ঘরের দরজার সামনে থমকে দাঁড়ালেন বিমলবাবু৷
"আমায় বলছিস"?
"আর কাকে বলব?", ল্যাপটপ থেকে মুখ না তুলেই বললে সুমন, "এই পোড়োবাড়িতে আমরা দু'জন ছাড়া তো আর কেউ নেই"।
"ব্রেকফাস্টে আজ রুটি খাবি? রাত্রের বাড়তি আটামাখা আছে৷ তা'হলে আর দুধ কর্নফ্লেক্সের দরকার নেই"।
"তুমি এস্কেপিস্ট৷ মা ঠিকই বলত"।
"রুটিই হোক তা'হলে"।
**
সাতটা চুয়ান্ন।
বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন বিমলবাবু।
ঠিক আটটা পাঁচে অফিসের বাস আসবে৷ হাতে এখনও এগারো মিনিট৷ দিব্যি এ'দিক ও'দিকের ভালোমন্দ চিন্তা করে এ'কয় মিনিট কাটিয়ে দেওয়া যাবে৷
বিমলবাবুর চিন্তা নম্বর ১:
রুটি-আলুভাজা ব্রেকফাস্ট মন্দ ছিল না তবে সুমন এখনও ডাইনিং টেবিলে আসেনি৷ ও জিনিস ঠাণ্ডা হয়ে গেলে বিশ্রী লাগবে।
বিমলবাবুর চিন্তা নম্বর ২:
"কী করেছি আমি সমুর জন্য"?
বিমলবাবুর চিন্তা নম্বর ৩:
"সমুর জন্য একটা ভালো চেয়ার কিনতে হবে৷ দিনে ষোলো ঘণ্টা প্রায় কাজ করে ছেলেটা, ওয়ার্ক ফ্রম হোম৷ অথচ কাঠের চেয়ারটা এত কাটখোট্টা, ধুস"৷
বিমলবাবুর চিন্তা নম্বর ৪:
"সুতপার জন্য কি আদৌ তেমন কিছু করতে পেরেছি কি? মেয়েটা বড় এলেবেলে ভাবে ফস্কে বেরিয়ে গেল৷ ইশ্! এখন হাত কামড়ে কী হবে"?
বিমলবাবুর চিন্তা নম্বর ৫:
"শ্যাম্পুর ব্র্যান্ডটা এ'বার পাল্টাতে হবে৷ আগেরটা ছ'মাস হল৷ আর ভাল্লাগছে না৷ দামী একটা ব্র্যান্ড কিনে সমুকে চমকে দেওয়া যাক আবার৷ বাবার এখনও ঘ্যাম আছে, বুঝুক সে"।
বিমলবাবুর চিন্তা নম্বর ৬:
"যথেষ্ট করা তো হয়নি সমুর জন্য৷ কারুর জন্যই তেমন কিছু করা হল না৷ সব জায়াগায় ফাঁকি৷ আর ছেলেপিলেদের একটু ধমকধামক না খেলে গার্জেনলেস বাবারা ভেসে যেতে পারে৷ একটু বকেছে, বেশ করেছে"৷
বিমলবাবুর চিন্তা নম্বর ৭:
"মোটেও আমি এস্কেপিস্ট নই৷ মোটেও না৷ ব্যাটাচ্ছেলে ভেবেছেটা কী! অমন হাইক্লাস রুটি-আলুভাজা ঠাণ্ডা চিমসে করে খেয়ে মুখ ভ্যাটকাবে আর বাবা সে'টা মেনে নেবে? আজ সমুরই একদিন কি আমারই একদিন"!
বাস আসতে আরও তিন মিনিট আছে৷ হুড়মুড় করে বাড়ির ভিতর ফেরত গেলেন বিমলবাবু। ঢুকেই হুঙ্কার;
" অ্যাই ব্যাটা সমু, কোথায় তুই"!
"আরে চেল্লাচ্ছ কেন খামোখা", ডাইনিং টেবিকে বসে সমু রুটি চেবাচ্ছে৷
ফের থমকালেন বিমলবাবু৷
সমুই আবার বললে, "বাবা, কর্নফ্লেক্সের বদলে এ জিনিস সত্যিই অমৃত"!
"তাই না রে"?
"আলবাত। ইয়ে, তুমি অফিস যাবে না"?
"যাব তো৷ এই আসি"।
"এসো৷ আর আজ রাতে কিন্তু আমি রান্না করব বাবা"।
"এইত্তো সাচ্চা বাঘের বাচ্চার মত কথা"!
" হে হে হে"!
"আসি"!
"বাবা, রাগ করেছ? সরি"!
" নেকু! আসি"।
***
অফিসের বাস আজ পাঁচ মিনিট লেট৷
বাড়ির সামনে একলা দাঁড়িয়ে থাকা বিমলবাবুর ওপরের দিকে তাকালেন। গেটের ওপর জড়িয়ে থাকা বোগেনভিলিয়ার দিকে তাকিয়ে গলার মধ্যে সামান্য চিনচিন বোধ করলেন। নিজেকে প্রশ্ন করতেই হল,
"ব্রাদার বিমল, কী করেছো তুমি কারুর জন্য"?
No comments:
Post a Comment