। নোবেল তো সরালাম। তারপর সে উজবুক ডাকাতদলের নেতা মোহান্ত আমার থেকে মেডেল নিলে আমার হাতে দু'শো টাকা ধরিয়ে দিলে।
- অ্যাঁ, সে কী। অর্ধেক বখরা বলে দিনে ডাকাতি? ছিঃ ছিঃ। এ'ভাবে তোমার হকের নোবেল ছিনিয়ে নিলো রবীন্দ্রনাথ?
- ভাবুন স্যার, কী বদমাইশের দল। তার সঙ্গে চড়-লাথিও কষলে।
- ইশ্। খুব লেগেছে?
- পকেটমার মানুষ। ও'সব মার আমাদের গায়ে লাগে না।
- তা রবীন্দ্রনাথ, মার খেয়েও তোমার এত ফুর্তি কীসে?
- আমি শিল্পী মানুষ স্যার। মোহান্তর মত ডাকাত সর্দার নই। সে আমায় ধোঁকা দেবে? ধুস। লাথি খাওয়ার আগেই মোহান্তর পকেট থেকে নোবেলের মেডেল সরিয়ে নিয়েছি। ও জিনিস এখন আমার বুকপকেটে স্যার। হে হে হে হে।
- হে হে হে হে।
- হে হে হে...কেমন দিলাম ভূতদা?
- না:, মানতে হবে যে তুমি এলেমদার লোক।
- তা, এখন আমি চলি?
- চললে কোথায় ?
- আজ্ঞে, ভেবেছিলাম বাড়ি গিয়ে সোজা বউয়ের হাতে তুলে দেব সোনার মেডেল খানা। কিন্তু এখুনি ভেবে দেখলাম বউ তো সোনা গলিয়ে সমস্ত টাকাই ঢেলে দেবে সংসারের পিছনে। ছাতের এসবেস্টস সারাই কর রে, খোকার নতুন প্যান্টালুন কেন রে, ছাগল কেন রে, বেগুন চাষ কর রে; তার বায়নাক্কা কি কম ? সংসার তো থাকবেই, সে সংসারের অভাবও মিটবার নয়। আমি ভাবছি এই সোনা বিক্রি করে দু'দিন একটু ফুর্তি করে আসি। দিনের পর দিন পান্তা আর আলুসিদ্ধ খেয়ে খেয়ে জিভ চটকে গেছে গো ভূত-দাদা। সেই কবে পাইনঅ্যাপেল কেক খাইয়েছিলে দিনু-চোর, প্রফেসর পুরকায়স্থদের রান্নাঘর থেকে ঝেড়ে। ভাবছি কদিন একটু ভালো মন্দ খাই। পাঁঠার কিমা, কাবাব-টাবাব, রোল, চাউমিন, কেক, রসগোল্লা। ক'দিন কলকাতা থেকেও ঘুরে আসতে পারি। মাসখানেক দেদার ফুর্তি হয়ে যাবে এই সোনা বেচে। কী বলেন? আরে বৌ-ছেলে তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না। সে তো রইলই।
- তুমি যথার্থই বড় মাপের মানুষ রবীন্দ্রনাথ।
- তা আপনার নামটা ভূত-কত্তা ? ও কী! গায়েব হয়ে গেলেন নাকি ? ও মশাই ?
৮।
ভাবনাটা মনে ধরেছিল রবীন্দ্রনাথের। দিনরাত সংসার-সংসার করে হাড়মাস পুড়ে ছাই হয়ে গেল। পকেটে সোনাটা আসার পর থেকেই বউয়ের ওপরও বিরক্তিটা চড়চড় করে বাড়ছিল। দু'দণ্ড তিষ্ঠোতে দেবে না, বাপ রে বাপ! শুধু এ'টা চাই, ও'টা চাই, এ'টা হয়নি, ও'টা বাকি আছে। ধুর ধুর। সে যে মোহান্তর পকেটে থেকে নোবেল ঝেঁপে দিয়েছে, ও'কথাটা বউকে না বললেই হবে। এমনিতেই এখন বাড়ি ফেরায় গোলমাল বাড়বে, মোহান্তর চ্যালাচামুণ্ডারা নিশ্চয়ই নজর রাখছে। তারচেয়ে মাসখানেক নোবেল বেচা টাকায় ফুর্তি করে ফিরে এসে বউয়ের হাতে দুশো টাকা গুজে দেবে খন। সাপ মরবে, লাঠিও ভাঙবে না।
প্ল্যানটা স্পষ্টভাবে ছকে নিলো।
