Tuesday, July 16, 2024

প্রমথনাথের রবীন্দ্রনাথ



সম্প্রতি একটা দুর্দান্ত গল্পের বই পড়ে শেষ করেছি৷ যেহেতু আমার লেখার হাত ছিয়ানব্বুইয়ের ইডেন সেমিফাইনালের পিচের মতই কাঁচা, সেহেতু আমায় গিমিকের আশ্রয় নিতে হয়৷ প্রথম লাইনে 'গল্পের বই'য়ের ব্যবহারটা তেমনই একটা গিমিক। পড়লাম প্রমথনাথ বিশীর "রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন"; এ বই আত্মজীবনীমূলক৷ রসেবসে সামান্য যাত্রাযোগ ইতিউতি হয়ে থাকলে সে দায় প্রমথনাথের, কিন্তু বইটা আগাগোড়া সত্যি ঘটনাক্রমেই বাঁধা৷ ঘটনার ব্যাপারে বিস্তৃতভাবে জানতে হলে মানুষ খবরের কাগজ পড়বে। বইয়ে আশ্রয় নেওয়া সমস্ত ঘটনাদের 'ট্রীটমেন্ট' অন্যরকম হতে হবে; সে'খানে ঘটনাপ্রবাহের সত্যিটুকুকে আগলে রেখে রসালো গল্প ফেঁদে বসাটা লেখকের একটা জরুরি দায়িত্ব৷ সে'দিক থেকে, প্রমথনাথ একজন মডেল লেখক।

এর আগে ওঁর লেখা মাইকেলের জীবনী পড়ে মুগ্ধ হয়েছি৷ এই বইখানা সে মুগ্ধতাকে অন্য পর্যায়ে নিয়ে গেছে৷ প্রমথনাথের ভাষা ও হিউমর সম্বন্ধে জ্ঞানগর্ভ কিছু বলতে গেলে আমি খামোখা লোক হাসাবো৷ শুধু এ'টুকুই স্বীকার করে নেওয়া; রবীন্দ্রনাথের মানবিক ও অতিমানবিক দিকগুলো খানিকটা অ্যাপ্রিশিয়েট করতে হলে এ'রকম উপাদেয় বই বোধ হয় খুব বেশি নেই।

সতেরো বছর শান্তিনিকেতনে থেকে পড়াশোনা করেছেন প্রমথনাথ। শান্তিনিকেতনের গোড়ার দিনগুলো স্বচক্ষে দেখেছেন, উপভোগ করেছেন৷ রবীন্দ্রনাথ আদর্শ শিক্ষা বলতে যে প্রসেসকে বুঝতেন, সেই প্রসেসের মধ্যে দিয়ে প্রমথনাথের চরিত্র ঘষামাজা হয়েছে৷ সে অর্থে, তাঁর কাছে রবীন্দ্রনাথ শুধু পেল্লায় একজন সাহিত্যিক নন, একজন মাস্টারমশাইও বটে৷ এই বইয়ে সেই মাস্টারমশাই রবীন্দ্রনাথের গল্প রয়েছে৷

আর রয়েছে শান্তিনিকেতনের শান্তিনিকেতন হয়ে ওঠার গল্প। একদিক থেকে সে'টাও রবীন্দ্রনাথেরই গল্প৷ রবীন্দ্রনাথ ভদ্রলোক যে কী 'খতরনাক', আর শান্তিনিকেতন যে কত বড় একটা বিপ্লব; সে কথা অনায়াসে লিখেছেন প্রমথনাথ৷ আর সে'সব তুলে ধরেছেন দুর্দান্ত সব গল্পের মাধ্যমে; সে'খানে মূলচরিত্র হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও উঠে এসেছেন অন্যান্য শিক্ষকরা, স্কুলের ছাত্ররা, অন্যান্য কর্মীরা, আর অতি অবশ্যই; বোলপুর৷

এই বইয়ের স্থান-কাল-পাত্র সমস্ত যদি কাল্পনিকও হত; তা'হলেও এ বই দর্শনের গভীরতা আর হিউমরের ধারে বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল রত্ন হয়ে টিকে রইত। বলাই বাহুল্য, এ বই সত্য-নির্ভর এবং একটি ঐতিহাসিক দলিল৷ নেহাত নিরুপায় পাঠকরা এ বই পড়তে পড়তে মাঝেমধ্যেই হে-হে করে উঠছে, তাই সমঝদার ক্রিটিকরা টুপি খুলে এই বইকে যোগ্য সেল্যুট জানাচ্ছেন না৷

বইয়ে কী আছে না আছে তা বলে দিলে মোটেও স্পয়লার দেওয়া হবে না৷ কিন্তু সে সম্বন্ধে আমি বিশেষ কিছু বলছি না কারণ যে বিষয়ে প্রমথনাথ কথা বলেছেন, আমার মত মোটাদাগের ব্লগার সে'গুলো কোট করতে গেলে প্রমথনাথের সাহিত্যবোধকে ছোট করা হবে৷

শুধু তিনটে কথা।

এক, এই বইতে দু'টো অধ্যায়ের উল্লেখ করছি৷ একটায় প্রমথনাথ শান্তিনিকেতনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ঋতু বৈচিত্রের কথা বলেছেন৷ প্রকৃতির সৌন্দর্য বর্ণনা জিনিসটা যে কী 'সিরিয়াস' একটা ব্যাপার আর সে'টা যথাযথ ভাবে করতে হলে সৌন্দর্যবোধ, ভাষার ওপর দখল আর আর ভাবনার গভীরতাকে যে কী পর্যায় টেনে নিয়ে যাওয়া দরকার; তার শ্রেষ্ঠ নমুনা বইয়ের এই অংশটা৷

দুই, প্রমথনাথ ছাত্রদের বাঘ শিকার নিয়ে একটা ফিচেল অধ্যায় লিখেছেন৷ অমন গুণী মানুষ যে কী নিশ্চিন্তে ফচকেমির জগতে বিচরণ করতে পারেন, সে'টা না পড়লে বিশ্বাস হয় না৷ ফচকেমি কথাটা বললাম ওই গিমিক অর্থে। আদতে হিউমরের ব্যাপারে প্রমথনাথের কলম ক্ষুরধার; আর সেই ক্ষুরে নিজেকে রক্তাক্ত করতেও তিনি পিছপা নন; সে'খানেই তাঁর ফচকেমি হয়ে ওঠে রবীন্দ্র-লেভেলের (এ'টাও গিমিক হলো। বোধ হয়)।

তিন, এক গুরুজনের সঙ্গে আমি মাঝেমধ্যেই এঁড়ে তর্ক জুড়ি 'রিগর' (Rigour) নিয়ে৷ তিনি বলেন "যাই করবি, তা'তে রিগর থাকবে৷ অলসভাবে কোনো কিছু করবি না, এমনকি আলসেমিও না"৷ আমি তার দাবী খণ্ডন করে বলি, "রিগর মন্দ না, কিন্তু কিছু ক্ষেত্র ও'সব রিগর-ডিসিপ্লিনের বালাই না রেখে স্রেফ গা এলিয়ে উপভোগ করাই ভালো"৷ সে গুরুজন মৃদুস্বরে বলেন, "না না; রিগর থাকলে ফুর্তির কোয়ালিটিও ইম্প্রুভ করবে"৷ আমি পাত্তা না দিয়ে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যাই৷ এ'দিকে প্রমথনাথের লেখা শান্তিনিকেতনের ছাত্রজীবনের গল্প পড়ে মনে হলো; রিগর ব্যাপারটা সত্যিই বড় দামী৷ রবীন্দ্রনাথের সেই 'ইস্কুলে'র মূল উদ্দেশ্যই বোধ হয় ছিল ছোট ছেলেমেয়েদের মধ্যে 'রিগর'য়ের প্রতি আনুগত্য ঢুকিয়ে দেওয়া। সিলেবাসের বাইরে যা কিছু, যা কিছু অদরকারী; সে'গুলোও যদি মনপ্রাণ দিয়ে আয়ত্ত করা যায়- তা'হলে সেই অ-সিলেবাসিও আর অদরকারী জিনিসপত্রেও অমরত্বের জেল্লা লাগে। বইটা পড়ে সামান্য মনখারাপই হল বটে; কোনো কিছুই মন দিয়ে করা হলো না।

No comments: