Tuesday, July 16, 2024

ঘুড়ি আর নাড়ু



সন্ধেনাগাদ, সরোজদার অঙ্ক কোচিং সেরে বাড়ি ফেরার সময় একটা নীল-সাদা ঘুড়ি কুড়িয়ে পেলো নাড়ু৷ স্কুলবাড়ির দক্ষিণ দিকের পাঁচিল লাগোয়া একটা জামরুল গাছের নীচে পড়েছিল।

ক্লাস এইটে পড়া নাড়ু ঘুড়ি ওড়াতে পারে না, সে বিষয়ে কোনও আগ্রহও নেই৷ ঘুড়িকে রীতিমতো অদরকারী বলে মনে করে সে৷ লাটাই, মাঞ্জা ইত্যাদি ব্যাপার তার ধাতে সয় না৷ এ'সবের চেয়ে ক্যাম্বিসবল, ভিডিওগেম, বা কমিক্সের ব্যাপারে তার আগ্রহ অনেক বেশি৷ কিন্তু তবু আজ কী মনে করে যেন ঘুড়িটা তুলে সে'টার ল্যাজের সুতো দিয়ে সাইকেলের কেরিয়ারে বেঁধে নিলো৷

তারপর ধীরেসুস্থে প্যাডেল করতে করতে এগোল মদনদার চপের দোকানের দিকে৷ বাবা অফিসের কাজে বাইরে কোথাও একটা গেছে, আজ সন্ধ্যেয় বাড়ি ফিরতে দু'দশ মিনিট দেরী হলে ক্ষতি নেই৷
**

- এ'টা কী হচ্ছে?

- ইয়ে..।

- তুমি চোর?

- না ভাই। মাইরি বলছি৷ আমি চোর না।

- চোর নয় তো রাত দু'টোর সময় আমার ঘরে ঢুকে জিনিসপত্র হাতড়াচ্ছ কেন? খবরদার, আমায় মার্ডার করার চেষ্টা করবে না৷ আমার বালিশের নীচে পিস্তল রাখা আছস৷ এ'দিক ও'দিক করলেই ঢিঁশকাউ!

- ছি ছি৷ ভাই। ও কী কথা! মার্ডার? ও'সব কথা মুখে এনো না প্লীজ। বুকের মধ্যে কেমন ধড়ফড়িয়ে ওঠে।

- মাকে ডাকব? মা জানলে তোমার কপালে যা উত্তমমধ্যম পড়বে না..।

- প্লীজ। প্লীজ ভাইটি।

- ভাইটি আবার কী? আমার নাম নাড়ু৷

- নাড়ু?

- পছন্দ হলো না বুঝি? চার্লস নাম হলে চুরি করে আনন্দ পেতে?

- এই নাড়ু। অনেক হয়েছে। আর একবার আমায় চোর বললে কিন্তু..।

- ডাকব মাকে? মেজপিসিকে? মেজপিসি হালিশহর থেকে ঘুরতে এসেছে। পিসে আবার থানায় কী'সব সাপ্লাই দেয়, দারোগা-কন্সটেবলদের সঙ্গে মারাত্মক দহরমমহরম।

- উফ৷ কী ছেলের পাল্লায় যে পড়লাম৷ শোনো নাড়ু, আমার নাম বল্টু৷ আর আমি চোর নই?

- বল্টু? ও'টা কোনো নাম হলো?

- নাড়ুর থেকে ঢেরগুন ভালো।

- কী চাই? সত্যি করে বলো..। নয়তো মেজপিসের কাছে খবর গেলে।

- আমি একটা দরকারে এসেছি।

- আমার ঘরে তোমার কী দরকার?

- নাড়ু৷ এই ঘুড়িটা তুলে আনার জন্য থ্যাঙ্কিউ।

- ওই ঘুড়িটা তোমার?

- হ্যাঁ।

- এ'টা ফেরত নেওয়ার জন্য তুমি রাত্রিবেলা চোরের মত এই বাড়িতে ঢুকেছ?

- ঠিক ঢুকিনি৷ বেরিয়ে এসেছি বলতে পারো।

- যাচ্চলে। এর মানে কী!

- আমি এই ঘুড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছি৷

- মেজপিসেকে ডাকব? আর আমাদের পাশের বাড়ি হুলোদা নিয়মিত জিম করে।

- নাড়ু৷ আমার কথা একটু মন দিয়ে শুনবে?

- বলো।

- আমি এই ঘুড়িতে সেঁধিয়ে নেমে এসেছি। এই ঘরটা কদ্দিন দেখিনা৷ ক'দিন ধরেই মনটা কেমন করছিল। তাই তক্কে তক্কে ছিলাম। তবে আমাদের ডাইরেক্ট নেমে আসা ব্যাপারটা তোমাদের গপ্প-সিনেমায় হয়৷ আমরা মাটির কাছে ডাইরেক্ট নামতে পারিনা৷ তাই ঘুড়ি জিনিসটা আমাদের জন্য বড় দরকারি।

- যাতা বলে যাচ্ছ বল্টুদা। আরে আমি পুলিশে খবর দেব না৷ মাকেও ডাকব না৷ আর বালিশের তলায় চ্যুইংগামের প্যাকেট আছে৷ রিল্যাক্স করো। তুমি কি কলেজে পড়ো?

- তুমি আমায় দাদা বললে, বুক জুড়িয়ে গেলো। তোমরা এই বাড়িতে কদ্দিন আছ?

- গতবছর বাবা এই বাড়িটা কিনেছে৷

- হুঁ। তোমার এই ঘরটা, এ'টা একসময় আমার ছিল।

- এই বাড়িটা আগে তোমাদের ছিল?

- আমার বাবা-মা-জ্যেঠু-জেঠি; সবার৷ তিন দিনের জ্বরে আমায় চলে যেতে হলো৷ ওরাও এ বাড়ি বিক্রি করে চলে গেল৷ অনেকদিন ধরে সাধ হচ্ছিল আমার এ ঘরটা আর একবার দেখার।

- বল্টুদা। তুমি ভূত?

- ভূত শব্দটা শুনলেই মনে হয় আনন্দমেলা শুকতারা কিশোরভারতী পড়ছি। তবে আমি ঠিক তোমার মত করে ঠিক বেঁচেবর্তে নেই৷

- ঘুড়ি ব্যাপারটা তা'হলে..।

- ও'টা মানুষ ওড়ায় শখে৷ কিন্তু জিনিসটা আমাদের ট্রেন, বাস, ট্যাক্সি, এরোপ্লেন, স্পেসশিপ; সব৷ দিব্যি ব্যবস্থা৷

- এ'বার ফিরবে কী ভাবে?

- এগেইন্সট গ্র্যাভিটি যেতে অসুবিধে হয় না৷ কাজেই নিজেই ফিরে যেতে পারব৷ কিন্তু নীচের দিকে নেমে আসতে হলে আমাদের ওই ভোঁকাট্টা ঘুড়ির দরকার পড়ে। যা হোক। বড় ভালো লাগলো এ'খানে এসে। আজ আসি।

- আবার আসবে তো? তুমি ওই ঘুড়ি নিয়ে স্কুলবাড়ির আশেপাশেই নেমো। আমি ঠিক চিনে নেবো৷ উঠিয়ে নিয়ে চলে আসবো।

- আসতে তো চাই ভাই৷ কিন্তু এক-একটা ঘুড়ির জন্য যে কত লম্বা ওয়েটলিস্ট আমাদের ও'দিকে, তা যদি জানতে ভাই নাড়ু৷ তা, তুমি ঘুড়ি ওড়াও না কেন? যত বেশি ছেলেমেয়ে ঘুড়ি ওড়াবে, তত আমাদের সুযোগ বাড়বে।

- কাল থেকেই লেগে পড়বো৷ সামনের বিশ্বকর্মা পুজোর আগেই এক্সপার্ট কাইট ফ্লায়্যার হয়ে সবাইকে চমকে দেব।

- বেশ৷ এই ঘুড়িটা দিয়েই শুরু কোরো। আজ আসি। টাটা নাড়ু।

No comments: