Thursday, November 21, 2024

ইশারা



বেড়লটা ইশারায় ডাকলো বলেই সমরবাবু সাইকেল দাঁড়িয়ে করিয়ে ফুটপাথ ধরে এগিয়ে গেলেন। ছিমছাম একটা কফিশপ, সেটার দরজার বাইরে সাদা রঙের বেড়ালটা বসেছিল। এর আগে কোনোদিনও বেড়ালের ইশারার মুখোমুখি হননি সমরবাবু। অতএব সামান্য নার্ভাস বোধ করছিলেন।

বেড়ালকে তো আর "আমায় ডাকছিলেন কি" মার্কা প্রশ্ন করা যায় না। তাই সামনে গিয়ে সামান্য ঝুঁকে ভুরু নাচাতে হলো। কী আশ্চর্য, ল্যাজের ইশারায় সে বেড়ালটা সমরবাবুকে কফিশপের ভিতরে যেতে বললে। এ'সব দামী কফি সমরবাবুর ধাতে সয় না, কিন্তু বেড়ালের এহেন ইন্সট্রাকশন উড়িয়ে দিতে মন সরল না। কফিশপের দরজা খুলে পিছন দিকে তাকিয়ে বেড়ালটার চোখের সামনে তর্জনী ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করার চেষ্টা করলেন যে সে কফিশপে ঢুকতে আগ্রহী কিনা। কিন্তু বেড়ালটা ততক্ষণে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে।

কফিশপে তেমন ভিড় নেই, কোণের একটা টেবিল দেখে বসলেন সমরবাবু। সবচেয়ে সস্তা কফির অর্ডার দিলেন, খিদে ছিল পেটে কিন্তু এখানে এত দাম দিয়ে কিছু নেওয়ার মানে হয় না। শৌখিন কফি শৌখিনতর কাপে এলো, খয়েরি কফির ওপর সাদা ফেনায় একটা হার্ট সাইন আঁকা। বেশ জমকালো ব্যাপার আর কী। তবে বেড়ালের ইশারা ব্যাপারটা দামী কফির চেয়েও জব্বর ব্যাপার, এই ভেবে কফিতে চুমুক দিলেন তিনি।

কফিটা তড়িঘড়িই শেষ করলেন সমরবাবু। বেড়ালটিকে আর একবার দেখা দরকার, ফের যদি ইশারায় কিছু বলে। বিল মিটিয়ে টেবিল ছেড়ে উঠে যখন কফিশপের দরজা খুললেন বেড়ালটা তখন দোকানের বাইরে রাখা চেয়ারের ওপর কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে। সাইকেলের দিকে এগিয়ে যেতে গিয়েও থমকালেন সমরবাবু। স্পষ্ট মনে আছে বেড়ালটার ল্যাজ বাদে গোটা গা ধবধবে সাদা ছিল। অথচ এখন দেখা যাচ্ছে পিঠের দিকে একটা পেল্লায় খয়েরী রঙের গোল ছোপ, আর তার ওপরে সাদা শৌখিন একটা হার্ট চিহ্ন।

আর তখুনি জিভে বিশ্রী কিছু একটা ঠেকলো। জিভে হাত দিয়ে দেখতেই দিতেই সে'টা আঙুলের ডগায় উঠে এলো। সে'টা চোখের কাছে আনতেই সমরবাবু বুঝলেন যে বিশ্রী জিনিসটা আদতে একগোছা সাদা লোম।

মৃণালবাবুর রিসার্চ

মৃণালবাবুর একটা রাগের ডায়েরি আছে। রাগের ডায়েরি মানে ভাববেন না যে তা'তে সঙ্গীতের ছিটেফোঁটাও আছে। ভদ্রলোক নিজেকে গবেষক বলে ভাবতে ভালোবাসেন, আর আজীবন তাঁর গবেষণার বিষয় হলো রাগ; মানুষের রাগ। কাউকে রাগতে দেখলেই সে রাগের বহিঃপ্রকাশ সম্বন্ধে নিজের অব্জার্ভেশন নোট করে রাখেন মৃণালবাবু।

সেই ফার্স্ট ইয়ারে শুরু। মৃণালবাবুর প্রেমের চিঠিটা দলা পাকিয়ে ফাঁকা ক্লাসরুমের জানালার বাইরে ছুঁড়ে ফেলেছিল নয়না। ছুঁড়ে না ফেললেই পারত; সামান্য "না" বললেই ল্যাঠা চুকে যেত। কিন্তু ওই দাঁতে দাঁত চেপে চিঠিটা দলা পাকানোর মধ্যে একটা তলপেটে-ঘুষি মারার সমান ব্যাপার আছে, জানালার বাইরে সে কাগজের দলাটা ছুঁড়ে ফেলার মধ্যে একটা ঠাস-চড় আছে। "না" বলে ফিরিয়ে দেওয়ার মধ্যে সাদামাটা তথ্যই আছে, আগুন নেই। অবশ্য নয়নার রাগের কারণটা আজও ঠিক ধরতে পারেননি মৃণালবাবু। সম্ভবত ওরকম একটা ন্যালাক্যাবলা ছেলের থেকে প্রেমের চিঠি পাওয়া ব্যাপারটা বেশ অপমানজনক ঠেকেছিল নয়নার, তাও ওর স্মার্ট জনা-তিন বন্ধুর সামনে।

মায়ের রাগ ভারী অদ্ভুত ছিল। যার ওপরেই রাগ হোক, সমস্ত গজগজ গিয়ে পড়তো বাবার ওপর। আর বাবার রাগ মানে স্রেফ চুপ করে যাওয়া। সেই শান্ত নির্বাক বাবার চেহারাটা ভাবলে আজও মৃণালবাবুর বুক কেঁপে ওঠে।মেজমামার রাগও বেশ মনে পড়ে মৃণালবাবুর, রেগে গেলেই মামা হাইস্পিডে পায়চারী শুরু করতেন। কারণে-অকারণে রেগে যেতেন, অতএব যখন তখন পায়চারী, কাজেই যদ্দিন বেঁচে ছিলেন বেশ ছিপছিপে ছিলেন। সহকর্মী সমরেশ রেগে গেলেই অফিস মাথায় তুলতো চিৎকার-চ্যাঁচামেচি করে। দু'একবার ফাইলপত্রও ছুঁড়ে ফেলেছে রাগের চোটে। কিন্তু কী অদ্ভুত ব্যাপার, উচ্চপদস্থ কারুর সামনে কখনও সমরেশের সেই বিটকেল রাগটা বেরিয়ে আসেনি। সমরেশ বলতো সে'টাই হলো প্রফেশনালিজম, মৃণালবাবুর মনে হত ধান্দাবাজি। অবশ্য ধান্দাবাজির ব্যাপাটা কখনও সমরেশকে জানানোর সাহস হয়নি, স্রেফ নোটবুকে টুকে রেখেছেন।

পথে-ঘাটে কত রাগী মানুষ দেখেন মৃণালবাবু। সামান্য খুচরো আদানপ্রদানের গোলমালে বাসযাত্রী কন্ডাক্টরকে খামোখা গাল পাড়লেন। উত্তরে কন্ডাক্টর পেঁদিয়ে বৃন্দাবন দেখানোর আশ্বাস দিলেন। মানুষের জিনিসপত্র কেনাকাটি বাড়ছে, বাড়ছে কাস্টোমার কেয়ারে ফোন করে ঘ্যানঘ্যান করার তাগিদ। কাস্টোমার কেয়ারে বসে থাকা সাতপাঁচের খবর না রাখা সামান্য মাইনের ছেলে-মেয়েরা খদ্দেরদের রাগ-ঘেন্না হজম করছেন গোটা দিন ধরে। মানুষের যে কত রকমের চাপ। প্রতিবেশী অমিয়বাবু যেমন; অফিসে পিষে যাওয়া বাপ বাড়ি ফিরে নিজের ছেলের গ্রামার ভুল ধরে ভাঙচুর শুরু করছেন। ছোটছেলে দেবব্রত স্রেফ একটা চাকরীর হিল্লে না জোটাতে পেরে দিনে বারো ঘণ্টা জিম করছে; মৃণালবাবু জানেন যে দেবু ঠিক শরীরের সাধনায় মত্ত নয়, স্রেফ নিজের রাগ আর বিরক্তিটাকে সামাল দিতে পারছে না।

এখন সন্ধে পৌনে সাতটা। দেবু যথারীতি জিমে গেছে। বড়ছেলে দেবাঞ্জন ব্যাঙ্গালোরে চাকরী করে। মৌমিতা নেই বছর পাঁচেক হলো। এ'বার চেয়ার ছেড়ে উঠে বাড়ির আলোগুলো জ্বালতে হবে, পাম্প চালাতে হবে, চা বসাতে হবে। রাগের ডায়েরিটা পাশের টেবিলে রেখে খানিকক্ষণের জন্য চোখ বুজলেন মৃণালবাবু। মৌমিতার রাগ আবার ভারী সুরেলা এবং ধারালো ছিলো; সে'টাকে রাগ না বলে গোঁসা বলা ভালো। বড়ছেলে সে রাগের ধাত পেয়েছে।

গত চল্লিশ বছরে এই রাগের ডায়েরিতে অন্তত আড়াই হাজার মানুষের রাগের অভিব্যক্তির কথা লেখা আছে। বলাই বাহুল্য প্রায় প্রতি বছর নতুন ডায়েরি কিনতে হয়েছে। অথচ নিজের রাগ নিয়ে কোনো কথা লেখা হয়নি। তবে রাগ ব্যাপারটা নিয়ে এতটাই তলিয়ে দেখেছেন এত বছর মৃণালবাবু যে আদতকারণটা তিনি জানেন। মাথার ভিতরের চেপে রাখা বিষাক্ত ফনাটা ফস্ করে উঠলো। এত বছর ধরে সময়ে-অসময়ে ডায়েরিতে খসখসিয়ে লিখে যাচ্ছেন। যার তার সামনে, যখন তখন। অথচ পরিবার-পরিজন বন্ধু-বান্ধব কেউই কখনও সামান্য আগ্রহও প্রকাশ করেনি মৃণালবাবুর ডায়েরি লেখা সম্বন্ধে। কী এত লিখে যান, কী বিষয়ে লিখে যান; কেউ কোনোদিনও জানতে চায়নি। মৃণালবাবু কি এতটাই ম্যাড়মেড়ে? এতটাই অনাগ্রহের বস্তু? এ'সব ভাবতেই মাথাটা দাউদাউ করে জ্বলতে শুরু করলো।

ঘরের সমস্ত আলো জ্বেলে, জলের পাম্প চালিয়ে, তারপর রান্নাঘরে ঢুকে চায়ের জল চাপালেন মৃণলবাবু। রাগের ডায়েরি থেকে খানিকটা তফাতে এসে স্বস্তি বোধ করলেন ভদ্রলোক। রাগ-বিশারদ হিসেবে তিনি জানেন যে সবচেয় উচ্চমার্গীয় রাগ হলো নিখাদ অভিমান, সবচেয়ে বিষাক্তও বটে। হাইক্লাস অভিমানে ভাষা ও অভিব্যক্তি অচল। অতএব এ পৃথিবীর সবচেয়ে পেল্লায় রাগ-জার্নাল শ্রেষ্ঠ রাগের উল্লেখ থাকবে না। এ অপূর্ণতা যতটা ট্র্যাজিক, ততটাই কাব্যিক।

