প্রতি রোব্বার সকালবেলা আমি একটা ওজনমাপার যন্ত্রের ওপর গিয়ে দাঁড়াই। ওই দাঁড়ানোটাই আমার ডিসিপ্লিন। এক প্রকার হুঙ্কারও বলা যেতে পারে; এই দ্যাখো। আমি নেহাৎ ন্যালাখ্যাপা নই। জাতে হাভাতে কিন্তু তালে "হেল্থ অ্যাওয়ারনেস" আছে।
সক্কাল সক্কাল ওজন মেপেই মনে হয় " নাহ্, মনের মধ্যে একটা ফোকাস দানা বাঁধছে"৷ ওজন বাড়তি না কমতি সে'সব বাজে প্রশ্নে নিজেকে বেঁধে ফেলার মানে হয়না৷ এই যে ওজন মাপছি, সে'টা ভেবেই নিজের প্রতি মারাত্মক রেস্পেক্ট তৈরি হয়৷ এ'বার একটা চাবুক সিস্টেমে নিজেকে ফেলতে পারলেই হল৷ আর সে'দিক থেকে রোব্বারের জবাব নেই৷ সকাল সাড়ে ন'টায় ঘুম ভাঙার পর এমনিতেই নিজেকে ভারী মজবুত বলে মনে হয়৷ সেই মজবুত মনোভাবটা লুচি-তরকারি চিবোতে চিবোতে বাড়তে থাকে৷
কিন্তু হুজুগে ঝাঁপ দিলেই তো চলে না৷ কাজেই সোফায় লম্বা হয়ে একটু মেডিটেট করতে হয়। এই যে একটা প্রবল ডিসিপ্লিন-বোধ, সে'টা একটা ইস্পাতের ফলা৷ সাবধানে ব্যবহার করলে প্রডাক্টিভ, নয়ত কচুকাটা হওয়ার সম্ভাবনা৷ তা সে'টাকে আমি ঠিক কী'ভাবে ব্যবহার করব, সে'টা নিয়ে একটু মাথা ঘামানোর প্রয়োজন। এ'খানে বলি, আমার একটা মারত্মক লেবু-সরবতের ফর্মুলা আছে৷ একটু বাড়তি মিষ্টি, সামান্য সোডা সহযোগে সে এক মারকাটারি জিনিস৷ ওই মুকুজ্জে-স্পেশাল-লেমোনেডে চুমুক দিলে মেডিটেশন জমে ভালো। এ'বার থেকে তবে দিনে বারো হাজার স্টেপ্স? ডিনারে জিরো কার্ব? হপ্তায় একদিন ফ্রুট ডিটক্স? এ'সব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে দুর্দান্ত সব স্পার্ক তৈরি হয়ে শিরা-উপশিরায় ছড়িয়ে পড়ে৷
সমস্যা হল, পোস্ট লুচি আর প্রি-মাংস মানসিক স্তরে একটা খুব রোমান্টিক ঝিমুনি আসে৷ ঘুম নয়, ঘুম নয়৷ বেশি ঘুম ভালো নয়। ও'টা একটা আলগা আমেজ বলা যেতে পারে৷ যে আমেজে যাবতীয় শব্দপ্রবাহ স্তিমিত হয়ে আসে, চারপাশের মানুষজন ঝাপসা হয়ে পড়ে। ইংরেজিতে যাকে বলে "ট্রান্স"। সে সমাধি ভাঙতে ভাঙতে স্বাস্থ্য-তপস্যা কিঞ্চিৎ বিঘ্নিত হয় বটে৷ কিন্তু এ অনাবিল জীবনে তো আর রোব্বারের অভাব নেই৷ এ রোব্বার হল না, পরের রোব্বার হবে'খন৷ দুনিয়া তো গোল্লায় যাচ্ছে না৷ এ'টা ভেবে একটা প্রবল তৃপ্তি অনুভব করি, আহ্ - সামনের রোববার থেকে দুনিয়াটা পালটে যাবে, ডিসিপ্লিনের গঙ্গায় মছলিবাবা স্টাইলে ডুবসাঁতার দিয়ে ঘুরে বেড়াব৷
স্নান করতে যাওয়ার আগে কী খেয়াল হল, খানিকক্ষণ বসে বাংলা খবরের চ্যানেল চালিয়ে দিলাম৷ রোব্বার তো, একটু ডেয়ারডেভিল কিছু করা দরকার৷ তিনটে পার্টির তিনজন মানুষ নাগাড়ে চিল্লিয়ে চলেছেন। অজস্র মিথ্যে খুনে-কনফিডেন্স নিয়ে বলছেন, যুক্তিফুক্তির মত ফালতু ব্যাপারকে তোয়াক্কা করছেন না৷ ওই, টিআরপির জগতে রাজনৈতিক আলোচনা যেমন হওয়া উচিৎ আর কী৷
বাইশ মিনিট শুনলাম। ব্রেনের ভিতর স্টিলের গেলাসে ডিম ফেটানোর খটরখটর শব্দ শুনতে পাওয়া মাত্র টিভি বন্ধ করতে হল৷ টের পেলাম, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে৷ গলা শুকিয়ে এসেছে৷ স্মার্টঘড়ি বলছে রেস্টিং হার্ট রেট স্যাট করে বেড়ে গেছে৷ ইন্টেরেস্টিং৷ সুট করে গিয়ে ফের ওজন মাপার যন্ত্রে দাঁড়ালাম৷ সকালের তুলনায় একশো গ্রাম কম।
ব্রাভো! ব্রাভো! ব্রাভো! আজ লাঞ্চে দু'পিস বাড়তি মাটন খাওয়া যাবে৷
No comments:
Post a Comment