ক্যাম্পের বাইরে স্টোভের ওপর ছোট্ট সসপ্যানে স্যুপ চাপানো হয়েছে৷ মিনিট পনেরোর মধ্যেই ডিনার রেডি হয়ে যাবে, সঙ্গে থাকবে শহর থেকে বয়ে আনা পাউরুটি৷ মন্টু মণ্ডল মন দিয়ে বসে জোনাকি গুনছিলেন৷ জঙ্গলি বাতাসে বেশ একটা মিঠে ভাব, গরমের অস্বস্তি একেবারেই নেই৷ খাবারদাবার সেরে তবেই তাঁবুর ভিতর ঢুকে লম্বা হবে, তেমনটাই ইচ্ছে৷
ঠিক সেই সময়ই আমি তাঁর সামনে ঝুপ করে নামলাম৷ আপনার ভাবছেন কোথা থেকে নামলাম৷ ভূতেরা এমনিই নামতে ওপরে, তেনাদের কোনো মাচা, ব্যালকনি বা গাছের ডালের দরকার হয় না৷ ঝুপ করে নেমে আসাটাই আমাদের বিশেষত্ব৷ বলাই বাহুল্য মন্টুবাবু আমার উপস্থিতি টের পাননি। জঙ্গলে এসে মানুষ জন্তুজানোয়ার, গাছপালা, পোকামাকড় নিয়ে এমন শশব্যস্ত হয়ে পড়ে যে ভূতটূত নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামায় না৷ ভদ্রলোক আদেখলার মত তখন থেকে জোনাকিদের দিকে তাকিয়ে আছেন৷ এ'সব নেচারলাভারদের দেখলে গা-পিত্তি জ্বলে যায়। অবশ্য আমার গা না পিত্তি কোনোটাই আর নেই, আছে শুধু ঝুপ করে নেমে আসা।
আপনার হয়ত ভাবছেন মন্টু মণ্ডলকে আমি কী'ভাবে চিনি। তা'হলে বলি, আমি সমর, মন্টু মণ্ডলের বাড়িতে বছর সাতেক রান্না করেছি৷ ব্যাচেলর শৌখিন মানুষ; খেতেন কম, কিন্তু সমঝদার। তাঁর সঙ্গে গপ্প করে আর তাঁকে খাইয়ে দেদার সুখ৷ আমার রান্নার কদর করতেন আর আমায় বড় স্নেহ করতেন। সে স্নেহের সুযোগ নিয়ে নিয়মিত তার পকেট থেকে টাকাপয়সা সরিয়েছি৷ শেষের দিকে ভদ্রলোকের শখের অ্যান্টিক সংগ্রহ থেকে ছোটখাটো মালপত্তর তোলা শুরু করেছিলাম, ও ব্যাপারে আমার বিশেষ জ্ঞানগম্যি ছিল৷ মন্টু মণ্ডল লোক ভালো, তার ওপরে বেজায় পয়সাওলা৷ ছোটখাটো হাতসাফাই বছরের পর বছর চালিয়ে গেলাম কিন্তু সে'সব তার নজরে পড়লো কই৷ শেষে যখন মোগল আমলের নীলাটা সরালাম, তখন আর ভদ্রলোকের চোখের ঠুলির ওপর ভরসা করতে পারিনি৷ তা'ছাড়া ও জিনিস বেচে আমার পকেটে অন্তত সোয়া লাখ টাকা আসত, মাস ছয়েক দিব্যি ফুর্তিতে কাটিয়ে দেওয়া যেত৷ তারপর দেখেশুনে আর এক পিস মন্টু মণ্ডল খুঁজে নিলেই হলো৷
কিন্তু কপালের ফের, মাঝরাত্তিরে মন্টুবাবুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে বড়জোর দু'দশ পা গেছি, একটা পেল্লায় ট্রাক এসে পিষে দিয়ে বেরিয়ে গেলো৷ সেই থেকে এ জঙ্গলে এসে আস্তানা গেঁড়েছি৷ দু'দিন ধরেই বাতাসে মন্টু মণ্ডলের গন্ধ পাচ্ছিলাম। সে গন্ধের টানে গতকাল থেকে হন্যে হয়ে ঘুরছি, কিছু একটা যেন আমায় টানছিল৷ এখন মন্টুবাবুকে দেখে বুঝছি এ টান কীসের৷ ভদ্রলোকের অনামিকার আঙটিতে উজ্জ্বল হয়ে বসে আছে সেই নীলাটা যে'টা নিয়ে আমি ফস্কে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলাম৷ ও'টার দিকে তাকিয়ে থেকেও তৃপ্তি৷ আহা৷
ভদ্রলোক এ'বার সসপ্যানের ঢাকনা সরাচ্ছেন, স্যুপ হয়ে এলো বোধ হয়।
ও'দিকে মন্টুবাবু ততক্ষণে পরিতৃপ্ত। তার জঙ্গল অভিযান সফল হতে চলেছে৷ দু'দিনেও সাড়া না পেয়ে হতাশ হতে শুরু করেছিলেন। সমর তাঁকে চিরকাল বোকা ঠাউরে গেল। একশো-দুশো টাকা নিয়মিত সরিয়ে আর দু'একটা পুরনো অ্যান্টিক সরিয়ে সে ভেবে বসলে যে তার মালিক কানা। এ'দিকে মালিকের যত টাকাপয়সা আর জমিদারি সবই যে ভূত তৈরি করে আর ডার্ক ওয়েবে ভূত বেচে; সে'টা যদি মূর্খ সমর বুঝতো। আর রাঁধুনি ভূতের যা দর, এই একটি বেচেই বছর পাঁচেক নিশ্চিন্দি৷ তদ্দিনে নতুন রাঁধুনি ব্যাটা তৈরি হয়ে যাবে জবাইয়ের জন্য৷
মিষ্টি হেসে সসপ্যানের ঢাকনাটা সরালেন মন্টু মণ্ডল৷ পাতি লোক বা খেলো ভূত কী করে বুঝবে যে এই সসপ্যান আদতে ঘোস্ট ক্যাচার?
(ছবি: জেমিনাই)