Saturday, August 19, 2023

ফটোগ্রাফ

** অনন্ত**  

একটা অত্যন্ত সাদামাটা মানুষের বহুপুরোনো একটা সাদাকালো ছবি। সাদামাটা বলছি কারণ ভদ্রলোকের চেহারায় তেমন কোনও বিশেষত্ব আমার চোখে অন্তত ধরা পড়ছে না। বয়স ওই তিরিশ-বত্রিশ। মাঝারি হাইট, পাতলা চুল ছোট করে কাটা আর পাট করে আঁচড়ানো। একটা নিরীহ গোঁফ, তার সঙ্গে লাগসই ভদ্রলোকের ম্যাদামারা চাউনি। পরনে চেক হাফশার্ট, কালো ঢলা প্যান্ট আর চামড়ার চটি। পিছনের দেওয়াল জুড়ে হাতে আঁকা ছবি, ডাললেকে শিকারা ভাসছে; আর পাঁচটা পুরনো ফোটো স্টুডিওতে যেমনটা থাকত আর কী। ভদ্রলোকের সামনে একটা বেতের চেয়ার। কোনও অদ্ভুত কারণে চেয়ারে না বসে তিনি চেয়ারটা ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। স্টুডিওর সস্তা কার্পেটে ফুল ফুল ডিজাইন। সম্ভবত পাঁচ বাই সাত ইঞ্চি সাইজের প্রিন্ট, সস্তা কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো। হলদে দেওয়ালটার একদিকে একটা ক্যালেন্ডার, অন্যদিক বইয়ের তাক; ঠিক মাঝখানে ঝুলছে এই ছবিটা।

এই ঘরটা আমি চিনি না, অতএব এই দেওয়ালটাও আমার চেনার কথা নয়।
এই অচেনা ভদ্রলোকের ছবিটাও আমার কাছে তাই ভীষণ অচেনা; তবু কেন যে ছবিটার থেকে চোখ সরাতে পারছি না কে জানে। এইভাবে আমি কতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি? পনেরো সেকেন্ড? পনেরো মিনিট? সোয়া ঘণ্টা? ঠিক বলতে পারব না।
আমি আজকাল কিছুই বলতে পারি না।
আমি শুধু জানি আমি ছবিটার থেকে চোখ সরাতে পারছি না।
আমি কি এই ভদ্রলোককে আগে কোথাও দেখেছি? বা এই ছবিটা আগে কোথাও নজরে পড়েছে?
কে জানে।
নিজের ওপর খানিকটা বিরক্ত বোধ করছিলাম। আমি কি এতটা অকেজো? দিনদুপুরে এই ছবিটার দিকে তাকিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকার কোনও মানে হয়?
কিন্তু কী আশ্চর্য, বিরক্তি সত্ত্বেও চোখ সরাতে পারছিলাম না। কী একটা ভেবে যেন দু'পা এগিয়ে ছবিটার ঠিক নিচে গিয়ে দাঁড়ালাম। 

এইভাবে কতক্ষণ ছবিটার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম জানিনা। আচমকা একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর কানে ভেসে এলো। ঘুরে দেখলাম ডাক্তারবাবু।



** ডাক্তার চ্যাটার্জী ও অনন্ত ** 

- আপনি কখন এলেন ডাক্তারবাবু?

- এইতো।

- ভালো আছেন? 

- দিব্যি। তুমি কেমন আছ অনন্ত?

- শরীরে ব্যথা-বেদনা কিছু টের পাচ্ছিনা।

- গুড। গুড। এক্সেলেন্ট।

- ডাক্তারবাবু, আমি কোথায় আছি বলতে পারেন?

- আমার চেম্বারে। 

- এ'টা আপনার চেম্বার?

- না না। এ'টা তোমার মনের ভিতর। হিপনোটিকালি তোমার মনের মধ্যে আমি এই স্মৃতিটা উস্কে দিয়েছি।  তুমি আমার চেম্বারের কাউচে চোখ বুজে শুয়ে আছো, তন্দ্রাচ্ছন্ন। আমি তোমার সঙ্গে চেম্বারে বসে কথা বলছি, তুমি চোখ বুজে আমার কথা শুনতে পারছ। আর তোমার মনের মধ্যের এই ঘরটায় আমাকেও এনে ফেলছ।

- ওহ্‌। সামনের দেওয়ালটা কাঁপছে।

- হিপনোটিজমের মায়াজাল ছিঁড়তে আরম্ভ করেছে। আমি তোমায় ধীরেসুস্থে ওই স্বপ্ন থেকে ফিরিয়ে আনছি। যারা আমায় কোয়্যাক বলে উড়িয়ে দেয় অনন্ত, তাদের আমি কেয়ার করি না। কিন্তু তুমি তো জানো অনন্ত, প্রতি হপ্তায় আমি কী'ভাবে তোমায় একটু একটু এগিয়ে দিই...।

- ডাক্তারবাবু, এই দেওয়ালটা আমার কল্পনায় তৈরি?

- বললাম তো, আমার কাজ খালি উস্কে দেওয়া। পুরো ছবিটাই তোমার তৈরি। নিজের মেমরিতে ভর দিয়ে তুমি তৈরি করেছ।

- সব কিছু স্পষ্ট দেখছি...কিন্তু আমি চিনতে পারছি না কেন...। 

- ফোকাস। স্বপ্নাচ্ছন্ন ভাবটা আরও কিছুক্ষণ থাকবে, দেওয়ালটা এখনই উবে যাবে না। নিজের স্মৃতিকে চেনার চেষ্টা করো। কী কী দেখছ তুমি?

- একটা হলদেটে দেওয়াল। একদিকে একটা ক্যালেন্ডার; মণ্ডল ভ্যারাইটি স্টোর্সের, তা'তে স্বামী বিবেকানন্দর ছবি। অন্যপাশে একটা বইয়ের শেলফ। আর মাঝে...।

- মাঝে? 

- একটা ছবি...ফটো-ফ্রেম ছবিটা...ছবিটার দিক থেকে আমি চোখ ফেরাতে পারছি না। ভারি অস্বস্তি হচ্ছে আমার...।

- ভেরি গুড অনন্ত। কীসের ছবি ও'টা...তুমি দেখতে পারছ?

- একটা পুরনো ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ছবি। স্টুডিওতে তোলা।

- বাহ্‌। বেশ ডিটেইলড তো। ছবিতে কী দেখছ?

- একজন গোবেচারা ভদ্রলোক। পাতলা গোঁফ। হাফশার্ট। একটা বেতের চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে...।

- চেয়ার? তা'তে কে বসে?

- ফাঁকা। চেয়ারটা ফাঁকা। 

- ওহ্‌। আর কিছু দেখছ?

- না। ওই ছবিটা থেকে আমি চোখ সরাতে পারছি না।

- হুম।

- ডাক্তারবাবু, দেওয়ালটা এ'বার আবছা হতে আরম্ভ করেছে। 

- হ্যাঁ, তোমার তন্দ্রা এ'বার কেটে যাচ্ছে।

- সব মিলেমিশে যাচ্ছে...দেওয়াল...ক্যালেন্ডার...বই...ফটো-ফ্রেম...।

- ওয়েক আপ অনন্ত। ওয়েক আপ!

- ডাক্তারবাবু..।

- শরীর কেমন লাগছে? 

- একটু...একটু ক্লান্ত। আমি কি অনেকক্ষণ এ'ভাবে শুয়েছিলাম?

- না না। কয়েক মিনিট মাত্র।

- নার্সকে ডেকে দিচ্ছি, ও তোমায় নিয়ে যাবে।

- আমি আর কতদিন আপনার হাসপাতালে থাকব ডাক্তারবাবু? 

- তাড়াহুড়ো কীসের অনন্ত। সুস্থ হয়ে নাও। আর কোথায় যেতে চাও তুমি?

- কোথায়...কোথায় যাব বলুন তো?

- আমি তোমার প্রগ্রেসে খুব খুশি। আর ক'দিন যাক। তুমি নিজেই বলতে পারবে তুমি কোথায় যেতে চাও।

- আমার...আমার কিছুই ঠিকভাবে মনে পড়ে না...।

- পড়বে। খুব শিগগির। আমি নিশ্চিত।


**ডাক্তার চ্যাটার্জী**

খোকাকে ওর বেডে শুইয়ে, নার্সকে ওর নতুন ওষুধপত্রগুলো বুঝিয়ে দিলাম। বড় ক্লান্ত হয়ে পড়ে এই সেশনগুলোর পর ও। তবে আমি ভীষণ খুশি আজ। প্রথম ছ'টা সেশন ও শুধু দেওয়ালটাই দেখেছে। গত দু'দিন ধরে ক্যালেন্ডার আর বইয়ের তাকটা দেখতে শুরু করেছিল। এদ্দিন চেষ্টার পর আজ খোকা ফটোটা দেখতে পেরেছে, আর নিজে বারবার বলেছে যে সেই ফটোর দিক থেকে চোখ সরাতে পারছে না। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি; এ সমস্তই অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। ফিরে আসবে, খোকার স্মৃতি ফিরে আসবে। মোটর অ্যাক্সিডেন্টটাই অনন্তর জীবনের শেষ কথা হয়ে দাঁড়াবে না। চেম্বার বন্ধ করে ওপরে নিজের ঘরে যখন পৌঁছলাম তখন দুপুর তিনটে। বাড়ির নীচেই হসপিটাল থাকার এই এক সুবিধে। খিদে ছিল না, লাঞ্চটা তাই আজও বাদ গেল।

সোজা গিয়ে দাঁড়ালাম আমাদের উত্তরের ঘরটায়, সেই হলুদ দেওয়ালটার সামনে। এইতো, অনন্তর ঠিকঠাকই মনে পড়ছে। ওই তো বাঁ দিকে সেই ক্যালেন্ডার, ডানদিকে বইয়ের শেলফ। আর মাঝে সেই ছবিটা। নিমাইগঞ্জের আনন্দলোক স্টুডিওতে তোলা। তখন আমার কতই বা বয়স; পঁয়ত্রিশ বড়জোর। হেহ্‌, অনন্ত আমায় গোবেচারা বললে! আমার সামনে বেতের চেয়ারে ছোট্ট অনন্ত; আমার খোকা। তখন তার বয়স আড়াই। চেয়ারে থেবড়ে বসে, ড্যাবড্যাবে চোখ, মুখে হাসি।

সেই হাসি ফিরবেই। আমি ফেরাবো। ফেরাবোই!
আর কদিন পর খোকার স্বপ্নের মধ্যের ফটো-ফ্রেমে এই চেয়ার আর ফাঁকা থাকবে না।
আর সে'দিন খোকা আমায় চিনবেই। চিনবেই। 

***

(বিশ্ব ফটোগ্রাফি দিবস; তাই এই লেখা)

Tuesday, August 15, 2023

রেজাল্ট

- কী রে সুমন। অত নার্ভাস হচ্ছিস কেন? এগজ্যাম ভালো দিয়েছিস। ভাইভাও বললি চমৎকার হয়েছে। এখন এত ঘাবড়ানোর কী হয়েছে কে জানে।

- পিলুদা। তুই অদ্ভুত একজন মানুষ মাইরি৷ তোর টেনশন হচ্ছে না? আধঘণ্টার মধ্যে রেজাল্ট বেরোবে, ও'রকম গায়ে হাওয়া লাগিয় কী'ভাবে ঘুরছিস কে জানে। রেজাল্ট তো তোরও বেরোবে।

- টেনশন নিয়ে করবটা কী বল্৷ তার চেয়ে একদান দাবা খেলি চ'।

- অসম্ভব। ইশ, আচমকা মনে হচ্ছে ইকনমিক্সের উত্তরগুলো কাঁচা হয়ে গেছে। আর একটু ভেবে এগোনো উচিৎ ছিল..। ইশ্!

