শীতের সন্ধ্যে, সাতপুরোনো দিল্লী।
জামা মসজিদের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে একশো সাতাশির নামতা পড়ছিলেন এক প্রৌঢ়, বাংলায়; উঁচু স্বরে, সুর করে। বেদম ভিড়, হট্টগোল; কিছুই তাঁকে টলাতে পারছিল না। পরনে ময়লা চেক হাফশার্ট, আর খয়েরি ফুলপ্যান্ট। গালে খোঁচা দাড়ি, অদ্ভুত শান্ত মুখ৷
"ইন্ট্রিগিং" শব্দটা মনের মধ্যে দু'বার আউড়ে নিয়ে ভদ্রলোকের দিকে এগিয়ে গেলেন দীপকবাবু। মাসে একবার এ অঞ্চলে এসে নিজের মনে ঘোরাঘুরি করেন; প্রচুর হাঁটেন তিনি। স্ত্রী সোমা আর স্কুল-পড়ুয়া মেয়ে ফুলিকে ছাড়া অন্য কোথাও যাওয়া না হলেও, এই পুরনো দিল্লীর গলি-ঘুপচিতে ঘুরতে বেরোনোর ব্যাপারে তিনি একটু প্রাইভেসি পছন্দ করেন, এ'টাই তাঁর 'মি টাইম'৷ সাধারণত রাস্তায় দাঁড়িয়ে নতুন মানুষজনের সঙ্গে আলাপ করার লোক তিনি নন৷ কিন্তু আজ এই বাংলায় নামতা পড়া বৃদ্ধকে দেখে আগ্রহটা সামাল দিতে পারলেন না৷ এগিয়ে গিয়ে সটান দাঁড়লেন সে ভদ্রলোকের সামনে, নামতা আউড়ানো থমকে গেল।
- এক্সকিউজ মি স্যার৷ আপনি বাঙালি?
- নয়ত বাংলায় নামতা পড়াটা বাড়াবাড়ি হত।
- আমি দীপক চ্যাটার্জি। লাজপতের দিকে থাকি৷
- তা'তে কী?
- না মানে সরি৷ ওই, ইচ্ছে হল আলাপ করতে।
- বেশ করেছেন৷ আমি যে কোন দিকে থাকি কে জানে।
- আপনার নামটা যদি..।
- আমায় কিছু খাওয়াবেন?
- নিশ্চয়ই! চলুন না৷ আল জওহরের রুটি-মাংস খেয়েছেন কি আগে?
- আল জওহরের রুটি-মাংস৷ এ'টা কি কোনো কবিতার লাইন দীপকবাবু?
- না না৷ ইয়ে, চলুন না খেয়ে আসি, রুটি মাংস! ওই সামনেই দোকানটা। চলুন৷ ভারি ইচ্ছে হচ্ছে আপনার সঙ্গে আলাপ করতে।
- উম..গতকাল বিকেলে খিচুড়ি খেয়েছিলাম জানেন। চাঁদনি চৌকের এক শেঠ বড় আদর করে খাওয়ালে৷ আমি তাকে ক্যাপ্টেন স্কটের গল্প শুনিয়ে মুগ্ধ করেছিলাম কিনা। তা সেই খিচুড়ির ভার এখনও লাঘব হয়নি মনে হচ্ছে, কাজেই রুটি-মাংস গুরুপাক হয়ে যাবে৷ অল্প মিষ্টি খাওয়ান বরং।
- বেশ তো৷ ওই আল জওহরের উলটো দিকেই একটা গুমটিতে মারাত্মক ভালো শাহিটুকরা পাওয়া যায়৷ টপ-ক্লাস!
- শাহিটুকরা৷ কী সুন্দর নাম! তাই না? রাজকীয়, অথচ ফুলের মত নরম।
- খেতেও অমৃত। চলুন না প্লীজ৷ ওই সামনের রাস্তাটার গোড়াতেই আছে..। কাছেই..।
- রাস্তা?
- ওই যে..।
- দেখুন ভালো করে, রাস্তা কই? ও'টা তো নদী। আলোমানুষদের নদী।
- এই সেরেছে।
- ফোকাস করুন। দেখতে পাবেন৷ ওই ভিড়ে হেঁটে এগোনো অসম্ভব। ভেসে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। তাই বলি, ও'টা রাস্তা নয়, নদী। আচ্ছা দীপকবাবু..। আপনি তো সংসারি মানুষ, একা একা পালিয়ে বেড়ান কেন মাঝেমধ্যে?
