** অনন্ত**
একটা অত্যন্ত সাদামাটা মানুষের বহুপুরোনো একটা সাদাকালো ছবি। সাদামাটা বলছি কারণ ভদ্রলোকের চেহারায় তেমন কোনও বিশেষত্ব আমার চোখে অন্তত ধরা পড়ছে না। বয়স ওই তিরিশ-বত্রিশ। মাঝারি হাইট, পাতলা চুল ছোট করে কাটা আর পাট করে আঁচড়ানো। একটা নিরীহ গোঁফ, তার সঙ্গে লাগসই ভদ্রলোকের ম্যাদামারা চাউনি। পরনে চেক হাফশার্ট, কালো ঢলা প্যান্ট আর চামড়ার চটি। পিছনের দেওয়াল জুড়ে হাতে আঁকা ছবি, ডাললেকে শিকারা ভাসছে; আর পাঁচটা পুরনো ফোটো স্টুডিওতে যেমনটা থাকত আর কী। ভদ্রলোকের সামনে একটা বেতের চেয়ার। কোনও অদ্ভুত কারণে চেয়ারে না বসে তিনি চেয়ারটা ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। স্টুডিওর সস্তা কার্পেটে ফুল ফুল ডিজাইন। সম্ভবত পাঁচ বাই সাত ইঞ্চি সাইজের প্রিন্ট, সস্তা কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো। হলদে দেওয়ালটার একদিকে একটা ক্যালেন্ডার, অন্যদিক বইয়ের তাক; ঠিক মাঝখানে ঝুলছে এই ছবিটা।
এই ঘরটা আমি চিনি না, অতএব এই দেওয়ালটাও আমার চেনার কথা নয়।
এই অচেনা ভদ্রলোকের ছবিটাও আমার কাছে তাই ভীষণ অচেনা; তবু কেন যে ছবিটার থেকে চোখ সরাতে পারছি না কে জানে। এইভাবে আমি কতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি? পনেরো সেকেন্ড? পনেরো মিনিট? সোয়া ঘণ্টা? ঠিক বলতে পারব না।
আমি আজকাল কিছুই বলতে পারি না।
আমি শুধু জানি আমি ছবিটার থেকে চোখ সরাতে পারছি না।
আমি কি এই ভদ্রলোককে আগে কোথাও দেখেছি? বা এই ছবিটা আগে কোথাও নজরে পড়েছে?
কে জানে।
নিজের ওপর খানিকটা বিরক্ত বোধ করছিলাম। আমি কি এতটা অকেজো? দিনদুপুরে এই ছবিটার দিকে তাকিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকার কোনও মানে হয়?
কিন্তু কী আশ্চর্য, বিরক্তি সত্ত্বেও চোখ সরাতে পারছিলাম না। কী একটা ভেবে যেন দু'পা এগিয়ে ছবিটার ঠিক নিচে গিয়ে দাঁড়ালাম।
এইভাবে কতক্ষণ ছবিটার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম জানিনা। আচমকা একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর কানে ভেসে এলো। ঘুরে দেখলাম ডাক্তারবাবু।
** ডাক্তার চ্যাটার্জী ও অনন্ত **
- আপনি কখন এলেন ডাক্তারবাবু?
- এইতো।
- ভালো আছেন?
- দিব্যি। তুমি কেমন আছ অনন্ত?
- শরীরে ব্যথা-বেদনা কিছু টের পাচ্ছিনা।
- গুড। গুড। এক্সেলেন্ট।
- ডাক্তারবাবু, আমি কোথায় আছি বলতে পারেন?
- আমার চেম্বারে।
- এ'টা আপনার চেম্বার?
- না না। এ'টা তোমার মনের ভিতর। হিপনোটিকালি তোমার মনের মধ্যে আমি এই স্মৃতিটা উস্কে দিয়েছি। তুমি আমার চেম্বারের কাউচে চোখ বুজে শুয়ে আছো, তন্দ্রাচ্ছন্ন। আমি তোমার সঙ্গে চেম্বারে বসে কথা বলছি, তুমি চোখ বুজে আমার কথা শুনতে পারছ। আর তোমার মনের মধ্যের এই ঘরটায় আমাকেও এনে ফেলছ।
- ওহ্। সামনের দেওয়ালটা কাঁপছে।
- হিপনোটিজমের মায়াজাল ছিঁড়তে আরম্ভ করেছে। আমি তোমায় ধীরেসুস্থে ওই স্বপ্ন থেকে ফিরিয়ে আনছি। যারা আমায় কোয়্যাক বলে উড়িয়ে দেয় অনন্ত, তাদের আমি কেয়ার করি না। কিন্তু তুমি তো জানো অনন্ত, প্রতি হপ্তায় আমি কী'ভাবে তোমায় একটু একটু এগিয়ে দিই...।
- ডাক্তারবাবু, এই দেওয়ালটা আমার কল্পনায় তৈরি?
- বললাম তো, আমার কাজ খালি উস্কে দেওয়া। পুরো ছবিটাই তোমার তৈরি। নিজের মেমরিতে ভর দিয়ে তুমি তৈরি করেছ।
- সব কিছু স্পষ্ট দেখছি...কিন্তু আমি চিনতে পারছি না কেন...।
- ফোকাস। স্বপ্নাচ্ছন্ন ভাবটা আরও কিছুক্ষণ থাকবে, দেওয়ালটা এখনই উবে যাবে না। নিজের স্মৃতিকে চেনার চেষ্টা করো। কী কী দেখছ তুমি?
