Wednesday, July 12, 2023

স্পাইন



- আর একটু ভাত দিই রন্টু?

- আর না বাবা।

- কাল থেকে এই বাড়ির ডালভাতই রাজভোগ মনে হবে৷ 

- হেহ্৷ আচ্ছা দাও আর দু'টো ভাত।

- তোর মা থাকলে আমার ওপর কী রাগটাই না করত৷ আজকের দিনটা অন্তত ঝোলভাত খাওয়াতে পারতাম। আসলে সময় এত কম..।

- হ্যাঁ। তুমি মাছ এনে ঝোল রেঁধে খাওয়ানোর তাল করলে ডুবতে হত৷ শেষে পাউরুটি চিবিয়ে বেরোতে হত।

- ওরা এলো বলে, তাই না রন্টু?

- খবর তো সে'রকমই।

- রন্টু। জেলে বোধ হয় লপসি দেয়, তাই তো?

- কাতলার ঝোল, গন্ধরাজ লেবুর টুকরো দিয়ে যে ভাত সার্ভ করবে না সে'টা নিশ্চিত। 

- তুই ঘাবড়ে যাস না রন্টু। সমরকাকু বলেছে বেইল পেতে অসুবিধে হবে না..আরে দেশে আইনকানুন তো এখনও উঠে যায়নি।

- সমরকাকুর সাধের লিগ্যাল প্র‍্যাক্টিস এ'বারে ডুবলো বোধ হয়।

- ওরা চাপ দেবে বুঝি? থ্রেট? চোটপাট? মাস্তানি?

- তোমার কী মনে হয়?

- সমরের স্পাইন আছে৷ ও নুইয়ে পড়বে না৷

- সমরকাকুর একটা সংসারও আছে। সব হারানোর ভয়ও আছে৷ একটা সিডিসাস ছেলের হয়ে সওয়াল করতে গিয়ে যদি ফ্যামিলি সেফটি বিঘ্নিত হয়..।

- হ্যাঁ রে রন্টু৷ তোর মা নেই৷ তাই আমার থাকাটাও ম্যাটার করে না, তাই না? তাই তোর  সংসার নেই? শুধুই স্পাইন আছে?

- স্পাইনটা তোমার থেকেই পাওয়া৷ অফিসে ঘুষ নেওয়ায় মদত দাওনি বলে মারধোর খাওনি তুমি? 

- অফিসের ওপরওলাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো আর গোটা পলিটিকাল মেশিনারির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোটা কি এক হল রে? তোকে দেখে আমি যে কী ইন্সপায়্যারড হই রন্টে..।

- এই সেরেছে। মনে রেখো, মেরুদণ্ডের গল্প প্রবন্ধে লেখা এক জিনিস৷ কিন্তু বয়স হলে বোন ডেন্সিটি কমে যায়৷ এ বয়সে তোমার পুলিশের লাঠি সইবে না৷

- আমায় আন্ডারএস্টিমেট করিস না৷ তুই জানিস এককালে আমি মুগুর ভেজেছি?

- সে'তো ভালো কথা৷ তা'বলে বেগুনটা আজ এক্সট্রা ভেজে কালো করে ফেলবে?

- এহ্৷ মনে হচ্ছিল বটে যে ওভারডোজ হয়ে যাচ্ছে৷ তেতো লাগছে নাকি রে?

- না না। অতটাও খারাপ নয়৷

- রন্টু, এই শোন৷ জেলে ওরা তোকে..। মানে..তোকে যদি ফস করে..মানে।

- কী?

- না মানে..সমস্ত মেশিনারি ওদের হাতে৷ চাদ্দিকে কত কিছু শুনি। কিন্তু যদি..।

- যদি?

- না না৷ নেগেটিভ কিছু ভাবব না৷ অপটিমিজম ছাড়া রিভোলিউশন হয় না৷

- বাবা৷ আমার কপালে লপসি ফেস্টিভাল নাচছে৷ তুমি নার্ভাস হয়ো না।

- নার্ভাস? আমি? হেহ্৷ হাসালে ব্রাদার৷ এক কোপে পাঁচ কিলোর কাতলা দু'ফালি করে দিই এখনও৷ নার্ভস অফ স্টিল।

- ব্রাভো।

- ফিরে আসিস বাবু৷ কেমন?

- তোমায় বেশিদিন একা ছাড়লে মা দুশ্চিন্তার চোটে ওপর থেকে নেমে এসে চোটপাট শুরু করবে। সে রিস্ক নেওয়া যাবে না।

- কী গর্ব হচ্ছে আমার তোকে নিয়ে বাবু৷ কী গর্ব। তুই জয়েন্টে যেদিন ফস্কে গেলি, আমি তো রেগে ফায়্যার। তোর মা বারবার আমায় বলেছিল, রন্টুকে জয়েন্ট-মেডিকালের স্কোরে বাঁধা যাবে না৷ 

- উফ্! বাবা! এই নড়বড়ে মন নিয়েই বেগুনভাজা পুড়িয়ে ফেললে মাইরি।

- হেহ্। আর একটু ভাত নে না রন্টু। নে। আর একটু৷ এই একটু। এক চামচ মাত্র৷ এ'টুকুই তো৷

- দাও।

- যাকগে। লপসি মুখে দিয়ে বাপের রান্নার সুবাস মনের মধ্যে টেনে আনিস৷ দেখবি স্পাইন টনটনে থাকবে।

- বাবার রান্নার হাত; অমর রহে।

- জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ!

আসি



"এইবারে তোমাদের পৃথিবীর ঝড়ঝাপটায় টপাৎ করে ফেলে দেব৷ কেমন? বিটি, তুই একদিকে হন্যে হবি। আর এই যে বাবা মদনচন্দর..সে অন্যদিকে ন্যাজেগোবর হতেহতে তোর সামনে এসে দাঁড়াবে৷ ওয়েট, দাঁড়ালে চলবে না; নতজানু হবে৷ এরপর ন্যাবাকুমার দায়িত্ব নিয়ে সমস্তটা ডুবিয়ে দেবে৷ সে ডোবাবে, তুমি টেনে ভাসিয়ে রাখবে৷ এই ল্যুপেই চলবে। বানিয়ে বলছি না, এই দেখো দেখো; নোটবুকে লিখে রাখা আছে"।

***

"এইব্বারে। সিকুয়েন্স বুঝে নাও! ইম্যাজিন! চাদ্দিকে গোলাগুলি ছুটছে;সে এক ধুন্ধুমার ব্যাপার। বারুদের মোচ্ছব, দেদার রক্তারক্তি। এ ওর মাথায় কাঁঠাল ভাঙছে তো ও এর পিঠে ছুরি দিয়ে ছবি আঁকছে।

এ'সবের মধ্যে তোমরা দু'টিতে গল্প জুড়বে৷ ওটাই হোমটাস্ক।
দু'জনেই নয়নতারা ভালোবাসো জেনে লাফিয়ে উঠবে।
বাদাম শেষ হলে ঠোঙা দিয়ে বুকমার্ক বানাবে।

ভালোবাসবে।

কী..ভাবছো বানিয়ে বলছি? আরে না হে৷ নোটবুকের সতেরো নম্বর পাতাটা দেখো..এই যে..দাগিয়ে দিয়েছি। ঠিক হ্যায়? ভালোবাসবে "!

***

"কবিতা? এ কী ধরণের সিলি কোশ্চেন! পোয়েট্রি ভালো না বাসলে চলবে কেন? এই এখানে ইন্সট্রাকশন লিখে রাখছি; মনে থাকে যেন; মাসকাবারির ফর্দ তোমাদের কথোপকথন।

আর হ্যাঁ৷ তর্ক না থাকলে মুক্তি কোথায়? আচমকা বৃষ্টি নামলে তর্কের ঝড় উঠবে- জানালা বন্ধ করার দায়িত্ব কার, তা নিয়ে৷ ফয়সালা হওয়ার আগেই বিছানায় জল। তারপর দোষারোপ, অভিমান, তিল থেকে তাল, মুখ ফসকে ভুলভাল, চোখ চলকে টপাটপ। 

তারপর হাওয়া ঠাণ্ডা হলে খিচুড়ি, আলুভাজা আর 'শোনো না, ময়দান যাবে'?"

***

"এরপর। 
হঠাৎ একদিন৷
কিছু মনে কোরো না।
হঠাৎই একদিন।
ডিসেম্বরের সন্ধের মত ঝুপ করে নামবে;
'আসি'৷
ব্যাস, আর কী!
ক্যাবলাচরণের মত পড়ে রইবে কলকাতা"৷

Thursday, July 6, 2023

আরামকুঞ্জ


আমার একটা ব্লগ আছে। সে'টার বয়স পনেরো ছাড়িয়েছে। এর আগে কোনোদিন কোনও শখ-আহ্লাদ (ক্রিকেটারের ছবি জমানো, স্টাম্প জমানো, সিগারেটের প্যাকেট জমানো, ডায়েরি লেখা, মর্নিং ওয়াক, ইত্যাদি) আঁকড়ে দিন পনেরোর বেশি থাকতে পারিনি। কিন্তু ব্লগের ব্যাপারে স্রেফ এই টেনাসিটির জন্য নিজেকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে। প্রবলভাবে দরকচা মারা পোস্ট লিখেছি, নিজের বহু লেখা পরে নিজে পড়ে শিউরে উঠেছি, দুঃখের লেখা পড়ে পেট খামচে হেসেছি, হাসির লেখা পড়ে চোখে জল এসেছে।

কিন্তু ইয়ে। ব্লগ ছেড়ে যাইনি।
যাবও না। যদ্দিন না ব্লগার প্ল্যাটফর্মটাই বন্ধটন্ধ হয়ে যায়। ব্লগ ব্যাপারটা এমনিতেই বহুদিন ধরে পড়তির দিকে। আর ব্লগিং প্ল্যাটফর্মগুলোর মধ্যেও বোধ হয় ব্লগারের কদর ওয়ার্ডপ্রেস মিডিয়ামের চেয়ে বেশ কম। আমি হত্যে দিয়ে পড়ে আছি স্রেফ "শিফটিং ইজ ট্যু মাচ ওয়ার্ক" বলে। আমার লেখা যে' দু'চারজন পড়েন, তা ওই মূলত ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম গোছের প্ল্যাটফর্মেই। অথচ আমার যত আহ্লাদ তা এই পদ্মলোচন বংপেন ডট নেটকে নিয়েই। মাঝেমধ্যেই "লুক" চেঞ্জ করি। গত কয়েক শতাব্দী ধরে ব্লগারের টেমপ্লেটগুলো সেই থোড়-বড়ি-খাড়া; সে'গুলোই এ'দিক সে'দিক করে "রিডিজাইন" করি। এই উইডথ বাড়াচ্ছি, ওই ফন্টের রঙ পালটে দিচ্ছি, ইত্যাদি, ইত্যাদি। পোস্টে বানান-ব্যাকরণের দশা সকরুণ কিন্তু বাহারে কারুকাজের দিকে ষোলোআনা নজর। সামান্য জিনিসপত্র ওলটপালট করে নিজেই দেখি, নিজেই মুগ্ধ হই।

গতকাল রাত্রে আধঘণ্টা গঙ্গায় দিয়ে আবার ব্লগের রঙচঙ পালটে দিয়েছি। পাল্টানোর পর নিজে নিজেকে বলেছি, "কী করে পারিস তন্ময়। জাস্ট বিউটিফুল"। তারপর মারাত্মক তৃপ্তি নিয়ে ঘুমোতে গেছি। সে'টারই স্ক্রিনশট ফেসবুকে দেওয়ার ইচ্ছে হল, তাই এই ইয়ালম্বা কৈফিয়ত।

পুনশ্চ:
এই bongpen.net ব্যাপারটা বারান্দায় (বম্বেতে আমার বারান্দা জোটেনি, কিন্তু মনেমনে আমি চিরকালীন বারান্দিস্ট) পাতা বহুদিনের পুরনো মোড়ার মত রয়ে গেছে। হুল্লোড় করার আসবাব সে'টা নয়; সে'টা হল ধপাস করে গা-ছেড়ে বসে পড়ার হাইক্লাস আরামকুঞ্জ।

Wednesday, July 5, 2023

"না"

গাম্বাটের মত কথায় কথায় "না" বলব কেন? শিক্ষিত মার্জিত ভদ্দরলোক মানুষ, আমার "না"য়ে পালিশ না থাকলে যে দুনিয়াটা রসাতলে যাবে৷ পজিটিভিটির যুগ, ঘ্যানঘ্যানে যদু মিত্তির মেজাজের দিন শেষ৷

সোজাসুজি "না" না বলে, বলব:

"ও মা! এতটুকু কাজ? কোনও চিন্তা করবেন না৷ আমি আছি তো৷ হয়ে যাবে৷ এই আমার গ্যারেন্টি রইল রে বাবা। তবে আজ নয়৷ আজ হয়েছে কী, মাটনটা ম্যারিনেট করে রেখেছি৷ টাইমিংটা এ'দিক ও'দিক হলেই একটা হেঁসেল- হাওলা ঘটে যাবে৷ কাল? কাল আবার শুনেছি বৃষ্টি হবে৷ দু'ফোঁটা গায়ে লাগলেই আমার টনসিলটা একটু ট্রাবল দেয় কিনা৷ পরশুই হোক৷ কী বলেন? সে'টাই হোক? পরশু আপনি না বললেও শুনছি না কিন্তু। এই বলে রাখলাম"।

অথবা

"আরে আসুন আসুন৷ এই আপনার কাজটাই ধরব বলে ভাবছিলাম জানেন। মনে মনে সব ছকে রেখেছি৷ কিন্তু কী হল, দুপুরবেলা সামান্য গড়িয়ে ওঠার পর থেকেই দেখছি গা-টা সামান্য ম্যাজম্যাজ করছে.."।

অথবা

"দেখুন৷ কাজটা এ'বারে করেই ফেলব ভাবছি। না না, এ'বারে এক্কেবারে এস্পারওস্পার৷ আর দেরী নয়৷ কিন্তু সমস্যা হল আজ একটা পার্টির মিছিল আছে৷ আমায় ছাড়া আবার ছেলেপুলেগুলো এক-পা এগোতে পারে না৷ আর পঞ্জিকা অনুযায়ী এ'হপ্তাটা বেশি লম্ফঝম্প না করাই ভালো৷ তা'হলে ক'দিন বরং একটু জিরিয়েই নিই"।

অথবা

"অ্যাকশন চাই! অ্যাকশন৷ একেবারে আগুন অ্যাকশন!  টু হেল উইথ আলিস্যি৷  ডান হাতে কাজ নেব আর অমনি বাঁ হাত স্যাট করে সে কাজ নামিয়ে দেবে৷ এই হচ্ছে আমার পলিসি৷ তবে, ইয়ে, অম্বলভাবটা আগে কাটুক৷ একটু পুদীনহরা পেলে ভালো হত"।

অথবা

"ভেবেছেন খামোখা বসে আছি? ভুল ভেবেছেন৷ আমার চোখে চোখ রাখুন, বুঝতে পারবেন কাজে নামব বলে কী ইনিটেন্স ফোকাসে রেখেছি মনটাকে৷ কাজেই আর টালবাহানা না করে আগে প্ল্যানিংটা সেরে ফেলা যাক, কেমন? তবে আগে দু'টো শিঙাড়া আনান দেখি, তা'তে ব্রেনস্টর্মিংটা জমে ভালো। শিঙাড়ার সঙ্গে এক পিস পান্তুয়া আনালেও আপত্তি করব না"।

অথবা

"না কথাটাই আমার ডিকশনারিতে নেই। আমায় কাজ দিয়েছেন, এ'বার নিশ্চিন্তে থাকুন৷ আমি খুব মন দিয়ে ভেবে দেখছি"।

শহরের হালহকিকত



- আলেক্সা, শহরের হাল হকিকত কী বুঝছ?