বোলপুরে স্টেশনে যাওয়ার মানে হয় না, মোহান্তর লোক নির্ঘাত ঘুরঘুর করবে। হাইওয়ে থেকে কোনও ট্রাকের সঙ্গে ঝুলে পড়ে সোজা দুর্গাপুর। সে'খান থেকে আসানসোল। আসানসোলে নোবেলটার একটা হেস্তনেস্ত হয়ে যাবে। সেখানকার ঈশ্বরদাস ঢনঢনিয়া এসব কেনাবেচা করে। তারপর মাসখানেকের ফুর্তি। হঠাৎ ইচ্ছে হল দীঘা যাওয়ার। সমুদ্রের ধারে বসে দেদার মাছভাজা খাবে আর কুমার শানুর গান শুনবে। আহা। ভাবতেই প্রাণে একটা আনন্দের ঝিলিক খেলে গেল।
কপালটাও ভালো। হাইওয়ের ধারে মিনিট পাঁচেক দাঁড়ানোর পরেই এক ডাকে একটা ম্যাটাডোর সামনে এসে দাঁড়ালে। সহৃদয় ড্রাইভার দাদা বললেন ট্রাকের পিছনে গিয়ে বসতে। রবীন্দ্রনাথ একটা একশো টাকার নোট অফারও করেছিল, ড্রাইভারদাদা সলজ্জ ভাবে মাথা নেড়ে সে'টাকা নিতে অস্বীকার করলে। ভারী ভালো মানুষ।
ট্রাকের পিছনে গিয়ে উঠতেই ব্যাপারটা গোলমাল হয়ে গেল। সে'খানে থেবড়ে বসে রয়েছে মোহান্ত আর তাঁর চ্যালা ছাতু। মোহান্তর মুখে হাসি, কিন্তু চোখে গনগনে রাগ। রবীন্দ্রনাথের গলা শুকিয়ে গেছিল, মোহান্তই কথা শুরু করলে।
- রবীন্দ্রনাথ, তুমি চালাকচতুর মানুষ, ডালে ডালে খেলা করে বেড়াও। তবে মনে রেখো, আমি চলি পাতায় পাতায়।
- তা, এই ট্রাকে করে আপনারা কোথায় চললেন কর্তা?
- পকেটমার পকেটমারের মত থাকো। বুক ফুলিয়ে। ন্যাকামি তোমার সাজে না। এ ট্রাক আমারই। তা ভাই রবীন্দ্রনাথ, তুমি বাড়ি না ফিরে হাইওয়ে ধরে কোথায় চললে?
- ও আমি মাঝেমধ্যে হাওয়া খেতে বেরোই। পু...পুরনো অভ্যাস।
- বটে? বেশ বেশ। এ তো ভালো ব্যাপার। ভেরি গুড। যাকগে। তুমি হাওয়া খাও। তবে আগে আমার নোবেলটা ফেরত দাও দেখি।
- নোবেল? ও মা। ও তো আমি আপনাকে দিয়ে দিলাম। আপনি আমায় দু'শো টাকা প্রণামী দিলেন।
- একদম বাজে কথা নয়। কেমন? ভেবেছ মোহান্তর পকেট কেটে পার পাবে?
- কী মুশকিল। আমি আপনাকে নোবেল দিলাম। আমায় দু'শো টাকা দিলেন। লাথি কষলেন। আমি পড়ে রইলাম। আপনারা চলে গেলেন। নোবেল পাবো কই?
- ছাতু!
মোহান্তর ইঙ্গিতে ছাতু এগিয়ে এসে রবীন্দ্রনাথকে পিছমোড়া করে বেঁধে ফেললে। ট্রাকের মধ্যে। তারপর দু'জনে মিলে রবীন্দ্রনাথের জামাকাপড় ঘেঁটেঘুঁটে সোনার মেডেল খোঁজা শুরু করলে। রবীন্দ্রনাথ জানে যে মেডেল তাঁর বুকপকেটেই। আর সে জিনিস পেলেই মোহান্ত বুঝে যাবে রবীন্দ্রনাথের বাটপাড়িটা। তখন নিশ্চয়ই এরা তাকে খুন করবে। বুকটা ধড়ফড়িয়ে উঠছিল রবীন্দ্রনাথের। তার চোখে জল চলে এলো, অবশ্য মারা যাবে বলে কান্না পাচ্ছে না। কান্না পাচ্ছে এই ভেবে যে সে তার বউ আর ওইটুকু ছেলেকে ঠকিয়ে ফুর্তি করতে চেয়েছিল। ছিঃ ছিঃ। তার মরে যাওয়াই ভালো।
কিন্তু আদত গোলমালটা তখনই ঘটল। রবীন্দ্রনাথের বুকপকেট থেকে নোবেল পাওয়া গেল না। কোনও পকেট থেকেই পাওয়া গেল না। মোহান্ত হতাশ, রবীন্দ্রনাথ থ। কিন্তু নিজের চমকটাকে চেপেচুপে রাখলে সে।
মোহান্ত ছাতুকে বললে রবীন্দ্রনাথের বাঁধন খুলে দিতে। তারপর রবীন্দ্রনাথের কাঁধে হাত রেখে বললে,
- কিছু মনে করো না ভাই। আচমকা দেখলাম পকেটে নোবেলটা নেই। ভাবলাম তুমিই হয়ত সরিয়ে দিয়েছ। পকেটমার তো, হয়ত অভ্যাসের টানে...।
- ও মা! আপনি দু'শো টাকা মূল্য ধরে দিলেন। সে জিনিস আমি ফিরিয়ে নিই কী করে। পকেটমার হতে পারি কর্তা, কিন্তু দায়দায়িত্ব তো আছে।
- তাই তো। তা শোন ছাতু। রবীন্দ্রনাথকে এখানে নামিয়ে দে। খামোখা টেনে নিয়ে গিয়ে কী লাভ। সে জিনিস রাস্তাতেই পড়ে গেছে কোথাও । চল আমরা জঙ্গলে ফেরত যাই। যদিও মনে হচ্ছে ফসকেই গেল...।
ট্রাক থেকে নামার পর রবীন্দ্রনাথ টানা আধ ঘণ্টা দৌড়ল। বাড়ি অবশ্য তখনও ঢের দূরে। তবু, মনের মধ্যের এ আনচান কাটতে বেশ কয়েকদিন লাগবে।
৯।
রবীন্দ্রনাথ যখন বাড়ি ফিরলে তখন ভোররাত।
খোকা ঘুমিয়ে কাদা। বউ জেগে, চোখমুখ ফোলা, সম্ভবত কেঁদেটেঁদে। ঝগড়া করে বেরিয়ে গোটা রাত বাইরে থাকাটা বোকামি হয়ে গেছে, বেশ বুঝলে রবীন্দ্রনাথ।
আমতা আমতা করে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই বউ হাউমাউ করে একটা অদ্ভুত কথা পেড়ে বসলে।
- তুমি জানো কী হয়েছে?
- কী হয়েছে বউ!
- সাংঘাতিক ব্যাপার।
- বল কী হয়েছে।
- বলতে গিয়ে আমার গা হাত পা কাঁপছে গো।
- আরে ধুরছাই বলবি তো।
- তুমি চলে যাওয়ার পর তো আমি কেঁদে কেঁদে সারা। রাত পেরোতে চলল তোমার ফেরার নাম নেই। লক্ষ্মীর আসনের সামনে গিয়ে হত্যে দিয়ে পড়লাম। মা লক্ষ্মী, আমায় বিধবা করে দিও না মা। পকেটমারের তো শত্তুরের অভাব নেই। আর তখনই…।
- তখনই?
- আমার হাতের ধাক্কা লেগে লক্ষ্মীর ঝাঁপিটা গেল উলটে। আর সেই ঝাঁপি থেকে বেরোল এ’টা। ও ঝাঁপিতে আমি আজ দুপুরেই দু’টো দু’টাকার কয়েন রেখেছি। তখনও ওখানে এসব কিচ্ছু ছিল না।
পকেটমার রবীন্দ্রনাথ অবাক হয়ে দেখল, তার বউয়ের হাতে জ্বলজ্বল করছে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল।
রবীন্দ্রনাথের বুকে পেটে একটা বিটকেল আনচান শুরু হল। একটা বিশ্রী গা-গুলুনি।
এরপর নিজের রাতের অভিজ্ঞতা খোলতাই করে বউকে শোনালো রবীন্দ্রনাথ। বউ রবীন্দ্রনাথের ওপর খানিকটা রেগে গেলেও হাতে ধরা নোবেলটার জন্যই হতে চেঁচিয়ে উঠল না।
শুধু রবীন্দ্রনাথ যখন ভূতের প্রসঙ্গটা তুলল তখন বউ “ভীমরতি” বলে মুখঝামটা দিয়ে তাকে দমিয়ে দিলে। দু'চারটে ঢোক গিলে রবীন্দ্রনাথ ফের শুধোলে;
- হ্যাঁ রে বউ, আমার চুরি করার নোবেল প্রাইজ তোর ঝাঁপিতে এলো কী করে?
