এখন সন্ধ্যে পাঁচটা সাত। অর্থাৎ গোরেগাঁও লোকাল আসতে আরো মিনিট দশেক। ও'টায় ভীড় কম, সীট পাওয়া না গেলেও নিশ্চিন্তে দাঁড়িয়ে যাওয়া যায়৷ আর এই অপেক্ষার দশ মিনিট বেশ জমজমাট৷ প্ল্যাটফর্মের এক কোণে দাঁড়িয়ে সমরবাবু নিজের ব্লুটুথ ইয়ারফোনটা অফিসের ব্যাগ থেকে বের করে কানে গুঁজবেন৷ তারপর সেই ইয়ারফোন মোবাইলে কনেক্ট করে তিনটে বাছাই করা হেমন্তর গান চালাবেন; রোজকার নিয়ম। এই গানগুলো রোজ পালটে যায়৷ লিস্টে আজ আছে: "বনতল ফুলে ফুলে ঢাকা", "পালকির গান" আর "এমন আমি ঘর বেঁধেছি"। হেমন্তবাবুর কণ্ঠ ব্যাকগ্রাউন্ডে থাকলে শশব্যস্ত বান্দ্রা স্টেশনও ভারী সুন্দর হয়ে ওঠে৷
আজ বিকেলের তিন-গানের প্লেলিস্ট শুরু হয়ে সবে হেমন্তবাবু রোমান্টিক দীর্ঘশ্বাসে পৌঁছেছেন; "শুধু এই পথ চেয়ে থাকা, ভালো কী লাগে"৷ এমন সময় গানের সুতো কেটে গেলো, একটা বিশ্রী কণ্ঠের "হ্যালো"তে হেমন্ত ধরাশায়ী। কী আশ্চর্য, কল এলো কখন, রিং তো শোনা যায়নি৷ সাড়া দেওয়ার আগে ফোনটা পকেট থেকে বের করে দেখলেন সমরবাবু; অদ্ভুত, কোনো কলই আসেনি। অথচ কানে স্পষ্ট শুনতে পারছেন সেই হেঁড়ে কণ্ঠস্বর;
"সমর৷ সমরবাবু৷ মিস্টার দাস! মিস্টার সমর দাস! প্লীজ রেস্পন্ড। প্লীজ সাড়া দিন"।
তিরিশ সেকেন্ড কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার পর সাড়া দেবেন বলে মনস্থ করলেন সমরবাবু।
- হ্যালো, হু ইজ দিস?
- উফ, এতক্ষণে আপনার সাড়া দেওয়ার সময় হলো সমরবাবু? আর আমি যখন বাংলায় প্রশ্ন করছি তখন দুম করে ইংরেজি ফলানোর কী আছে?
- না মানে..ইয়ে। এক মিনিট! আপনি কে? কী'ভাবে কথা বলছেন আমার সঙ্গে? কী চাই?
- মন দিয়ে শুনুন সমরবাবু৷ ব্যাপারটার ওপর আপনার জীবন-মরণ নির্ভর করছে।
- এক্সকিউজ মী?
- আবার ইংরিজি! ধুচ্ছাই! যাকগে শুনুন৷ আপনি পাঁচটা সতেরোর গোরেগাঁও লোকাল ধরবেন বলে দাঁড়িয়ে আছেন৷ তার আগে অন্য কোনও ট্রেন এলেও চট করে উঠে পড়বেন না যেন।
- নিজের গ্যাঁটের পয়সা করে টিকিট কেটেছি৷ তাও ফার্স্টক্লাসের৷ আমি কোন ট্রেনে উঠব বা উঠব না, সে বিষয়ে জ্ঞান দেওয়ার আপনি কেন? বলুন দেখি, আপনি কে?
- সমরবাবু৷ আমিই আপনি।
- ইয়ার্কি হচ্ছে?