- আর বলো কেন ভায়া! শনির দৃষ্টি এক্কেবারে৷ বাতাসে-মাটিতে-খানাখন্দে মারাত্মক গোলমালের সম্ভাবনা৷ কতজনের যে ঘটিবাটি চাঁটি হবে। হাঁটুজল আর জলের অভাব; কোনোটাই বাদ থাকবে বলে মনে হচ্ছে না। এ'বেলা পরিস্থিতি না পাল্টালে সবার গলা-বুক জ্বালা, অসময়ে ঘামাচি, ডালে নুনের অভাব৷ এক্কবারে ক্যালামিটি।

- বলো কী! আমি তো দেখছি দিব্যি চারদিক। বৃষ্টি থেমেছে, ফুরফুরে হাওয়া৷ উৎসবের মেজাজ, সেনসেক্স সাঁইসাঁই। টোটাল সেলিব্রেশন-মোড তো৷ তোমার খালি সবকিছুতেই ঘ্যানরঘ্যানর..।

- শুধু কেঠো ব্যাপারগুলোই দেখলে ব্রাদার? ফিউচারে গ্যামাক্সিন পড়ছে সে'ব্যাপারটা নোটিস করবে না? ঘণ্টা চারেক প্রেমিকার মেসেজ না পেয়ে এক ব্যাটাচ্ছেলে হন্যে হয়ে পথে পথে ঘুরছে! চারপাশটা তার কাছে আবছা। সে বেচারির দীর্ঘশ্বাস থেকে শহর নিজেকে বাঁচাতে পারবে ভেবেছ? তুমি চোখের ঠুলি ঠেলে দেখছ ইট ইজ দ্য বেস্ট অফ টাইমস। জেনে রাখো ব্রাদার, প্রেমেট্রেমের দিব্যি; এ'টা ওয়ার্স্ট অফ টাইমসও বটে।

Sunday, July 2, 2023

লেড়োত্ব



স্রেফ হাফডজন লেড়োর লোভে ছুটির বিকেলে কফি নিয়ে বসি৷

লেড়ো এমনই গভীর ব্যাপার যে তার সঙ্গে জোলো ব্ল্যাককফি অচল৷ ঘন দুধে বানানো কড়া কফি, তাতেই চুবিয়েই লেড়োর উত্তরণ। সে চুবনিটাও মাপা হিসেবের বাইরে গেলেই সর্বনাশ।

সর্বোপরি, লেড়োপ্রেমি মাত্রই জানেন যে লেড়ো-চেবানো মুচুরমুচুরে তাড়াহুড়ো মিশলেই সমস্তটা মাটি৷ স্নেহ-মিশ্রিত আলস্য না পেলে লেড়োর লেড়োত্বটাই নষ্ট।

ফুলফিল



শ্বেতার পাল্লায় পড়ে আমায় মাঝেমধ্যেই ফুলের দোকানে যেতে হয়৷ আমার ফুল চেনার দৌড় অবশ্য ওই কুমড়ো ফুল আর ফুলকপি পর্যন্ত৷ কিন্তু ফুলবিক্রেতা দাদা-দিদিদের সঙ্গে শ্বেতার আলাপচারিতা শুনতে বেশ লাগে৷ ফুল ব্যবসার টানাপোড়েন, দরদাম; আরও কত কী৷ দিনকয়েকের মধ্যেই দোস্তি জমে যায়৷ ফুলটুল অ্যাপ্রিশিয়েট না করতে পারি, রাস্তায় গজিয়ে ওঠা দিলদরিয়া আড্ডাদেরকে দিব্যি চিনতে পারি।

বলাই বাহুল্য; বম্বেতে এসে শ্বেতার ফুল-আড্ডা আর আমার ফুল-টিউশনি থেমে যায়নি৷

সুযোগ



- ভাই পল্টু, অ্যাটেনশন! সোমা লাইব্রেরিতে একা বসে।

- তা'তে কী?

- তা'তে কী মানে! এই তো সুযোগ৷

- সুযোগ?

- সুবর্ণ সুযোগ।

- কীসের সুযোগ?

- তুই এতটাই গবেট?

- আহ্। খুলে বল না।

- মনের কথা জানান দেওয়ার এত বড় মওকা আর পাবিনা৷

- লাইব্রেরিতে গিয়ে এ'সব কথা বলব? সমরেশবাবু পেটাবেন যে!

- আরে ধের। সেই যে রোমান্টিক চিঠিটা লিখে রেখেছিস, ওই যে, কী'সব কঠিন কবিতাফবিতা কোট করে৷ ওইটা স্ট্রেট গিয়ে ওর সামনে রেখে দে৷ কথার চেয়ে ওই চিঠিতে কাজ দেবে বেশি৷ তা'ছাড়া সোমার তোর প্রতি উইকনেস আছে৷ ওর চোখে সে'টার রিফ্লেকশন আমি দেখেছি।

- সত্যি দেখেছিস ভাই?

- মা কালীর দিব্যি৷

- তা'হলে চিঠিটা গিয়ে দিয়েই দি বল? লাইব্রেরিতে?

- শুভস্য শীঘ্রম।

- ইয়ে৷ সমরেশবাবু যদি বাগড়া দেন? যদি..চিঠি দেওয়াটা ট্র‍্যাক করে ফেলেন? লাইব্রেরিয়ান হিসেবে বড্ড বদমেজাজি ভদ্রলোক৷ লাইব্রেরির স্পিরিট নষ্ট করেছি বলে আমায় না রগড়ে দেন৷

- হুম। অকারণে বেজায়গায় নাক গলানোর অভ্যাস আছে বটে ভদ্রলোকের। একটা কাজ কর..হেডস্যার আমায় একটা অফিস মেমো দিয়েছিলেন লাইব্রেরিতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য৷ এ'টা বরং তুইই নিয়ে যা৷ সমরেশবাবুর হাতে আগে দিয়ে দে। এ'টা নিশ্চয়ই উনি খানিকক্ষণ মন দিয়ে পড়বেন৷ সেই ফাঁকে সোমার পাশের চেয়ার বসে; চিঠি দিয়ে কেল্লা ফতে।

- তোর মত বন্ধু হয় না ভাই। তোকে যে আমি কী বলে..।

- বলার কী দরকার। খাইয়ে দিবি না হয়৷ ফিশফ্রাই, চিকেন ফ্রায়েড রাইস, চিলি চিকেন। আর চকোলেট আইসক্রিম৷

- হবে৷ হবে। সব হবে৷ 

- এই যে, সেই লাইব্রেরির মেমো। এ'বার ছুট্টে যা দেখি৷ তা, প্রেমপত্রটা সঙ্গে আছে তো?

