মাঝেমধ্যে মানুষকে সাহায্য না করতে পারলে ভালো লাগেনা। এই আমার একটা রোগ। দিনে দু'একবার পরোপকার না করলে আমার চলেনা। কী করব, পার্সোনালিটিটাই ও'রকম। এই যেমন এই মাত্র অফিসের সীট ছেড়ে উঠে পায়চারি শুরু করলাম। চারপাশটা জরীপ করে দেখলাম কোন অভাগার সামান্য এমপ্যাথির প্রয়োজন। এই প্রসেসটাকে আমি বলি 'দ্য ওয়াক অফ এমপ্যাথি'।
আজ দেখলাম অ্যাকাউন্টসের গোকুলবাবু চেয়ারে বসে ছটফট করছেন আর কপাল চাপড়াচ্ছেন। এসি রুমে বসেও কপালে বিন্দুবিন্দু ঘাম। দুশ্চিন্তা মাখানো মুখটা তোবড়ানো টিফিন বাক্সর মত হয়ে আছে। দুম করে ঝাঁপিয়ে পড়লাম না, শরীর-টরীর খারাপ হলে একটু দূর থেকে দেখাই ভালো। হঠাৎ হাসপাতাল-টাসপাতাল ছোটাছুটি করতে হলে সে এক অন্য হ্যাপা। আমার আবার ঘণ্টাখানেক পর একটা জরুরী মিটিং আছে। কিন্তু খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিশ্চিন্ত হলাম যে গোকুলবাবুর হার্টঅ্যাটাক গোছের কিছু হয়নি। ভদ্রলোক স্রেফ ঘাবড়ে আছেন। দূর থেকে কান পেতে যা শুনলাম তাতে মনে হল অফিসের কোনও গোলমাল৷ কিছু ফাইলটাইল হারিয়েছে, জরুরী ডেডলাইন ফস্কে যাওয়ার উপক্রম৷ বুঝলাম, এ'খানে আমার কিছু একটা করার দরকার। ওই যে বললাম, সাহায্য করার সুযোগ পেলে আমার আর কিছু মাথায় থাকে না৷
"এই যে গোকুলবাবু" বলে স্মার্টলি এগিয়ে গেলাম। আমার মুখে তখন একটা মাখন হাসি, যে'টা দিয়ে বহু জটিল সমস্যার আমি করেছি৷ গোকুলবাবু মানুষটা সরল, বুঝতে পারলাম যে আমার উপস্থিতিতে বুকে বল পেয়েছেন।
"কী যে বলি দাদা..." বলে গোকুলবাবু নিজের সমস্যার বাক্সপেটরা খুলে বসলেন৷ এই এক গেরো, পরোপকার করতে এসেছি বলে কি আমার সময়ের কোনও দাম নেই? দু'কাপ কফি শেষ হয়ে গেল কিন্তু গোকুলবাবুর হাহাকার থামার কোনও নাম নেই৷ দামড়া লোক, ফাইল হারালি কোন আহ্লাদে৷ আর ডেডলাইন মিস হতেই পারে, বসকে অত ডরানোরই বা কী আছে।
একটা সময় বাধ্য হয়ে বলতে হল, "বুঝেছি গোকুলবাবু, বুঝেছি। বাকিটা না বললেও চলবে"। গোকুলবাবু থামতেই ঝুলি থেকে বের করে আনলাম ব্রহ্মাস্ত্রটি৷ সেই এক অমোঘ বাণী যা দিয়ে কত মানুষের সমস্যা আমি তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছি৷ কত উদ্ভ্রান্ত মানু্ষের মুখ থেকে দুশ্চিন্তার কালো মেঘ মুছে দিয়ে সহস্র চাইনিজ টুনিবাতি জ্বেলে দিয়েছি৷
আমি গলাটা একটু নামিয়ে আর খানিকটা ব্যারিটোন ইয়ে এনে বললাম, "গোকুলবাবু৷ সমস্যাটা সিরিয়াস৷ তবে সামাল দেওয়া যাবে৷ ইজি, ইজি৷ শুধু আমার দেওয়া গুরুমন্ত্রটা মনে রাখবেন"।
গোকুলবাবুর চোখ গোল গোল, মুখে আশার ঝিলিক।
স্মিত হেসে বললাম, "ক্রাইসিস ম্যানেজ দেওয়ার ফর্মুলা একটাই৷ টেনশন নেবেন না৷ একদম টেনশন নেবেন না৷ ব্যাস, তা'তেই সবকিছু জলবৎ তরলং৷ দেখবেন ট্রাই করে৷ অব্যর্থ"।
কিছু একটা উত্তর দিতে চেয়েও থমকে গেলেন গোকুলবাবু, "টেনশন নেব না"?
" না৷ টেনশন নেবেন না৷ কেমন"?
গোকুলবাবুর মুখ দিয়ে কোনও শব্দ বেরোল না৷ বুঝতে পারলাম, মুগ্ধ হয়ে কথা আটকে গেছে। এত সহজ সমাধান, অথচ এ'টাই এতক্ষণ ওর মাথায় আসেনি। টেনশন না নিলেই তো মিটে গেল।
বত্রিশ সেকেন্ড পর্যন্ত গোকুলবাবু যখন একটা শব্দও উচ্চারণ করতে পারলেন না, তখন আমি বাধ্য হয়ে উঠে পড়লাম৷ একা গোকুলবাবুতে আটকে থাকলে তো চলবে না৷ ঘুরেফিরে দেখি আর কার উপকার করতে পারি।
No comments:
Post a Comment