- নাহ্। তুই সত্যিই বড্ড চাপ নিয়ে ফেলেছিস। দাঁড়া চা বসাই। তা'তে যদি তোর বুকে বল আসে।

- পিলুদা..যদি কোয়ালিফাই না করতে পারি..।

- সুমন। এই একটাই তো পরীক্ষা আছে ভাই, যে'খানে ফেল করার উপায় নেই। দু'বছর অন্তর এগজ্যাম, বাঁধাধরা পাস।

- তুই জানিস এই সিটিজেনশিপ পরীক্ষাটা আমার জন্য মরণবাঁচন লড়াই। এ'বারেও যদি ইথিওপিয়ার জন্য সিলেক্টেড না হই..উফ্। জাস্ট ভাবতে পারছি না।

- আজ থেকে বছর ষাটেক আগেও কিন্তু ইথিওপিয়ান সিটিজেনশিপের জন্য এত মারামারি ছিল না৷ ডেটা আর্কাইভে ঘেঁটে দেখেছি সে'সময় ইউরোপিয়ান দেশের লিস্টে কোয়ালিফাই করার জন্য কী রক্তারক্তি লড়াইটাই না চলত। অথচ আজ দ্যাখ। ইথিওপিয়া কী ফ্যাসিনেটিং প্রগ্রেসটাই না করলে, বিশেষত গত বছর দশেকে। ভাবতে অবাক লাগে, তাই না।

- আহ্। দ্যা সানরাইজ ল্যান্ড অফ ট্যুয়েন্টি থার্ড সেঞ্চুরি; ইথিওপিয়া!

- তবে তুই এত চাপ কেন নিচ্ছিস কে জানে৷ সেই তো দু'বছর অন্তর ফের গ্লোবাল সিটজেনশিপের পরীক্ষায় বসা৷ ফের নতুন করে প্রিপারেশন৷ নতুন করে গ্লোবাল সিটিজেনশিপ লিস্টে নিজের নাম খোঁজা৷ এ'বারে ভাগ্যে ইথিওপিয়া পড়ল, অথচ পরেরবার দেখলি কানাডা। আপ অ্যান্ড ডাউন থাকবেই..ভাগ্য কি আর লিনিয়ার ভাবে এগোবে ভেবেছিস?

- দু'বছর পরে কী হবে দু'বছর পর ভাবব'খন। আপাতত এই বেলজিয়াম থেকে না বেরোলেই নয়। দম বন্ধ হয়ে আসছে।

- আমার এ দু'বছর তেমন মন্দ কাটেনি কিন্তু সুমন। তোর সঙ্গে দিব্যি গপ্প-আড্ডায় কেটে গেলো। সবচেয়ে বড় কথা অন্তত বছর দুই তো প্রাণখুলে বাংলায় বলা গেল। 

- প্লীজ পিলুদা। তোমার সঙ্গে আমারও দিব্যি কেটেছে। কিন্তু ভবিষ্যতের প্ল্যান না করে কোনও উপায় আছে কি? একটা কথা বলো, তুমি ভারত বা বাংলাদেশের জন্য কোয়ালিফাই করলে খুব খুশি হবে৷ তাই না?

- ধুস। একশো বাইশ বছর ধরে প্রতি দু'বছর অন্তর গোটা পৃথিবীর মানুষকে গ্লোবাল সিটিজেনশিপ টেস্ট দিতে হচ্ছে আর পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে ইউনাইটেড নেশনস  মানুষের সিটিজেনশিপ নির্ধারণ করছে। দু'বছর অন্তর হিসেবকষে অঙ্ক-মেনে মাস-মাইগ্রেশন। বাঙালাদেশ বা ভারতে গেলেই বাঙালি ইয়ারদোস্ত জুটিয়ে নেওয়া যাবে নাকি! গতবছরের যা স্ট্যাটিস্টিক্স দেখছিলাম, ভিয়েতনামের নাগরিক লিস্টে নাম উঠলে বরং বাঙালি প্রতিবেশী জোটার চান্স সবচেয়ে বেশি।

- ওহ্৷ তোমার যা ফুড প্রেফারেন্স, ভিয়েতনামে কোয়ালিফাই করার চান্স প্রায় নেই বললেই চলে। জানো পিলুদা, ইথিওপিয়ার লিস্টে আমাদের দু'জনেরই নাম উঠলে যে কী দারুণ আনন্দ হবে..।

- সোজাসাপটা বলো চাঁদু৷ তিন নম্বর নামও একটা দেখতে চাও তুমি ইথিওপিয়ার লিস্টে। মিস মৌমিতা।

- হে হে৷ ও এত ব্রিলিয়ান্ট। গত ছ'বছর ধরে ইথিওপিয়ার জন্য কোয়ালিফাই করছে৷ এ'বারেও ফস্কাবে না৷ 

- এই নে। চা।

- পিলুদা৷ তুমি না থাকলে এই কথায় কথায় হাইক্লাস চা এগিয়ে দেওয়ার কেউ থাকবে না। 

- হেহ্৷ হ্যাঁ রে সুমন, তোর বাবা মা এখন কোথায়? জানিস? এ ব্যাপারে কোনওদিন কথা হয়নি, জিজ্ঞেস করাটাও উচিৎ না। তবে অদ্যই হয়ত শেষ রজনী। তাই ভাবলাম..।

- মায়ের খবর কোনওদিনই জানি না৷ আমার সোশ্যাল রেকর্ডেও মায়ের ডিটেল কোনওদিনই ছিল না। বছর বারো আগে খবর পেয়েছিলাম বাবা মঙ্গোলিয়াতে ছিলেন। ওই, একবার কথা হয়েছিল। ইয়ে, তোমার বাবা মা?

- জানি না৷ অনেক চেষ্টা করেছি ডেটাবেসে ট্র‍্যাক করার৷ জানতে পারিনি৷ আমার লিনিয়েজ সম্বন্ধে একটাই খবর আমি জানি৷ আমার এক পূর্বপুরুষ, কোন জেনারেশন আর ব্রাঞ্চ কে জানে, তিনি নাকি বছর কুড়ির চেষ্টাতেও ভারতের সিটিজেনশিপ লিস্টে নিজের নাম দেখতে না পেয়ে আত্মহত্যা করেন৷ 

- সুইসাইড অন আকাউন্ট অফ প্যাট্রিওটিক অ্যালিজিয়েন্স? ওহ।

- হ্যাঁ। ফলত আমার জেনেটিক রেকর্ডে একটা দাগ রয়ে গেছে৷ কাজেই ইথিওপিয়া আর্জেন্টিনার মত ওপরের সারির দেশে সুযোগ আমি পাব না৷ কিন্তু সুমন, আমি কিন্তু মন থেকে চাই তোর নাম এ'বারের ইথিওপিয়ার লিস্টে দেখতে। আর মৌমিতার খোঁজ পেলে আমায় একটা স্মাইলিং ইমোজি পাঠাস৷ আমি বুঝে নেব।

Sunday, August 13, 2023

কোড রেড আর এজেন্ট মন্টু

স্পাই হওয়ার যে কী ঝামেলা! মনের সুখে বারো মিনিট সময় নিয়ে যে একটু চুল আঁচড়াবো, তারও উপায় নেই৷ সবে স্নান করে বেরিয়ে কাপড়জামা পরে  আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছি। গোটা ঘরময় নারকোল তেলের মনোহারিণী সৌরভ। একদিকে সে তেলের গুণে চুল চপচপ করছে, অন্যদিকে তার সুবাসে মনেপ্রাণে আলাদা জেল্লা এসেছে। দিব্যি পরমানন্দে চুল আঁচড়াচ্ছি আর দুলে দুলে মাংস ম্যারিনেট করার কথা ভেবে মনেমনে চমৎকৃত হচ্ছি। এমন সময় আমার রিস্টওয়াচের এমার্জেন্সি অ্যালার্ম উঠল বেজে৷ 

প্যাঁপোরপোঁপ্যাঁপোরপোঁপোঁপোঁপোঁপ্যাঁপোরপো।  

সে এক মারাত্মক পিলে চমকানো শব্দ। নেহাৎ আমার পিলে ইস্পাত-কঠিন৷ ঘুমের মধ্যে দু'চারটে হাইড্রোজেন বোমা ফাটার শব্দ কানে এলেও আমি বড়জোর আড়মোড়া ভেঙে বলবে "আহ্, এ'টা পটকা ফাটনোর সময় হল নাকি"৷ 

এ শব্দের মানে একটাই হয়৷ হলও তাই৷ অ্যালার্ম থামার আড়াই সেকেন্ডের মাথায় ঘটরঘটরঘটঘট শব্দ৷ বাড়ির ওপর হেলিকপ্টার, ক্যাপ্টেন টক্কা এসে পড়েছেন তা'হলে৷ ড্রেসিংটেবিলের পাশের গ্রিলহীন জানালাটার পাল্লা খোলাই ছিল, সে'খানে দিয়ে দড়ি নেমে এসেছে। ক্যাপ্টেন টক্কার সবেতেই বাড়াবাড়ি,  সদর দরজা দিয়ে বেরোনোর সময়টুকু দিতেও মন সরে না৷ যা হোক, চুলে পরিচর্যা ছেড়ে জানালা দিয়ে গলে গিয়ে দড়ি ধরে ঝুলে পড়তেই দড়িটা সুরসুর করে ওপরে টেনে নেওয়া হল। 

হেলিকপ্টারে উঠে দেখি ক্যাপ্টেন মুড়িমাখায় পরিপূর্ণ একটা ঢাউস বাটি কোলে নিয়ে বসে আছেন৷ ভদ্রলোক হামলে পড়ে কচরমচর করে মুড়ি চেবাচ্ছেন না, তার মানে নির্ঘাৎ ব্যাপারটা গোলমেলে। পাশে বসতেই মুড়ির বাটি আমার দিকে এগিয়ে দিলেন ক্যাপ্টেন টক্কা৷ থ্যাঙ্কিউ বলে মুঠো বড় করে যতটা সম্ভব মুড়ি  তুলে নিলাম।

"কোড রেড", মিইয়ে যাওয়া গলায় জানালেন ক্যাপ্টেন।

অমন আচারের তেল দিয়ে কষে মাখা মুড়ি; তবু হাতের মুড়ি হাতেই রইল, মুখে চালান করা সম্ভব হলনা! এ কী খবর শুনলাম! কোড রেড!

- কোড রেড? আপনি নিশ্চিত? 