মৃণালবাবু ঠিক করলেন আজ দেবুর জন্য স্পেশ্যাল পেঁয়াজি ভাজবেন।

মাদুলিস্ট



- সায়েন্টিস্ট!
- বলুন।
- এ আমি কী শুনছি!
- কী শুনেছেন সে'টা বিশদে না বললে আমার মতামত দিই কী করে ক্যাপ্টেন।
- তুমি নাকি এক্সিস্ট করো না?
- ওহ, এই কথা। তা কে বললে?
- ভোরের আলো। ঘুম ভাঙব ভাঙব করছে।
- ওহ, সেল্‌ফ রিয়ালাইজেশন।
- ব্যাপারটা কী, তুমি সত্যিই এক্সিস্ট করো না সাইন্টিস্ট?
- আপনার গলায় ঝোলানো মাদুলিটা কিন্তু এক্সিস্ট করে ক্যাপ্টেন। ঘুমের ঘোরেও ছুঁয়ে দেখতে পারেন।
- মাদুলিটা রিয়েল। অথচ তুমি ব্যাটাচ্ছেলে আমার ফিগমেন্ট অফ ইমাজিনেশন।
- ক্যাপ্টেন, গুরুদেবের দেওয়া মাদুলিটাই রিয়েল হয়ে রইল আপনার জীবনে। এ'টা একটা ট্র্যাজেডি বটে।
- অ্যাই এ'সব ফালতু কথা বলার কোনও মানে হয় না। রোজ ঘুমের মধ্যে এ'সব লজিকাল বকর-বকর আর সয় না।
- মাদুলিটা বাদ দিন ক্যাপ্টেন। ইউ আর বিগার দ্যান মাদুলি।
- এই, এই যে। সকালের রোদ্দুর মুখে এসে পড়ছে। এ'বার ঘুম ভাঙবে। তুমি কেটে পড়ো দেখি সাইন্টিস্ট। ঘুমের কোয়ালিটি ইমপ্যাক্ট করছে এইসব বকবক।
- আর মাদুলিটা?
- আরে গুরুদেব কি আর এমনি এমনি দিয়েছে ও জিনিস? বেস্পতিটার পোজিশনটা ঠিক নেই। তারপর আবার রবির মুভমেন্টটাও নাকি রিলায়েবল নয়। সঠিক সময়ে মাদুলির সঠিক ডোজ না পড়লে ঘরে অশান্তি বাড়বে, অফিসের প্রমোশন ফসকাবে, শেয়ারের টাকাগুলো জলে যাবে। স্পষ্ট দেখেছেন গুরুদেব।
- ক্যাপ্টেন, সংসারে অশান্তি বাড়ছে আপনি মন দিয়ে বাড়ির লোকজনের কথা শুনছেন না বলে। অফিসের প্রমোশন ফসকাচ্ছে কারণ আপনি কাজের প্ল্যানিংয়ে মন দিচ্ছে না। শেয়ারের টাকাগুলো জলে যাবে কারণ ও'টা সাট্টাবাজার নয়, সে'খানে রিসার্চ আর ধৈর্য দুইই দরকারি। চট করে টাকাটা তুলে পিপিএফ অ্যাকাউন্টে রেখে দিন, সে'খানেই আপনার স্বস্তি ও মুক্তি।
- ফের সেই এক ঘ্যানরঘ্যানর। আরে বাবা মাদুলির পাওয়ারকে আন্ডারএস্টিমেট করার কোনও মানে হয় না। আমার মেজশালা এই গুরুদেবের থেকেই মাদুলি নিয়ে ফুলকপির পাইকারি সাপ্লাইয়ের ব্যবসায় নেমে লাল হয়ে গেলো।
- সে লাল হয়েছে উদয়াস্ত খেটে।
- তুমি ভারি অ্যান্টি-মাদুলি সায়েন্টিস্ট। জাস্ট বিরক্তিকর!
- না, আমি প্রো-আপনি ক্যাপ্টেন। আমি আপনার দলে।
- যত বাজে কথা। তুমি আমার কল্পনা! আর এই যে আমার গলায় ঝুলছে এই মাদুলি; এ'টা কিন্তু এক্কেবারে রিয়েল ভায়া সায়েন্টিস্ট।
- আমায় সাইন্টিস্ট ডাকনামটা আপনারই দেওয়া, তাই না?
- স্বপ্নে আলাপ। স্বপ্নেই দেওয়া নাম।
- আপনার স্বপ্ন ফেলনা হতে যাবে কেন ক্যাপ্টেন? কত গুণী মানুষ আপনি, আর আমি সেই গুণী মানুষের বুকের সাহস ক্যাপ্টেন। আমি আপনার সাহস! আর ওই মাদুলিটা আপনার ভয়। ভেবে দেখুন, কোনটাকে রিয়েল বলে ধরে রাখতে চান।
- নাহ্‌। ভারি ইরিটেটিং তুমি সায়েন্টিস্ট। ভাবছি গুরুদেবের থেকে একটা বাড়তি টোটকা চাইতে হবে স্বপ্ন-লেস ঘুমের।
- টোটকাটা যদ্দিন না আপনার হাতে আসছে ক্যাপ্টেন, চেষ্টা আমায় চালিয়ে যেতে হবে। সায়েন্টিস্ট নাম দিয়েছেন, হাল ছাড়লে চলবে কেন?
- অ্যালার্মটা যে কখন বাজবে ছাই! যত্তসব গাজোয়ারি ব্যাপারস্যাপার!
( ছবিঃ জেমিনাই)

টিফিন



এইমাত্র আমার বাঁ কানের দু'ইঞ্চি দূর দিয়ে শাঁ করে একটা বুলেট বেরিয়ে গেলো। বয়েই গেছে তা'তে আমার। যুদ্ধে নেমে বাঁচা-মরা নিয়ে অত ভাবনা চিন্তা করতে নেই। মাথার ঘিলু আজ আছে কাল নেই, যে ঠ্যাঙ সকালে থাকবে সে'টা বিকেলে খসে পড়বে। অত ভাবলে বেঁচে থাকা মুশকিল, আর টপাৎ করে মরে গেলে তো ল্যাঠাই চুকে গেল।

চিরকাল ভাড়াটে সৈনিক ছিলাম না। এককালে দিব্যি অ্যাকাউন্টান্টের চাকরী করতাম। দুপুর একটা থেকে দেড়টা পর্যন্ত লাঞ্চ, আমি বলতাম টিফিন-টাইম। বছর সাতেক আগে দেশে যুদ্ধ-টুদ্ধ লাগলো, চাকরী গেল, ঘরবাড়ি গেল। শুধু এই সাধের টিফিন-টাইমটাকে ধরে রেখেছি। অন্যদিনের মত আজও আমি টিফিন-টাইম শেষ না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ করব না।

একটু গাল চুলকে নিয়ে পিঠের ক্যানভাস বাগটা নামিয়ে আনলাম সামনে। সে'টার মধ্যে একটা মারাত্মক দামী জিনিস আছে। স্টিলের তোবড়ানো একটা বড়সড় টিফিনবাক্স। বাক্সটা হাতে নিয়ে খানিকক্ষণ উলটেপালটে দেখলাম। এমন সময় হাত-কুড়ি দূরে একটা গ্রেনেড এসে পড়লো; দড়াম! বাঁ কানে গত দু'হপ্তা ধরে তালা লেগে আছে, সে'টা একদিক থেকে বাঁচোয়া; গ্রেনেডের শব্দের চোট শুধু ডান কানেই পড়লো। যাক গে। আসল ব্যাপার হলো এই টিফিন বাক্সটা।

