সে কতদিন আগের কথা৷ জোড়াডিম চ্যাটার্জি তখন সবে কলেজে ঢুকেছে। দু'চোখ জুড়ে স্বপ্ন; সে একদিন নামজাদা অমলেট হবে৷ চিজ অমলেট বা মসালা অমলেট বা আরও কত কী ধরণের মুরুব্বি হওয়ার সম্ভাবনা তার। একদিন সবাই তাকে কেউকেটা বলে সমীহ করবে, পাড়ার ক্লাব তাকে ডেকে মানপত্র দেবে, নামী পত্রিকায় তার ছবি জ্বলজ্বল করবে, বাপ-মা চোখ মুছে বলবে "আহা, আমাদের সোনার ছেলে"।
কিন্তু সে স্বপ্নের নির্মল বাতাসে ভবিতব্য কালো ধোঁয়া মিশিয়ে দিলে। বেনিয়ম, বেহিসেব আর বেআক্কেলেপনা এসে তার অমলেট হওয়ার সাধ দিল ঘুচিয়ে। সামান্য ভুর্জি হয়ে যখন সে দ্য গ্রেট চাটু ইউনিভার্সিটি ছেড়ে বেরোলে, তখন জোড়াডিম টের পেলে যে সে হারিয়ে যাচ্ছে; সমস্ত স্বপ্ন মিথ্যে হয়ে যেতে বসেছে।
সত্যি বলতে কী, জোড়াডিম চ্যাটুজ্জ্যে হারিয়েই যেত যদি না সে বাসিভাত মাস্টারের সান্নিধ্যলাভ করত। বাসিভাত মাস্টার ভারি খামিখেয়ালী মানুষ, জিনিয়াস কিন্তু বেপরোয়া। এক রাত্রে ফ্রিজপাড়ার শুঁড়িখানা থেকে বেরোনোর সময় পথের ধারের বেঞ্চিতে গা এলিয়ে পড়ে থাকা যুবক জোড়াডিমের দিকে তার নজর গেল। নেশাগ্রস্ত অবস্থাতেও বাসিভাতবাবু প্রতিভা চিনতে কসুর করলেন না। বুঝলেন, বেঞ্চিতে শুয়ে থাকা ছেলেটা ভদ্রসন্তান, তার প্রতিভা আছে। ক্ষণিকের অন্ধকারে সে বিভ্রান্ত বোধ করছে বটে, তবে তার সামনে প্রদীপ জ্বেলে ধরলেই সে ফ্লাডলাইট হয়ে ঘুরে দাঁড়াবে।
ব্যাস, যেমন ভাবনা তেমনি কাজ৷ বাসিভাত মাস্টার জোড়াডিম চ্যাটুজ্জ্যের সঙ্গে গিয়ে আলাপ জমালেন৷ খানিকক্ষণ পর বাসিভাতবাবু বলেই বসলেন;
- তুমি তো ভুর্জি৷ কিন্তু তোমার ইচ্ছে ছিল অমলেট হওয়ার। কী, তাই তো?
- অদ্ভুত! আপনি কী ভাবে বুঝলেন?
- আমি জাতে মাস্টার। পথভোলাদের কান টেনে পথে আনাটাই আমার কাজ৷ শোনো, তুমি যদি আমার সঙ্গে আসতে রাজি হও; আমি কথা দিচ্ছি তোমার জীবনের মোড় আমি ঘুরিয়ে দেব।
- কিন্তু আমি ঠিক..।
- কী? ভুর্জি হয়ে শেষ না হয়ে চাও না বড় কিছু করতে? চাও না?
- কিন্তু অমলেট হওয়া তো আর সম্ভব নয়!
- যদি বলি এর চেয়েও বড় সম্ভাবনা অপেক্ষা করে আছে তোমার জন্য? কী, পারবে আমায় বিশ্বাস করতে?
- অপরাধ নেবেন না৷ কিন্তু আমি এক এলেবেলে মানুষ৷ আপনি কি পারবেন আমায় বিশ্বাস করতে মাস্টারমশাই? আর আমি কি সত্যিই পারব বড় কিছু একটা করতে?
- আমি তো হীরে চিনতে ভুল করি না হে জোড়াডিম। চলো, এ'বার। আর বিলম্ব নয়।
- যাব? কোথায় যাব?
- বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, বাজে প্রশ্নে বহুদূর। এ'বার চলো জোড়াডিম। অনেক কাজ পড়ে আছে।
নতুন প্রজেক্টের আগ্রহে বাসিভাত মাস্টারের নেশা ততক্ষণে ছুটে গেছে৷ হন্তদন্ত হয়ে তিনি এগিয়ে চলেছেন, তার সঙ্গে তাল রাখতে হিমশিম খাচ্ছে জোড়াডিম।
খানিকক্ষণের মাথায় একটা জরাজীর্ণ ক্লাবঘরের সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন বাসিভাত মাস্টার। জোড়াডিম কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটা জবরদস্ত হাঁক পাড়লেন তিনি; "তোরা কে কোথায় আছিস, বেরিয়ে আয়৷ দ্যাখ কে এসেছে আমার সঙ্গে"।
অমনি ক্লাবঘরের ভিতর থেকে একদল তরুণ বেরিয়ে এসে সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠলে, "আরে মাস্টারমশাই আপনি এদ্দিন পর৷ আমরা সেই কবে থেকে আপনার অপেক্ষায় বসে....আর এ'টা কে"?
স্মিত হেসে মাস্টার বাসিভাত বললেন, "পেয়েছি! এদ্দিনে পেয়েছি৷ ক্লাবের নতুন সেক্রেটারি; এর নাম জোড়াডিম। তোরা একে জোড়াডিমদা বলে ডাকবি৷ আর বাবা জোড়াডিম, আলাপ করিয়ে দিই৷ এই হল পেঁয়াজ দাস, ও গাজরচন্দ্র, ও'দিকে বীনস সেন, ওই যে কাঁচালঙ্কা খাসনবিস, আদা আলি, রসুন দত্ত, সোয়্যাসস্ হালদার, আর ভিনিগার ভট্ট৷ আরও কয়েকজন আছে, তারাও এলো বলে৷ এসো জোড়ডিম, এ'বার তোমার উত্তরণের পালা"।
তখনই আপ্লুত জোড়াডিমের চোখ গেল ক্লাবঘরের বাইরের দেওয়ালে ঝোলানো আধভাঙা সাইনবোর্ডটার দিকে যে'খানে বড় বড় হরফে লেখা আছে;
"হঠাৎ-ইচ্ছেয়-সহজে-বানানো এগ ফ্রায়েড রাইস সঙ্ঘ"।
No comments:
Post a Comment