- নয়ত আর রোববার দুপুরের ভাতঘুমের বারোটা বাজিয়ে হেলিকপ্টারে টোটো করছি কেন বলো ভাই মন্টু।

- প্রাইম মিনিস্টার কী বলছেন?

- গত আড়াইঘণ্টা ধরে তিনি অস্থির হয়ে ঘুরপাক খেয়ে চলেছেন। মাঝেমধ্যেই বলে চলেছেন " ওরে তোরা কে কোথায় আছিস, বড় এক গেলাস মিছরির সরবত নিয়ে আয়, জলদি"। সেক্রেটারি যখনই মনে করাচ্ছেন যে ওঁর সরবত খাওয়া বারণ তখনই  খেঁকিয়ে উঠছেন।

- সেনাপ্রধান কিছু ফন্দিফিকির বের করেছেন কি?

- আরে আর্মির সবেতেই চালাও মুগুর পেটাও কুকুর ব্যাপার৷ এই জটিল সিচুয়েশনে সেনাবাহিনীকে খোলতাই অপারেশনে নামালে দেশের মানুষ অস্থির হয়ে পড়বে যে।

- তবে উপায়?

- ও মা! তোমায় নিয়ে যাচ্ছি কী করতে?

- আবার আমি কেন। এই সবে চারটে বড়সড় হ্যাকিং অ্যাটাকের প্ল্যানে জল ঢেলে দেশে ফিরেছি৷ কোথায় একটু জিরিয়ে নেব..।

- আরে ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে পড়ে থাকলে চলবে কেন এজেন্ট মন্টু? কোড রেড! গত সতেরো বছরে এই প্রথম!

- তা'তে অত লাফানোরই বা কী হয়েছে বলুন৷  গত সেঞ্চুরিতে শুনেছি এ'সব জলভাত ছিল।

- তবে আর কী! সে অন্ধকার শতক ফিরিয়ে আনলেই হয়৷ শোনো, এ'টা একবিংশ শতক নয়৷ আর তুমিও নেকুপুষুসুন্টুনিমুন্টুনি নও।

- রেডকোডটা কোথায় ফ্ল্যাশ হয়েছে?

- লোকালই। বেহালায়। 

- ওহ। তাই হেলিকপ্টারে চেপে যাওয়া। ইয়ে, বেহালা মেট্রোটা কবে চালু হবে বলুন দেখি ক্যাপ্টেন?

- সে খবর ভগবানই জানেন। তবে এই সুযোগে ও'দিকে একটা ফ্ল্যাট কিনে রাখব ভেবেছি, মেট্রো চালু হলে যদি দামটাম বাড়ে। বুঝলে কিনা, রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট। যাক গে। কথা ঘুরিও না৷ কোড রেড।

- দ্যাবাটি কে?

- শ্রীমান নিমো দত্ত। বয়স বত্রিশ৷ নিবাস বেহালা।

- দেবী?

- মিলি সরকার। বয়স বত্রিশ৷ নিবাস বেহালা।

- নিমো দত্ত মিলি সরকার; বেশ। এর একটা বিহিত হওয়া দরকার।

- তোমায় চৌরাস্তার মোড়ে নামিয়ে দিচ্ছি। তোমার ডিজিটাল ওয়েলেটে ওদের পরিচয় ঠিকানা সব দেওয়া আছে।

- মুড়িটা বড় ভালো মেখেছিলেন ক্যাপ্টেন। 

**

একটা আধোঅন্ধকার ঘর। একটা সুবিশাল লম্বা টেবিল, তার একদিকে দু'টো চেয়ার, আর মুখোমুখি অন্যদিকে একটা চেয়ার৷

একদিকে পাশাপাশি বসে নিমো আর মিলি; তাদের সদ্য ঘুম ভেঙেছে। টেবিলের অন্যপাশে একপেশে ভেজা-বেড়াল মুখ নিয়ে বসে আমি; এজেন্ট মন্টু।

নিমো: র‍্যানসম কী চাই সে'টা বলে দিলেই মিটে যায়৷ তবে আগেই বলে দিই, মিস মিলির হয়ে র‍্যানসম আমি দেব না। আমার বয়ে গেছে!

মিলি: ওর র‍্যানসম আমার চাইও না৷ কিন্তু ওর পাশে আমায় বসানোর জন্য আমি আপনার থেকে কম্পেনসেশন দাবী করব। সে আপনি গুণ্ডামস্তান যাই হোন না কেন!

আমি: আচ্ছা, শুনুন..।

নিমো: শুনেছেন কিডন্যাপারবাবু? শুনেছেন কেমন রুডলি কথা বলে? যেন দুনিয়ায় সবার মাথা কিনে নিয়েছে! দেখিয়ে দিন দেখি নিজের পিস্তলটিস্তল কিছু! তখন মামনি বুঝবে কত ধানে কত চাল! 

আমি: আরে ভাই নিমো..।

মিলি: ওঁর মুখ দিয়ে তো মধু ঝরে। তাই না? লায়্যার! শুনুন, আপনি কেন আমাদের কিডন্যাপ করেছেন আপনিই জানেন৷ তবে এই চিজটির থেকে সাবধান থাকবেন৷ আপনাকে ডান হাতে কিনে বাঁ হাতে বেচে দেবে, ধরতেও পারবেন না।

আমি: এই সেরেছে..।

নিমো: আমি লায়্যার? তুমি ফ্রড। তোমার চোদ্দগুষ্টি ফ্রড।

মিলি: ওই তো৷ একটু খোঁচাতেই বেরিয়ে এলো দাঁত-নখ৷ বাহ্ বাহ্৷ গুষ্টি তুলে কথা! ইস, এর পাশে বসতে আমার গা ঘিনঘিন করছে। 

আমি: দাদাভাই, দিদিমণি...একটাবারে জন্য যদি..।

নিমো: তোমার পাশে বসে আমার গা জ্বলছে। জাস্ট গা জ্বলছে।

মিলি: গণ্ডারের চামড়ায় জ্বালা ধরিয়েছি৷ আমায় ধন্বন্তরি বলতে হবে।

নিমো: দেখুন স্যার৷ আমায় ফ্যাটশেম করছে।

মিলি: ছি ছি। মিথ্যে সবসময় জিভের ডগায় ঝুলেই থাকে না? আমি তোমায় বেহায়া বলেছি!

আমি: আরে ধুচ্ছাই।

নিমো: এই আমি বলে রাখছি কিন্তু..!

আমি: চোপ! 

মিলি: আপনি ওইভাবে চোপ বলতে পারেন না৷ খুন করতে হয় করুন, কিন্তু মাইন্ড ইওর টোন।

আমি: আমি নিমোবাবুকে চোপ বলেছি..।

মিলি: কেন বলবেন?  কিডন্যাপ করেছেন বলে কি ওর মাথা কিনে নিয়েছেন?

নিমো: থ্যাঙ্কিউ মিলি।

মিলি: তুমি একদম গায়ে পড়ে কথা বলবে না!

আমি: দেখুন। প্লীজ। প্লীজ আমায় দু'মিনিট কথা বলতে দিন।

মিলি: আপনাকে তো কথা বলতে কেউ বারণ করেনি। খামোখা হাইপার হচ্ছেন কেন?

নিমো: ঠিক বলেছ মিলি। একদম ঠিক..।

মিলি: ন্যাকামি কোরো না নিমো। আর নেওয়া যাচ্ছে না!

আমি: এই শুনুন। আপনারা যদি এ'বার চুপ করে না শোনেন আমি আপনাদের সোশ্যাল রেজিস্ট্রি কোড এ'দিক ও'দিক করে সে'খানে সুকুমার রায়ের ছড়া ফীড করে দেব৷ দেখবেন তারপর হয়রানিটা। 

মিলি (সুর নরম করে): পাষণ্ড!

নিমো (মিইয়ে আসা গলায়): ঠিক বলেছ মিলি৷ লোকটা কেমন যেন..।

মিলি: প্লীজ নিমো। আর নয়।

নিমো (গলা উঁচিয়ে): এই কী মতলব মশাই আপনার? বলে ফেলুন৷ এখুনি।

আমি: সতেরো ঘণ্টা আগে আপনাদের প্রেম ভেঙেছে৷ আপনারাই ভেঙেছেন। 

নিমো (ভিজে সুরে): আর বলবেন না সে যে কী ট্র‍্যাজেডি..।

মিলি: ইন্ট্রুশন অফ প্রাইভেসি! আপনি কে বলুন দেখি?

নিমো (ফের আগুন কণ্ঠে): হ্যাঁ। আমিও তাই বলতে চাইছিলাম। আপনি কে?

আমি: প্লীজ। আমায় বলতে দিন। ন্যাশনাল সোশ্যাল রেজিস্ট্রি অনুযায়ী আপনারা রাজজোটক। আপনাদের প্রেম তাই অবশ্যম্ভাবী ছিল৷ আগামী কয়েকদশকের প্রজেকশনে আপনাদের একসঙ্গে থাকার কথা; ন্যাশনাল প্রডাক্টিভিটি কোশেন্টে দিক থেকে সে'টাই অপটিমাম৷ আপনাদের প্রেম ভেঙে যাওয়াটা তাই ন্যাশনাল প্ল্যানিং বহির্ভূত ব্যাপার৷ কোড রেড! আমি এজেন্ট মন্টু, সরকারের তরফ থেকেই ব্যাপারটা শুধরে দিতে এসেছি।

নিমো (সামান্য গদগদ মেজাজে): ওহ। তাই বলুন৷ বেশ। দেশের প্রয়োজনে যদি প্রেম করতে হয় তা'হলে আমরা আর কী করতে পারি৷ তাই না গো মিলি? তা'হলে ওই কথাই রইল..।

মিলি: তুমি থামো! যত্তসব ন্যাকাপনা! রাবিশ!

নিমো (ফের আগুন): ইয়ে..মানে। হ্যাঁ! তাই তো! একদম না৷ খবরদার যদি আবার প্রেম জোড়ার কথা শুনেছি। উফ, ডিসগাস্টিং। আমি আপনার নামে কেস করব মন্টুবাবু!

আমি: কেন বুঝতে পারছেন না৷ আমাদের রেজিস্ট্রি সমস্ত সিমুলেশন চালিয়ে দেখে নিয়েছে। একে অপরের জন্য আপনারা পার্ফেক্ট৷ এ প্রেম ভাঙলে ক্ষতি শুধু দেশের নয়, আপনাদেরও। 

নিমো (মাথা নেড়ে): তবে! এত ক্ষতি তো মেনে নেওয়া যায় না!

মিলি: তুমি অসহ্য নিমো!

আমি: শুনুন মিলি..।

মিলি: আপনি আমার কথা শুনুন এজেন্ট মন্টু। আপনাদের সিস্টেম খুবই মজবুত। ন্যাশনাল সোশ্যাক রেজিস্ট্রি খুবই বড় মাপের একটা ডিজিটাল ম্যাজিক৷ সব মেনেও বলছি; আপনাদের হিসেবে ভুল আছে। কেন জানেন? আমাদের এত বছরের সম্পর্কে কোনও বিষয়ে আমরা একে অপরকে একটি বারের জন্যও সরি বলিনি৷ নিজের ভুল স্বীকার করিনি! ও করেনি, আর আমি স্বীকার করছি আমিও করিনি৷ এ'টাও একধরণের বিষিয়ে যাওয়া৷ অবশ্য এজেন্ট মন্টু সে'টা বুঝবেন কিনা আমি জানি না।

নিমো: মিলি..।

মিলি: কোনওদিন বলেছ নিমো? নিজের কোনও একটা ভুলের জন্য একটা সরি বেরিয়েছে তোমার মুখ দিয়ে? আমি স্বীকার করে নিই আমিও কোনওদিন কোনও ব্যাপারে সরি বলিনি...নিজের ভুল স্বীকার করার প্রয়োজন বোধ করিনি৷ কোথাও তো একটা বড় গলদ আছে। তাই না?