টিফিনবাক্সের ঢাকনাটা সেঁটে বসে আছে অনেকদিন হলো। রোজকার মতই এখন আমার কসরত শুরু হবে সে ঢাকনা খোলার। মাথার ওপর দিয়ে খান ছয়েক বোমারু বিমান উড়ে গেল, তাদের উড়ে যাওয়ার সুরে দুলে দুলে হেই সামালো বলে টিফিনবাক্সের প্যাঁচে জোর লাগালাম। আজও খুললো না। অগত্যা ব্যাগ হাতড়ে দু'টুকরো শুকনো পাউরুটি বের করলাম। অগত্যা বলছি বটে, এই টিফিন বাক্স আমি গত তিন বছরে খুলতে পারিনি। প্রথম হপ্তা-দুই একটা পচা গন্ধ বেরিয়েছিল। সম্ভবত রুটি-সবজির। কী সবজি কে জানে। মিরুস্কিয়াকে যে জিজ্ঞেস করে জানবো যে সবজিটা কীসের ছিল তারও উপায় নেই। যে'দিন এ টিফিন সে আমার ব্যাগে গুঁজে দিয়েছিল, সে'দিন আমাদের বাড়িতে বোমা পড়ে।

আমি যে ভাঙা বাড়ির চাতালে বসে আছি, তার উল্টোদিকে বাড়ির তিনতলার ব্যালকনি থেকে ঝুপ করে একটা সৈনিকের লাশ সোজা পড়লো সামনের রাস্তার ওপর। বাইনোকুলারে চোখ রেখে দেখলাম দু'সেকেন্ড। ওঁর নাম ব্রুক্রসভ, আমার চেয়ে বছর সাতেকের ছোট। আলুর পাইকারি ব্যবসা ছেড়ে স্নাইপিং ধরতে হয়েছিল তাঁকে। সামান্য খারাপ লাগলো বটে, তবে টিফিন-টাইমে এ'সব ব্যাপারে বেশি মাথা না ঘামানোই ভালো। ফের পাউরুটিতে কামড় দিলাম। সামান্য বাসি, তবে বাসি পাউরুটির একটা দিব্যি স্বাদ আছে। এর সঙ্গে একটু মাংসের ঝোল পেলে জমে যেত। মাংস রাঁধত বটে মিরুস্কিয়া। অবশ্য শুধু মাংস কেন, শাকপাতা যাই রাঁধত মনে হত অমৃত। ওর হাতে সত্যিই জাদু ছিল। ওর শেষ রান্নাতেও কী তুকতাক ছিল কে জানে, আজ পর্যন্ত টিফিনটা খুলতেই দিল না। রোজ দুপুরের টিফিন-টাইমে চেষ্টা করি, সে ঢ্যাঁটা স্টিলের টিফিনবাক্স কিছুতেই খোলে না।

ধড়াম! আমার থেকে বড়জোর দেড় ফুট দূরে একটা বড় কংক্রিটের চাঁই পড়লো।

হাসলাম, যদ্দিন স্টিলের টিফিনের ঢাকনা খুলছে না, তদ্দিন এ যুদ্ধ আমায় স্পর্শ করতে পারবে না। মিরুস্কিয়া যে জাদুতে এই টিফিন সাজিয়ে গেছে, সেই জাদুই আমায় বাঁচিয়ে রাখবে। যে'দিন ঢাকনা খুলবে, সে'দিন মিরুস্কিয়ার সঙ্গে আবার দেখা, ফের তাকে টিফিন সাজাতে বসতে হবে যে।

(ছবিঃ জেমিনাই)

পড্‌

অনিন্দ্য দিব্যি রোব্বারের মেজাজে সোফায় বসেছিলেন। সামনের দেওয়ালের মিউট রাখা টিভিতে এক আধুনিক গাইয়ে অত্যাধুনিক ভাবভঙ্গি করে গাইবার চেষ্টা করছিলন। সেন্টার টেবিলের ওপর রাখা প্লেটটা সাফ হয়ে গেছে, তবে লুচি-বেগুনভাজার এঁটো চিনতে অসুবিধে হয় না।

এমন সময় মোবাইলটা বেজে উঠলো।
-হ্যালো!
- অনিন্দ্যবাবু! কেমন আছেন?
- আপনি কে? আমি...আমি কোথায়..।
- হে হে। আমি অফিস অ্যালার্ম। আপনার ড্রিমপডের দশ মিনিট কোটা শেষ। এ'বারে যে কাজে ফিরতে হয়।
- ওহ। তাই তো। যাচ্চলে। লুচির গন্ধটা এখনও আঙুলের ডগায় যে।
- এই না হলে সুপার পাওয়ার ন্যাপ। এ'বারে চটপট টেবিল গিয়ে বর্গিন অ্যান্ড বার্ক্সের ফাইলটা প্রসেস করে ফেলুন। বস অপেক্ষা করছেন।

ইমোশনাল ম্যাচুরিটি কী?

মাছের সিংহভাগ শেষ পাতের জন্য ফেলে রেখে, থালার বেশিরভাগ ভাত মাছের অক্ষত টুকরোটির দিকে তাকিয়ে শুকনো ভাবে চিবিয়ে না যাওয়া।

পেট ভরে গেলে জিভের ধার কমে যায়।

খিদের চাড় থাকতে থাকতে ভাত-মাছের কম্বিনেশন সুন্দর মাপা পরিমাণে এবং সঠিক রেশিওতে মুখে চালান দেওয়াটাই ম্যাচুরিটি।

ওষুধ

বাঙালির জরুরী ওষুধের ফর্দ:

১। বোরোলিন।
২। জোয়ানের আরক।
৩। জেলুসিল।
৪। গাঁট্টা।
৫। গড়িয়ে নেওয়া।
৬। ভাতেভাত।
৭। একটু হাওয়া খাওয়া।
৮। জুতোপেটা।

মিউ



বাতাসে একটা মিঠে ভাব, চারদিকটা কী অপূর্ব ভাবে শান্ত। মনের মধ্যে আজ একটা অনাবিল স্বস্তি।
অরূপবাবু ঢুলছিলেন ভালো লাগায়, তৃপ্তিতে।

