সে'দিন বাড়ির পরিবেশ অগ্নিগর্ভ।
সুবিমল একথলে চুনোমাছ নিয়ে সদ্য বাজার থেকে ফিরেছে৷ বলাই বাহুল্য চুনোমাছগুলো বাজার থেকে না কাটিয়েই সে বাড়ি চলে এসেছে৷ ছুটির বাজারে কোনও মাছওলার অত সময় নেই যে আলাদা করে আধকিলো চুনোমাছ কেটে, ছাড়িয়ে, পরিষ্কার করে প্যাকেট করে দেবে৷ কাচুমাচু সুবিমল বাড়ি ফিরেই অবশ্য নিজেই রান্নাঘরের সিঙ্কে মাছের প্যাকেট উপুড় করে তা বাছতে বসেছে৷
লিপির মেজাজ সপ্তমে, সে'টা অকারণ নয়৷ আধকিলো মাছ কেটে ধুয়ে গামলায় রাখতে সুবিমলের বেলা কাবার হয়ে যাবে৷ রান্না চাপাতে চাপাতে বেলা গড়িয়ে বিকেল৷ সন্ধের চা আর দুপুরের ভাত একসঙ্গে খেতে হবে৷ পুরো দিনটাই জলে।
সুবিমলের এই এক রোগ, বড় ধীরেসুস্থে তার চলাফেরা৷ রোববার বাজারে তিনঘণ্টা ঘোরাঘুরি করে যৎসামান্য জিনিসপত্র নিয়ে বাড়ি ফেরা৷ দাড়ি কামাতে গিয়ে অন্তত চল্লিশ মিনিট ধরে গালে সাবান ঘষে আর গুনগুনিয়ে নচিকেতার গান গাওয়া৷ ক্রসওয়ার্ড পাজল সলভ করে অবলীলায় ছুটির বিকেলগুলো কাটিয়ে দেওয়া।
সুবিমলের এই গা-এলিয়ে চলা অভ্যাসের জন্য লিপিকে যে কতরকম হয়রানি সামলাতে হয়৷ সামান্য বাতাসা আনতে বেরিয়ে ঘণ্টা দুই ঘোরাঘুরি করে ফিরে এসে বলে, "যাহ্, ভুলে গেছি"৷ অফিস ফেরতা দু'জনের সিনেমা দেখতে যাওয়ার কথা। লিপি সিনেমা হলের সামনে বেমক্কা দাঁড়িয়ে রইল, অথচ সুবিমলের দেখা নেই আর তাঁর মোবাইল বেজে যাচ্ছে; ফোন ধরার নাম নেই৷ দুশ্চিন্তায় জেরবার হয়ে ঘণ্টাখানেক পর লিপি বাড়ি ফিরে গেলে৷ জানা গেল সুবিমল মোবাইল ফোন অফিসে ফেলে বেরিয়ে পড়েছিল। অত্যন্ত ভিড় দেখে পর পর বেশ কয়েকটা বাস ছেড়ে দিয়েছে।
সুবিমলকে মন দিয়ে মাছ বাছতে দেখে সে'সব কথাই বারবার মনে পড়ছিল লিপির। লিপি জানে এখুনি সুবিমল লিপির দিকে ঘুরে তাকিয়ে বোকা বোকা হাসির ঢাল বাগিয়ে বলবে, "একদম ফ্রেশ পেয়ে গেলাম, বুঝলে, টপ কোয়ালিটি৷ একেবারে হাইক্লাস৷ চট করে ভেজে নিচ্ছি, তারপর দু'জনে মিলে রসিয়ে রসিয়ে ঘি-ভাতের সঙ্গে খাব'খন৷ এখুনি রেডি হয়ে যাবে"৷
তারপরেই প্রবল ঝগড়া৷
সে বাড়ির ছাত উড়িয়ে দেওয়া ঝগড়া৷
আকাশ কালো করে আসা ঝগড়া৷
আগুনে ঘি ঝগড়া৷
সেই ঝগড়ার ঠিক আগের মুহূর্তে নিজের মোবাইলে সুবিমলের এই ফটোটা তুলেছিল লিপি৷ নীল-সাদা টিশার্ট আর পাজামা পড়ে কিচেন সিঙ্কের সামনে দাঁড়িয়ে সুবিমল। দ' হাতে চুনো মাছ কচলাচ্ছে, আর ঘাড় ঘুরিয়ে লিপির দিকে তাকিয়ে সে কী মারাত্মক বোকা-বোকা হাসির ফোয়ারা বইয়ে দিচ্ছে।
এত রাগ, এত ঝগড়া৷ তবু সে বোকাবোকা হাসিতে নির্ঘাৎ একটা গোলমেলে ব্যাপার ছিল৷ নয়ত ওই তেলেবেগুন অবস্থাতেও লিপি সুবিমলের ছবি তুলে রাখতে যাবে কেন? অত রাগবিরক্তির মধ্যে এই ছবিটা কেন তুলে রেখেছিল লিপি?
মোবাইলের স্ক্রিন বন্ধ করে খানিকক্ষণের জন্য চোখ বুঝলে লিপি৷ আজও, সুবিমলের সেই আলাভোলা হাসি যখনতখন দেখার জন্য তার মোটেও মোবাইল ফোনের দ্বারস্থ হতে হয় না৷
No comments:
Post a Comment