টাই-ঠাই আমি ছাই বাঁধতে পারি না। তার চেয়ে এই খালি গলাই ভালো। বছর পাঁচেক আগে নিউ মার্কেট থেকে কেনা দেড়-হাজার টাকার ব্লেজার, তখনও আমাদের বিয়ে হয়নি। এই কালো-সাদা চেক শার্টটা গত পুজোয় মিতুল দিয়েছিল। এমন কি এই কালচে-নীল ট্রাউজারটাও ওরই দেওয়া। গোটা আলমারি ঘেঁটে যা বুঝলাম, আমার যে ক’টা ভদ্রস্থ জামা-কাপড় তা সবই মিতুলের দেওয়া। আচমকা মনে একটা খটকা লাগলো; আরে! এ’বার পুজোয় কি মিতুল আমায় নতুন শার্ট প্যান্ট দেবে? নাকি ডিভোর্সের পর পুজোর জামা-কাপড়ও বন্ধ হয়ে যাবে? কে জানে।
ব্যাপারটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে করতে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ গাল চুলকে নিলাম। যা হোক, এ নিয়ে বেশি ভেবে লাভ নেই। ড্রেসিংটেবিল থেকে আফটার শেভ লোশনের শিশিটা তুলে নিয়ে হাতের তালুতে কয়েক ফোঁটা ঢেলে নিয়ে গালে হাত ঠেকাতেই মেজাজ ফুরফুরে হয়ে গেলো, এমন সুবাস; সুমিষ্ট অথচ গায়ে-পড়া নয়। শিশির গায়ে দামটা দেখলাম, বাপ রে। মিতুল যে কত বাজে খরচ করত, উফ্। এ’বার আমি নিশ্চিন্তে ফটকিরিতে ফিরে যাব। অবশ্য এ শিশিতে যে’টুকু আছে, তা দিয়ে আমার আগামী মাস-খানেক দিব্যি চলে যাবে। যা হোক, পৌনে আটটা বেজে গেছে। এ’বার চটপট বেরোতে হবে। এই ইন্টারভিউটায় এস্পারওস্পার না করলেই নয়। হাতে অবশ্য এখনও দশ মিনিট আছে। ততক্ষণে ব্রেকফাস্ট সেরে নেওয়া যায়। বাসি পাউরুটি টোস্ট করে নিলে তার বাসিত্ব চলে যায়, এ’টা একটা ভালো ব্যাপার।
**
সন্ধে পৌনে ছ’টা, মিতুল বোধ হয় এখনও অফিস থেকে বেরোয়নি। নির্ঘাত কোনও জরুরী মিটিংয়ে ব্যস্ত। নয়তো এতবার রিং হওয়ার পর নিশ্চয়ই রিসিভ করত। যাক গে, সে বেরিয়েই কল ব্যাক করবে। এখন একটু সেলিব্রেট করা দরকার। চাকরীটা শেষমেশ জুটেই গেল। উফ, তিন মাস বড্ড দুশ্চিন্তা গেছে। কপালের জোরে এ’বার বেতনটাও একটু বেড়ে গেল বটে। তবে চাকরী পাওয়া আর মাইনে পাওয়ার মধ্যে মাস-খানেকের তফাৎ রয়েছে, কাজেই পকেটের শোচনীয় অবস্থাটা এখনই পালটায়নি। এ অবস্থায় মনের মধ্যে যতই পুলক থাক, দামী রেস্টুরেন্ট বা বারে ঢুকে পড়ার কোনও মানে হয় না। তার চেয়ে বরং সস্তা মদ কিনে বাড়ি ফেরা যাক, সঙ্গে রুটি আর মুর্গি কষা। মিতুল নেই যখন তখন সস্তা মদের বোতল দেখে আঁতকে ওঠার কেউ নেই। একদিন থেকে উপকারই হল, মিতুলের রুচিকে তোল্লা দিতে গিয়ে বিস্তর বাজে খরচ করতে হত। এখন সে’সব চিন্তা নেই।
কিন্তু সামনের মাসে প্রথম মাইনে পেয়েই একটা পেল্লায় রেস্টুরেন্টে ঢুকে ইয়াব্বড় মেনু ঘেঁটে; কঠিন উচ্চারণের আগুনে তপ্ত কোনও পদ চেয়ে নেব। আর তার সঙ্গে দামি হুইস্কি। প্রথম মাইনে পেয়ে কি মিতুলকে একটা কিছু কিনে দেওয়া দরকার? শাড়ি বা দামী পারফিউম গোছের কিছু? নাকি ডিভোর্সের পর এ’সব গায়ে পড়া উপহারে মিতুল খানিকটা উত্ত্যক্ত বোধ করবে? নাহ্। এ’সব ভেবে পিছিয়ে গেলে চলবে না। শাড়িই একটা দেওয়া হবে’খন। বিশ্ববাংলা শোরুমের ওই ম্যাড়ম্যাড়ে অথচ মারাত্মক দামী সুতির শাড়িগুলো মিতুলের ভারী পছন্দ ছিল, সে’টাই একটা দিয়ে দেওয়া যাবে। টের পেলাম, একটা ধূর্ত হাসি নিজের মুখে আপনা থেকেই চলে এলো। সামনের মাসের শেষে মাইনে পেয়ে যদি মিতুলকে শাড়ি কিনে দিই, তা’হলে তার ক’দিন পরেই তো পুজো। চক্ষুলজ্জার খাতিরে কি তখন ও বাধ্য হবে না আমায় পুজোর জন্য একটা শার্ট-প্যান্ট কিনে দিতে? এ’সব ব্যাপারে ওর পছন্দগুলো কিন্তু সত্যিই ঘ্যাম, অথচ জামার রঙ পছন্দ করার কথা মনে এলেই আমার গায়ে জ্বর আসে। আর একবার যদি পুজোয় জামা-কাপড় দেওয়া শুরু হয়, তা’হলে সে’টা বছরে পর বছর চলতে বাধ্য। ওই ব্যাপারে তা’হলে আমার একটা বাৎসরিক হিল্লে হয় যায়।
**
পৌনে ন’টা পর্যন্ত যখন মিতুল কল ব্যাক করলো না, তখন অগত্যা মৃণালকে ফোন করলাম। এত বড় খবর, কাউনে জানাতে না পেরে পেট ফেটে যাচ্ছে।
- হ্যালো মৃণাল, একটা গুড নিউজ আছে।
- আবার বিয়ে-টিয়ে করিসনি তো?
- আরে ধুর। একটা চাকরী জুটিয়ে নিয়েছি।
- ভাই! খাওয়া!
মিনিট দশেক হাবিজাবি কত গল্প হল।
মৃণালের পর ফোন করলেম অভিষেককে। ঘুরে ফিরে সেই, “ভাই, খাওয়া”। তাকেও আশ্বস্ত করে আরও মিনিট পনেরো গালগল্প করলাম।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত সাড়ে ন’টা বাজলো। রুটি মাংসের প্যাকেটটা খুলতে ইচ্ছে করলো না, চালান হল ফ্রিজে (পরের দিন সকালে টের পেয়েছিলাম যে রুটিটা প্যাকেট থেকে বের করে ফ্রিজের বাইরে রাখতে হত)। দুধ-মুড়ি জিন্দাবাদ। ওল্ডমঙ্কের বোতলটা স্টিলের আলমারিতে ঢুকিয়ে রাখলাম, এখন আলমারিতে স্পেস অনেক – চাইলে সেখানে বইখাতাও রাখা যায়।
নিজের জামা-কাপড় নিজে পছন্দ করে কিনতে হবে ভেবে গা-হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। নাহ্, ডিভোর্স-পেপারে ফস করে সই করে দেওয়াটা ঠিক হয়নি, এই ধরণের জরুরী ব্যাপারগুলোর একটা মাইডিয়ার গোছের ফয়সালা কাগজে-কলমে ছকে রাখা উচিৎ ছিল। দেখি, সামনের মাসের শেষে দামী সুতির শাড়ি গছিয়ে কোনও কাজ হয় কিনা। নয়তো অন্য ফন্দি আঁটতে হবে।
No comments:
Post a Comment