- আমিই সমর দাস৷ আমিই আপনি৷ শুধু সময়ের হেরফের।
মাথাটা তড়াং করে গরম হয়ে গেল সমরবাবুর, কান থেকে ইয়ারফোনটা খুলে পকেটে রাখলেন৷ রাস্কেল, স্টেশনে দাঁড়িয়ে কেউ প্র্যাক্টিকাল মস্করা কষছে! যত্তসব! দিলে মেজাজটা বিগড়ে। আর কেরামতি দ্যাখো, কণ্ঠস্বরটাও ঠিক তাঁর নিজেরই মত বিদঘুটে- নির্ঘাৎ এআই ব্যবহার করেছে। ডিজিটাল স্ক্যাম যে কী ভীষণভাবে আমাদের আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরছে।
এমন সময় বোরিভলি লোকাল স্টেশনে ঢুকলো। সমরবাবু অবাক হয়ে দেখলেন ট্রেনটা বেশ ফাঁকা! এ'দিকে গোরেগাঁও লোকাল আসতে এখনও মিনিট পাঁচেক দেরী৷ উঠে পড়লেই হয়। কিন্তু..কিন্তু ইয়ারফোনে শোনা সেই বিটকেল কণ্ঠস্বরটার কথা তখনও কানে বাজছিল৷ তাই খানিকক্ষণ থমকে দাঁড়ালেন৷
প্ল্যাটফর্ম ছাড়ার জন্য ট্রেনটা নড়েচড়ে উঠতেই সমরবাবুর মনে হলো এ'সব প্র্যাঙ্ক কলারদের বেশি লাই দিতে নেই৷ অমনি সোজা ছুট দিলেন ট্রেনের দিকে৷ কামরায় একটা পা রেখেও ফেলেছিলেন কিন্তু ট্রেনের স্পীডের হিসেবটা একটু এ'দিক ও'দিক হয়ে গেল। একটা বিশ্রী হ্যাঁচকা টান, ট্রেন-প্ল্যাটফর্ম থেকে হইহই চিৎকার আর দেড় সেকেন্ডের মধ্যে চলন্ত ট্রেনের নীচে তলিয়ে গেলেন সমর দাস।
***
সম্বিৎ ফিরতে সমরবাবু টের পেলেন তিনি বান্দ্রা স্টেশনেই দাঁড়িয়ে৷ তবে এ যেন অন্য জগত। সন্ধ্যের যে'টুকু আলো, সে'টুকু বাদে কোনো ইলেক্ট্রিক বাতি নজরে পড়ল না৷ ট্রেনের শব্দও নেই৷ একটু মন দিয়ে চারপাশটা দেখে সমরবাবু বুঝলেন চারপাশে মানুষজন কুকুর-বেড়াল কেউই নেই৷ মনে হলো গোটা পৃথিবীতে তিনি একা। ট্রেনের তলায় পড়ার কথা মনে পড়ল৷ গা শিউরে ওঠার কথা, কিন্তু খুব একটা বিচলিত বোধ করলেন না তিনি৷ ব্যাপারটা আঁচ করতে সবিশেষ অসুবিধে হচ্ছে না তবে এ'দিকটা যে এমন সিনেমার সেটের মত হবে সে'টা আশা করেননি৷
এমন সময়, সমরবাবুর নজরে পড়ল উজ্জ্বল লাল রঙের টেলিফোনটা, আদ্দিকালের রিসিভারগুলো যেমন হত - অনতিদূরে একটা কাঠের টেবিলের ওপর রাখা। এই টেবিলটা প্ল্যাটফর্মের মধ্যে এ'ভাবে থাকার কথা নয়৷ তবে এ তো আর গড়পড়তা বান্দ্রা স্টেশন নয়৷ টেলিফোনটা দেখে সহজেই দুইয়ের সঙ্গে দুই জুড়ে চার করতে পারলেন তিনি৷ চেষ্টা করে যে বিশেষ লাভ হবে না তাও বুঝতে পারছিলেন৷ তবু, একটা শেষ চেষ্টা করতে ক্ষতি নেই৷
মরিয়া হয়ে এগিয়ে গিয়ে ফোনের রিসিভারটা তুলে কানে ঠেকাতেই হেমন্তবাবুর মায়াবী কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, "শুধু এই পথ চেয়ে থাকা, ভালো কী লাগে"৷ আচমকা সে গান থমকে গেল, রিসভারে ভেসে এলো একটা জলজ্যান্ত বান্দ্রা স্টেশনের হইচই। সমরবাবু জানেন রিসিভারের ওপারে কে আছে। সাহস করে তিনি বলে উঠলেন;
"সমর৷ সমরবাবু৷ মিস্টার দাস! মিস্টার সমর দাস! প্লীজ রেস্পন্ড। প্লীজ সাড়া দিন"।
No comments:
Post a Comment