ইতিহাস ব্যাপারটা তো শুধু রাজা-রাজড়া, নেতা-নেত্রী, যুদ্ধ-বিগ্রহ বা কেল্লা-প্রাসাদে আটকে রাখলে চলবে না৷ আমাদের মত আতিপাতি মানুষের আশেপাশেই কত জরুরী ইতিহাসের মলিকিউল ভাসছে; অথচ সে'গুলোর ওপর মাইক্রোস্কোপ ধরার কেউ নেই।
এই যেমন ধরুন এই ডিমের বড়ার কষানো ঝোলের রেসিপি। এ জিনিস রান্না করে বহু খাইয়ে-মানুষের মন জয় করেছে মা৷ আমরাও মাঝেমধ্যেই আবদার করি মায়ের কাছে, "আজ ওই ডিমের বড়ার ঝোলটা রাঁধবে মা প্লীজ"?
এই রেসিপিটা মা আয়ত্ত করেছে দিদার থেকে। দিদার চার ছেলেমেয়ে, মা সবার বড় আর মায়ের তিন ভাই৷ দাদু অল্প মাইনের স্কুল-মাস্টার, অতএব ছেলেবেলায় মায়েরা দেখেছে নিদারুণ অভাব-অনটনের সংসার। দাদু স্কুলের কাজে গোটাদিন পরিশ্রম করছেন, সন্ধেবেলা গুটিকয় টিউশনি। ও'দিকে সংসারের যাবতীয় কাজকর্মের দায় ঠেলে চারজন পিঠোপিঠি ছেলেমেয়েকে সামাল দেওয়ার দায় সমস্তই দিদার কাঁধে৷ অতএব দিদার কাছে সময় ও অর্থ; দু'টোরই বিস্তর অভাব ছিল।
এ অবস্থায় এই ডিমের বড়ার কষানো ঝোল ছিল দিদার হেঁসেলের তুরুপের তাস। তিনটে ডিম ভেঙে, আলুসেদ্ধর সঙ্গে মিশিয়ে মেখে যে পরিমাণ বড়া ভাজা যেত; তা দিয়ে অনায়াসে ছ'জনের একবেলার খাওয়া হয়ে যেত৷ পাতে আমিষও পড়লো, আবার কষানো ঝোলের স্বাদের চোটে অনায়াসে থালা-থালা ভাতও উড়িয়ে দেওয়া গেল৷ সবচেয়ে বড় কথা, মাছের ঝোলের তুলনায় এ ঝোল রাঁধতে-বাড়তে সময়ও অনেক কম লাগে৷
দিদা নেই৷ অভাব-সামাল দেওয়ার ফর্মুলা হিসেবে এই রেসিপির পরিচয়টা আমাদের চোখে এখন ফিকে হয়ে গেছে৷ এ'টা এখন আমাদের খাওয়ার টেবিলে মাঝেমধ্যে উঁকি মারে 'ডেলিকেসি' হিসেবে। কিন্তু এই পদটার সুবাস রীতিমত এক টুকরো ইতিহাস; সে'খানে মধ্যবিত্তের গ্রাসাচ্ছদনের জন্য সংগ্রাম আছে, ষাটের দশকের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির রেশ আছে। আর আছে আমার দিদা - আমার ঝাপসা ইতিহাস-বোধে যে মানুষটার গুরুত্ব কোনো দিগ্বিজয়ীর চেয়ে কম নয়৷
No comments:
Post a Comment