- অত ভেবে আর কী হবে বলো, ঝাঁপি তো আমার নয়। দেবী লক্ষ্মীর। তিনি যখন মুখ তুলে চাইবেন ঠিক করেছেন তখন আর আমার সোনা পাওয়া ঠেকায় কার সাধ্যি। এ'বার শোনো, ধীরেসুস্থে ছাতটা সারাই করতে হবে। খেতে বেগুন বুনতে হবে। খোকার জামাকাপড় কিনতে হবে...।
- বউ, আমি কিন্তু তোকে একজোড়া দুল গড়িয়ে দেব। না শুনব না।
- সোনা গলিয়ে সোনা গড়াব? অকারণ মজুরির টাকা নষ্ট হবে।
- সে হোক। দুল কিন্তু নেবই। আর বউ শোন, দীঘা যাবি? আমরা তিনজনে বসে সমুদ্রের ধারে মাছভাজা খাব'খন। দারুণ মজা হবে।
- সত্যি? নিয়ে যাবে গো?
১০।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর তাঁর আপ্লুত বউ সোনার ড্যালাটা নিয়ে এতটাই বিহ্বল ছিল যে তখন তাঁদের ভাঙাচোরা চালের থেকে ঝুলতে থাকা একজোড়া গা শিরশিরানো ঠ্যাঙের দুলতে থাকাটা খেয়ালই করেনি। নিচ থেকে পকেটমার রবীন্দ্রনাথ আর তাঁর বউয়ের কথাবার্তা ভেসে আসছিল। ছাতে বসে সে'সব শুনতে ভারি মিঠে লাগছিল চলমান অশরীরীর। এমন সময় একটা ঝুপ শব্দ হওয়ার ছাতে বসে ঠ্যাং দোলানো বন্ধ করে ঘুরে তাকালেন তিনি। নিজে ভূত হলেও দুম করে অন্য ভূত দেখলে একটু বুক কাঁপে বইকি। তবে এ ভূতটা অচেনা নয়।
- কী ব্যাপারে রবিদা, এ তো পোড়োবাড়ি নয়। দিব্যি লোকজনের বসবাস। এই ছাদে বসে পা দোলাচ্ছ কেন?
- ওই বাজে নিয়মের আমি তোয়াক্কা করি না। মরে গেছি বলে মানুষের থেকে দূরে দূরে থাকতে হবে, এ কেমন কথা।
- ভূতের জগতে ওটাই কালচার রবিদা।
- বয়ে গেছে সে কালচারে। যাক গে ভাই, শোনো। তোমায় কতবার বলেছি, আমায় চলমান অশরীরী বলে ডাকবে। রবি নামটায় ঘ্যাম বড্ড কম।
- ঘ্যাম? আপনার মুখে এ কী ভাষা!
- ওরে পাগলা, তোরা কী ভেবেছিস, রবীন্দ্রনাথের প্রতিভাকে তোরা শুধু শান্তিনিকেতনি ব্র্যান্ডে বেঁধে রাখবি? কাঁচকলা পারবি! এই দ্যাখ, মরার এত বছর পর এসে নিজের ইমেজ ভাঙার চেষ্টা করছি।
- সে'সবের চান্স নেই গুরু। পাবলিক তোমায় গুরুদেবের পোস্ট ছাড়তে দেবে না। সে তুমি যাই করো রবিদা।
- এহ্। বড় এলেন হে। যাক গে, আমায় রবিদা বলা বন্ধ করো। আমায় চলমান অশরীরী বলেই ডাকতে হবে। ওই যে, কমিক্সে যেমন পড়ছি।
- চলমান ফলমান বড্ড লম্বা নাম রবিদা। তাছাড়া আপনি বিশ্বকবি, ভূত হলেও আপনার মুক্তি নেই।
- দ্যাখ, একটা গোটা জীবন স্রেফ দিস্তে দিস্তে লিখেই খরচ করে দিলাম। মরার পর সে'সব ব্যামো আর নয়। নিজের মুক্তির ব্যবস্থা এ'বার নিজেই করছি ভাইটি।
- কী করে?
- আমি আজ পকেট মেরেছি।
- মাইরি?
- সত্যি। পকেট মেরে সাফ করে দিয়েছি।
- কার পকেট মারলেন?
- সে'টাই তো মজার। রীতিমত একজন পকেটমারের পকেট মেরেছি!
- সে কী! চোরের ওপর বাটপাড়ি?
- যে সে পকেটমার নয়। সে পকেটমারেরও নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
- গুল মারছেন রবিদা?
- মা কসম, খাঁটি সত্যি বলছি।
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভূত পকেটমার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পকেট মেরেছে?
- ঠিক।
- তা, পকেটমারা মাল কোথায় রাখলেন?
- সে ব্যবস্থা করে ফেলেছি। আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে ভাই। ইচ্ছে করছে কুমার শানুর গানের সুরে খানিকক্ষণ নীচে নিই। ভূত হয়ে এই সুবিধে- নাচতে নেমে ছন্দ-তাল ভেবে হিমশিম খেতে হয় না।
আনন্দের চোটে ছাদের ওপর বেশ কিছুটা নেচে নিলেন রবীন্দ্রনাথ।
(শেষ)