- একটা হলদেটে দেওয়াল। একদিকে একটা ক্যালেন্ডার; মণ্ডল ভ্যারাইটি স্টোর্সের, তা'তে স্বামী বিবেকানন্দর ছবি। অন্যপাশে একটা বইয়ের শেলফ। আর মাঝে...।
- মাঝে?
- একটা ছবি...ফটো-ফ্রেম ছবিটা...ছবিটার দিক থেকে আমি চোখ ফেরাতে পারছি না। ভারি অস্বস্তি হচ্ছে আমার...।
- ভেরি গুড অনন্ত। কীসের ছবি ও'টা...তুমি দেখতে পারছ?
- একটা পুরনো ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ছবি। স্টুডিওতে তোলা।
- বাহ্। বেশ ডিটেইলড তো। ছবিতে কী দেখছ?
- একজন গোবেচারা ভদ্রলোক। পাতলা গোঁফ। হাফশার্ট। একটা বেতের চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে...।
- চেয়ার? তা'তে কে বসে?
- ফাঁকা। চেয়ারটা ফাঁকা।
- ওহ্। আর কিছু দেখছ?
- না। ওই ছবিটা থেকে আমি চোখ সরাতে পারছি না।
- হুম।
- ডাক্তারবাবু, দেওয়ালটা এ'বার আবছা হতে আরম্ভ করেছে।
- হ্যাঁ, তোমার তন্দ্রা এ'বার কেটে যাচ্ছে।
- সব মিলেমিশে যাচ্ছে...দেওয়াল...ক্যালেন্ডার...বই...ফটো-ফ্রেম...।
- ওয়েক আপ অনন্ত। ওয়েক আপ!
- ডাক্তারবাবু..।
- শরীর কেমন লাগছে?
- একটু...একটু ক্লান্ত। আমি কি অনেকক্ষণ এ'ভাবে শুয়েছিলাম?
- না না। কয়েক মিনিট মাত্র।
- নার্সকে ডেকে দিচ্ছি, ও তোমায় নিয়ে যাবে।
- আমি আর কতদিন আপনার হাসপাতালে থাকব ডাক্তারবাবু?
- তাড়াহুড়ো কীসের অনন্ত। সুস্থ হয়ে নাও। আর কোথায় যেতে চাও তুমি?
- কোথায়...কোথায় যাব বলুন তো?
- আমি তোমার প্রগ্রেসে খুব খুশি। আর ক'দিন যাক। তুমি নিজেই বলতে পারবে তুমি কোথায় যেতে চাও।
- আমার...আমার কিছুই ঠিকভাবে মনে পড়ে না...।
- পড়বে। খুব শিগগির। আমি নিশ্চিত।
**ডাক্তার চ্যাটার্জী**
খোকাকে ওর বেডে শুইয়ে, নার্সকে ওর নতুন ওষুধপত্রগুলো বুঝিয়ে দিলাম। বড় ক্লান্ত হয়ে পড়ে এই সেশনগুলোর পর ও। তবে আমি ভীষণ খুশি আজ। প্রথম ছ'টা সেশন ও শুধু দেওয়ালটাই দেখেছে। গত দু'দিন ধরে ক্যালেন্ডার আর বইয়ের তাকটা দেখতে শুরু করেছিল। এদ্দিন চেষ্টার পর আজ খোকা ফটোটা দেখতে পেরেছে, আর নিজে বারবার বলেছে যে সেই ফটোর দিক থেকে চোখ সরাতে পারছে না। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি; এ সমস্তই অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। ফিরে আসবে, খোকার স্মৃতি ফিরে আসবে। মোটর অ্যাক্সিডেন্টটাই অনন্তর জীবনের শেষ কথা হয়ে দাঁড়াবে না। চেম্বার বন্ধ করে ওপরে নিজের ঘরে যখন পৌঁছলাম তখন দুপুর তিনটে। বাড়ির নীচেই হসপিটাল থাকার এই এক সুবিধে। খিদে ছিল না, লাঞ্চটা তাই আজও বাদ গেল।
সোজা গিয়ে দাঁড়ালাম আমাদের উত্তরের ঘরটায়, সেই হলুদ দেওয়ালটার সামনে। এইতো, অনন্তর ঠিকঠাকই মনে পড়ছে। ওই তো বাঁ দিকে সেই ক্যালেন্ডার, ডানদিকে বইয়ের শেলফ। আর মাঝে সেই ছবিটা। নিমাইগঞ্জের আনন্দলোক স্টুডিওতে তোলা। তখন আমার কতই বা বয়স; পঁয়ত্রিশ বড়জোর। হেহ্, অনন্ত আমায় গোবেচারা বললে! আমার সামনে বেতের চেয়ারে ছোট্ট অনন্ত; আমার খোকা। তখন তার বয়স আড়াই। চেয়ারে থেবড়ে বসে, ড্যাবড্যাবে চোখ, মুখে হাসি।
সেই হাসি ফিরবেই। আমি ফেরাবো। ফেরাবোই!
আর কদিন পর খোকার স্বপ্নের মধ্যের ফটো-ফ্রেমে এই চেয়ার আর ফাঁকা থাকবে না।
আর সে'দিন খোকা আমায় চিনবেই। চিনবেই।
***
(বিশ্ব ফটোগ্রাফি দিবস; তাই এই লেখা)