।। গোয়া-১।।
গত হপ্তাটা জিরিয়ে কেটেছে৷
অনেকেই জানেন না হয়ত, উনবিংশ শতাব্দীর ব্যাতিক্রমী দার্শনিক মঁসিয়ে গ্যুল দ্যে মেঁপে বলেছিলেন;
"জিরোনোর প্রথম শর্তই হল সবার আগে দিস্তে দিস্তে প্ল্যান কষতে হবে৷ তারপর দরাজ মনে সে'সব প্ল্যান ভেস্তে দিয়ে; মনোগ্রাহী গুলতানিতে মন দিতে হবে৷ তবেই আত্মার বিশ্রাম, তা'তেই প্রাণের 'অল্প গড়িয়ে নেওয়া'।"
তা সেই মতই প্ল্যান কষে, তারপর সেই যত্ন করে খিলি করা প্ল্যানে জল ঢেলে 'রিল্যাক্স' করতে গেছিলাম গোয়া।
গুরুজনেরা পইপই করে বলে দিয়েছিলেন সী-ফুড ছাড়া কিস্যুটি ছোঁবে না৷ আমিও শপথ করেছিলাম, তাই হবে৷ গোয়া পৌঁছেই শপথ বাবাজীকে সমুদ্রে চুবিয়ে প্রথম লাঞ্চেই খেলাম ডাল (আহ, ওই হলো, ডাল ফ্রাই), আলু চচ্চড়ি (হ্যাঁ হ্যাঁ, জিরে আলু), ভিন্ডালু আর রুটি। সী-ফুডের স্পর্শ বলতে কোলভা বীচের হাওয়াটুকু। আর শেষ দিনের লাঞ্চ সারলাম মনজিনিসের একটা আউটলেটে চার রকমের প্যাটি খেয়ে৷
****
।।গোয়া-২।।
হ্যাঁ।
স্বর্গদ্বার-কাকাতুয়া মতাদর্শ মেনে,
বৈকুণ্ঠ-চার্জড লালমোহনের কলজে আঁকড়ে,
মারাত্মক রঙচঙে জামা আর চোখে কটকটানো ফ্লুরোসেন্ট হাফপ্যান্ট পরে,
বীচ দিয়ে ড্যাঙড্যাঙিয়ে হাঁটতে হাঁটতে,
রহমান-লৌহকপাট স্টাইলে;
অবশ্যই গেয়েছি-
"এই বালুকাবেলায় আমি লিখেছিনু
(টিং)
একটি সে'নাম আমি লিখেছিনু
(টিং)
আজ সাগরের ঢেউ দিয়ে তারে যেন মুছিয়া দিলাম
(টিঁ...টিঁ-টিঁ-টিঁ-টিঁ...টিঁ-টিঁ-টিঁ-টিঁ..টিঁ..টিঁ..টিঁ..টিঁ)
****
।।গোয়া-৩।।
যা বলছিলাম।
প্ল্যান করতে বসা উচিৎ "লুটেগা ভাণ্ডার, মারেগা গণ্ডার" ফর্মুলায়। প্ল্যান করার সময় নিজেকে আলেকজান্ডার ভাবতে হবে, আর প্ল্যান এক্সেকিউট করার হয়ে উঠব বাবু তন্ময়; তা'তেই ধর্ম রক্ষা হবে।
সেই মত ভেবে নিয়েছিলাম যে এক মস্ত গাড়ি ভাড়া করে গোয়ার হোটেল থেকে দূর দূর পাড়ি দেব। ভোরবেলা উঠে স্যান্ডুইচ ডিমসেদ্ধ প্যাক করে বেরিয়ে পড়া। এই দুধ সাগর ফলস, তারপর আর দূরে দিয়ে গোকর্ণা, তার ওপর আরও কত কী। বেশ একটা লিভিংস্টোনিও ব্যাপারস্যাপার, ভাবলেই গায়ে কাঁটা৷ সেই অনুযায়ী ভাড়ার খবরাখবর নেওয়া হল, পড়াশোনা করা হল, ব্লুপ্রিন্ট তৈরি হল৷
তারপর আর কী। প্ল্যান-আলেকজ্যান্ডারকে নীল ডাউন করিয়ে স্টেজ আলো করে এগিয়ে এলেন মেজাজসম্রাট শ্রীতন্ময়৷ অতএব যা হওয়ার তাই হলো৷ সোজা গিয়ে একটা স্কুটি ভাড়া করে ক'দিন ঢিকিরঢিকির স্পীডে পনেরো কিলোমিটার রেডিয়াসে আটকে রইলাম৷ বলাই বাহুল্য, সে টইটইতে সমুদ্রের চেয়ে বেশি ছিল গোয়ার গ্রাম্য রাস্তা। লাওতলিম, বেনোলিম আরও কত আদি পাড়া৷ দু'পাশ সবুজে সবুজ আর ছোট্ট খোকাখুকুর ক্রেয়ন্সে আঁকা ছবি থেকে তুলে নেওয়া সব বাড়ি।
আর ইয়ে, লাওতলিম (আমি বোধ হয় ভুল উচ্চারণ করছি, তবে দরদটা মিথ্যে নয়) অঞ্চলের গীর্জার পাশে একটা এত্তটুকু চায়ের দোকান। পেটিএমে টাকা দিয়ে টের পেলাম দোকানটার নামটা গাল ভরা, 'লুকাস বার অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট। তবে ভ্রমণ-সঙ্গীটি পরে দেখালে দোকানের গায়ে লেখা 'বাবা ফাস্ট ফুড'। তা, সে'খানকার চিকেন শিঙাড়া আমি মুগ্ধ। হলফ করে বলতে পারি- ও'জিনিস জিভে ছোঁয়ালেই পুণ্যলাভ।
।।গোয়া-৪।।
মাছটাছ যা খেলাম, তার মধ্যে সবার ওপরে রয়েছে (আমি রেখেছি) পালোলেম বীচের অনতিদূরে ফার্ন (বাই কেট) রেস্টুরেন্টে সার্ভ করা 'ক্র্যাব সুক্কা'-কে। আমি যে'টাকে বলব কষা কাঁকড়া৷
ঝাল? চাবুক। চাবুক।
ঝোল? কবিতা। কবিতা।
ভাত-রুটি সব সুটসাট উড়ে যাবে।
আর কাঁকড়ার সাইজ বা কোয়ালিটি যা দিয়েছিল; "আহা" বলে তাকে ছোট করব না, বলব; "অহো"!
সে রেস্টুরেন্টে আমি একটা বিগলিত সেল্যুট রেখে এসেছি।
আর। ইয়ে।
আমি আর কী বুঝি। তবে কেউ কেউ বলেন যে কাজু ফেনির সঙ্গে লিমকা ব্যাপারটা নাকি ঠিক ওই শরতে কাশ বা আলুভাতেমাখায় ভাজা শুকনো লঙ্কার মত ঘ্যাম। লোকে বলে, তাই সে কথা আমার কানে এসেছে। কে জানে এ'সব কথা কতটা সত্যি।
।। গোয়া-৫।।
লাইফ ইজ নট আ বেড অফ রোজেস।
চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়।
আচমকা একদিন সে কী জ্বরজ্বর ভাব। মুখে বললাম, "ও কিছু না৷ আই অ্যাম ফাইন"। মনে মনে বললাম, " হোয়াট আ টেরিবল কেলোর কীর্তি"। ট্র্যাভেলিং পার্টনার ডাক্তারের চরিত্রে অভিনয় করা অশোককুমারের স্টাইলে বললে, "ইমিডয়েটলি প্যারাসেটামল চার্জ করতে হবে"৷
আমি ব্যবস্থা করলাম প্যারাসেটামলের গ্র্যান্ডফাদারের- ডোলোর বদলে এলো চিরঅমলিন বিশল্যকরণী; চিলিচিকেন (মারাত্মক ঝাল, স্পেশ্যাল ইন্সট্রাকশনে বানানো) আর হাত-রুটি৷
ব্যাস, এক ডোজেই চাঙ্গা। গোয়া প্ল্যান তো আর জলে দেওয়া চলে না।
।।গোয়া-৬।।
যে'খানে সমুদ্র, সে'খানেই পুরী। মনটাকে ধরে রাখতে পারলেই হল। ভূগোল, ইতিহাস, রাজনীতি; সে সমস্তই ছলনা।
সেই পুরীর কসম; সমুদ্রের যে কী মায়া৷
নিরিবিলি বিকেল বা সন্ধ্যেয়,
একা,
নিশ্চিন্তে গা এলিয়ে,
মনের ভিতরের যত আগাছা কিছুক্ষণের জন্য ঝেঁটিয়ে বিদেয় করে,
আধভেজা বালির ওপর থেবড়ে দু'দণ্ড বসতে না পারলে;
সে মায়াকে স্পর্শ করা যায় না৷
নাহ্। স্পর্শ-টর্শ আমিও করতে পারিনি৷ সে'সব হবে'খন, একদিন হবে। একদিন হবেই।
No comments:
Post a Comment