আমি: মিলি। মন দিয়ে শুনুন। আপনার মেসেজিং অ্যাপ্লিকেশনের ড্রাফটে দু'শো বাইশটা আনসেন্ট মেসেজ আছে, যে'গুলো নিমোবাবুকে আপনি পাঠাতে গিয়েও পাঠাননি, বিভিন্ন সময়ে৷ সবকটা মেসেজই "সরি" লেখা, আছে আন্তরিক ক্ষমাপ্রার্থনা। পাঠানো হয়নি বলে কি ড্রাফটগুলো মিথ্যে হয়ে যাবে?

নিমো: মিলি..?

মিলি: ছি ছি! এ দেশে গভর্নেন্সের নামে প্রাইভেসিকে শেষ করে দেওয়া হয়েছে। কন্সটিটিউশিনটা ফেলেই দিন না...সে'টা নিশ্চয়ই মানুষকে অন্য মানুষের ড্রাফট মেসেজ ফোল্ডারে উঁকি দেওয়ার অধিকার দেয়নি?

আমি: আপনার ব্যক্তিগত মেসেজ পড়ার অধিকার আমার নেই৷ কোনও মানুষেরই নেই। সে ব্যাপারে আমাদের প্রতি আস্থা রাখতেই পারেন। আপনার ড্রাফট ফোল্ডারের মেসেজ দেখে কোড রেড ঘোষণা করেছেন প্রাইম মিনিস্টার; গত সত্তর বছর ধরে যিনি দেশ পরিচালনা করছেন৷ আগামী হাজার বছর যিনি করবেন৷ একজন সুপার-হিউম্যান আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স দ্বারা চালিত রোবোট আপনার মেসেজ পড়েছেন; কোনও মানু্ষ নয়। তিনিই আমাদের জানিয়েছেন। 

মিলি: তবুও..আপনার কী মনে হয় মন্টুবাবু? এ'টা ঠিক?

আমি: নিমোবাবুর ড্রাফট মেসেজ ফোল্ডারে আপনার জন্য লেখা কিন্তু সেন্ড না করা বারোশো বিরানব্বুইখানা মেসেজ আছে৷ প্রতেকটাই সরি বলতে। 

মিলি: এজেন্ট...।

আমি: চারশো বিরানব্বুই। আর দু'শো বাইশ।  সাতশো চোদ্দটা সরিদের খাঁচা খুলে বের করে দিয়ে গেলাম। দেখুন, যদি নতুন করে শুরু করতে পারেন৷

***

কোড রেড কেটে যাওয়া সুখবরটা ক্যাপ্টেন টক্কার রিসিভারে ট্রান্সমিট করে পাবলিক হেলিকপ্টারের লাইনে দাঁড়ালাম। মিলি নিমোর হাত ধরে তাঁকে নিজের কাছে টেনে নেওয়ায় যে প্রবল স্বস্তি পেয়েছিলাম তা বলাই বাহুল্য। তবু, মনের মধ্যের খচখচানিটা কিছুতেই যাচ্ছিল না। সব কিছুকে হিসেবের বাড়াবাড়িতে বেঁধে ফেলছি না তো?

নাহ্, এ'সব গোলমেলে চিন্তা অবিলম্বে মাথা থেকে উড়িয়ে দেওয়া উচিৎ৷ অফিসফেরতা প্যাসেঞ্জারদের লম্বা লাইন আমার সামনে৷ একজন ঘটিগরমওলাকে একটা স্পেশ্যাল বানাতে বলে একটা বাউল ধরলাম।

Monday, August 7, 2023

সৈন্যদল

গোটা ছাউনি জুড়ে গা-কাঁপানো নিস্তব্ধতা। খান কুড়ি জওয়ান আর গোটা সাতেক অফিসার গোল করে দাঁড়িয়ে; সবারই মুখ কালো। 

আর সেই থমথমে বৃত্তের পরিসরেই কর্নেল ডঙ্কা অস্থির হয়ে পায়চারি করছিলেন। থেকে থেকেই   বলে উঠছিলেন, "আসুক ব্যাটাচ্ছেলেরা, সবকটাকে জ্যান্ত কবর দেব"।

একসময় বাধ্য হয়ে সুবেদার গোলদারি মিনমিনিয়ে বলে উঠলেন "জ্যান্ত কবর দেওয়ার ব্যাপারটা তো ওরা না আসলে শুরু করা যাবে না। মানে হাতে সময় যখন আছে একটু চা বসিয়ে দিই না হয়"।

কর্নেল ডঙ্কা পায়চারি থামিয়ে আগুন চোখে তাকালেন গোলদারির দিকে৷ পলাশগাঁ না ঘুরঘুরিয়াপুর; কোথায় যেন একজন তান্ত্রিক চোখের দৃষ্টি দিয়ে চামচ বেঁকিয়ে দিতে পারে; এমন তেজ তাঁর। কর্নেল ডঙ্কা খানিকক্ষণ কনসেনট্রেট করার চেষ্টা করলেন, যদি সুবেদার গোলদারির ঝুলো গোঁফজোড়ায় একটা মারাত্মক টান দেওয়া যায়। সুবিধে করতে না পেরে "ধিত্তিরি" বলে ফের শুরু করলেন পায়চারি।

পরিস্থিতিটা গোলমেলে বুঝে ক্যাপ্টেন গঁট্টা সপাটে একটা ধমক দিলেন সুবেদার গোলদারিকে; "তোমার বুদ্ধির বলিহারি ভাই গোলদারি। কথায় কথায় তোমার শুধু চা আর চা। আরে ইউনিটের সামনে একটা মারাত্মক বিপদ৷ কোথায় কফি আর সামান্য ভাজাভুজির ব্যবস্থা করবে তা না চ্যা চ্যা চ্যা! ছি: ছি:"।

আর সহ্য হল না কর্নেল ডঙ্কার। বেরিয়ে এলো হতাশা মেশানো হুঙ্কার, "কী কুক্ষণেই না একদল  মেনিমুখোকে নিয়ে ফ্রন্টে এসেছিলাম"।

গোলদারি ফস করে বলে বসলেন "এ জন্যেই আমি হাতের কাছে একটা পঞ্জিকা রাখি। দিনক্ষণ এ'দিক ও'দিক হলেই চিত্তির আর কী"। 

কর্নেল ডঙ্কার পায়চারি থামলো।

গোলদারি কর্নেলের চোখ এড়িয়ে ছাউনির ছোট্ট জানালার বাইরে তাকালেন। বাতাস বারুদের গন্ধে ভারি হয়ে আছে, চারপাশটা ভীষণ গুমোট। 

"আর মোটামুটি আধঘণ্টা", খানিকটা শান্ত হয়ে বললেন কর্নেল ডঙ্কা, "তারপরেই মাতামাতিল্যান্ডের এয়ারফোর্স এসে বোমবাজি শুরু করবে"।

ক্যাপ্টেন গঁট্টা গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে বললেন, "ভাজাভুজির সময় হবে না হে গোলদারি৷ কাজেই সাতপাঁচ না ভেবে কফিই হোক৷ আর ইয়ে, বলছি ভায়া আবশুল, তোমার স্টকে ক্রীম বিস্কুট শুনেছি"?

সুবেদার আবশুলের চিঁচিঁ প্রতিবাদ শোনা গেল, "দু'টিন মাত্র৷ ও'তে সবার হবে না৷ আমিই বরং যতটা পারি একা খেয়ে নেব৷ বম্বিং ব্যাপারটা টিনের বাক্স সার্ভাইভ করতে পারবে না তো। তাই আর কী.."।

"তোমরা বদ্ধ উন্মাদ", এ'বারে চেঁচিয়ে উঠলেন কর্নেল ডঙ্কা। 

গোলদারির মুখ এ'বার উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, "আর আপনি আমাদের নেতা"।

হাল ছেড়ে নিজের চেয়ার টেনে নিয়ে ধপাস করে বসে পড়লেন কর্নেল ডঙ্কা। আড়াই মিনিটের মাথায় মুখের তিতিবিরক্ত ভাবটা কেটে গেল। কর্নেল ডঙ্কা এ'বার খানিকটা মিহি সুরে বললেন, "দ্যাখো, দেশের জন্য তোমরা তো কম করলে না৷ বাহদিব্যিস্তান তোমাদের আত্মত্যাগ ভুলবে না। শেষবারের জন্য বলছি৷ পোজিশন আঁকড়ে আমি আছি। শেষ রিপোর্টিংয়ের ব্যাপারটা আমিই সামলে নিতে পারব৷ এখনও কিছুটা সময় আছে, তোমরা পারলে এ'খান থেকে চলে যাও। প্রাণে বাঁচলেও বাঁচতে পারো"।

ক্যাপ্টেন গঁট্টা এ'বারে গলায় দরদ এনে বললেন, "বুঝলে গোলদারি৷ কর্নেল সাহেবের বোধ হয় চায়ের দিকেই ঝুঁকেছেন৷ বেশ, থাক তা'হলে কফি৷ কফির মর্ম আর ক'জন বুঝবে। চাপাও সসপ্যান। ফরওয়ার্ড মার্চ"।

গোলদারি হাততালি দিয়ে উঠলেন, "এই হলো সাচ্চা বাঘের বাচ্চার মত কথা। আরে আমি আগেই আদা থেঁতো করে রেখেছি। ওই চায়ের কাছে কোথায় লাগে কাঠখোট্টা কফি.."।

একরাশ হতাশা নিয়ে কর্নেল বলে উঠলেন, "পাগল। সবকটা বদ্ধ পাগল"।

ফের শোনা গেল সুবেদার আবশুলের চিঁচিঁ কণ্ঠস্বর,  "চা হোক আর কফিই হোক৷ দু'টিন ক্রিম বিস্কুট কিন্তু আমি একা খাবো বলে দিচ্ছি৷ বউটি নিজের হাতে আমার ব্যাগে ঢুকিয়ে দিয়ে পইপই করে বলেছিল যাতে ও জিনিস আমি বারোভূতকে খাইয়ে শেষ না করি"।

**

চায়ের কাপটা টেবিলে নামিয়ে রেখে গোলদারির দিকে সম্ভ্রম নিয়ে তাকালেন কর্নেল ডঙ্কা, "তোমার সত্যিই জবাব নেই গোলদারি। এ চা নয়, অমৃত"। গোলদারি ফর্সা দু'গালে সামান্য লালচে ছোপ লাগলো। 

তখুনি, বাইনোকুলারে চোখ রাখা এক জওয়ান মৃদু স্বরে জানালে যে  মাতামাতিল্যান্ড এয়ারফোর্সের কয়েকটা বিমানকে আকাশে চক্কর কাটতে দেখা যাচ্ছে।

ক্যাপ্টেন গঁট্টা চেঁচিয়ে উঠলেন, "এইবারে তা'হলে যে'যার জায়গায় চলে যাওয়া যাক"।

" এক মিনিট", শান্ত সুরে বললেন কর্নেল ডঙ্কা। নিজের প্লেটে পড়ে থাকা শেষ ক্রীমবিস্কুটটা হাতে নিয়ে এগিয়ে গেলেন সুবেদার আবশুলের দিকে। আবশুল আনমনে ছাউনির জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিল, দু'হাতে আঁকড়ে ধরা দু'টো বিস্কুটের টিন।

"আবসুল", কাঁধে হাত রাখলেন কর্নেল ডঙ্কা। 

"স্যর", সম্বিৎ ফিরে পেল আবসুল। 

" আমি কিন্তু খেয়াল করেছি তুমি একটা বিস্কুটও না খেয়ে সবাইকে বিলিয়ে দিলে"।

"কর্নেল সাহেব, আমার বাড়িতে বুড়ো বাপ-মা, ছোট্ট দুই ছেলে আর বৌ৷ অভাবের সংসারে ভুট্টা আর গমের বাইরে খরচ করার সুযোগ কোথায়? ক্রিমবিস্কুট তো বিলাসিতা। বড় শখআহ্লাদে কেনা কয়েকটা বিস্কুটের টিন, আমায় জোর করে গছিয়ে দিল ফ্রন্টে আসার সময়৷ কত করে বোঝালাম, আরে অত ক্রিমবিস্কুট আমি একা খাবো কী করে৷ বাড়ির বাচ্চাগুলোকে দাও অন্তত৷ বৌ গোঁ ধরলে, বাড়ি থেকে কতদূরে কতদিন থাকব, ও'টুকু নাকি সঙ্গে না নিলেই নয়৷ পুঁচকে ছেলেগুলোও এক সুরে কথা বললে। মায়ের ন্যাওটা তো খুব৷ জানেন, ও বিস্কুট একটাও কেউ মুখে দেয়নি। সে বিস্কুট আমি কী করে খাবো কর্নেল সাহেব"?

আবশুলকে জড়িয়ে ধরলেন ক্যাপ্টেন ডঙ্কা। বোমারু বিমানের তর্জনগর্জনে তখন কান পাতা দায়।

তেলবাজ



ইলিশের তেল নিয়ে আমাদের আহ্লাদ অযৌক্তিক নয়৷ কিন্তু কাতলা (বা রুই) মাছের তেলের চচ্চড়িও মারাত্মক জমজমাট একটা ব্যাপার যা দিয়ে এক থালা ভাত অনায়াসে উড়িয়ে দেওয়া যায় (আমি অন্তত উড়িয়ে দিতে সক্ষম)। মায়ের রান্না তেল-বেগুনের (অবশ্যই পেঁয়াজ আর উদারহস্তে লঙ্কাকুচি ছড়ানো) মাখোমাখো চচ্চড়ির ইউএসপি হল টানটান-নুনঝালের পাশাপাশি একটা অত্যন্ত মিহি আধ-তেতো 'আফটারটেস্ট'৷ আধ-তেতো বললাম কারণ তিতকুটে বললে ভুল বলা হবে৷ ভাষার ওপর দখল থাকলে আরও লাগসই শব্দ লাগিয়ে দিতে পারতাম৷ কিন্তু আমার ভাষার অক্ষমতায় তো আর মায়ের রান্নার স্বাদ আটকে নেই, সে এক তোফা ব্যাপার। বেগুন, তেল মিহিভাবে মিশে গিয়ে সুপারফাইন একটা ব্যাপার তৈরি হয়৷ ও জিনিস পাতে পড়লে ঝোলডালের দিকে আর মন যেতে চায় না। 

মায়ের কাতলা তেলচচ্চড়ির একটা নন-বেগুন ভার্সনও রয়েছে৷ সে'টাকে তেল-পেঁয়াজ বলা ভালো কারণ সে চচ্চড়িতে আসল খেল তেলের সঙ্গে মিশে যাওয়া মুচমুচে অথচ নরম ভাজা পেঁয়াজের৷ পেঁয়াজ-নির্ভরশীল যে'কোনও রান্নার মতই, মায়ের মতে এই চচ্চড়ির আদত স্বাদ নির্ভর করে পেঁয়াজ কতটা নিখুঁত ভাবে কাটা হয়েছে তার ওপর৷ অত্যন্ত সাধাসিধে পদ, স্বাদে দুর্দান্ত। অফিসের কাজে মাসখানেকের জন্য বাইরে যেতে হবে, বেরোবার আগে দুপুরবেলায় পাতে ছিল ডিমওলা পাবদার পাতলা ঝোলের পাশাপাশি এই কাতলার তেল-পেঁয়াজ চচ্চড়ি। এর চেয়ে বড়মাপের 'দুগ্গা দুগ্গা' আর কীই বা হতে পারে৷

এ রুই-কাতলার তেলের চচ্চড়ি প্রসঙ্গে এ পদের আরও দু'টো ধরণ উল্লেখ না করলেই নয়৷ আমার শ্বাশুড়িমা তেলের চচ্চড়ি করেন যত্নে কুচোনো ডুমো-ডুমো আলু দিয়ে। সে জিনিসও অতি সরেস। কী আশ্চর্য,  রান্নার টেকনিক প্রায় এক হলেও, বেগুন পেঁয়াজ ও আলু; তিনটের স্বাদই সম্পূর্ণ আলাদা।

এ'বাদে আছে আরও একটা ধরণ৷ সে'টা অতিমাত্রায় সরল এবং বাহুল্যবর্জিত। শুধু মাছের তেল ভাজা। বছর চারেকের কলকাতাইয়া মেসজীবনে ও জিনিস প্রতি হপ্তায় একাধিকবার খেয়েও আমার মন ভরেনি৷ এ জন্য মেসের সর্বেসর্বা আন্টি আর মেসের হেঁসেল আগলে রাখা শিউলিমাসির প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই৷ মেসে অনেকরকম ছেলেদের বাস, সে'খানকার ঝোল তাই ট্যালট্যালে হওয়াটাই কাম্য৷ অতএব সে ঝোল আমার তেমন পছন্দ হত না৷ তাই মাঝেমধ্যেই আমার জন্য বরাদ্দ থাকত স্পেশ্যাল ভাজা-মাছের-তেল৷ 'তন্ময়ের পেটির মাছই প্রিয়', আন্টির স্নেহ আর আস্কারার জন্য আমার পাতে বরাবরই রুই-কাতলার পেটির পিসটাই পড়েছে; আমার পছন্দমত কড়া করে ভাজা৷ আর তার পাশে থাকত একটা ছোট্ট বাটিতে অমৃতসমান মাছের তেলচচ্চড়ি (বা তেলভাজা)। মেসবাড়িটা আমার বাড়ি বনে গেছিল কি সাধে?

নিউ লক্ষ্মী ভাণ্ডার

- এই যে স্বপনদা! বাহ্৷ দোকানে দেখছি বড় ফ্রিজ বসিয়েছ মামা? চাল-ডালের পাশাপাশি এ'বার আইসক্রিমও গছাবে নাকি?

- আইসক্রিম, কোল্ডড্রিঙ্কস। ছোট ফ্রিজটায় তো মাখনটাখনের বেশি কিছু..। যাক গে৷ তোর অত খবরে কাজ কী রে মদনা!

- আমাদের অত সময়ও নেই৷ হপ্তা বের করে দাও৷ কেটে পড়ি। বুলবুলদা আর হ্যাঁ, এ'মাসে বাজারের সবার থেকে দু'শো টাকা এক্সট্রা নিচ্ছে৷ পুজোফুজো আসছে তো।

- হপ্তা বলিস কেন রে ইডিয়ট? বল তোলা আদায় করতে এসেছিস। বাবা, বাঙালির ছেলে মাস্তানিতে নেমেছিস, বাঙালির নেকু কেরানী বদনাম ঘুচোচ্ছিস; তা তো ভালো কথা৷ কিন্তু বাংলা ভুললে চলবে কেন? আর হ্যাঁ। বুলবুলকে বলে দিস এ'টা মামার বাড়ি নয়, যে দু'শো এক্সট্রা চাইলেই দু'শো পাবে।

- স্বপনদা, বুলবুলদাকে রঙ দেখাতে যেওনা৷ কেলিয়ে কেলো মুখ ফর্সা করে দেবে৷

- আরে থাম। যে মাস্তান দু'শো বেশি চেয়ে ঘ্যানঘ্যান করে তার জাত আমার জানা আছে৷ ক'দিন পর তো সিঁদ কাটতে নামবি।

- বাড়াবাড়ি হচ্ছে কিন্তু স্বপনদা। বুলবুলদা যদি জানতে পারে..।

- মদনা, আমার বাজে বকার সময় নেই৷ এই নে টাকা৷ আর বুলবুলকে বলে দিস আমি দু'শো টাকা কেটে রেখেছি৷ আগের কিছু বাকি ছিল৷

- দেব নাকি চামড়া গুটিয়ে?

- তবে রে রাস্কেল! তুই গোটাবি আমার চামড়া? ডাক বুলবুলকে৷ তুই ডাক হারামজাদা।

- তোমার কি মাথাটাথা গেছে?

- বুলবুলের ডানা আমি যদি না ছেঁটেছি..তবে আমার নাম স্বপন দত্ত নয়।

- তোমার ব্যবস্থা হচ্ছে। বুলবুলদা তোমার নতুন ফ্রিজ তুলে নিয়ে গিয়ে তা'তে বিয়ারের বোতল রাখবে৷ দেখে নিও। আর তোমায় ল্যাম্পপোস্টে বেঁধে কয়েক ঘা না দেওয়া পর্যন্ত..।

- টিংটিঙে লগবগ্গার দল! তাদের নাচনকোঁদন দেখে হেসে বাঁচিনে৷

- আমি এখুনি গিয়ে বুলবুলদাকে খবর দিচ্ছি...তোমার দোকান যদি না তুলিয়েছি আজ..।

********

- স্বপনদা, আধকিলো মুসুরডাল আর আড়াইশো গুড়ের বাতাসা দাও।

- এই দিই৷ মদনা। এই ব্যাটা! হাফকিলো মুসুরি আর আড়াইশো লাল বাতাসা দে দেখি৷ চটপট৷ কাস্টোমারকে এই রোদে বেশিক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখিস না বাপ। চট করে নিয়ে আয়৷ তা, আর কিছু দেব নাকি হরিহর?

- না না। আর কিছু না।

- বেশ বেশ।

- তা স্বপন, সাতদিন ধরে দেখছি মদন গুণ্ডা তোমার দোকানে ফরমাশ খাটছে। ব্যাপারটা কী?  বুলবুলের স্যাঙাৎগিরি ছেড়ে তোমার দোকানে চাল-ডাল ওজন করছে..ও কি মাস্তানি ছেড়ে দিল?

