বাহাত্তর নম্বর "হ্যাপি নিউ ইয়ার" আদানপ্রদান পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। মদনবাবু একগাল হেসে ঘাড় দুলিয়ে সামান্য ঝুঁকে বিগলিত ভঙ্গীতে বলে উঠছিলেন, "হে-হে-হে-সে-হে-হে-ম টু-হু-হু-হু ই-উ-হু-হু"। রাস্তায় দেখা হওয়া পাড়ার এমএলএ-য়ের পেয়ারের মাস্তান হুব্বা দত্ত বা অফিসের বারান্দায় মুখোমুখি হওয়া বড়সাহেব চৌহানের মত কেউকেটা হলে দরদ দিয়ে জুড়ে দিয়েছেন, "উইশ ইউ আ ফ্যান্টাস্টিক ট্যুয়েন্টি ট্যুয়েন্টি ফৌর"। সবই জ্যামিতির হিসেবে চলছিল। ব্যালকনির ওপার থেকে রাহাবাবু, মর্নিংওয়াকে লাফিং ক্লাবের দস্যু সদস্যরা, কাটোয়া লোকালের ডেলিপ্যাঞ্জার ক্লাব, অফিসের ইয়ারদোস্ত; বাহাত্তরখানা নিউইয়ার শুভেচ্ছা বিনিময় দিব্যি ঘটেছে।
গোলমাল বাঁধল তিয়াত্তর নম্বর 'হ্যাপি নিউ ইয়ারে' এসে। রোজকার মত অফিস থেকে বেরিয়ে বাসস্ট্যান্ডের কাছে পিন্টুর পানের দোকানে দাঁড়িয়ে একটা খয়েরছাড়া সাদাপান দিতে বলে গোল্ডফ্লেক ধরিয়েছিলেন। খদ্দেরদের ভীড় কম থাকলে পিন্টুর সঙ্গে সামান্য গপ্পগুজব চলে যতক্ষণ না হাওড়ার মিনি আসছে। আজ যে কী হলো, পানটা খিলি করে এগিয়ে দিতে দিতে পিন্টু বলে বসলে, "আসুন মদনদা, হ্যাপ্পি নিউ ইয়ার"।
মদনবাবুর বলার কথা ছিল, "হ্যাপি নিউ ইয়ার টু ইউ টু পিন্টু"। কিন্তু মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, "পিন্টু, বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছে না জানো"!
খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিল পিন্টু, ভাব দেখালো যেন শুনতে পায়নি। কিন্তু এই তিয়াত্তর নম্বর 'হ্যাপি নিউ ইয়ারের' চাপে মদনবাবুর মাথাটা কেমন যেন একটু ঘেঁটে গেছিল।
- তুমি আদর করেই বলেছ হ্যাপি নিউ ইয়ার। সে'টা আমি বুঝেছি পিন্টু।
- হে হে...আপনি...।
- কিন্তু জানো পিন্টু, হ্যাপি-ট্যাপির বিশেষ কিছু নেই।
- অ। মনটন খারাপ নাকি মদনদা? শরীরটরীর?
- শরীর মজবুত আছে। কোলেস্টেরলের গ্যারেন্টি নেই অবশ্য। গতমাসে টেস্ট করিয়েছিলাম। ডাক্তার নস্কর বলে দিয়েছেন মটন খেয়ে ওঁর চেম্বারে ঢুকলে ঠ্যাঙ ভেঙে দেবেন। তবে এ'ছাড়া তেমন ইয়ে নেই। মনটা ততটা মজবুত হয়ত নেই জানো। অমন নড়বড়ে মন নিয়ে মিছিমিছি নিউ ইয়ার উইশ করে গেলাম বটে অনেকগুলো আজ। গুনে গুনে বাহাত্তরটা। কারুর ভালো চেয়ে উইশ করিনি জানো পিন্টু? কী বিষ লোক ভাবো আমি।
- ছি ছি মদনদা। অমনভাবে ভাবছেন কেন!
- এই তুমি...তুমি এত আদর করে রোজ পান খাওয়াও...তোমায় মিছিমিছি উইশ করতে ইচ্ছে হলো না।
- বেশ তো। আমায় না হয় মন থেকেই বলুন, হ্যাপ্পি নিউ ইয়ার। নিন, বলে দিন।
- সে'খানেই তো সমস্যা ভাইটি। নিজের মেজাজ এমন খিঁচড়ে থাকে, অন্যর জন্য মন থেকে ভালো কিছু চাইতে ইচ্ছে করে না।
- তা'হলে থাক না। ব্যস্ত হচ্ছেন কেন।
- পিন্টু, আমার বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করে না।
- আপনার বাড়িতে কে কে আছেন?
- ওহ। এদ্দিন পান খেলাম। এত গল্প করলাম; ক্রিকেট পলিটিক্স ইলিশের দাম কত কী। এ'সব বলা হয়নি। আমার বাড়িতে আমি আছি। আর আমার এক পিসেমশাই আমার সঙ্গে থাকেন। সম্ভবত নিজের পিসেমশাই নন। কী'ভাবে যেন লতায় পাতায় জড়িয়ে গেছি। তাঁরও কেউ নেই, আমারও...। কেউ না থাকাটাই আমাদের সম্পর্ক।
- বে-থা?
- এককালে একটা বিয়ে করেছিলাম। টেকেনি। আমারই দোষে জানো, ওই যে বললাম। মহাবিষ চীজ আমি। সে বেচারি পালিয়ে বেঁচেছে। সে যাওয়ার পর বছর দশেক ভাবলাম সব তারই দোষ, বদমাইস মেয়েমানুষ। তারপর টের পেলাম ম্যানুফ্যাকচারিং ডিফেক্ট আমার মধ্যে।
- ইয়ে, মদনদা...আপনার শরীর ভালো আছে তো?
- বিয়ের আসবাব সে কিছুই নিয়ে যায়নি। এমন ছ্যাঁকা খেয়ে সরে পড়েছে যে ও'সবের দাবী জানাতে আসারও সাহস পায়নি। সেই থেকে-যাওয়া আসবাবের মধ্যে একটা ঢাউস ড্রেসিং টেবিল আছে জানো। তার ইয়াব্বড় আয়না। ও'টায় আমি ভূতের ভয় পাই। আমার বাড়ি যেতে ইচ্ছে করে না যে।
- মদনদা। ও মদনদা। আপনি একটু দেরী করে বাড়ি ফিরলে পিসেমশাই চিন্তা করবে না তো?
- টেরই পাবে না। লতা এসে খাবার দিয়ে যাবে, তা'হলেই হবে। খিদের কষ্ট টের না পেলে তিনি আমায় চিনতে পারেন না। খোঁজও করেন না।
- আপনি একটু ওই বেঞ্চিতে বসবেন? আধঘণ্টা নেব, তার মধ্যে ঝাঁপ নামিয়ে আসছি।
- তুমি দোকান বন্ধ করে দেবে?
- বছরের পয়লা, বেশিরভাগ অফিসই তো বন্ধ। আমার বাড়ি মেচেদায়। এখানে একটা ছোট্ট ঘর ভাড়া করে থাকি। অবশ্য সে'টাকে গুমটি বললেও চলে। সে'খানে রোজ সন্ধ্যেবেলা তাসের আড্ডা বসে। রামি। আপনার চলে?
- রামি? চলে।
- চার নম্বর মক্কেল, স্ক্র্যাপের দালাল বল্টু সামন্ত দিনতিনেকের জন্য কলকাতার বাইরে। আপনি সঙ্গ দিলে আজকের সন্ধেটা জমে যাবে।
- ইয়ে, এ'সবের আবার কী দরকার..।
- রুটি, মুর্গির ঝোলে আপত্তি নেই তো মদনদা?
- দ্যাখো দেখি কাণ্ড, আমি উড়ে এসে তোমাদের ঘাড়ে উঠে বসলাম।
- মদনদা। স্বার্থ আমার। সস্তায় একটা সেকেন্ডহ্যান্ড ড্রেসিংটেবিল খুঁজছি অনেকদিন৷ একা মানুষ হলেও, টেরির শখটা বহাল আছে৷ হে হে।
- হ্যাপি নিউ ইয়ার ভাই পিন্টু৷ হ্যাপি নিউ ইয়ার টু ইউ।
No comments:
Post a Comment