হাতঘড়ির ব্যাপারে আমার তেমন শখ-আহ্লাদ নেই। স্মৃতি কিছু আছে। ক্লাস এইট নাগাদ মা একটা টাইমেক্স ঘড়ি কিনে দিয়েছিল। তখন শুধু পরীক্ষার সময় ঘড়ি পরে যেতাম। কালচে সবুজ ব্যান্ড, ম্যাটম্যাটে হলদেটে ডায়াল। ডায়ালের একটা ছোট্ট খোপে তারিখ দেখা যায় - শুধু ১ থেকে ৩১য়ের মধ্যে একটা সংখ্যা; মাস বা বছর নয়। ও'টা যে আমার কী প্রিয় ছিল, পরীক্ষায় লিখতে লিখতে কতবার অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকেছি বাঁ হাতের কব্জির দিকে। সেকেন্ডের কাঁটা বারোরা ঘর পেরোলেই মিনিটের কাঁটায় যে সামান্য ঝাঁকুনি , সে'টা দেখে ভারি তৃপ্তি-বোধ হত। মাঝেমধ্যেই হাত থেকে খুলে রুমাল দিয়ে পুছে নিতাম। কলেজে যাওয়ার আগে উপহার পেয়েছিলাম একটা স্টিল ব্যান্ডের টাইটান ঘড়ি। ও'টায় বেশ একটা ভারিক্কি চাল ছিল। কবজিতে সে'টা আঁটসাঁট করে বাঁধা থাকতো না, সে'টাই সে স্টিল ব্যান্ডের ঘ্যাম। বছর পাঁচেক সে'টা নিয়েই দিব্যি কেটে গেছিল। এরপর বেটারহাফ একটা জবরদস্ত বিদেশী ঘড়ি দিয়েছিল, যে'টার বয়স এখন আমাদের বিয়ের থেকে মাস কয়েক বেশি। প্রমাণ সাইজের সাদা ডায়াল, সেকেন্ডের কাঁটা লাল, চামড়ার ব্যান্ড। সে ঘড়ি আমার সবচেয়ে শৌখিন সম্পত্তিগুলোর মধ্যে একটা। আজও ও'টা হাতে পরলে মনে হয় মনের মধ্যে একটু বাড়তি পালিশ যোগ হলো। ও ঘড়ি হাতে দিয়ে কোথাও দেরীতে ঢুকলে মনে হয় লজ্জায় মাথা কাটা গেল, সে ঘড়িই যেন আমায় ধমকে দেবে। অমন মখমলে জিনিস হাতে নিয়ে ব্যাকরণ ভুল করাও হয়ত ঠিক নয়, এমন তার রোয়াব। দেড়-দশক পরেও সে ঘড়ি দেমাক নিয়েই চলছে।
মাঝে বছর ছয়েক ঢুকে গেলাম ফিটনেস ট্র্যাকারে। ভালো-মন্দ নিয়ে বলার আমি কেউ নই। তবে ও জিনিসে আমার কিঞ্চিৎ উপকার হয়েছে বটে। দশ হাজার স্টেপ নিচ্ছি কিনা, যথেষ্ট ঘুমচ্ছি কিনা, হার্ট-রেট কেমন চলছে; এ'সব কতটা জরুরী কে তা বিশেষজ্ঞরাই বলবেন। তবে নিয়মিত ডেটার দিকে তাকানোয় যে'টা হয়, সচেতনতা খানিকটা হলেও বাড়ে। এ ক'বছরে হাঁটার ব্যাপারে একটা ডিসিপ্লিন আয়ত্ত করা গেছে। তা আমার ফিটনেস ট্র্যাকার সম্প্রতি খারাপ হয়ে গেল। অনেক চেষ্টা করেও সে'টাকে সারানো সম্ভব হলো না।
এরপর কী শখ উদয় হলো, একটা নতুন ঘড়ি কিনে বসলাম। একটা ডিজিটাল ঘড়ি, ফিটনেস ট্র্যাকার নয়। আচমকা মনে হলো হাঁটার অভ্যাসটা যখন দাঁড়িয়ে গেছে, তখন আর ফিটনেস ঘড়ির খুড়োর কলের কী দরকার (হয়ত এই ধারণাটা ক'দিন পরেই পালটে যাবে, কে জানে)। আরও মনে হলো, আমি কোনোদিন ডিজিটাল ঘড়ি পরিনি। সেই ছেলেবেলায় যেমন দেখতাম, পাড়ার দাদাদের হাতে; ক্যাসিওর ডিজিটাল ঘড়ি। তা'তে অ্যালার্ম দেওয়া যায়, অন্ধকারে একটা সুইচ টিপে ডায়ালে আলো ফেলা যায়। আর ও জিনিসের এমনই চাল যেন তা পরে অবলীলায় স্পেসশিপে ঢুকে পায়চারি করা যায়। নিজের হাতের টাইমেক্স ঘড়িকে কতবার বিবর্ণ মনে হয়েছে সে'সব ডিজিটাল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে। যা হোক, সে শখ এইবারে পূরণ করাই যায়।
আমি কিনলাম ক্যাসিওর এফ-নাইনটি ওয়ান ডাব্লু। হাজার টাকা মত খরচ হলো। ১৯৮৯ সালে এ ঘড়ি প্রথম বাজারে ছেড়েছিল ক্যাসিও, আর এ জিনিস এখনও হট কচুরির মতই বিক্রি হচ্ছে। খোদ আমেরিকার ওয়ালমার্টে এ ঘড়ি নিয়মিত বিক্রি হচ্ছে, বাজারে আসার পঁয়ত্রিশ বছর পরেও। একসময় ওবামা এই ঘড়ি হাতে দিয়েছেন। আবার ইয়ে, একসময় ওসামাও এই ঘড়ি হাতে দিয়েছেন; এ ঘড়ির ব্যাপ্তি এতটাই। গত ছ'বছরে স্মার্টঘড়ি চার্জ করার একটা অভ্যাস তৈরি হয়ে গেছিল। ক্যাসিওর এই ঘড়ির ব্যাটারি নাকি বছর সাতেক চলবে। এ ব্যাপারটা ভেবে আমি মাঝেমধ্যেই হেসে উঠছি। নিজের হাসি তো নিজে সবসময় দেখা যায় না, তবে আমার ধারণা এ হাসি যথেষ্ট স্মিত। এ হাসি দেখলে বুদ্ধ আমায় পিঠ চাপড়ে দিতেন নির্ঘাত। সবচেয়ে বড় কথা, স্মার্টঘড়িতে হাজার ধরণের 'ফেসিলিটি' আছে, কিন্তু তা সবসময় চেখে দেখা হত না। অথচ এই ঘড়ির জটিল অ্যালার্ম দেওয়ার পদ্ধতিতে সড়গড় হয়ে মনে হচ্ছে কেল্লাফতে করে ফেলেছি। মাঝেমধ্যেই অ্যালার্ম সেট করছি। একটু পরে মিটিং আছে। লাগাও অ্যালার্ম। একটু পরে নেটফ্লিক্স দেখব। লাগাও অ্যালার্ম। একটু পরে ও'পাশ ফিরে শোব। লাগাও অ্যালার্ম। কিছুই ভালো লাগছে না, লাগাও অ্যালার্ম। মেজাজটা ফুরফুরে, লাগাও অ্যালার্ম। আর এ অ্যালার্ম বাজার সুমধুর পিকপিক, আহা, সঙ্গীত। আর সর্বোপরি প্রতি ঘণ্টায় একটা করে সুমিষ্ট পিক্, উফ্। কানে-প্রাণে যেন এক টুকরো স্নেহ হয়ে ঝরে পড়ে।
তা'ছাড়া এ ঘড়ি সত্যিই পালকের মত হালকা, হাতে তারকেশ্বরের সুতো বাঁধলেও তার ওজন এর চেয়ে বেশি মনে হবে। বৃষ্টিতে ভিজলে বা ঘড়ি হাতে শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে পড়লেও চিন্তা নেই। বাঘা ঘড়ি অথচ কোনও বাড়তি ঘ্যাম নেই। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এই ঘড়ির একটা বোতাম টিপলে একটা ফিকে হলুদ আলো জ্বলে ওঠে। সে আলো এতটাই ফিকে যে তা'তে ঘড়ির ছোট্ট স্ক্রিনের একটা কোণাও স্পষ্ট ভাবে জ্বলে ওঠে না। তবে যতবার সেই আলো জ্বালি (দিনে চোদ্দবার জ্বেলে দেখি), ততবার মনে হয়ে ছেলেবেলার পাড়ায় ফিরে গিয়ে চৌকস পাড়াতুতো-দাদাদের ডেকে দেখাই, "এই দ্যাখো দাদারা, তোমাদের মতই ডিজিটাল ঘড়ি আমার হাতে! এই দ্যাখো আলো জ্বেলেছি। এই দ্যাখো অ্যালার্ম দিয়েছি। দ্যাখো দ্যাখো"।
মোটের ওপর, এ ঘড়ির সংস্পর্শে এসে ক'দিন বড়ই তৃপ্তিতে রয়েছি।
No comments:
Post a Comment