- এক্কেবারে বুকপকেটে। অলওয়েজ৷

***

সোমা বসে ছিল লাইব্রেরির উত্তর দিকের জানালার সামনে৷ নরম রোদ্দুরে যে কী মায়াময় দেখাচ্ছিল তাকে। সোমার একটা ডাকনাম দিয়েছে পল্টু, মনে মনে; সুমি৷ সুমি, সুমি; মনে মনে বার দুই বলতেই বুকের ভিতরটায় কেমন মিষ্টি হাওয়া বয়ে গেল৷ আহা৷

কেমিস্ট্রির ঢাউস রেফারেন্স বইটা থেকে আচমকা চোখ তুলল পল্টুর সুমি। পল্টুর মনে হল সুমি তাকে দেখে খানিকটা খুশিই হয়েছে৷ চিঠি দিয়ে মন জয় করার এই আদর্শ সুযোগ, সমরেশবাবু এখন নির্ঘাৎ হেডমাস্টারের মেমোয় নিমজ্জিত। 

সুমির সামনের চেয়ারটা টেনে বসলে পল্টু৷ মুখে    বেকায়দা হাসি। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। কাঁপা হাতে এগিয়ে ধরল সেই যত্নে রাখা প্রেম-দলিল৷ সুমি যেন সে চিঠির অপেক্ষাতেই ছিল। কাগজটা ফস্ করে নিজের হাতে বাগিয়ে নিল সে। তিনটে প্রকাণ্ড ঢোক গিলল পল্টু। 

কেমিস্ট্রির বইয়ের আড়াল সম্বল করে চিঠির ভাঁজ খুললো সোমা; পল্টুর সুমি৷ কিন্তু একটা চাবুকের শপাং টের পেল পল্টু যখন সোমার মুখের হাসি সুট্ করে মিলিয়ে গেল৷ ততক্ষণে তার হাতের তেলো ঘামতে আরম্ভ করেছে৷ তবে কি হিসেবে গড়বড়? সোমা কি পল্টুর সুমি হতে চায় না? 

এ'বার সোমা সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকে শুধোল, "এই পল্টু, লাইব্রেরিয়ানের জন্য লেখা হেডমাস্টারমশাইয়ের মেমো আমায় দেওয়ার কী মানে"? 

মাথাটা ভোঁভোঁ করে উঠলো পল্টুর৷ আর তখনই একটা জলদগম্ভীর হিমশীতল কণ্ঠস্বর লাইব্রেরির স্তব্ধতা চুরমার করে দিলে; "এই যে রসের নাগর পল্টেকুমার! আমার সঙ্গে মস্করা? এ'দিকে আয়, তোর চামড়া ছাড়িয়ে যদি পুরো এনসাইক্লোপিডিয়ার সেট মলাট না দিয়েছি তো আমি হেডলাইব্রেরিয়ান সমরেশ সাহা নয়"!

Saturday, July 1, 2023

খ্বাব ও হকিকত



রাতের বৃষ্টি। স্লগওভারের ঝমঝম পেরিয়ে এ'বার ঝিরঝিরিয়ে ধরে খেলার সময়৷ ইতিমধ্যে মিঠে হাওয়া খেল জমিয়ে দিয়েছে৷ সবচেয়ে বড় কথা; বৃষ্টির ঝাপটার চোটে জানলা-দরজা বন্ধ করে গুমোট ঘরে বসে গজরগজর করতে হচ্ছে না৷ বারান্দায় পাতা মোড়ার কদর তখন আলেকজান্ডারের সিংহাসনের চেয়ে বেশি৷

সেই একটানা ঝিরিঝিরিতে সঙ্গত দিচ্ছেন মেজদার সন্তোষ টেপরেকর্ডার থেকে মাপা ভল্যুমে ভেসে আসা কিশোরকুমার; "খ্বাব হো তুম ইয়া কোই হক্যিকত"। মাপা ভল্যুম, অর্থাৎ যা শুনে বাবা এই রাতের বেলা এসে টেপরেকর্ডার ঝুলবারান্দা থেকে ছুঁড়ে ফেলবেন না৷ কিশোরকে মাঠে আলগা ছেড়ে দিয়ে মেজদা অবশ্য ঘ্যাঁতঘ্যাঁত করে ঘুমোচ্ছে।

ও'দিকে রাজাধিরাজ বাপ্টুকুমার তখন ব্যালকনির মোড়া আলো করে বসে রাতের রাজ্যপাট পরিচালনা করছেন৷ দু'দিনের মাথায় টেস্ট পরীক্ষা, বাপ্টু জানে ওর চোদ্দপুরুষের ক্ষমতা নেই তাকে সসম্মানে উতরে দেওয়ার৷ কিন্তু এই জমাট বৃষ্টির রাতের ওয়ানডেটা সামান্য টেস্টের চিন্তায় নষ্ট করাটা নির্ঘাৎ গবেটামো হবে৷

উলটোদিকের ব্যালকনিটা খালি, সে ব্যালকনি ঘেঁষা কাচের জানলার গায়ে আলো দেখে বোঝা যাচ্ছে যে জোর পড়াশোনা চলছে। বাপ্টু জানে যে কাচের ও'পাশে খ্বাবদেবী দুলে-দুলে পড়ছেন; তরতরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন কিলোকিলো নম্বর বাগানোর উদ্দেশ্যে৷ আর এই ব্যালকনিতে মোড়াশ্বর বাপ্টুকুমার হকিকতের অঙ্ক কষে যাচ্ছেন; খ্বাব ব্যালকনির আলো নেভানো হয়নি, পড়ার শেষে নিশ্চয়ই সে আলো নেভাতে সে বাইরে আসবে৷ নিশ্চয়ই আসবে; ওই ব্যালকনির আলোর স্যুইচ যে ব্যালকনির দেওয়ালেই।

এ'দিকে হকিকত ব্যালকনির বাল্বটা দিনতিনেক আগেই কেটেছে। বড়দার দেওয়া বাল্ব কেনার টাকা চপ খেয়ে উড়িয়ে কী মারাত্মক মুখচোপাটাই না সহ্য করতে হয়েছে বাপ্টুকে। কাজেই এ ব্যালকনি ঘুটঘুটে অন্ধকার, ও ব্যালকনি আলোয় আলোময়। ঘরের ভিতর থেকে মেজদার ঘুম জড়ানো গলা ভেসে এলো, "না পড়ে বারান্দায় বসে গুলতানি মারা? ভিতরে আয় ইডিয়ট"। পরক্ষণেই নাক ফের ডাকার শব্দ; বাপ্টুর নিরেট হকিকত থেকে হকিকততর হয়ে চলে৷ তা'ছাড়া বৃষ্টির রাত যতটা রোম্যান্টিক, ততটাই বিটকেল হল বেয়াদপ মশাদের কামড়।

বাহাত্তর নম্বর মশার কামড় হজম করার পর উল্টো দিকের ব্যালকনির দরজা ফটাস করে খুলে যায়৷

***

দরজা খোলার কেঠো শব্দে চমকে ওঠেন বাপ্টুকুমার ওরফে বাবু হকিকত। খ্বাবদেবী পাশে এসে দাঁড়ানোয় তাঁর সম্বিত ফিরে এসেছে।

- সে এক বয়স ছিল, জানো৷ কতবার রাত জেগে ব্যালকনিতে বসে মশার কামড় খেয়েছি। কখন তুমি কয়েক সেকেন্ডের জন্য বেরিয়ে আসবে। কখন, কখন!

- তোমার সে অধ্যবসায় সংসারে থাকলে বর্তে যেতাম।

- সে অধ্যাবসায় পড়াশোনায় থাকলেও নোবেলটোবেল পেয়ে যেতাম বোধ হয়। অবশ্য, নোবেল দিয়ে ছাই করতামটা কী। এই ভালো।

- বটে? নেহাৎ প্রেমিক হয়েছ বলে নোবেল ছেড়েছ?

- ন্যাচারালি। দেয়ার আর মোর নোবেল লর্যিয়েটস দ্যান নাম্বার অফ ব্যালকনিস্টস যারা হকিকতের বুলডোজারের নীচে নিজের খ্বাবকে শুইয়ে দেয়নি। উই আর রেয়ার।

- ন্যাকা!

- সে যাই বলো, প্রেমের দুনিয়ায় আমিই আলেকজান্ডার! যাক, এই বৃষ্টির রাতে তোমায় জরুরী গান শোনাই বরং৷ ওকে গুগল, প্লে "খ্বাব হো তুম ইয়া কোই হকিকত বাই কিশোরকুমার"।

ফাঁকিবাজ

- এক্সকিউজ মি, আপনার দেশলাইটা পকেট থেকে পড়ে গেল৷ তুলে নিন৷
- থ্যাঙ্কিউ কাকা...ও'টা হারালে যে কী চাপ..তাই..ওহ্..ওহ্।
- আরে!
- ওহ্!
- অনিকেত?
- অ..অনিকেত? কে অনিকেত?
- ক্লাস ইলেভেনের ছেলে..সিগারেট ধরিয়েছ?
- ক..কে ক্লাস ইলেভেন? আমি তো..আমি তো রেলের অফিসে জুনিয়র ক্লার্ক।
- বটে? তুমি বকুলবাগান হাইস্কুলের ছাত্র অনিকেত বাগচি নও? হেডমাস্টারের চোখে ধুলো দেবে?
- আ..আমার নাম মোটেও অনিকেত নয়..আমি..।
- কে?
- আমি..। আমি...।
- নিজের নামটা মনে পড়ছে না?
- মনে..মনে পড়েছে৷ সুভাষচন্দ্র।
- সুভাষচন্দ্র? বসু? বটে?
- বসু কেন হবে স্যার৷ ওর'ম হয় নাকি৷ আমার নাম সু..সুভাষচন্দ্র ঠাকুর।
- ওহ্৷ আর তোমার বয়স সতেরো নয়?
- স..সতেরো?৷ হা হা হা হা হা৷ সতেরো..হা হা। আপনার..আপনার চোখে ন্যা..ন্যাবা পড়েছে।
- শাটাপ!
- আমার নাম সুভাষ ঠাকুর৷ আমি রেলে চাকরি করি৷ আমার বয়স চব্বিশ৷ বকুলবাগান হাইস্কুল আমি কোনওদিন দেখিইনি৷ আমি তো নাগপুরে থাকি, ক'দিনের জন্য চেঞ্জে এসেছি।
- বকুলবাগানে চেঞ্জে এসেছে বাবা সুভাষ?
- হ..হ্যাঁ। ফ্যাটনাস্টিক জায়গা৷ বি..বিউটিফুল ওয়েদার।
- তুমি অনিকেত নও?
- খামোখা অনিকেত অনিকেত করছেন কেন কে জানে..যান দেখি৷ আমার আবার দাড়ি কামানোর ব্লেড কিনতে হবে৷ দিনে তিনবার কামাতে হয় তো..আমার আবার স্মুদ শেভ না হলে চলে না৷ নতুন জায়গা, কাছে কোথায় যে দোকান পাই..তার মাঝে এই আপনি এসে কী'সব বাজে কথা শুরু করলেন। এই নিন, মশাই, দেশলাইটার দিকে নজর তো? রাখুন৷ বারোটা কাঠি আছে৷ অন্যের পিছনে গিয়ে যত ইচ্ছে ব্যবহার করুন৷ আমি আসি।
- সরি৷ আমার ভুল হয়েছে৷ আসলে সকলকে তো স্কুল ইউনিফর্মে দেখে অভ্যাস..।
- আ..আপনার এ'বার রিট্যায়ার করা উচিৎ। ছাত্র চিনতে পারেন না৷ হেডমাস্টারি করবেন কী করে!
- তা অবশ্য ঠিক৷ এ'বার সন্ন্যাস নেওয়ার সময় এসেছে বটে৷ দামড়া বুড়ো আর ছাত্রদের মধ্যে তফাৎ বুঝি না, আর মাস্টারি ফলানো সাজেনা৷ তবে বাবু সুভাষচন্দ্র, একটা সাজেশন দিই। কেমন?
- আবার সাজেশন কেন স্যার। আমার বড্ড তাড়া।
- দাড়ি কামানোর ব্লেড কিনতে হবে৷ জানি৷ তবু৷ মাস্টারকে অল্পবিস্তর মাস্টারি করে যেতে দিন৷ বলছিলাম যে, পারলে একবার নিজের ছেলেবেলার স্কুলের হেডমাস্টারের কাছে ফেরত যান৷
- ক..কেন বলুন তো?
- জবাবদিহির দায় এড়াতে দেবেন না সে ব্যাটাকে।
- আ..আজ্ঞে?
- কষিয়ে দু'ডজন গাঁট্টা মারার সময় গাঁট্টা না মেরে গুল হজম করে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার দায়, এড়াতে দেবেন না সে মাকালফলটিকে৷ যান৷ দাড়ি কামানোর ব্লেড কিনে, সোজা পৌঁছে যান সে হেডমাস্টারের বাড়ি৷ ব্যাটা বেদম ফাঁকিবাজ, একদম ছেড়ে কথা বলবেন না।

জয় জিলিপি

আজ, অফিস ক্যান্টিনে জিলিপি ছিল।

একের পর এক কর্পোরেট বাবু-বিবি জিলিপির মোহ এড়িয়ে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেলেন।
"মিষ্টি ব্যাপারটা কার্টেইল করছি বুঝলেন" বা "ওহ, এ'সব এরা কেন যে সার্ভ করে",
"এক্কেবারে ক্যালরির ডিপো",
"জলেবি ইজনট মাই ফেভারিট ইউ নো",
কিন্তু বলাই বাহুল্য, বেশির ভাগ মানুষই পরাস্ত হলেন।

তারপর যা হওয়ার তাই ঘটল। দু'চার কামড় পড়তেই অফিস ক্যান্টিনের হাওয়া পাল্টাতে শুরু করল। জিলিপির প্যাঁচওলা কর্পোরেট বাবুবিবিদের মন থেকে সমস্ত মারপ্যাঁচ গায়েব৷ একেবারে ধুয়েমুছে সাফ। সামান্য কিছু জিলিপাইজড মুহূর্তেরই জন্য হোক, কিন্তু সে'টুকুও যে অমূল্য।

নাকে-মুখে যা কিছু গুঁজে উঠে পড়া ব্যস্তবাগীশ কর্পোরেট কমান্ডাররা খানিকক্ষণের জন্য গা এলিয়ে দিলেন। স্প্রেডশিট, ডকুমেন্টের বাইরে কিছু না চেনা মানুষও জানালার দিকে তাকিয়ে উদাস সুরে বলে উঠলেন, "এ'বার একটু বৃষ্টি নামকে জমে যাবে"।

টেবিলে-টেবিলে রিভিউয়ের দুশ্চিন্তায় এসে মিশল হঠাৎ-পিকনিকের প্ল্যান।

আদা-কাঁচকলা সম্পর্কের মানুষজন একে অন্যের গাম্বাট ঠাট্টায় হেসে হদ্দ হলেন। কেউ কেউ হাসতে হাসতে বিষম খেলেন, আর প্রমোশনের জন্য লেঙ্গি মারা সহকর্মীটি এসে "আহা রে" বলে তাঁর পিঠে চাপড়ে দিলেন৷

রসালো অফিস গসিপ উড়িয়ে দিল সিনেমা-ক্রিকেট-গল্পেরবই নিয়ে জমাটি গপ্প-তর্ক আর আলোচনা।

খানিকটা সময়ের জন্য ঘড়ির কাঁটাও দু'দণ্ড জিরিয়ে নিয়েছিল বোধ হয়৷ জিলিপিতে কী না হয়।

জয় জিলিপি।

জিবিপির গল্প



আপনারা তো আর সব জেনে বসে নেই৷ সে'টাই স্বাভাবিক। তবে তা'তে আপনাদের আর দোষ কী৷ বিজ্ঞানও এই ব্যাপারটা এখনও ধরতে পারেনি। তবে আজ না পারুক, একদিন পারবে৷ এই যেমন ডারউইনের আগে ইভোলিউশন ব্যাপারটাকে সবাই "কী গুলতাপ্পি দিচ্ছিস বাপ্" বলে উড়িয়ে দিত৷ কিন্তু আজকাল সবাই বাঁদর দেখলেই ইয়ারদোস্তকে জড়িয়ে ধরে বলে "দ্যাখ দ্যাখ ভাই, ওই যে গাছে দোল খাচ্ছে, ও'দিকে..দ্যাখ...বাঁদিক থেকে দেখলে তোর মেজজ্যেঠুর সঙ্গে একটা মারাত্মক সিমিলারিটি দেখতে পাবি। ওই যে, যে জ্যেঠু চাঁদা চাইতে গেলেই চিঁচিঁ করে চেল্লাত। আরে রাগছিস কেন, মাইরি৷ দ্যাখ না ভালো করে"।

তেমনই জরুরী একটা ব্যাপার আজ জানিয়ে যাচ্ছি। গরীবের টাটকা কথা; কাজেই আজ আপনারা পাত্তা দেবেন না৷ তবে একদিন যখন এলিয়েনরা এসে পাড়ার মোড়ের গুমটিতে "দাদা একটা ফ্লেক আর ফ্যান্টাস্টিক একটা জর্দাপান দিন দেখি" বলে জিরোবে, সে'দিন আপনারা এ সত্য অনুভব করতে পারবেন৷

যাকগে৷ আসল ব্যাপারটা বলি৷ বাড়তি মাংসের ঝোল; রাতেরবেলা ডিনার শেষে ফ্রিজে ঢুকিয়ে দেওয়া মাত্রই কী হয় জানেন? জানেন না। আমি বলে দিচ্ছি৷ মাংসের ঝোল রাত্রে খাওয়ার পর সরিয়ে দেওয়া মাত্রই মহাকাশের একদম সেন্টার (অফ কোর্স সেন্টারটা কন্টিনিউয়াসলি পালটে যাচ্ছে) থেকে একটা ওয়েভ জেনারেট হয়ে সেই ঝোল-আলুতে এসে মেশে৷ এই দ্যাখো, ফ্যাক্-ফ্যাক্ করে আসে৷ বললাম তো; মাত্রাতিরিক্ত সাইন্স আম-আদমির সহ্য হয়না৷

যাকগে৷ যা বলছিলাম৷ তা ডিনার শেষে পড়ে থাকা মাংসের ঝোলে স্যাট করে এসে মেশে সেই মহাজাগতিক ওয়েভ৷ সে ওয়েভে থাকে জিবিপি (গডের বাবা পার্টিকল)৷ বুঝলেন? হাসবে না৷ মন দিয়ে শুনুন; জিবিপি৷

মাংসের ঝোলের মধ্যে সেই জিবিপি জাদুমন্ত্রের মত ছড়িয়ে পড়ে। আর তার ফলে তৈরি হয় এক মহাজাগতিক ম্যাজিক৷ যেই ম্যাজিকে আমার মত গাম্বাট মানুষের কবিতা পায় ( তা বলে লেখার রিস্ক নেয় না), অপ্রেমিক মানুষের মুখে জগজিৎ সিংয়ের গান এসে পড়ে, আরও বিভিন্ন রকম অদ্ভুতুড়ে ব্যাপারস্যাপার ঘটতে থাকে৷ সে'সব অদ্ভুতুড়ে ব্যাপারস্যাপারের তল পাওয়ার সময় এখনও আসেনি অবশ্য।

শ'খানেক বছর সবুর করুন, মেওয়া ফলবেই। আরে বিজ্ঞান তো আর থেমে থাকবে না; জিবিপির গল্প একদিন সে ফলাও করে বলবেই৷ তদ্দিন না হয় বাসি মাংসের ঘ্যামকে তুকতাক ভেবেই সন্তুষ্ট থাকুন৷ 

দিল্লীওলা



দিল্লীওলা আমার অন্যতম প্রিয় ট্যুইটার হ্যান্ডেল। ছবির ভালোমন্দ বলার আমি কে। তবে যে ভালোবাসা নিয়ে তিনি দিল্লীর ছোট-ছোট টুকরোগুলোকে ফ্রেম-বন্দী করেন, সে'টাকে সেলাম না ঠুকে থাকা যায় না। তিনি একদিক দিয়ে যেমন ফটো-জার্নালিস্ট, অন্যদিকে ফটো-বাউলও গোছের একটা ব্যাজ পরিয়ে দিলেও দিব্যি মানাবে তাঁকে। আটপৌরে যা কিছু, তার মধ্যেই জাদুমন্ত্র খুঁজে বেড়ানো মানুষ এই ময়ঙ্ক অস্টেন সুফি ওরফে দিল্লীওলা।

অবশ্য আমি আদৌ তাঁকে চিনি না। যে'টুকু দেখেছি তা টুইটার টাইমলাইনেই। এক ক্লান্ত ছোলেকুলচেওলা, বেঞ্চির ওপর পড়ে থাকা একটা শুকনো পাতা অথবা দিল্লীর মেঘলা আকাশ; ওর যে'কোনও ছবির দিকে তাকালেই মনে হয় কী সাধারণ, অথচ কী মায়ার; নির্ঘাত কেউ গল্প লিখছে। আর ওর ক্যাপশনগুলো পড়লে হয়ত যে কারুর মনে হবে যে ফটো-বাউল কথাটা নেহাত ফেলনা নয়। দিল্লীওলার টাইমলাইনের দিকে তাকানোর পর বার বার মনে হয়, "আরে, আমার চারপাশে না জানি কত ম্যাজিক পড়ে আছে। আমিই এক বেওকুফ...পাত্তা না দিয়ে ক্রমাগত খিটখিট করে চলেছি"।

দিল্লী ছেড়েছি মাসখানেক হল। বম্বেতে বসে মাঝেমধ্যেই দিল্লীওলার ছবি দেখি, ক্যাপশন পড়ি। আর যত দেখি, তত মনে হয়, "ইন্টারেস্টিং! আমি তা'হলেও দিল্লীকেও ঠিকঠাক ভাবেই ভালোবেসেছি"।

প্রতিটা শহরের যেন এমন কিছু কবি-ক্রনিকলর জুটে যায়।

ট্রেনের জানালা



ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকার নিয়মাবলি:

১-ক: ট্রেন নন-এসি হলে, জানালার গ্রিলে থুতনি ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে হবে৷
১-খ: ট্রেন এসি হলে, জানালার কাচে নাক ঠেস দিয়ে ড্যাবড্যাব করে তাকিতে থাকতে হবে।
খ: মনে রাখতে হবে, কোনও দৃশ্যপটই অদরকারী নয়।
গ: পাশে বসে কেউ বাজে প্রশ্ন করে চললে অন্যমনস্ক অনিচ্ছুক "হুঁ হাঁ" দিয়ে তাকে নিরস্ত করতে হবে।
ঘ: অচেনা প্ল্যাটফর্ম পেরোনোর সময় বাড়তি মনযোগ দরকার। প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চিগুলো কেমন? খাবারদাবারের দোকান কিছু আছে কি? টিকিটঘর, ওয়েটিংরুম, জলের ব্যবস্থা ইত্যাদি চোখে পড়ছে কি? এ'সব জিনিস মনেমনে নোট করতে বা পারলে জানালার সীটটাই মাটি৷
ঙ: মাঠ-ঘাট-গাছপালা সাঁইসাঁই করে পেরনোর সময় দু'চারকলি গান গুনগুন না করলেই নয়৷ তবে ট্রেনের আওয়াজ ছাপিয়ে সে সুর যেন নিজের কানে না ঢোকে, তা'তে সঙ্গীতরসে বিঘ্ন ঘটার সমূহ সম্ভাবনা৷
চ: রেলের ব্রিজ (যে সাইজেরই হোক) পেরোলেই, বাড়তি উত্তেজনাটাকে ফ্লো করতে দিতে হবে৷ কেউ পাত্তা না দিলেও বলে উঠতে হবে "আইব্বাস, দ্যাখ দ্যাখ দ্যাখ"!
ছ: মাঝেমধ্যে কয়েক সেকেন্ডের জন্য অবাক হয়ে দেখতেই হবে যে কী'ভাবে গাছপালা সব একটা দ্রুতগতির কনভেয়ার বেল্টে উল্টোদিকে ছুটে চলেছে আর ট্রেন একই জায়াগায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷

ক্রিকেট দেখুন



মনকে ভালো রাখতে,
মেজাজকে চনমনে রাখতে,
ক্রিকেট দেখুন।

মোবাইলে, ল্যাপটপে, টিভিতে, ক্রিকইনফোতে;
প্রয়োজনে পাশে বসা মানুষটার স্ক্রিনে উঁকি মেরে।
যে'খানে জোটে, ক্রিকেট দেখুন।

লাইভ ম্যাচে সুবিধে না করতে পারলে, ইউটিউবের দ্বারস্থ হোন।
প্রিয় ব্যাটসম্যান বোকার মত আউট হলে বা প্রিয় বোলার বেদম ঠ্যাঙানি খেলে; তাঁদের পুরনো পার্ফর্ম্যান্স দেখে গর্জে উঠুন।
কিন্তু দেখুন, ক্রিকেট দেখুন।

মনভার বুকে-হুহু যাই হোক, ক্রিকেট ছাড়বেন না।
কারণ আপনার শত দুঃসময়েও; ক্রিকেট আপনাকে ছেড়ে যায়নি।

লিঙ্কডইন ও মুড়ি-বেগুনি

লিঙ্কডইন আমি: ভুলে যেওনা ব্রাদার, লাইফ ইজ নট আ বেড অফ রোজেস। স্ট্রাগল তো থাকবেই, সে'সব পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যেতে পারাটাই হল এক্সেলেন্স।
মুড়ি-বেগুনি আমি: এই একটা দামী কথা বলেছ।
লিঙ্কডইন আমি: কথা দামী না হলে সে'সব মার্কেটে ছাড়বই বা কেন।
মুড়ি-বেগুনি আমি: মার্কেটে আমাদের মত মর্কটদের জায়গা নেই বলছ?
লিঙ্কডইন আমি: মার্কেটে নিজের জায়গা তৈরি করে নিতে হবে৷ নিজেকে এস্টাব্লিশ করতে হবে৷ দাপট না দেখালে চলবে কেন? ওই যে বললাম, মনে রাখতে হবে যে লাইফ ইজ নট আ বেড অফ রোজেস।
মুড়ি-বেগুনি আমি: আহা! ভারী দামী কথা৷ লাখটাকা ভরি একএকটা শব্দ।
লিঙ্কডইন আমি: এই, ঠাট্টা করছ না তো?
মুড়ি-বেগুনি আমি: সিরিয়াসলি ভাই৷ সত্যিই তো, জীবনকে গোলাপ ছড়ানো বিছানা ভাবলেই গা কেমন ঘিনঘিন করছে। জীবন অত খেলো নয়৷ জীবন হল গিয়ে..! এই যে ভাইটি..শোনো না৷ এ'বার আমিও একটা দামী কথা বলব। বলি?
লিঙ্কডইন আমি: তুমিও দামী কথা বলবে? মার্কেটে অতিরিক্ত দামী কথা চালাচালি হলে কথার দাম পড়ে যাবে যে। বেসিক ডিমান্ড অ্যান্ড সাপ্লাই ইস্যু। তবে ইচ্ছে হয়েছে যখন বলো। শুনি।
মুড়ি-বেগুনি আমি: অর্জ কিয়া হ্যায়..।
লিঙ্কডইন আমি: এই আবার নাটুকেপনা শুরু হল..উফ!
মুড়ি-বেগুনি আমি: লাইফ ইজ নট আ বেড অফ রোসেস। বাট লাইফ ক্যান বি আ কাঁথা অফ নয়নতারাস৷ একটু চোখকান খোলা রাখলেই হল।
লিঙ্কডইন আমি: তুমি কান ধরে বাহাত্তরবার ওঠবস করো ব্রাদার।

বার্ডস আর নট রিয়েল

আমি সম্প্রতি একটা জরুরী ফেসবুক গ্রুপ জয়েন করেছি। বার্ডস আর নট রিয়েল।
প্রথম দু'দিন চরম বিরক্তিতে কেটেছে। মহাগুলবাজদের গ্রুপ। পাখি মানেই নাকি ড্রোন। পাখি আদতে আদিম বট। ইত্যাদি। ইত্যাদি। ঘ্যাচাং করে আনফলো করে দিলাম। কিন্তু কী মনে হলো, বেরিয়ে আসিনি গ্রুপ থেকে।
এরপর একটা অদ্ভুত ব্যাপার শুরু হলো। টাইমলাইনে আর সে গ্রুপ থেকে পোস্ট আসে না। কাজেই আমি সেই গ্রুপে যাতায়াত আরম্ভ করলাম। কেন করলাম? জানি না। দিন পাঁচেকের মাথায় আমার প্রাথমিক অবজ্ঞার মধ্যে সামান্য সন্দেহ এসে মিশলো। তলিয়ে ভেবে দেখলাম, পাখিরা আদতে কিন্তু মহাফেরেব্বাজ। বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকুই বা জানি। ডানাওলা জিনিস, সুটসাট উড়ে বেড়ায়। এত হাজার বছরে মানুষকে তারা কনভিন্স করতে পেরেছে যে তাদের মুখ দিয়ে বেরোনো চ্যাঁ-চোঁ চিকিরমিকির মার্কা হেজিপেজি শব্দ আসলে গান। গান না হাতির মাথা। এই জাতকে চোখ বুজে বিশ্বাস করা ঠিক নয়। কেমন?
মানছি, ৯৯% সম্ভাবনা যে তারা রিয়েল। কিন্তু ১% সন্দেহ ওদের প্রতি রাখতে পারলে মানুষের মঙ্গল। কাজেই আজকাল পায়রা দেখলেই বাঁকা চোখে দেখছি। পালকের আড়ালে স্ক্রু-পেরেক যদি কিছু নজরে পড়ে। একটা কাকের ইয়ে গায়ে পড়ল। ঘেন্নার মধ্যে সামান্য আতঙ্কের চোনা মিশে গেল; কোনও ঘ্যাম লেভেলের কেমিকাল এজেন্ট নয় তো?
দিনকাল ভালো না। উড়ুউড়ু বদখত জিনিসপত্র দেখলেই আদেখলাপনা করব না ঠিক করেছি।

অভ্রর জন্মদিন



- অভ্র! মেনি হ্যাপি রিটার্নস অফ দ্য ডে!
- থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ অরূপদা।
- কেমন আছ?
- খুব ভালো৷ অনেকদিন পর তোমার মেসেজ পেয়ে কী'ভালোই না লাগছে। আর আজকাল জন্মদিন-টন্মদিন বেশ মনে রাখছ দেখছি৷ বিয়েটা তা'হলে ক্যারেক্টার রিফর্মেশনে হেল্প করছে বলো।
- হা হা! বিয়ের খবরটা পেয়েছ দেখছি।
- ফেসবুক থাকতে এ'সব ব্যাপার চুপচাপ সেরে ফেলা ইম্পসিবল৷ যা হোক, কনগ্র্যাচুলেশনস। আমাদের পাওনা-ভোজটা ভুলে যেও না৷ তুমি শহরে ফিরলেই একটা আসর বসা চাই।
- লাইক গুড ওল' টাইমস। হ্যাঁ রে, তোর সেই গান-বাজনার অভ্যাসটা আছে তো?
- আজকাল হারমোনিয়াম ছেডে য়্যুকুলেলে ধরেছি বুঝলে। টুংটুং বাজিয়ে একের পর গাইছি আর ইন্সট্যাগ্রামে আপলোড করছি৷
- রিয়েলি! লিঙ্ক পাঠাস তো। শুনব।
- এই'যে। এ'টা গতকালই আপলোড করলাম৷ <লিঙ্ক>।
- বাহ্৷ এ তো দেখছি বাউল। শুনব।
- আরও কিছু আছে প্রোফাইলে৷ সময় পেলে সে'গুলোও শুনো। আর ফীডব্যাক দিও।
- এই ভিডিওতে দেখছি আমাদের পাড়ার দীপকও তোর সঙ্গে গলা মেলাচ্ছে। ও কেমন আছে?
- তোমারই ক্লাবে ভিড়েছে। মাসখানেক আগে বিয়েটা সেরে ফেললে।
- বটে! দাঁড়া। ওকে কংগ্রাচুলেট করে মেসেজ করি।
- লাভ নেই মেসেজ করে। সে এখন সোশ্যাল মিডিয়া ডিটক্সে আছে৷ হোয়্যটাস্যাপ বা কোনও মেসেঞ্জারে পাবে না। এসএমএস-ও সে দেখবে না৷ তাকে পেতে হলে একমাত্র উপায়, আদি অকৃত্রিম টেলিফোন।
***
অ্যালার্মটায় চমকে উঠলে অরূপ।
ফোন হাতে তুলে দেখলে:
"ওয়ান নিউ কনভার্জেশন ইনিশিয়েটেড অ্যান্ড সাকসেসফুলি কনক্লুডেড৷
ওয়ান পেন্ডিং অ্যাকশন পয়েন্ট"।
নোটিফিকেশনটা পড়ে মনটা দিব্যি ভালো হয়ে গেল৷ ব্যাক্তিগত এ-আই বটটা যে কী উপকারি। অরূপের আনসোশ্যাল বদনামটা এদ্দিনে ঘুচেছে। হুররাহ্ বলে একটা মার্কিন কোম্পানির তৈরি এই বট-অ্যাসিসস্ট্যান্ট কিনতে বেশ খানিকটা খরচের ধাক্কা, তবে একবার কিনে ফেললে কাজ হয় ম্যাজিকের মত। বট-বাবাজি দিব্যি নিজের প্রভুর কথাবার্তার স্টাইল ও ভাষার মারপ্যাঁচ রপ্ত করে নেয়; একশো বারোটা ভাষায় নিখুঁত ভাবে কাজ করে। ব্যাপারটাও জলবৎ। নিজের সমস্ত সোশ্যাল মিডিয়ার অ্যাকসেস দিয়ে দাও। নিজের ব্যাপারে শ-খানেক প্রশ্নের উত্তর দিয়ে বায়ো আপলোড করে দাও। তারপর, ইউজারকে ঠিক করতে হবে সে কোন ডিগ্রীর সামাজিক জীব হতে চায়; দশটা লেভেল, অরূপ নিজেকে ছয়ের ঘরে রেখেছে। ব্যাস, নিশ্চিন্দি। বট বাবাজি নিজেই সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে খবর রাখবে কোন আত্মীয় বা বন্ধু কী করছে, তাদের জীবনের ভালোমন্দ রাখবে নখদর্পনে। আর তারপর অবিকল ইউজারের ব্যক্তিগত স্টাইলেই সবার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখবে, চ্যাটে গল্প-আড্ডা জমাবে। বিশেষ দিনগুলোয় বিশেষ-বিশেষ মেসজ পাঠিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেবে। আর অন্য কারুর বোঝার উপায় রইবে না যে সেই চ্যাটগুলো আদতে অরূপের বদলে তাঁর আজ্ঞাবহ দাস, হুররাহ্ কোম্পানির বট, চালিয়ে যাচ্ছে।
খানিকক্ষণ আগেই যেমন দিব্যি সেই বট-ভাইটি অরূপের হয়ে হাজার পুরনো পাড়ার পরিচিত মুখ অভ্রর সঙ্গে গল্প করে ফেলেছে খানিকটা। স্বাভাবিকভাবেই অভ্র টেরও পায়নি যে সে অরূপের বটের সঙ্গে গল্প জুড়েছে। ম্যাজিক সে'খানেই৷ এ বট কিনতে গিয়ে অরূপকে মোটা টাকা গচ্চা দিতে হয়েছে বটে, কিন্তু গোটা ব্যাপারটা যে পয়সা-উশুল পর্যায় গেছে, এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত। যাক, অভ্রর মাধ্যমে বট জানতে পেরেছে যে আর এক পরিচিত মুখ দীপক সদ্য বিয়ে করেছে। অভ্রর মত দীপকও ছেলেবেলার পাড়ার বন্ধুদের মধ্যে পড়ে। যেহেতু দীপক সোশ্যাল মিডিয়ায় নেই, তাই বট পুরোপুরি কাজটা সেরে ফেলতে পারেনি।
এ'বার দীপককে একটা ফোন করতেই হয়।
***
- হ্যালো! দীপক?
- আরে। অরূপদা। কেমন আছ?
- আমি? ভালোই। কংগ্রাচুলেট করতে ফোন করলাম। বিবাহিত জীবন আশা করি ভালোই কাটছে।
- ওহ্। ধন্যবাদ অরূপদা।
- কী, ব্যাপার বল তো৷ এদ্দিন পর কথা হচ্ছে...তুই এত ঝিমিয়ে কথা বলছিস কেন?
- আমি ভাবলাম তুমি খবরটা জেনে ফোন করেছ..।
- কী খবর? খানিকক্ষণ আগে অভ্রর সঙ্গে হোয়্যাটস্যাপে কথা হচ্ছিল৷ সেই জানালে তুই বিয়ে করেছিস..।
- অভ্র? অভ্রর সঙ্গে তোমার খানিকক্ষণ আগে কথা হচ্ছিল?
- এই ধর, আধঘণ্টা আগে কথা হল। আজ সে ব্যাটার জন্মদিন তাই পিং করেছিলাম..।
- অরূপদা..।
- তা সেই বললে যে তুই নাকি..।
- অরূপদা। সামান্য গোলমাল হচ্ছে। ঘণ্টাখানেক আগেই একটা মোটরবাইক অ্যাকিসিডেন্টে সে..সে..। ঘণ্টাখানেক আগেই অভ্র মারা গেছে অরূপদা।
- কিন্তু..কিন্তু..।
- ও ফোনে কোনও এ-আই বট ব্যবহার করত শুনেছি। কী এক হুররাহ কোম্পানির সোশ্যাল বট..তা'তেই বোকা বনেছ হয়তো..সরি তোমার এ'ভাবে..।