- তা কেন হবে? মদনা আমার সঙ্গে বুলবুলের নাম নিয়ে অসভ্যতামি করেছিল৷ আমি তাই দিলাম বুলবুলকে জোর এক ধমক৷ লজ্জায় পড়ে গিয়ে একমাসের জন্য মদনাকে আমার পদসেবায় লাগিয়েছে বুলবুল৷ বিকেল পর্যন্ত দোকান দেখে৷ সন্ধ্যেবেলা আমার গা হাত-পা টিপে দেয়৷ রাত্রে আমার জন্য বটতলার হাট থেকে বাজার করে থলি বাড়ি পৌঁছে দিয়ে তবে ওর ছুটি।

- বুলবুল তোমায় এত সমীহ করে?

- না করে উপায় কী বলো..।

- ব্যাপারটা কী..।

- বুলবুল সদ্য বিয়ে করেছে জানো তো? সে ভারি গদগদ প্রেম৷ আমাদের গো বুলবুলকে আর চেনার উপায় নেই৷ গুণ্ডা-মাস্তানি যে'টুকু করে, নেহাতই পেটের দায়ে। আদতে সে এখন প্রেমিক মানুষ। আর ওর বউ, বুল্টি,  সেলাই স্কুলের দিদিমণি।  বুঝলে? ভারি ভালো মেয়ে৷ সেই সকাল সাতটায় বেরোনো, ফেরা রাত আট্টায়৷ কী খাটনিটাই না খাটে৷ এ'দিকে বুলবুলের যা কাজের নেচার, সে'টা তো ওয়ার্ক ফ্রম হোমই বলা যায়৷ কাজেই রান্নার ভারটা এখন তার কাঁধে৷ 

- বলো কী!

- এ'তে অবাক হওয়ার কী আছে৷ ন্যাচরাল ডিভিশন অফ লেবার৷ অবশ্য আমাদের সমাজের ভদ্দরলোকেরা ও'সবের তোয়াক্কা করে না৷ কিন্তু মাস্তান বুলবুলের জ্ঞানগম্যিটুকু আছে আর সে বুল্টিকে সত্যিই ভালোবাসে৷ আজকাল তাই মনের সুখে হেঁসেল সামলায়৷ তার রান্নার হাতও মন্দ নয়৷ বুলবুল জানে যে হাইকোয়ালিটির মশলাই হল রান্নার প্রাণ৷ আর বেস্ট মশলাপাতির ব্যাপারে স্বপন দত্তর নিউ লক্ষ্মী ভাণ্ডারের ওপর চোখ বন্ধ করে ভরসা করা যায়৷ আমায় তো জানো, এই টিট্যুয়েন্টির যুগে দাঁড়িয়েও প্যাকেট মশলায় নেমে যাইনি৷ নিজে গিয়ে শুঁকে নেড়েচেড়ে জিনিসপত্র আনি৷ তাই তো আমার দোকানের এক চিমটি লঙ্কা গুঁড়োর যা ঝাঁজ, তা প্যাকেট মশলার চার চামচেও হবে না৷ সে ভরসার দাম যে তোলা আদায়ের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

- সে কথা তো আমিও বারবার বলি।

- দ্যাখো হে, বন্দুক দেখিয়ে একদিন-দু'দিন কাজ চলতে পারে৷ কিন্তু বুলবুল জানে, রান্নার ইনগ্রেডিয়েন্ট সোর্সিংয়েও ভালোবাসা আর সম্মান থাকা দরকার৷ যেকোনও গুণী রাঁধুনি তোমায় বলে দেবে; হাইকোয়ালিটি  ইকোসিস্টেম না হলে হাইকোয়ালিটি কুকিং অসম্ভব৷ মদনা ব্যাপারটা না জেনে সেই ইকোসিস্টেম ঘেঁটে দিতে গেছিল, তাই বুলবুল ওকে দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করাচ্ছে।

- সত্যি স্বপন। যো বিবি সে করে প্যার, উয়ো নিউ লক্ষ্মী ভাণ্ডারকো ক্যায়সে করে ইনকার।

ম্যান ঈটারস অফ করবেট



জিম কর্বেট ন্যাশনাল পার্ক লাগোয়া রিসর্ট।
মধ্যরাত৷

নদী? আছে৷ এক্কেবারে কুলকুল করে বইছে। সাউন্ডটা ভীষণ কমফর্টিং।
নিকালো কিন্ডল, চলে যাও পছন্দসই বইটির আশ্রয়ে।

পাহাড়? তাও আছে। এক্কেবারে চার্মিং । এইত্তো চাই।
এ'বার চেয়ারে গা এলিয়ে ঠাং ছড়িয়ে জুত করে বসো দেখি৷

জ্যোৎস্না? মেঘের ইন্টারফারেন্স নেই, অতএব চাঁদ চালিয়ে খেলছে৷ চাদ্দিকে এক্কেবারে মায়াময় একটা ইয়ে৷ ইয়ে বলতে; মনের ভাবটা বুঝে নিতে হবে৷
এ'বারে দু'পাতা 'ম্যান ঈটার অফ কূমায়ুন' আর দু'মিনিট প্রকৃতি৷ দু'পাতা বই, দু'মিনিট নদী-পাহাড়-এটসেটেরা। আহা। 

সবে জুত করে বসেছি। দেড় পাতা এগিয়েছে৷ এমন সময় বার্মুডা ছাপানো টিঙটিঙে ঠ্যাংজোড়া জানান দিলে, প্রকৃতির আর একটা মারাত্মক এলিমেন্টও আছে যে'টা ফুর্তির আবহে ঠাহর করতে খানিকটা দেরী হয়েছে। মশা। অসংখ্যা হতচ্ছাড়া-হাড়বজ্জাত মশাদের দল।

অমনি টুপ করে পাহাড়ি চাঁদনি আর তিরিতিরি নদীর কম্বিনেশন ছাপিয়ে মনে পড়ল একটা এসি আর অলআউট লিকুইডেটর সমৃদ্ধ আরামদায়ক রুম আমায় অনুপস্থিতিতে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে।

সাময়িক উচ্ছ্বাস কেটে যেতে মন ফিরে এলো আনন্দ-নিকেতনে। হোটেল রুমের নরম খাটে গা এলিয়ে করবেট বা বিভূতিভূষণ পড়াটাই যে আদত প্রকৃতি-পুজো, এই অমোঘ শহুরে সত্যটা পাশ কাটিয়ে যাওয়ার কোনও মানে হয় না৷

ডিম্বড়া



ফ্রিজে তেমন কিছু নেই৷ কিন্তু নোলার আনচান বহাল রয়েছে (আরে নোলান বলিনি রে বাবা)।  এমন পরিস্থিতিতে চটজলদি সলিউশন হল ভাতেভাত (হেঁসেল আমার পাল্লায় পড়লে ম্যাগি), বা শর্টকাট ভাজাভুজি৷ কিন্তু অল্পসময়ের মধ্যেই রান্নাঘরে পিঞ্চহিট করার ব্যাপার মায়ের জুড়ি নেই৷ এই  প্রসঙ্গে মায়ের ম্যাজিক বাটিচ্চড়ির নিয়ে একটা দরদী এস্যে লেখাই যায়৷ তবে সে ব্যাপারে অন্যদিন গপ্প ফাঁদা যাবে৷

চচ্চড়ি-সেদ্ধ-ভাজার বাইরে গিয়ে আলগোছে হাইপাওয়ার ঝোলভাত নামিয়ে দেওয়াটাও মায়ের বাঁ হাতের খেল৷ ডিমকষাও সেই ক্যুইক-কামাল ক্যাটেগরিতে পড়ে। ডিমের ঝোলের একটা সরেস 'দুসরা' ভার্সনেও মায়ের হাত শানানো আছে। ডিমের বড়ার ঝোল৷ আলুসেদ্ধয় ডিম দিয়ে ভালো করে ফেটিয়ে নিয়ে সে'টার বড়া ভেজে নেওয়া৷ তারপর তার জমজমাট ঝোল৷ দু'টো মাঝারি সাইজের আলু প্রতি চারটে ডিম; মোটামুটি ওই রেশিওতেই ব্যাপারটা নাকি ভালো দাঁড়ায়৷ তুলতুলে বড়াগুলো ঝাল-ঝাল ঝোল অবলীলায় শুষে নেয়। ফলত, সে ডিমের বড়া হয়ে ওঠে হাইক্লাস আর সুপারঘ্যাম৷

করোলবাগের চিঠি



- যাই বলুন মশাই! এক্কেবারে চ্যাম্পিয়ন কোয়ালিটির বিকেল। রোদের কোয়ালিটি নরম, বৃষ্টিশেষের মিঠে হাওয়া। রোম্যান্টিক-ম্যাক্স।

- তা গোলাপবাবু, হাওয়া যে মিঠে সে'টা ফ্লাইটে বসেই টের পাচ্ছেন?

- আগামী নভেম্বরে ফিফটু ক্রস করে ফিফটি থ্রিতে পড়ব৷ তা'ছাড়া অল্প বয়স থেকেই আমি বিকেলের ব্যাপারে অবজার্ভ্যান্ট। এই বলে রাখলাম গোলদারবাবু; ল্যান্ড করার পর টের পাবেন কী প্রিসাইসলি বিকেলের কোয়ালিটি অ্যাসেস্ করেছি।

- তা এমন হাইকোয়ালিটি বিকেল, এমন বিটকেল কাজে নষ্ট করা কি ঠিক হবে?

- প্রফেশনটাই তো বিটকেল গোলদারবাবু৷

- তা এই প্রফেশনে থেকে বিকেল অবজার্ভ করার আদেখলাপনা দিয়ে হবেটা কী।

- বাহ্। ফ্রিল্যান্স তোলাবাজির কাজ করি বলে কি বিকেলের ভালোমন্দের ব্যাপারে সেনসিটিভ হওয়া বারণ?

- দেখুন গোলাপবাবু৷ আপনার ভালো চাই তাই বলি৷ আর ঘণ্টা দুইয়ের মাথায় করোলবাগের ব্যবসায়ীর ভুঁড়িতে বন্দুকের নল চেপে পঞ্চাশ লাখ বের করবেন৷ সে'খান থেকে চল্লিশ ক্লায়েন্টেকে দিয়ে দশ পকেটস্থ করে রাতের ফ্লাইটেই আস্তানায় ফেরত৷ হাই-ফোকাসের কাজ, এক চুল এদিক ওদিক হলেই চালান হয়ে যেতে হবে৷ কাজেই এ'সবের মধ্যিখানে বিকেল-বিকেল করে নেত্য না করলেই আপনার মঙ্গল৷ 

- কিছু মনে করবেন না গোলদারবাবু। আপনি ভারি কাঠখোট্টা।  

- আমি আছি তাই আপনি ভেসে যাননি এদ্দিন।

- থামুন মশায়৷ করোলবাগ পৌঁছতে এখনও ঢের দেরী। তার আগে আমাদের কর্তব্য হচ্ছে এমন হাইক্লাস বিকেলের শোভাটাকে যত্ন করে অ্যাবসর্ব করা।

- তা সেই অ্যাবসর্ব করার প্রসেসটা কী?

- করোলবাগের রাস্তায় শুনেছি মারাত্মক লেভেলের মনভোলানো ছোলেকুলচে পাওয়া যায়৷ 

- এই একরোগ৷ কথায় কথায় খালি গেলার স্বপ্ন দেখা৷ ধুর। কাজের আগে অত খাইখাই করতে নেই। 

- আরে, খাওয়ার কথা কে বলছে। ইম্যাজিন করুন, এমন সোনালী বিকেল আর সন্ধ্যের আবছায়া এসে মিশছে। বাতাসে রোম্যান্টিক 'আমিই উত্তম আমিই উত্তম' মার্কা একটা মিহি ইয়ে। আর সেই দিলদার আবহে...।

- দিল্লীতে এসে উত্তমের বদলে মুঘলাই কায়দা নামালে হয় না? মখমলের ওয়াড় দেওয়া বালিশ বুকে চেপে শায়রি ভাঁজা বাদশার রঙিন মেজাজ?

- আপ রুচি রোম্যান্স মশাই৷ যা হোক৷ সেই মাহেন্দ্রক্ষণে, ছোলেকুলচের সুবাস বুকে নিয়ে, সুমনাকে একটা চিঠি লিখব।

- সুমনা? গোলাপবাবু? ফিজিক্স অনার্স সুমনা?

- ফিজিক্স অনার্স সুমনা। 

- যে সামনে এসে পড়লে আপনার গলা দিয়ে ননস্টপ একটা নালায় লেংচে পড়া ঘোড়ার মত চিঁচিঁ শব্দ বেরোত?

- সেই সুমনা।

- তাকে চিঠি লিখবেন? সে কী! কয়েক যুগ ভদ্রলোকের সংস্পর্শ থেকে দূরে বাস করছেন। এখন কোথায় সুমনা, আর কোথায় ভাড়াটে গুণ্ডা গোলাপবাবু। ঠিকানা পাবেন কোথায়? 

- গোলদারবাবু৷ আপনার দ্বারা এ'সব ফাইন ব্যাপারস্যাপার বোঝা সম্ভব নয়। আরে সেরা চিঠিরা পোস্ট হয় না। ড্রয়ারের গোপন কোণায় বা বইখাতার ভাঁজে তাদের পুষে রাখতে হয়। 

- নাহ্৷ আজ আপনি ডোবাবেন দেখছি গোলাপবাবু।

- যদি সত্যিই মনোরোম বিকেলে; করোলবাগের রাস্তার ধারে বসে, ছোলকুলচার সুবাস ইন্সপায়ার্ড প্রেম-প্রেম চিঠি লিখতে গিয়ে তোলা আদায় ডুবে যায় গোলদারবাবু, তবে জানবেন এখনও বেঁচে থাকার ধক আছে এই শর্মার।

- এই সেরেছে!

***

ভদ্রলোকের যেমন কথা তেমনি কাজ। অটোরিক্সা করোলবাগ অঞ্চলে পৌঁছতেই অটোচালককে নবাবি মেজাজে বললেন গোলাপ গোলদার;

"অটোমশাই, ইধর কিসি খাতাকলম কা দোকান মে রুকিয়েগা। দু'টো চিঠি লিখনে কা শৌখিন কাগজ অউর এক গুলাবি খাম, মানে ইয়ে, এনভিলপ লেনা হ্যায়৷ কেমন"?

ফুডভ্লগার

- কেমন আছেন শশধরবাবু?

- ও কী৷ বলা নেই কওয়া নেই৷ দুম করে আমার টেবিলে বসে পড়লেন যে? আর..আর..এই..এই..এক মিনিট, আপনি আমার নাম জানলেন কী করে?

- গোটা কফিশপ ফাঁকা৷ আপনি খামোখা একা বসে হাহুতাশ করে কী করবেন বলুন৷ তাই, বসে পড়লাম, একটু সঙ্গ দিই না।

- এই খবরদার, একদম বাজে কথা বলবেন না৷ কীসের হাহুতাশ? দিব্যি একটু মী-টাইম এঞ্জয় করছিলাম৷ দিলে সব চটকে।

- আরে ছাড়ুন মশাই মি টাইম৷ আপনার বড়ছেলে ভটকাই তো মেডিকালে এ'বারেও লটকালো৷ সে নিয়েই দুশ্চিন্তা করছিলেন তো? ও আমি বুঝতে পেরেছি!

- হোয়াট ননসেন্স৷ আপনি কি টিকটিকি নাকি? আমি কিন্তু চিৎকার করে ম্যানেজারকে ডাকব! ফাইনাল ওয়ার্নিং! ও কী৷ আপনি ক্যামেরায় কী রেকর্ড করা শুরু করলেন! ও মাই গড! 

- ইএমআইয়ের প্রেশার সামাল দিতে ভল্ট থেকে বৌদির সোনার বালা সরিয়ে দিলেন৷ এত গলাবাজি আপনার সাজে?

- মিথ্যুক! জোচ্চোর! আমি..আমি...আমি পুলিশ ডাকব।

- মিথ্যে?  রিয়েলি? যাদবপুরের ব্রাঞ্চ থেকে গত শনিবার বেলা পৌনে দু'টোয়..।

- কী..কী হচ্ছে কী এ'সব।

- বাহ্৷ এইত্তো গলার সুর নরম হয়ে এসেছে। সেই ভালো। হাওয়াবদলের সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করতে না পারলে চলবে কেন!  রাজনীতি নামার শখ আছে, গুণ্ডা পোষার টাকা আছে..আবার মিডিয়ার সঙ্গে মাখোমাখোটাও টিকিয়ে রেখেছেন। আপনার ফিউচার কিন্তু ব্রাইট। ভাববেন না, এইসব ফিনান্সিয়াল স্ট্রেস কেটে যাবে৷ সরকারপক্ষ বা অপোজিশিন, যে কোনও সোর্স থেকে একটা টিকিট পেলেই তো কেল্লা ফতে৷ কী, তাই তো?

- এই আপনি কে বলুন না৷ মন্টুদার দলের কেউ? ইয়ে, শোভা আপনাকে পাঠায়নি তো? আরে ধুর কাঁচকলা৷ রেকর্ডিংটা থামান না! আমার ভিতরটা কেমন আনচান করছে যে।

- শশধরবাবু৷ তলপেটের ব্যথাটাও অযথা চেপে যাচ্ছেন৷ এদ্দিনের নেশাভাঙের ইম্প্যাক্ট সহজে এড়ানো যাবে না৷ ডাক্তারের বলা টেস্টগুলো এ'বারে করিয়ে নিন। বয়স বাড়ছে। খুব দেরী হওয়ার আগে..।

- আপনি কে বলুন তো ভাই? আমায় ব্ল্যাকমেল করার জন্যই কী..?

- ছি: ছি:! এ'বাবা! তউবা তউবা! ওহহো৷ আমার পরিচয়টা দেওয়া হয়নি৷ আমি সুদর্শন গুপ্ত৷ ফুডব্লগার৷ এই আপনার ভিডিওটা আমার রেকর্ড করা একশো নম্বর ভিডিও৷ এই একশোটা ভিডিও নিয়ে কাল আমার ইউটিউব চ্যানেল লঞ্চ হবে৷ ফলো আর সাবস্ক্রাইব করতে ভুলবেন না।

- ক..ক..কিন্তু..।

- আরে আমি সমস্তটাই মিউটে রেকর্ড করেছি। মাইরি। আমাদের কথোপকথন কেউ শুনবে না। বললাম না, আমি ফুড ব্লগার। তবে উইথ আ ডিফারেন্স।

- কিন্তু ভাই সুদর্শন,  আমার টেবিলে তো এখনও খাবার কিছু আসেনি..। আমি কিছুই..।

- আরে মশাই ও'সব পাতি খাওয়া রেকর্ড করে ফুড ভ্লগিং ইকোসিস্টেমে ভীড় বাড়াতে চাইনা আমি৷ আমার ব্যাপারটা একটু স্পেশ্যাল।

- কী'রকম?

- ফুডভ্লগিং কী? এর খাওয়া আর ওর গেলাকে সাবজেক্ট করে উপাদেয় সব ভিডিও তৈরি৷ সিম্পল। আমি রকমারি মানুষের রকমারি স্টাইলে চাপ ও বিষম খাওয়া, আর কেস খেয়ে ঢোক গেলা রেকর্ড করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় তুলব৷ এই স্পেশ্যাল খাওয়াদাওয়া সবাই দেখতে চায়, দেখানোর লোক নেই। তাদের ডিমান্ড মীট করতেই আমার চ্যানেল লঞ্চ হচ্ছে কাল। হাইকোয়ালিটি ঢোক, বিষম, চাপ, ও কেস খাওয়ানো-গেলানো চাট্টিখানি কথা নয়, সে'টা হাইয়েস্ট লেভেলের রান্নাও বটে৷ আর সে'দিক থেকে আমি যে খুব বড় মাপের শেফ, তার প্রমাণ আপনি পেয়েই গেছেন৷ তাই তো? এ'বার আসি৷ সুদর্শন গুপ্ত, নামটা ভুলবেন না৷ আর কাল ইউটউবে একবার ঢুঁ মেরে সাবস্ক্রাইব অবশ্যই করবেন৷ কেমন?

মুরারিলাল



- ভায়া!

- উঁ...?

- ও ভায়া..।

- কী ভাইটু?

- এ'বারে তো বাড়ি ফিরতে হয় নাকি! সন্ধ্যে হলো বলে।

- বাড়ি? ধের ধের ধের৷ বাড়িফাড়ি ফিরে লাভ নেই৷ খোঁজ নিয়ে দ্যাখো দেখি, কুতুব মিনারটা কেনা যায় কিনা। অন্তত আশেপাশের দু'কাঠা জমি যদি পেতাম ভায়া মুরারিলাল..। রোজ রাত্তিরে উঠোনে মাদুর পেতে লম্বা হয়ে মিনারের দিকে তাকিয়ে গান ধরতাম। ঠুমরি৷ বা গজল।

- নাহ্। অতগুলো বিয়ারের বোতল ফস্ করে উড়িয়ে দিয়ে মোটেও ঠিক কাজ করোনি। 

- তুমি ভাই বড়ই নেকু মালুম হচ্ছে৷ অথচ খানিকক্ষণ আগে মনে হচ্ছিল শের কা বচ্চা৷ মনে হচ্ছিল, নাহ্, একজন মজবুত লোকের সঙ্গে ইয়ারি হয়েছে বটে৷

- তুমি সত্যিই কবি মানুষ ভাই আনন্দ৷

- শায়র বলো৷ শায়র৷

- গোস্তাখি মাফ।

- ভায়া মুরারিলাল,  তোমার সঙ্গে আলাপ হয়ে কী ভালোই যে লাগছে৷ কয়েকঘণ্টার আলাপ, অথচ মনে হচ্ছে কত জন্ম ধরে অপেক্ষা করছি এমনই এক বন্ধুর৷

- নেশাটা ভালোই চড়েছে তোমার৷

- করেক্ট৷ কিন্তু ইমোশনটা খাঁটি। জানো মুরারিলাল৷ মাঝেমধ্যে বড্ড একলা লাগে৷

- জানি৷ তাই তো এলাম।

- তুমি জানো আমি একা? তাই তুমি যেচে এসে আজ আলাপ করলে? কুতুব মিনার চত্ত্বরে এসে বিয়ার খাইয়ে আউট করলে? তুমি কি দেবশিশু? না ভূত? হে হে হে হে হে হে..বলো না ভাই।

- আমি মুরারিলাল।  সে পরিচয়টুকু কি যথেষ্ট নয়?

- দেখো৷ ফাঁকি দিয়ে সরে পড়ো না৷ গেলে ফোন নম্বর বা ঠিকানাটা অন্তত..।

- তোমার ছেড়ে আর যাব কোথায় বলো৷ হাঁক দিলেই হবে, আমি আসব। ঠিকানা, ফোননম্বর; এ'সব জোলো ব্যাপারে কাজ কী।

- তুমি তো অন্তর্যামী দেখছি৷ বেশ৷ তাই হোক৷ দেখি শ্রীবদনটা..মনের মধ্যে ছাপিয়ে নিই।

- এই চেহারায় আটকে থেকে কী হবে। বোধিসত্ত্বকে আজ দেখছ দিল্লী পোস্টআপিসের ক্লার্কবাবুটি হিসেবে৷ তাই বলে কালকেও সেই শেপ আর ফর্মেই পাবে ভেবেছ?

- আইব্বাস৷ তুমি যে মিস্টিরিয়াস ম্যাজিক ভাই মুরারিলাল। এনিগমা!

- আনন্দ, মনে দিয়ে খুঁজলেই আমায় পাবে৷ মিলের কর্মী, খবরের কাগজ ফেরিওয়ালা, পেটমোটা ব্যবসায়ী বা রিক্সাওলা; ডাকে যদি আন্তরিকতা থাকে বন্ধু, তোমার এই মুরারিলাল কাছে এসে তোমায় জড়িয়ে ধরবেই।

- প্রমিস করছ তো ব্রাদার?

- আলবাত! তবে এ'বার আমি আসি৷ তোমার ঢুলুঢুলু অবস্থা, খানিক পর নেশা হালকা হলে বাড়ি ফিরে যেও।

- আসছ মুরারিলাল?

- তুমি বড় ভালোমানুষ ভাই আনন্দ৷ মনে রেখো, আমি আছি। আর আমি থাকতে তোমার আর একা থাকার চিন্তা নেই৷ প্রাণ খুলে হাঁক পাড়লেই হবে।

- আসবে? ডাকলে এসো কিন্তু মুরারিলাল। এসো৷ কেমন? এসো। 

- আসব৷ কে জানে৷ হয়ত কোনও দিন বাউল হয়ে ফিরে আসবো আর গাইব; " ফিরেও আসব আমি তোমার সুবাসে, থাকবো তোমার বুকে আর আশেপাশে। আমাকে পড়লে মনে খুঁজো এইখানে, এ'খানে খুঁজছি আমি জীবনের মানে"। কেমন দিব্যি হবে না?

- সে'দিন যদি আমি না থাকি মুরারিলাল?

- গানটা তবুও আনন্দেরই থাকবে৷ 

- সাবাশ৷ তুমি ব্যাঘ্রশাবক মুরারিলাল!

Saturday, August 5, 2023

সমর চ্যাটার্জীর সমাধান

- এক্সকিউজ মী৷ আপনি সমরবাবু তো? সমর চ্যাটার্জী?
- হ্যাঁ। কিন্তু আপনাকে তো ঠিক..।
- আপনার হয়ত মনে নেই৷ আমি অরূপ দাস। বার্ন্স অ্যান্ড সন্ডার্সে যখন জয়েন করি তখন আপনি ম্যানেজার।
- অরূপ। অরূপ। মনে পড়েছে৷ আসলে এদ্দিন পর তো..রিটায়ার করেছি তাও তো বছর দশেক হল...মেমরিটা ঠিক..। যাক গে, তুমি তো ফিনান্স ডিপার্টমেন্টে জয়েন করেছিলে? তাই তো?
- আপনার মনে আছে? হ্যাঁ। ইন ফ্যাক্ট, কিছুদিন আপনি হাতে ধরে কন্ট্র্যাক্টের ব্যাপারস্যাপার বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। সে কৃতজ্ঞতাটা..।
- আই ওয়াজ অনলি ডুয়িং মাই জব। তা তুমি কি এখনও সে অফিসেই..?
- আজ্ঞে হ্যাঁ। এদ্দিন পর পুরীর সৈকতে আপনার সঙ্গে দেখা হবে ভাবিনি৷ তাও এই অসময়ে..রাতের সমুদ্র আপনাকেও টানে দেখছি।
- তা টানে বইকি৷ তা'ছাড়া এ'দিকটা শুনেছি সেফ৷ দশটা না বাজা পর্যন্ত তাই উঠি না৷
- এদিকটা বেশ নিরিবিলি৷ ভীষণ সুন্দর।
- দাঁড়িয়ে রইলে কেন? মাদুরে বসো। একাই বসে থাকি৷ পুরনো আলাপি একজন জুটেছে যখন..।
- থ্যাঙ্কিউ। আপনি কি নিয়মিত পুরী আসেন?
- এই সমুদ্রের সঙ্গে একটা নাড়ির যোগ হয়ে গেছে বোধ হয়..।
- স্যার, একটা প্রশ্ন ছিল, যদি কিছু মনে না করেন..।
- অফ কৌর্স।
- হয়ত আপনার কিছুই মনে নেই৷ তবু৷ আগ্রহটা ছিল তাই..আপনি রিটায়ার করার সাত দিন আগে সানফ্লাওয়ার শিপিং কোম্পানির একটা কন্ট্রাক্ট তাড়াহুড়ো করে প্রসেস করা হয়৷ ম্যানেজমেন্টর হুকুমেই। যদিও ব্যাপারটা ঘটানো হয় আমার হাতে দিয়ে৷ সে'দিন সমস্তটা বুঝিনি৷ কিন্তু এদ্দিন পর একটা অডিটে সানফ্লাওয়ার শিপিং নিয়ে একটা বড় গোলমাল ধরা পড়েছে৷ বেশ বড় ফিনান্সিয়াল স্ক্যান্ডাল৷
- এ ব্যাপারে আমায় আবার কেন..।
- আপনি আমায় কিছুই বলেননি সে সময়৷ কিন্তু গোলমালের ব্যাপারটা আপনি ঠিক আঁচ করেছিলেন। তাই তো?
- এ'বারে আমি উঠব৷
- সরি মিস্টার চ্যাটার্জি৷ কিন্তু ব্যাপারটা এতই..। পুলিশের হাতে যে কী বিশ্রী হেনস্থা হতে হয়েছে..আমার ফ্যামিলিটা শেষ হয়ে যাচ্ছে..।
- তুমি কাকতালীয় ভাবে পুরী আসোনি তা'হলে৷ রীতিমতো খোঁজখবর নিয়ে আমার পিছনে লেগেছ..।
- স্যার, প্লীজ..।
- তুমি কি আমায় চোর ভেবেছ? ঘুষখোর?
- অন দ্য কনট্রারি, আমার বিশ্বাস আপনি এর বিরুদ্ধে ছিলেন। নেহাত ম্যানেজমেন্টের জারিজুরির ওপরে কিছু করতে পারেননি..।
- এ ব্যাপার নিয়ে আমি আর একটাও কথা বলব না৷
- সমরবাবু। স্যার, তখন আমি অফিসে নতুন৷ অল্প বয়স। আটঘাট কিছুই বুঝতাম না৷ অথচ আজ এদ্দিন পর বিশ্রীভাবে আমায় ফাঁসানো হয়েছে৷ আমার মানসম্মান সমস্তই...। আপনি যদি আমায় একটু গাইড করতে পারেন..আপনার নিশ্চয়ই কিছু মনে আছে..। ম্যানেজমেন্টের বিরুদ্ধে প্রমাণ না পেলে..আমার নামের ওপর থেকে কালিটা আর মোছা যাবে না।
- দেখো অরূপ..।
- প্লীজ স্যার৷ প্লীজ৷
- সতেরোর বি বাই টু এইটি সিক্স বাই ডি। স্টোররুমের আর্কাইভ থেকে এই ফাইলটা বের করতে পারলে বাঁচলেও বাঁচতে পারো৷ আমি নিজের হাতে সানফ্লাওয়ারের গোলমালের ব্যাপারে টপ-ম্যানেজমেন্টের কমিউনিকেশন রেকর্ড সরিয়ে রেখেছিলাম। ও ফাইলের খবর কেউ জানে বলে মনে হয় না৷ দ্যাখো, সে ফাইল খুঁজে পাও কিনা।
- সেভেন্টিন বি বাই টু এইটি সিক্স বাই ডি।
- করেক্ট।
- সব যখন জানতেন, আমায় সাবধান করে দিলেন না কেন সে সময়?
- ওরা আমার রিটায়ারমেন্ট বেনেফিট আটকে দিত। আমি..আমি ভয় পেয়েছিলাম অরূপ। সরি।
- ওহ৷
- অরূপ। একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
- বলুন।
- তুমি আমার খোঁজ পেলে কী করে?
- খোঁজ পাওয়ার কথা তো নয়৷ তাই না?
- কী করে পেলে?
- হেহ্৷ বুঝতেই তো পারছেন।
- অরূপ!
***
- মিসেস দাস৷ এই সেভেনটিন বি বা টু এইটি সিক্স বাই ডি-য়ের ফাইলটার খবর আপনি জানলেন কী করে?
- সেই ইনফর্মেশন আমি শেয়ার করত পারব না৷ মিডিয়ার কাছে শুধু একটাই অনুরোধ। আপনাদের মাধ্যমে সবাই যেন জানতে পারে যে বার্ন্স অ্যান্ড সন্ডার্সের ম্যানেজমেন্ট কতটা কোরাপ্ট৷ শুধু কোরাপ্ট নয়, খুনিও বটে৷ আমার হাসব্যান্ড অরূপ দাসকে তারা খুন করেছে। হয়ত বুকে ছুরি বসায়নি৷ কিন্তু মিথ্যে বদনামের বোঝা চাপিয়ে তাকে শেষ করা হয়েছে।
- সে'টা এখন প্রমাণিত। কোর্ট ম্যানেজমেন্টের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নিচ্ছে৷ কিন্তু মিসেস দাস, এই গোপন ফাইলটার খবর তো কেউ জানত না! ফাইলটা যিনি গোপনে বানিয়ে রেখে গেছিলেন, বার্ন্স অ্যান্ড সন্ডার্সের রিটায়ার্রড ম্যানেজার সমর চ্যাটার্জি, তিনি মারা গেছেন বছর সাতেক হল৷ অর্থাৎ তাঁর রিটায়ারমেন্টের বছর তিনেকের মধ্যেই। অরূপবাবুও নিশ্চয়ই সে'টা জানতেন না, জানলে তিনি সুইসাইড করতেন না। কাজেই হঠাৎ আপনি কী'ভাবে..।
- যদি বলি অরূপ ওই ফাইলের খবর আমায় স্বপ্নে দিয়ে গেছে? তা'হলে বিশ্বাস করবেন? আমার আর কিছুই বলার নেই৷ প্লীজ, আমায় এ'বারে একটু একা থাকতে দিন।