বারো বাই দশ ফুটের ঘর৷ আসবাবপত্র বলতে একটা দেওয়াল জোড়া কাঠের বুকশেল্ফ, তা'তে বইপত্র এমনভাবে ঠাসা যে বাড়তি আর একটা পত্রিকাও গুঁজে রাখা যাবে না বোধ হয়। একটা স্টাডি টেবিল, তা'র ওপরে আর এক প্রস্থ বইয়ের স্তুপ৷ সঙ্গে দু'চারটে ডায়েরি, একটা রাইটিং প্যাড আর একটা সস্তা কলমে ভর্তি বাহারে পেনস্ট্যান্ড। টেবিলের পাশেই একটা ভারিক্কি চেহারার চেয়ার৷ ঘরের অন্যদিকে ছোটখাটো একটা সোফা, তার সামনে লাগসই সেন্টার টেবিল৷ সেন্টারটেবিলের ওপরেও কিছু বই৷
বেশিরভাগ বইই পুরনো, সেই পুরনো বইয়ের দলা-পাকানো গন্ধটা নির্মল দাসের মন্দ লাগছিল না৷ নির্মলবাবুর বয়স সত্তর পেরিয়েছে, মাথার চুল আশি শতাংশ পাকা। কিন্তু দৃষ্টিশক্তি নড়বড়ে হয়নি আদৌ৷ তিনি খেয়াল করেছেন যে ঘরের সমস্ত বইই ফিকশন, সত্তর শতাংশ ইংরেজি৷ খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর সেই সোফায় গিয়ে বসলেন নির্মল।
মিনিট দশেকের মাথায় সুবিমলের ডাকে চিন্তার সুতো ছিঁড়লো নির্মলবাবুর।
"মিস্টার দাস"?
"নমস্কার সুবিমল", সোজা হয়ে বসলেন নির্মল৷
"ব্যস্ত হবেন না"৷ সেন্টার টেবিলের নীচেই একটা ছোট বসার টুল ফিট করা ছিল। সে'টা টেনে নিয়ে সোফার উলটো দিকে বসলেন সুবিমল।
"আপনি চা খেয়েছেন নির্মলবাবু"?
"আপনার হাউসহেল্প অফার করেছিল৷ কিন্তু চা-কফির পাট আমি অনেকদিন তুলে দিয়েছি, তাই..."।
" আপনি কি জানেন আপনাকে আমি কেন ডেকেছি"?
"সুমিত আপনার সেক্রেটারি ছিল৷ কাজেই সে সম্বন্ধে যদি কিছু.."।
"সুমিত আপনার ছেলে বলে বলছি না৷ ওর মত এফিশিয়েন্ট মানুষ আমি খুব কম দেখেছি৷ আর হি ওয়াজ লাইক মাই ওয়ার্কিং পার্টনার৷ আমি কোনোদিনই ওকে নিজের সেক্রেটারি হিসেবে দেখিনি। নির্মলবাবু, ওর এই অসময়ে মৃত্যুটা.."।
"একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি সুবিমল"?
" হ্যাঁ, প্লীজ। বলুন না"।
"আপনি নিজে লেখক৷ এতগুলো বেস্টসেলার আপনার। অথচ এই ঘরের এতগুলো বইয়ের মধ্যে আপনার লেখা কোনো বইই রাখা নেই৷ কেন"?
"এ'টা আমার ফর্ট্রেস অফ সলিচুড বলতে পারেন৷ চারদিকে আমার প্রিয় বই৷ নিজের লেখা বই আমি নিজে তেমন পড়িনা৷ সে'সব ওই বইয়ের দোকানের সাজানো শোকেসে দেখতেই ভালো লাগে"।
"হিউমিলিটি"।
"আমি সত্যিই নগন্য"।
"কী প্রয়োজনে আপনি ডেকেছিলেন যেন"?
"নির্মলবাবু৷ এই চেকটা আপনাকে দেওয়ার ছিল"।
"আর কেন। সুমির শ্রাদ্ধের সময়ও তো..এর আগেই তো আপনি অনেক দিয়েছেন৷ আই অ্যাম ভেরি গ্রেটফুল"।
"ও'রকম ভাবে বলবেন না৷ কতটুকুই বা দিয়েছি। এ'টাও সামান্যই৷ সুমিত ডিজার্ভড মাচ মোর"।
"শুধু এই চেক দিতে আপনি আমায় ডেকেছিলেন সুবিমল"?
"নির্মলবাবু৷ হয়ত একটা ব্যাপার আপনি জানেন না..সে'টা.."।
"সুমিত আপনার হয়ে গোস্ট-রাইট করত। বইগুলো আপনার নামে ছাপা হলেও সে'লেখাগুলো আপনার নয়"।
" ওহ। সুমিত কথাগুলো আপনাকে বলেছে? আমরা কিন্তু রীতিমতো একটা কনফিডেনশিয়ালিটি এগ্রিমেন্ট সই করেছিলাম। সুমিত এ ব্যাপারটা যদি আপনাকে জানিয়ে থাকে তা'হলে সে'টা মারাত্মক একটা ভায়োলেশন.."।
"সুমিত আমায় জানায়নি৷ কিছু মনে করবেন না সুবিমল, সুমিত মারা যাওয়ার পর আপনি যখন আমার বাড়িতে এলেন। আপনার চোখেমুখে আমি আতঙ্ক দেখেছি; স্বজন হারানোর দু:খ নয়৷ আর সুমিত যেহেতু সেক্রেটারি হয়েও ওয়ার্ক ফ্রম হোম বেশি করত আর সে কাজটার সিংহভাগ জুড়েই লেখালিখি; খানিকটা আন্দাজ আমি করেই ছিলাম৷ আমি সুমিতের বাবা আর শিক্ষক; দুইই৷ সুমিত সাহিত্যটা আমার কাছেই শিখেছে৷ ওর লেখার স্টাইল আমার জানা৷ আর আপনার বেস্টসেলার গুলো সমস্তই আমার পড়া৷ সুবিমল, অঙ্কটা বুঝতে আমার খুব অসুবিধে হয়নি"।
সুবিমল খানিকক্ষণ গুম হয়ে বসে রইলেন৷ বৃদ্ধ নির্মল অল্প সময়ের জন্য চোখ বুজলেন৷ সুমির চলে যাওয়াটা তাকে বড় ভেঙে দিয়ে গেছে৷ বাপ-ব্যাটার সংসার, সে'টাও টিকল না৷
"নির্মলবাবু। এ নিয়ে আপনি হইচই বাঁধিয়েও তেমন কিছু করতে পারবেন না৷ আর নিতান্তই যদি জলঘোলা করতে চান, ফল সুবিধের হবে না"।
"সুবিমল। সুমিতের কথার খেলাপ আমি করব না৷ এ বিষয়ে আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। তা'ছাড়া ভালো লিখে লেখক হওয়ার যুগ তো আর নেই৷ ফিনান্সিয়াল রিসোর্স, পিআর মাসল ইত্যাদি না থাকলে বেস্টসেলার বেরোবে কী করে। অতএব, আপনার সিক্রেট অক্ষত থাকবে, সে ব্যাপারে আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন৷ এর জন্য যদি কিছু সইসাবুদও করতে হয়..."।
"থ্যাঙ্কিউ নির্মলবাবু৷ আমার উকিল সামনের সপ্তাহে আপনার বাড়ি গিয়ে কাগজপত্রের ব্যাপারটা বুঝিয়ে আসবে৷ আর মাসে-মাসে এই চেক আপনার বাড়ি পৌঁছে যাবে। প্লীজ না বলবেন না"।
"হুম"।
"আর একটা বিষয়ে আপনার সঙ্গে কথা বলার ছিল৷ বলতে পারেন রিকুয়েস্ট"।
" বলুন"।
"আমার একটা নভেল প্রকাশককে আগামী হপ্তার মধ্যে দেওয়ার কথা৷ থ্রিলার। প্রকাশকের পীড়াপীড়িতেই ও জিনিসে হাত দেওয়া হয়েছিল৷ নয়ত আমি..মানে..সুমিত রোম্যান্টিক লেখাতেই স্বচ্ছন্দ ছিল। তবে থ্রিলার লেখার সুযোগ পেয়ে ও নিজেও বেশ এক্সাইটেড ছিল৷ আমার ধারণা লিখেও ফেলেছিল৷ হয়তো ওর বাড়ির কম্পিউটারে কোথাও...। কিন্তু আমায় মেল করার আগেই এই.."।
"ওর কম্পিউটারের পাসওয়ার্ড আমার জানা আছে৷ ও লেখা আমি খুঁজে আপনাকে পাঠিয়ে দেব"।
সুবিমল বিহ্বল হয়ে নির্মল দাসের হাত টেনে ধরলেন৷
"আমি যে কী বলে আপনাকে.."।
বৃদ্ধ নির্মল এই হঠাৎ-আবেগকে তেমন পাত্তা দিলেন না৷
বেরোবার মুখে সুবিমল ঢিপ করে একবার নির্মলকে প্রণাম করে নিয়ে বললেন, "নির্মলবাবু, সুমিত সত্যিই প্রতিভাবান লেখক ছিল। ব্রিলিয়ান্ট। বাবা হিসেবে আপনার গর্ব হওয়া উচিৎ"।
ফ্যাকাসে মুখে খানিকক্ষণ সুবিমলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন নির্মল দাস৷ কী বলবেন তিনি? জানিয়ে দেবেন যে সুমির কোনোদিনই ক্ষমতা ছিল না পাতে দেওয়ার মত কিছু লেখার? মা-মরা ছেলের বিদঘুটে সব শখ আর দ্যাখনাইয়ের যোগান দিতে বৃদ্ধ পিতাকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ছেলের হয়ে নিজের লেখাকে বিক্রি করতে হয়েছিল এক বেস্টসেলার ব্যবসায়ীর কাছে? অবশ্য সে বিক্রির টাকার এক কানাকড়িও কোনোদিন চোখে দেখননি তিনি৷ সুমিটা দিন দিন বড্ড নির্মম আর অর্থ পিশাচ হয়ে উঠেছিল। সুমি মারা যাওয়ায় ভেঙে পড়েছেন বৃদ্ধ পিতা৷ কিন্তু বুকপকেটের পেল্লায় চেকটা তার ভিতরের লেখক সত্ত্বাটাকে খানিকটা হলেও স্বস্তি দিল৷
"আসি" বলে বেরিয়ে পড়লেন নির্মল।
(ছবি: মেটা)
No comments:
Post a Comment