তিব্বতিবাবার থেকে নেওয়া মন্তরটা এদ্দিন পরখ করে দেখা হয়নি। গত বছর প্রভিডেন্ট ফান্ড ভাঙিয়ে কৈলাসযাত্রাটা দিব্যি হয়েছিল, সেখানেই সে বাবাজীর সঙ্গে আলাপ। মাস দেড়েক বাবার পদসেবাতেই কেটেছিল অরূপবাবুর। বৈদ্যবাটির মানুষ, অথচ ভক্তির গুণে তিব্বতি পাহাড়ের গুহার হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডাও সয়ে গেছিল অরূপবাবুর। ফেরার মুখে সে বাবাই এ মহামন্ত্র কানে দিয়েছিলেন। তিব্বতি ভাষায় মন্ত্রের নাম যহিদ্যেয্যাবশোস, সে মন্ত্রেই নাকি আদত মুক্তি। মুক্তির প্রসেসটা ঠিক কী'রকম সে'টা খোলসা করেননি বাবা। তাছাড়া আত্মোপলব্ধি ছাড়া মুক্তির মত হাইভোল্টেজ জিনিস আয়ত্ত করা সম্ভবও নয়। মুক্তি তো আর শর্টহ্যান্ডে ডিক্টেশন নেওয়া নয়।

সংসারের হ্যাপা অরূপবাবুকে সামলাতে হয়নি কোনোদিন। তবুও, তিব্বত থেকে ফেরার পর অফিস আর পাড়ার ক্লাব নিয়ে ফের মেতে ওঠায় মুক্তি ব্যাপারটায় সামান্য জল এসে মিশেছিল। তবে তিব্বতি বাবা পইপই করে বলে দিয়েছেন এ জিনিস নিয়ে তাড়াহুড়ো কিছুতেই নয়। মুক্তির ডাক যেদিন অন্তরে এসে টোকা মারবে, সেদিনই সেই মন্ত্রের প্রতি নিজেকে সঁপে দিতে হবে।

আজ সন্ধের দিকে হাঁটতে বেরিয়ে একটু নিরিবিলি এলাকা দেখে বসে পড়েছিলেন। আজকের সূর্যাস্তটা যেন খানিকটা অন্যরকম ঠেকলো; খানিকটা বিষণ্ণ, আর খানিকটা স্বস্তির। টের পেলেন অরূপবাবু; সময় এসেছি। তিব্বতিবাবাকে সতেরোবার পেন্নাম ঠুকে বাহাত্তরবার সে মহামন্ত্র আওড়ালেন। যাবতীয় কোলাহল স্তিমিত হয়ে এলো। একটা অসামান্য তন্দ্রায় ভেসে যাচ্ছিলেন অরূপবাবু। টের পাচ্ছিলেন মুক্তির রঙ পানসে গোলাপি। বুঝতে পারছিলেন আর পিছুটান রইল না।

এ'ভাবেই কেটে গেল ঘণ্টা দুই। অরূপবাবু চোখ মেলে দেখলেন তাঁর চারপাশটা অয়েলপেন্টিংয়ের মত মায়াবী। আড়মোড়া ভেঙে অরূপবাবু বলতে চাইলেন "বাহ্"। অথচ স্পষ্ট শুনলন যে তাঁর মুখ দিয়ে যে শব্দটা বেরোল সে'টা একটা সুস্পষ্ট এবং সুরেলা "মিউ"।

ই-ওয়ালেট



~~দিন ১~~

জেপ্টো: এই নে৷ একশো টাকা দিলাম। রেখে দে।
আমি: আরে না না৷ কী দরকার..।
জেপ্টো: আরে আমি দিলাম তো নাকি, রাখ না৷
আমি: আচ্ছা।
জেপ্টো: কত দিলাম বল দেখি..।
আমি: ওই যে, একশো।
জেপ্টো: সামলে রাখিস বাপ৷ কেমন? বাজারঘাটের যা অবস্থা, একশোটা টাকা নেহাৎ ফেলনা নয়..।

~~দিন ৬~~

জেপ্টো: হ্যাঁ রে, সে'দিন যে একশো টাকা দিলাম তোকে...৷
আমি: তাই তো৷ ও আছে ওয়ালেটে।
জেপ্টো: ওয়ালেটে থাকলে তো সে'টাকা ডিম পাড়বে না বাপধন৷ সেলিব্রেট কর৷ মোচ্ছব হোক।
আমি: একশোয় হবেটা কী..।
জেপ্টো: বড্ড বাতেলা দেখছি, একশো টাকা দিয়েছি এ'বার খরচ কর৷ ওড়া দুই হাতে৷ চটপট।
আমি: আহা, বেশ, হবে'খন।

~~দিন ১৭~~

জেপ্টো: এ কী, যাচ্ছিস কই থলে হাতে?
আমি: কেন? বাজারে!
জেপ্টো: ওয়েলেটে কড়কড়ে একশো টাকা ভুলে তুই বাজারে যাচ্ছিস রে রাস্কেল?
আমি: না মানে, অনেক কিছু কেনার আছে তো..।
জেপ্টো: উফ৷ জ্বালালে দেখছি৷ এই নে, আরও পঁচিশ টাকা দিলাম৷ আর ঘ্যানঘ্যান করিস না।
আমি: বাহ্‌। থ্যাঙ্কিউ।
জেপ্টো: এক মিনিট, একশো পঁচিশ ফেলে চললি কই? এই, অ্যাই, সাইকেল থামা..অ্যাই!

~~দিন ২২~~

জেপ্টো: এই শোন..।
আমি: কী ব্যাপার..।
জেপ্টো: আজ বিস্যুদ....।
আমি: বটে।
জেপ্টো: শনিবারের মধ্যে আমার দেওয়া টাকা খরচ না করলে কেটে নেব..। এক্কেবারে ঘ্যাচাং।
আমি: ওহ, তাই নাকি।
জেপ্টো: ভদ্রলোকের হুমকি৷ নড়নচড়ন হবে না।
আমি: বেশ।
জেপ্টো: কাজেই আর ত্যান্ডাইম্যান্ডাই নয়৷ ওয়েলেট থেকে একশো পঁচিশ বের করে অর্ডার।
আমি: বেশ।

~~দিন ২৩~~

জেপ্টো: কেটে দিলাম কিন্তু..এই কেটে দিলাম..।
আমি: ওহ হো।
জেপ্টো: রাত বারোটার পরেই দেখবি ট্রেজার হাওয়া।
আমি: অগত্যা৷ কী আর করি।
জেপ্টো: হাল ছাড়িস না। অর্ডার দে। বেসনের লাড্ডু আনা৷ দু'কিলো পেঁয়াজ আনা৷ অলআউট আনা, দ্যাখ চাদ্দিকে কত মশা।
আমি: ও দ্যাখা যাবে।

~~দিন ২৭~~

জেপ্টো: মন খারাপ লাগছে রে?
আমি: কেন? কী ব্যাপার?
জেপ্টো: ওই যে সে'দিন অতগুলো টাকা কেটে দিলাম। খারাপ পেলি?
আমি: ওহ, না না৷ ঠিক আছে তো।
জেপ্টো: ওই দ্যাখো৷ কী মারাত্মক অভিমান৷ আচ্ছা ঠিক আছে৷ ওয়ালেটে একবারটি দ্যাখ, দেড়শো টাকা রেখে এসেছি৷ তবে ইয়ে, আজকের মধ্যেই খরচ না করলে কিন্তু..এই..ও কী..আনইনস্টল করছিস কেন রে হতচ্ছাড়া..এই দাঁড়া..আমি কিন্তু ওয়ালেটে দু'শো রেখে দেবো এ'রকম করলে..এই..এই..যাহ্‌!

ভালোবাসার গান

ভালোবাসার গান৷

তা'তে ওই কথাটা ঠিক দাঁড়ায়নি।
ওই লিরিক্সটা বড্ড ন্যাকা ন্যাকা।
এমন ভাবে কেউ গায় নাকি।
ও'রকম গদগদ প্রেমের গান শুনলে গা জ্বলে।

কত গান আমরা নস্যাৎ করে দিই সে'গুলো আমাদের কানে যথেষ্ট "স্মার্ট" ঠেকে না বলে (আমিও করি)। অথচ গান ব্যাপারটা কী ভীষণ ব্যক্তিগত একটা ম্যাজিক, কোন সুর কোন অসতর্ক মুহূর্তে প্রফেট হয়ে পাশে এসে দাঁড়াবে তা কেউ আগে থেকে আঁচ করতে পারে না৷
"সেই তো আবার কাছে এলে" গানটার লিরিক্স নিয়ে বেশ কিছু ঠাট্টা শুনেছি৷ কখনও সে ঠাট্টায় হয়ত যোগও দিয়েছি৷ অথচ আজ সেই কথাটাই যখন এক প্রবাসীর তোলা হাওড়া ব্রীজের ফটোর ক্যাপশন হিসেবে দেখলাম, সে সুরটা বুকের ভিতর মোচড় দিল৷ গান, গানের ম্যাজিক, আর সে ম্যাজিক আবিষ্কার করা; বড়ই ব্যক্তিগত একটা প্রসেস।

মধু মিত্র



মধু মিত্র সিগারেট খান না ক্যানসারের ভয়ে।
পান খান না দাঁত নষ্ট হওয়ার ভয়ে।
আর লজেন্স খান না ব্লাড-শুগারের ভয়ে।

অতএব কী অছিলায় পান-দোকানে গিয়ে গল্প জুড়বেন সে'টা ঠাহর করতে পারছিলেন না। এ'খানে স্বাভাবিক ভাবেই আপনি জিজ্ঞেস করতে পারেন পান-বিড়ি এড়িয়ে চলা মানুষের দরকারটা কী পান দোকানে যাওয়ার। সে'টা আগে বুঝিয়ে বলি। মধু মিত্রকে ঠিক যুবক বলা চলে না, নয় নয় করে বয়স ছত্রিশ পেরিয়েছে। কিন্তু চেহারা দেখে যদি আপনি বেয়াল্লিশ-চুয়াল্লিশ বলে ভুল করেন তা'হলেও আপনাকে দোষ দেওয়া সম্ভব নয়। একটা প্রাইভেট ফার্মে ছোটখাটো চাকরী করেন। অনেক চেষ্টা করেও বিয়েটা করে উঠতে পারেননি, কাজেই একাই থাকেন। হাতে অঢেল পয়সা না থাক, মায়ের রেখা যাওয়া পেল্লায় এক বাক্স গয়না আছে; সে'টা বেচে নিশ্চিন্তে একটা ব্যাচেলর জীবন ফুর্তিতে কাটিয়ে দেওয়া যায়। অবসর সময়ে বই কেনেন আর মোবাইলে রিল দেখেন। সম্প্রতি একটা নতুন বাড়ি ভাড়া নিয়ে এ পাড়ায় এসে উঠেছেন। দিব্যি ছিমছাম ফ্ল্যাট, মারাত্মক সুন্দর একটা ব্যালকনি আর ইয়াব্বড় একটা ড্রয়িং রুম। আর আছে একটা পেত্নী, শর্মিলা নামে। শর্মিলা সদালাপী, প্রাণোচ্ছল। প্রথম আলাপের পর মনে মনে শর্মিলা সম্বন্ধে প্রাণোচ্ছল বিশেষণটা ব্যবহার করেই অবশ্য জিভ কেটেছিলেন মধু মিত্র। ভালো শোনায় না, আহা রে, শর্মিলা নিষ্প্রাণ না হতে পারে; তাই বলে জ্যান্তও তো নয়। শর্মিলা অল্প সময়ের মধ্যেই তাকে দাদা বানিয়ে ফেললে, এমন সরল-সিধে মেয়ে। আগামীকাল ভাইফোঁটা, তাই রান্নাঘরের ময়লার ডিবের থেকে মাছের আঁশগুলো পরিষ্কার করেনি মধু। এমনিতে তার শুচিবাই সাংঘাতিক, অপরিচ্ছন্নতা সে সহ্য করতে পারে না। কিন্তু ওই আঁশের গন্ধটা শর্মিলার ভারি পছন্দ। মেয়েটার জন্য একদিন এ জিনিস বরদাস্ত করাই যায়, রান্নাঘর ব্যবহার না করলেই হলো।

শর্মিলার প্রতি একটা কৃতজ্ঞতা বোধও আছে মধু মিত্রের। ও ছিল বলেই এত সুন্দর ফ্ল্যাটটা প্রায় জলের দরে ভাড়া পেয়ে গেল সে। তা'ছাড়া শনিবার দুপুরে ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে শর্মিলার গালগল্প শুনতে বেশ লাগে। সে আত্মহত্যা করেছিল আজ থেকে বছর কুড়ি আগে, তখন তার বয়স ছিল একুশ। সে অর্থে সে মধু মিত্রর চেয়ে বয়সে বড়। অথচ মারা যাওয়ার পর থেকে শর্মিলার বয়স বাড়ছে না; সে'দিক থেকে তাকে কচি খুকিও বলা চলে। শর্মিলা ছোট বোনের মতই আবদারের সুরে কথা বলে, দিব্যি লাগে মধু মিত্রের। বিশেষত ছুটির দুপুর মানেই শর্মিলা আড্ডার আসর জমাবেই। মধু মিত্র নিজে বিশেষ গল্প বলতে পারে না, তবে তাঁর মত ভালো শ্রোতা খুব কমই আছে। সে জন্যই হয়তো শর্মিলার তাঁর এই নতুন দাদাটিকে এত পছন্দ হয়েছে। সেই স্নেহের জোরেই আজ দুপুরে শর্মিলা মধু মিত্রকে নিজের এক টুকরো দুঃখ জানালে। নির্মলের প্রেমে পড়েছিল সে ক্লাস নাইন থেকে। কিন্তু নির্মল পড়াশোনায় তেমন সুবিধের ছিল না, ডানপিটে হিসেবে পাড়ায় তার সবিশেষ বদনামও ছিল। অথচ শর্মিলা ছিন শান্ত মিষ্টি স্বভাবের মেয়ে। পড়াশোনাতেও ব্রিলিয়ান্ট। মাধ্যমিকে থার্ড হলে, উচ্চমাধ্যমিকে ফিফথ। ফিজিক্স নিয়ে রিসার্চ করার খুব ইচ্ছে ছিল, সেই মত পড়াশোনাও শুরু করেছিল। ও'দিকে নির্মল তদ্দিনে পড়াশোনা শিকেয় তুলে বাবার দেওয়া পানের দোকানে গ্যাঁট হয়ে বসেছে। কিন্তু প্রেম ব্যাপারটা শর্মিলাকে বেশ কাবু করে এনেছিল। তার খুব ইচ্ছে ছিল নাকি নির্মলের দুর্দশা ঘোচানোর, এমন একটা কিছু করার যাতে নির্মল পান দোকান ছেড়ে একটা বড়সড় ব্যবসা ফেঁদে বসতে পারে। সে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতো নির্মলকে। কিন্তু ব্যাপারটা জানাজানি হওয়ায় গোলমেলে অবস্থা হয়, বাবা শর্মিলার গায়ে হাত তোলেন। সে দুঃখ কাটিয়ে উঠতে পারেনি শর্মিলা। সে গল্প শুনতে শুনতে মধু মিত্রের চোখে জল এসে গেছিল।

"এই যে তুই আমার সঙ্গে এত মিষ্টি ভাবে আলাপ জমালি শর্মিলা, তুই নির্মলের সঙ্গে রোজ কথা বলিস না কেন"?

"তুমি খানিকটা খ্যাপাটে, আমারই মত। তাই ভূত-পেত্নীতে ঘাবড়ে যাও না। সবাই কি ছাই তাই"?

"কিন্তু নির্মল তোকে ভালোবাসতো তো, সে তো তোর সঙ্গে গল্প করতে পারলে খুব খুশিই হবে"।

"ভালোবাসার মানুষ চলে গেলে তার ফটোর দিকে তাকিয়ে চোখের জল ফেলতে হয়। তার ভূত দেখলে প্রেম-মহব্বত হাওয়া হয়ে যায়। হা হা হা হা হা হা"।

শর্মিলার খ্যানখ্যানে হাসি আর যুক্তি কোনোটাকেই পাত্তা দেননি মধু মিত্র। তিনি নিশ্চিত যে নির্মল যদি জানতে পারে শর্মিলা এখনও তার আশেপাশেই ঘুরঘুর করছে, সে নিশ্চয়ই গল্প করতে চাইবে। স্মৃতি রোমন্থন করতে চাইবে। ভাইফোঁটায় শর্মিলাকে ঠিক কী উপহার দেওয়া উচিৎ সে সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র সন্দেহ রইল না মধু মিত্রের। তাই খানিকক্ষণ পর, যখন দেখলেন নির্মলের পানের দোকানে অন্য কোনো খদ্দের নেই, তিনি "জয় মা" বলে এগিয়ে গেলেন।

***

চাটুজ্জেদের ফেলে যাওয়া ফ্ল্যাটের নতুন ভাড়াটে ভদ্রলোক যে ছিটগ্রস্ত সে সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ ছিল না নির্মলের। কিন্তু ভদ্রলোক এইমাত্র যা যা বলে গেল তা'তে তো মনে হয় সে বদ্ধ পাগল। কিন্তু নির্মলের তবু মাথাটা কেমন গুলিয়ে গেল, কেমন একটা অস্বস্তি চেপে ধরলো তাকে। শর্মিলা আর তার ছোটবেলার কথাগুলো এমন নিখুঁত ভাবে এই মধু মিত্র ভদ্রলোক জানলেন কী করে? এমন কী গঙ্গার ঘাটের বিকেলটার খবরও তাঁর অজানা নয়। নাহ, মনের অস্বস্তিটা কাটাতে ভদ্রলোকের বাড়িতে একবার ঢুঁ মারা দরকার। এত করে ভদ্রলোক বললেন যখন, আজ রাত্রেই যাওয়া যাক। যদি ফেরেববাজ কেউ হয়, তা'হলে তাঁকে একটু ধমক দিয়ে আসতে হবে। এই ভেবে দোকানটা সাত-তাড়াতাড়ি বন্ধ করে সামনের আধ-ভূতুড়ে অ্যাপার্টমেন্টের চার তলার তিন নম্বর ফ্ল্যাটের সামনে এসে দাঁড়ালেন নির্মল।

খটকা লাগলো, মধু মিত্রর ফ্ল্যাটের দরজাটা অর্ধেক খোলা। পাশের দু'টো ফ্ল্যাট নির্ঘাত ফাঁকা। এ'দিক ও'দিক তাকিয়ে দু'একবার হাঁক পড়লেন নির্মল; "মধুবাবু আছেন নাকি"? কোনো সাড়া নেই। কেন জানি না নির্মলের পেটের ভিতরটা কেমন গুড়গুড় করে উঠলো। দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলেন নির্মল। একটা টিউব জ্বলছে, আর ফ্যানে গলায় দড়ি দিয়ে যিনি ঝুলছেন তিনি আধঘণ্টা আগে নির্মলের পানের দোকানে দাঁড়িয়ে গল্প করে গেছেন। সামনের টি-টেবিলের ওপর একটা ঢাউস বার্মা কাঠের বাক্স। তার ওপর দু'টো ভাঁজ করা কাগজ। ওপরের কাগজটা হাতে নিয়ে টিউব-লাইটের আলোয় মেলে ধরলেন নির্মল;

"নির্মলদা,

এ'টা মধু মিত্রবাবুর হাতের লেখায় লেখা। আর কোনো উপায় না পেয়ে ভদ্রলোককে দিয়েই লিখিয়ে নিতে হলো। আশা করি তুমি বুঝবে।

তুমি ভালো আছো?
ভালো আছো না ছাই! আমি নেই, তুমিও ভালো নেই। সে আমি খুব জানি।

শোনো, অনেক হয়েছে, এ'বার ওই পান-দোকান তোমায় ছাড়তে হবে। এই কাঠের বাক্সে প্রচুর গয়না আছে। এ'গুলো বেচে তুমি একটা বড় কোনো ব্যবসা শুরু করো। আমার কত স্বপ্ন তোমায় নিয়ে নির্মলদা, কত বড় গলায় বাবাকে বলে গেছিলাম জানো, "তুমি দেখো বাবা, নির্মল চিরকাল ওই পান-দোকানে আটকে থাকবে না"। আমার কথা ফেলতে পারবে না তুমি, বলে রাখলাম। এই চিঠিটা তুমি ছিঁড়ে ফেলো, পারলে গিলে ফেলো। পাশাপাশি আর একটা চিঠি রেখে গেলাম; মধুবাবুকে দিয়েই লেখানো। ও'টাকে রেখে যেও। পুলিশ পড়বে মধু মিত্রর সুইসাইড নোট।

তোমায় ভালোবাসি নির্মলদা, কেমন? ভালো না বেসে আমার যে কোথাও যাওয়ার নেই।

আমার কত স্বপ্ন তোমায় নিয়ে, সে'গুলো পূরণ না হলে আমি কোথায় যাই বলতে পারো!

ইতি তোমার শর্মি"।

(ছবি: জেমিনাই)

প্রফেট

- কী…আমাদের এ'খানে নতুন মনে হচ্ছে!
- হ্যাঁ মানে, এই প্রথম এ’খানে এলাম কি না…।
- বেশ তো বেশ তো।
- আপনি কি এখানকার ম্যানেজার?
- ম্যা…ম্যানেজার? হা হা হা হা। এ’টা তো উপাসনালয়। আমি এ উপাসনালয়ের এক কোণে থেকে ভজন-সাধন করি, এই আর কী। ম্যানেজ করা কী আমার কম্ম হে। তিনি রেখেছেন, তাই আছি। যে'দিন বলবেন "এসো", নাচতে নাচতে বেরিয়ে যাবো।
- নাচতে নাচতে বেরোনোটা ভালো দেখাবে কি? আর কে আপনাকে বের করবে? ট্রাস্টিদের কথা বলছেন নাকি?
- হে হে, তুমি ভারি সরল দেখছি। তা ভালোই হলো এ'দিকে এসেছো। এ'খানে তোমার ভালো লাগবে। তা, তুমি কোন মতে বিশ্বাসী?
- আজ্ঞে?
- বলি কোন মতে উপাসনা করতে চেয়ে এ উপাসনালয়ে আসা হয়েছে? চিন্তা কোরো না। মন খুলে বলো। ধর্ম যাই হোক, মতাদর্শ যাই হোক, মুক্তির পদ্ধতিতে তো কোনও তফাৎ নেই।
- ইয়ে মানে, বাইরে এমন ঝপ করে বৃষ্টি নামলে, ছাতাটা আজ আবার অফিসে ফেলে বেরিয়েছি। কী বিপদ বলুন দেখি। আপনাদের এই দরজা খোলা দেখে ঢুকে পড়লাম। আশা করি আপনার আর আপনার জুনিয়রদের সাধনায় কোনও ব্যাঘাত ঘটিয়ে ফেলিনি।
- এ'খানে কেউ তো কারুর জুনিয়র নয়। সবাই সাধক। সবাই প্রেমে মগ্ন।
- এই রে। আমার মধ্যে প্রেম ব্যাপারটা ঠিক লাগসই ভাবে ফ্লো করে না বুঝলেন...।
- সে চিন্তা তোমার নয়। হয়তো আমাদের এ'খানে পথ ভুলে এসেছ, কিন্তু সঠিক পথের খোঁজও এ'খানেই পাবে।
- বৃষ্টির তেজ বাড়লো দেখছি।
- তা এ'খানে এসেই যখন পড়েছ আর আটকা যেহেতু পড়ে গেছ, তখন বাকি সবার সঙ্গে বসেই পড়ো দেখি।
- কোনও গান-বাজনা হবে নাকি স্যার?
- না হে না। এ'খানে শুধুই সাধনা, উপাসনা। দ্যাখো, সবাই কেমন বই পড়ায় মগ্ন।
- হ্যাঁ, ঠিক যেন একদল ক্লাস সেভেনের ছেলে-মেয়ে নতুন পূজাবার্ষিকী হাতে পেয়েছে। খুবই ভালো লাগছে দেখতে।
- বাহ্‌, সুন্দর বলেছ তো ভায়া। তাই তো, সেই আগ্রহ নিয়ে একাগ্রচিত্তে বসে থাকাটাই তো সাধনা।
- নাহ্‌। এ কথাটা মশাই আপনিও খুব সুন্দর বলেছেন।
- হে হে। বেশ তো। ওই দ্যাখো ও'দিকের দেওয়ালের তাকে প্রচুর বই আছে। সবই সাধনার। গীতা, কথামৃত, উপনিষদ, কিছুই বাদ নেই। এমন কী কোরান, বাইবেলও পাবে। নিজের পছন্দ মত বই বেছে নিয়ে বসে পড়ো। যতক্ষণ বৃষ্টি ততক্ষণ না হয়ে আমাদের সঙ্গে উপাসনায় যোগ দিলে। আমাদের তা'তে খুব ভালো লাগবে।
- উত্তম প্রস্তাব। বোকার মত দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে আমিও উপাসনায় যোগ দিই।
- ভেরি গুড। ভেরি গুড। বই নিয়ে এসো তা'হলে একটা পছন্দমত।
- আমার কাছে আছে।
- আছে?
- বই। এই ব্যাকপ্যাকে। রিলিজিয়াস বিলীফের ব্যাপার তো। তাই সঙ্গে রাখি সবসময়। তাবিজের মত কাজ করে।
- কী বই?
- আবোলতাবোল।
- হেহ্‌। তাই হোক। যার যে'খানে ডুব দিয়ে তৃপ্তি। এসো, বসো।