Tuesday, July 16, 2024

জ্বর



আধঘণ্টার ওপর হতে চললো, অথচ বৃষ্টি ধরার কোনো নাম নেই৷ বিপ্লব বেশ ফাঁপরে পড়ে গেছে৷ রামতনু মিত্র লেনের একটা বাড়ির জানালার মাথায় নুয়ে থাকা অ্যাসবেস্টসের নীচে দাঁড়িয়ে একটানা৷ সেলসের কাজে এ অঞ্চলে এসেছিল, এখন এই মুষলধার বৃষ্টিতে আটকে গেছে৷ অবশ্য সে ব্যাচেলর মানুষ, বাড়ি ফেরার যে সবিশেষ তাড়া আছে তা নয়। তা'ছাড়া সদ্য জ্বর সেরে উঠেছে৷ এখন আর কাকভিজে হয়ে কাজ নেই৷

জানালাটা বন্ধ, নীলরঙচটা কাঠের পাল্লা আর লোহার শিক; দু'টোরই জরাজীর্ণ অবস্থা৷ ঝমঝমে বৃষ্টি সত্ত্বেও জানালার ও'পাশ থেকে নানারকম কথাবার্তা ভেসে আসছিল৷ এক মা তার স্কুলপড়ুয়া মেয়েকে পড়াশোনা বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন৷ ইংরেজি ডিকটেশন শুনে মনে হলো ক্লাস থ্রি কি ফোর হবে৷ মেয়েটি চটপটে, মা তাকে ধরে ধরে আদর করে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন৷ বেশ লাগছিল বিপ্লবের৷

ইংরেজির পর এলো অঙ্ক৷ বৃষ্টি তখন তুঙ্গে৷ পাটিগণিত। বৃষ্টিতে সময় নষ্টের ব্যাপারে বিপ্লবের খুঁতখুঁত ততক্ষণে কমে এসেছে৷ মা-মেয়েটির তালে তাল মিলিয়ে মনে মনে যোগ-বিয়োগে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সে৷ আচমকা এক পুরুষকণ্ঠ এসে ছন্দে সামান্য বিঘ্ন ঘটালো৷
"মিউ, পড়তে বসেছিস বাবু? অঙ্ক করছিস? ভেরি গুড৷ সোনামেয়ে"।

বৃষ্টির ছাঁটে জামার ডান দিকটা ততক্ষণে ভিজতে শুরু করছে৷ কিন্তু বিপ্লব সবিশেষ পাত্তা দিলে না৷ বেশ লাগছে কিন্তু৷ বাচ্চা মেয়েটার ডাকনাম তা'হলে মিউ। কী সুন্দর৷ কী মিষ্টি৷ এখন নিশ্চয়ই বাপ-মা-মেয়ে মিলে আড্ডা বসবে। অঙ্কের পাশাপাশি থাকবে বাবা-মায়ের চা, মিউয়ের বোর্নভিটা৷ বাবা কি বাড়ি ফেরার পথে নিমকি-টিমকি কিছু নিয়ে এসেছেন? তবে তো আসর জমজমাট।

হুট করেই কল্পনার সুতোটা ছিঁড়ে গেল৷ বিপ্লব আচমকা শুনতে পেলে মা যেন একটু ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলছেন, "মিউ, তুমি পাশের ঘরে যাও৷ যাও বলছি৷ যাও! না একটু পড়ে নয়! এখুনি যাও। বড্ড বেশি কথা বলো তুমি। বললাম না এখুনি যাও"! মায়ের গলার হঠাৎ-দাপটে বিপ্লব নিজেই যেন কিছুটা সঙ্কুচিত হয়ে পড়লো। অস্পষ্ট মৃদু স্বরে কিছু একটা বলতে চাইছিল হয়ত মিউ, তারপর তার কণ্ঠস্বর মিলিয়ে গেল৷ ঢোক গিললো বিপ্লব।

মহিলার কণ্ঠস্বর থেকে আদুর মা সরে গিয়ে কেমন একটুকরো ইস্পাত এসে ঠেকলো৷
"কতবার তোমায় বলেছি, ভরসন্ধ্যেবেলা বাড়িতে না আসতে। মিউ ঘুমোনোর আগে কেন আসো তুমি? তুমি জানো না এতে ওর কত ক্ষতি.."!

আচমকা সে পুরুষ কণ্ঠ ছোবলের মত এসে পড়লো বিপ্লবের কানে৷ " শাটাপ! হরির লুটের মত টাকা দিচ্ছি কি মাগনায়? আমার যখন খুশি আসব! সাতসকালে আসব, ভরদুপুরে আসব৷ তোর মত মেয়েমানুষের মুখচোপা আমি শুনব কেন"?

শিলাবৃষ্টি শুরু হয়েছে ততক্ষণে৷ কতদিন পর বিপ্লব শিলাবৃষ্টি দেখল৷ শেষ দেখেছিল পাণ্ডুয়ার বাড়িতে। মাধ্যমিক দেওয়ার পর এক দুপুরবেলায়, মা তখনও বেঁচে৷ দু'হাত ভরে শিল কুড়িয়ে ছাত থেকে নেমে এসেছিল মা, ভিজে সপসপে, একমুখ হাসি। 'দ্যাখ বাবু দ্যাখ, বরফকুচি', মায়ের হাত থেকে একটা টুকরো তুলে নিয়ে কী আনন্দই না পেয়েছিল বিপ্লব৷

বিপ্লবের জ্বরের ভয় ততক্ষণে উবে গেছে৷ একছুটে বৃষ্টি মাথায় বড় রাস্তার দিকে এগিয়ে গেল সে।

No comments: