- নবাদা তুমি...! তুমি? তুমি তুমি তুমি! এ'খানে...?
- বিব্রত করলাম না তো রে?
- আসলে এই ভরদুপুরে রাস্তার মাঝখানে ঝুপ করে উদয় হলাম কিনা!
- বেশ করেছ। আমার বুকের ভিতরটা যে কী ধড়ফড়িয়ে উঠলো।
- শোন না। তোর সঙ্গে কিছু কথা ছিল...।
- আমার বাড়ি এসো না। এ'খান থেকে হেঁটে বড় জোর মিনিট দশেক। পথে মেয়ের স্কুল পড়বে। ওকে তুলে নিয়ে চলে যাবো। যাবে আমার বাড়ি নবাদা? অবশ্য না বললে শুনছেই বা কে!
- পুরনো প্রেমিককে নিজের সংসারে ঢোকাবি? ওই সব গৃহদাহ টাইপ ক্যালামিটি না শুরু হয়ে যায়৷
- কী'সব যে তুমি যাতা বলো। ও তো সবই জানে। লুকোচুরির কিছুই নেই। তুমি এসো না। আর আজ ডিনার করে যেও। ও অফিস সেরে ফিরলে ভালো গল্প জমবে...। না খাইয়ে ছাড়বই না, বাব্বা! প্রায় বছর সাতেক পর দেখা!
- তুই এখনও সেই পাগলাটে রয়ে গেলি মিঠু।
- সে জন্যেই তুমি পালিয়ে বেঁচেছিলে, তাই না নবাদা?
- মিঠু! একটা খুব জরুরী কথা বলতে তোর কাছে ছুটে এসেছি। এদ্দিন পর এ'ভাবে কেন এলাম কে জানে। তবে আজ মনে হলো কথাটা তোর জানা দরকার!
- বেশ তো, বাড়ি গিয়ে না হয়...।
- আমার হাতে অত সময় নেই যে মিঠু। আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আমায় শহর ছাড়তে হবে।
- ও মা। সে কী কথা। আর নবাদা, তুমি এমন ফিসফিসিয়ে কথা বলছ কেন?
- ব্যাপারটা একটু জটিল৷ এই নিরিবিলি গলিটায় তোকে কেন ধরলাম জানিস? কারণ কোনো কফিশপও আমার জন্য ঠিক নিরাপদ নয়।
- তুমি কেমন ভাবে কী'সব বলছ আমি কিছুই বুঝতে পারছি না নবাদা! আমার কেমন গা ছমছম করছ। তোমার কি কিছু হয়েছে?
- কিছুই হয়নি। বরং বলতে পারিস, নিজের কেরিয়ারে অনেকটা এগিয়ে এসেছি। আর আজকের দিনটা বড্ড স্পেশ্যাল। একটু মনকেমনেরও। দেশটা ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না। তবে ডিউটি অবহেলা করলে চলবে কেন।
- কী যে বলছ! তুমি তো কোন একটা সফটয়্যার কোম্পানিতে চাকরী করতে।
- এই দ্যাখ। সেই আইটি কোম্পানির আইকার্ড এখনও গলায় ঝোলানো থাকে। তবে এ'টা দেখনাই।
- আমি বোকাসোকা মানুষ৷ আমার মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে। তুমি এ'ভাবে হঠাৎ আমার সঙ্গে দেখা করতে এলে কেন নবাদা! কী চাও তুমি!
- শুধু স্বীকার করতে এসেছি মিঠু।
- কী?
- আমি তোকে ঠকাইনি। বড় চাকরী পেয়ে মফস্বলের মেয়েকে প্রেমে ফাঁকি দিইনি। আমি শুধু নিরুপায় হয়ে...।
- ঠকাওনি? দুম করে ভ্যানিশ হয়ে গেলে। ফোন করলে ফোন ধরতে না। এতগুলো চিঠি, ইমেল কিছুরই জবাব দাওনি। এ'তেও বলবে ঠকাওনি?
- আমার হাতে সময় বড্ড কম। এ'খান থেকে খানিকটা দূরেই একটা হেলিপকপ্টার আমার জন্য ওয়েট করছে। সে'টা চড়ে একটা গোপন আস্তানা। সে'খান থেকে চার্টার্ড ফ্লাইটে...তা সে বাদ দে। মিঠু, আমার সফওয়্যারের চাকরীটা সাজানো ব্যাপার। বলতে পারিস, আমার ছদ্মবেশের একটা প্রপ। কলেজের সেকেন্ড ইয়ার থেকেই আমি স্পাই হিসেবে...।
- তুমি কী ? কী সব আবোলতাবোল বকে চলেছ নবাদা! পথ ছাড়ো, মেয়ের স্কুল ছুটি হওয়ার সময় হয়ে গেল, আমি এগোব।
- মিঠু প্লীজ। পাঁচটা মিনিট ঠাণ্ডা মাথায় আমার কথা শোন। আমি একজন স্পাই। সেই সেকেন্ড ইয়ার থেকেই। তবে মানুষটা খারাপ নই; আমাদের এজেন্সি দেশের হয়ে লড়ছে।
- এ'সব পাগলের প্রলাপ গায়ে পড়ে কেন শোনাতে এলে তুমিই জানো নবাদা! তুমি কলেজের সেকেন্ড ইয়ার থেকে স্পাইয়ের কাজ করছ এ'টা জানাতে এলে? এতবছর পর? আমাদের আলাপ আর প্রেম তো তোমার থার্ড ইয়ারে নবাদা। তখন আমি সবে কলেজে ঢুকেছি। এ'সব স্পাই-ছাই ব্যাপারস্যাপার থাকতে আমার সঙ্গে ঘুরঘুর করেছিলে কেন? এ'টা ঠকানো নয়? আমি সরল, বোকা, তাই আমায় বেছে নিলে? আমি তো ঠকিয়ে প্রেম করতে চাইনি?
- সে অপরাধ স্বীকার করতেই ছুটে এসেছি মিঠু। তোর কাছে আমি সত্যিই অপরাধী রে। আসলে, খুব দরকার ছিল আর পাঁচটা ছেলেমেয়ের মত সাধারণভাবে থাকা। কলেজ, টিউশনি, প্রেম; ও'গুলো সমস্তই ছদ্মবেশের অংশ। কিন্তু একটা সময়ের পর সম্পর্কে ইতি টানা ছাড়া আর আমার কাছে কোনো উপায় ছিল না! বিশ্বাস কর!
- ছিঃ! নবাদা, ছিঃ!
- যাস না মিঠু। শোন!
- হাত ছাড়ো নবাদা। এ'টা রাস্তা।
- কেউ নেই এই গলিতে। মিঠু, আর দু'মিনিট আমার কথা শোন। তোর পায়ে পড়ি। শোন। হয়ত শুরুর দিকে প্রেমটা ছদ্মবেশের অংশ ছিল। কিন্তু তোর থেকে দূরে সরে গিয়ে আমি টের পেয়েছিলাম মিঠু যে তোকে আমি সত্যিই ভালোবেসেছি। আজ আমার এই উদ্ভ্রান্তের মত তোর সঙ্গে এ'ভাবে দেখা করতে আসার কোনো মানে হয় না। প্রোটকলের মধ্যেও পড়ে না এ'ভাবে নিজের পরিচয় ফলাও করে জানানো। কিন্তু বিশ্বাস কর, দেশ ছাড়ার আগে তোকে কথাগুলো না বললে আমার দমবন্ধ হয়ে আসত।
- কী বলতে এসেছো? ঠকাতে চেয়েছিল কিন্তু তবুও একটু স্নেহ তৈরি হয়ে গেছিল? এ'টা বলতে এসেছো? বেশ। জেনে ধন্য হলাম। এ'বার এসো।
- জানিস মিঠু, প্রাণ হাতে করে ঘুরে বেরিয়েছি কতগুলো বছর। তুই আমার পাশে থাকলে তোর ক্ষতিই হত, বিশ্বাস কর্। এই যে এখন একটা সাজানো সংসার সামলাচ্ছিস, সে'টা পেতিস না। একটানা লাইফ রিস্কের মধ্যে দিয়ে...।
- কী এমন কাজ তোমার নবাদা? তুমি খালি লাইফ রিস্কের কথা কেন বলছ?
- গত বছর সাতেক ধরে আমি আর আমার টীম একটা গ্যাংকে ডিসম্যান্টেল করে গেছি। ওরা ডেটা মাফিয়া, ওদের রোখা না গেলে দেশের ইকনমি শেষ হয়ে যেত। আমাদের দলের অনেকগুলো ছেলের প্রাণ অকালে গেছে বটে তবে ওদের দলটাকে মোটামুটি সমূলে বিনাশ করা ফেলেছি, অলমোস্ট৷ বড্ড ডেঞ্জারাস ওরা, শুধু আমাদের দেশের জন্য নয়, গোটা পৃথিবীর জন্য। ওদের রিংমাস্টারের নাম ডেক্সটার। সে'টা যে কেউ হতে পারে। কলকাতার কোনও ট্যাক্সি চালক অথবা ইথিওপিয়ার কোনো চাষি বা অস্ট্রেলিয়ার কোনো বিয়ারের হোলসেল ব্যাবসা সামলানো বৃদ্ধ। এমন কি ডেস্কটার আদতে কোনো সফটওয়্যার প্রোগ্রাম না অনেকজনের একটা দল হলেও আশ্চর্য হব না। তবে ওদের অন্যান্য মেম্বাররা বেশিরভাগই মারা গেছে। আমার ওপরও যে কতবার অ্যাটাক হয়েছে মিঠু...।
- ও মা নবাদা! তুমি আমার বাড়িতে চলো। প্লীজ। কী'সব বলে যাচ্ছ তখন থেকে...তুমি সুস্থ নও।
- উপায় নেই রে। আমি শুধু একটা কথাই বলতে এসেছিলাম, পারলে আমায় ক্ষমা করিস। গত দু'হপ্তা ধরে তোর আশাপাশে ঘুরঘুর করেছি, যদি একটু আলাদা করে পাওয়া যায়। এদ্দিনে, যাওয়ার মুখে সুযোগ পেলাম। তোর বরকেও দেখেছি। ভারি হ্যান্ডসাম, দিলদরিয়া ভালো মানুষ। আর তোর মেয়েটা কী মিষ্টি। কী নাম যেন ওর?
- পিঙ্কি।
- বাহ্। তোরা ভালো থাকিস। আমি ইউরোপ চললাম।
- ইউরোপ?
- ডেক্সটার ব্যাটাচ্ছেলে এখন কোণোঠাসা হয়ে পড়েছে, একটা টিপ পেয়েছি ওর কারেন্ট লোকেশনের ব্যাপারে৷ তাই আর কী। এ'দেশে ওর দলের সবাইকেই প্রায় জবাই করেছি। তবু ওদের এজেন্টরা তো এ'দিক ও'দিক ছড়িয়ে আছেই। আর আমি ওদের টার্গেটে রয়েছি কারণ আমার শরীরের মধ্যেই ওদের দলের ব্যাপারে বহু জরুরী ডেটা সমেত কিছু চিপ লোকানো আছে; ডেক্সটার সাফ হলে এই চিপ গুলো দিয়েই ওদের...। বাদ দে এ'সব ছেঁদো কথা। মোদ্দা কথা হলো, আমি ওদের কারুর হাতে পড়লে কুকুরের মত খুন হব৷
- আমি তোমায় কিছুতেই একা ছাড়ব না নবাদা। কিছুতেই না৷
- তোকে অনেক গড়গড়িয়ে কিছু বলে গেলাম। কেন জানিস মিঠু? এই স্পাই হয়ে সব কথা চেপেচুপে রাখতে হয়। আমাদের বন্ধু নেই, পরিবার নেই। আর আমার তো বাপ-মাও সত্যিই নেই। হঠাৎ মনে হলো গোটা দুনিয়ায় একজন আছে অন্তত যে আমার গোপন কথাগুলো বুকে আঁকড়ে রাখবে। মাই সিক্রেটস আর সেফ উইথ ইউ মিঠু। অনলি ইউ। তাই ছুটে এলাম৷ কেউ তো জানুক আমার পরিচয়৷ তাই এত বাড়তি কথা বলা।
- আমার হাত ছেড়ো না এখনই নবাদা। আর একটু দাঁড়াও। আর একটু৷ প্লীজ।
- আমি তোকে ভালোবেসেছিলাম কিন্তু।
- আমিও।
- ধুর পাগলি। এই শোন, তোর মেয়ের স্কুল ছুটি হয়ে গেছে। এ'বার আয়। আমাকেও কেটে পড়তে হবে। কখন কে দেখে ফেলবে। ওই যে বললাম। লাইফ রিস্ক।
- নবাদা! ভালো থেকো, কেমন?
- থাকবই তো। তুইও ভালোভাবে থাকিস।
- নবাদা।
- মি...মিঠু!!
নবা মিত্তিরের মাথাটা ফাঁকা হয়ে এলো। শুকিয়ে এলো গলা। পায়ের নীচের মাটি দপদপ করে কাঁপতে শুরু করলা। নবার অবিন্যস্ত চুল বেয়ে নামা ঘামের বিন্দু এসে মিশল কপালে ঠেকানো পিস্তলের হিমশীতল নলে।
ট্রিগারে রাখা মিঠুর আঙুলে সামান্য কাঁপুনিও নেই তখন।
"ভালো আমিও বেসে ফেলেছিলাম নবাদা। তোমারই মত, কিছুদিন পরে। তবে ছদ্মবেশের দরকার আমারও ছিল। ইউ আর আ গুড স্পাই, এ'টা স্বীকার করতেই হবে৷ তোমায় এতদিন সন্দেহ করেও কোনো অকাট্য প্রমাণ পাইনি৷ কিন্তু আমি যে তোমার চেয়ে একটু হলেও এগিয়ে। কেন জানো? তোমার ওই পুরুষের মন এত বছরেও মানতে চাইল না যে ডেক্সটার একজন খুনে পুরুষ বা মারাত্মক কোনো সফটওয়্যার না হয়ে গেরস্ত সামলানো, বর-মেয়ে ফাইফরমাশ খাটা একজন নিম্ন মধ্যবিত্ত বাঙালি বউও হতে পারে। এত বড়মাপের তোমাদের অপারেশন; আমাদের দলটাকে তো তছনছ করেই দিলে। শুধু ডেক্সটারকে চিনতে পারলে না এতদিনেও। আর আজ, এ'ভাবে এসে ধরা দিলে। সন্দেহ নিরসন করেকনফেশনও দিলে। মিঠু নরম৷ মিঠু পাগলি৷ সবচেয়ে বড় কথা, মিঠু একজন সংসার ঠেলা মেয়ে। এই ছদ্মবেশ তোমার পুরুষচক্ষু দিয়ে ভেদ করা অসম্ভবই বটে৷ সরি নবাদা। ট্রিগার টানলেও, তোমায় দেখলেই যে বুকের মধ্যে ধড়ফড়; সে'টা কিন্তু মিথ্যে নয়। সত্যিই ভালোবেসেছি। তবে এখন এসো। আমার মেয়ে নিশ্চয়ই স্কুলের গেটের বাইরে অপেক্ষা করছে। এ'বার আমায় ছুটতে হবে"।
No comments:
Post a Comment