- এক্সকিউজ মী?
- মাসে একবার এ'দিকে আসেন৷ ঘুরঘুর করেন৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও মুখে প্রশান্তি নেই, হাঁটায় নিশ্চিন্দি নেই৷ সারাক্ষণ একটা ছটফট। ভালো আছেন?
- এই, আপনি আমায় ফলো করছেন নাকি?
- তা করি বটে৷
- কিন্তু আপনাকে আগে তো কোনওদিন দেখেছি বলে..।
- আজ দেখা দিলাম৷ তাই দেখছেন।
- আপনি কে বলুন তো?
- দীপকবাবু৷ সত্যিই চিনতে পারছেন না?
- আদৌ না..।
- চিনতে পারছেন না?
- এক কথা কতবার বলব! আমি আসি।
- কোথায় আর যাবেন দীপকবাবু। শুনুন..।
- কী চাই..।
- আমার দিনটা আজ বড় মন-কেমনের। আজ ফুলির বিয়ে৷
- ফুলি?
- ফুলি। ফুলির বিয়ে৷ অথচ দেখুন, আমি বাড়িতে নেই৷ জামা মসজিদের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে নামতা পড়ছি। অথচ আজ আমার বাড়িতে থাকা উচিৎ ছিল..মা-মরা মেয়েটাকে আজ অন্তত আগলে রাখা উচিৎ ছিল..কিন্তু..সোমা চলে যাওয়ার পর থেকেই আমার যে কী হল, বাড়িতে আর মন বসে না..।
- শাটাপ! শাটাপ! ইউ ফ্রড..।
- আপনি চিৎকার করছেন কেন? আপনার চিৎকার তো কেউ শুনতে পাবে না৷ আপনি তো স্মৃতির ভাসমান একটু টুকরো মাত্র। এক অন্যধরণের শাহি টুকরা, এই রুখাশুখা বর্তমানে যার কোনও অস্তিত্বই নেই৷
- আপনি বদ্ধ উন্মাদ..।
- কে জানে। হতে পারি৷ তবে আমি নিজেকে জামা-বৈরাগী বলি, আপনি চাঁদনি বাউলও বলতে পারেন৷ এক পীরের আশীর্বাদে সময়ের ঢেউ পেরিয়ে পুরনো আমিকে খুঁজে বের করতে শিখেছি, তাঁর সঙ্গে গল্প জুড়তে শিখেছি৷ তার প্রমাণ এই আমাদের আলাপ-আলোচনা।
- আপনি চুপ করুন!
- শুধু একটাই কথা বলতে আপনাকে সময়ের এ'দিকটায় টেনে আনা দীপকবাবু; ভালোবাসার মানুষ বলতে তো ওই দু'টিই৷ ও'দের ছেড়ে একলা ঘুরে যতই শান্তি খুঁজুন, পাবেন কাঁচকলা। গেরস্থালির যে'টুকু যা হুড়মুড় তার বাইরে আপনার মুক্তি নেই৷ একদিন এ সিঁড়িতে এসে দাঁড়িয়ে একশো সাতাশির নামতা আপনাকে পড়তেই হবে৷ কিন্তু যে'কদিন হাতে আছে, তার এক মুহূর্তও নষ্ট হতে দেওয়া যবে না৷ ফুলি, সোমা বাড়িতে বসে আছে যে। স্রেফ ওই দু'টো মানুষই আপনার অপেক্ষায় বসে থাকে। বাকি সমস্তটা এলোমেলো৷
**
চোখে মুখে জলের ঝাপটা পড়তে চোখ মেলে তাকালেন দীপকবাবু৷ জামা মসজিদের সিঁড়ির ওপর তাঁকে ঘিরে তখন একটা ছোটখাটো জটলা৷ গত মিনিট দুয়েক তাঁর জ্ঞান ছিল না।
উঠে দাঁড়ানোর পর নামতা পড়া কোনও বিটকেল বৃদ্ধের খোঁজ করার দু:সাহস তাঁর ছিল না৷ এ'বার সোজা ট্যাক্সি ধরে বাড়ি, ফুলি আর সোমা অপেক্ষা করে বসে আছে৷ সামনের মাসে ওদের নিয়ে এসে একবার আল জওহরের মাংস-রুটি খাওয়াতেই হবে।
No comments:
Post a Comment