Tuesday, July 16, 2024

মোহনের প্রোমোশন



মোহন ম্রিয়মাণ থাকায় আজ আড্ডাটা কিছুতেই ঠিক দানা বাঁধছিল না। আমাদের এই বুধবার সন্ধ্যের আড্ডার 'চীফ' হলো মোহন। ছটফটে দিলদরিয়া মানুষ, আর তার গল্পের স্টক ফুরোয় না। অথচ আজ এমন ম্যাদা মেরে আছে যেন বিমলদার বানানো অমন অমৃত-সমান ডিম-টোস্টের বদলে থার্মোকলে কামড় দিয়ে ফেলেছে ।

অফিস ফেরতা এই সাপ্তাহিক জমায়েতটা ঠিক কী'ভাবে বুধবার ধরে শুরু হলো তা আমাদের কারুরই সঠিক মনে নেই। তবে আমরা জনা সাতেক সহকর্মী মিলে প্রতি বুধবার সন্ধেবেলা বিমলদার চায়ের দোকানে (যার পোশাকি নাম নিউ বেঙ্গল কেবিন) বসে ঘণ্টাখানেক খোশগল্প করি। বাড়ি ফিরতে এই দিনটায় কিছুটা রাত হয়ে গেলেও, আজকাল এই সাপ্তাহিক আড্ডাটার প্রতি একটা আসক্তি চলে এসেছে। আমরা সকলেই মধ্যবিত্ত ছাপোষা মানুষজন, কেউই সে অর্থে আর্টের প্রতি নিবেদিত প্রাণ নই। কিন্তু আমাদের এই আড্ডাটার মূলে কিন্তু রয়েছে আমাদের ওই একটু 'কনস্ট্রাকটিভ' গল্পগুজব করার ইচ্ছে। আমরা সকলেই চেষ্টা করি সপ্তাহের এই ঘণ্টাখানেক অন্তত অফিসের যাবতীয় আলোচনা আর গেরস্থালীর মারপ্যাঁচগুলোকে দূরে সরিয়ে রাখতে। আমাদের টীকা-টিপ্পনী আর গল্পের দৌড় অবশ্য ওই সিনেমার গান, বাণিজ্যিক পত্রপত্রিকা, চলতি গল্পের বই আর ক্রিকেট-ফুটবলের স্কোর পর্যন্তই। কিন্তু প্রতি বুধবারই আড্ডাটা বেশ জমজমাট হয়ে উঠত; আর রকমারি গল্পে মশগুল হয়ে আমাদের ঘণ্টাখানেক দিব্যি কেটে যেত । স্বীকার করে নিতে হয় যে তর্কবাগীশ মোহনের টেবিল চাপড়ানিতে আমাদের চায়ের কাপের তুফানে একটা আলাদা মাঞ্জা যোগ হত। এই ধরুন সমীরদা টেস্টম্যাচের স্কোর দেখে বললেন এ ম্যাচ বাঁচানো মুশকিল, অমনি মোহন ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রমাণ করবে এ টেস্ট আসলে আমাদের হাতের মুঠোয়। আমি বললাম অমুক সিনেমাটা বেশ ভালো হয়েছে, তখনই বিশ্ব সিনেমার রথীমহারথীদের কোটেশন তুলে এনে মোহন বুঝিয়ে দেবে যে ও'ই সিনেমাটা কোনও সমঝদারের পাতে দেওয়া যায় না। নিতাই বললে "এ বছর ম্যাক্সিমাম গরম পড়েছে", মোহন এক্কেবারে অঙ্ক কষে প্রমাণ করে দেবে যে গরমটা সামান্য আজ বেড়েছে বটে কিন্তু গতবছরের তুলনায় এই গরম কিস্যু না। মোহনের এই গায়ে পড়ে তর্ক জুড়ে দেওয়ার ব্যাপারটা খানিকটা বিরক্তিকর হলেও, আমাদের আড্ডার মূল ক্যাটালিস্ট সে'টাই।

সেই মোহনই আজ বিমর্ষ হয়ে বসে। হুঁ-হাঁ ছাড়া বিশেষ মন্তব্য করছে না। সুবিমলবাবু খানিকটা মোহনকে খোঁচা দেওয়ার উদ্দেশ্যেই বললেন, "নাহ্‌, আজকাল আর কাগজপত্র পড়া দায়। এ দেশের পলিটিকাল অ্যানালিসিস বলে কিছুই আর নেই। সবই গসিপমঙ্গারদের চিৎকার-চ্যাঁচামেচি, কী বলো মোহন?"। মোহন অন্যমনস্কভাবে জবাব দিলে, "তা বটে"। এর মাঝে সমীরদা আর বিপুল আচমকা বললে তাঁরা আজ বেশিক্ষণ না বসে বেরিয়ে যাবে; বাড়িতে জরুরী কাজ রয়েছে। তাঁরা বেরিয়ে যেতে গল্প চালাচালির গতি আরও শ্লথ হয়ে পড়লো। আড্ডা মুখ থুবড়ে পড়ার আগে বাধ্য হয় মোহনকে জিজ্ঞেস করলাম, "কী ব্যাপার বলো দেখি মোহন। অমন প্যাঁচামুখ করে তখন থেকে বসে আছো যে"! মোহনের মুখ থেকে কিছু দায়সারা শব্দ বেরোলো। এরপর বাকিরাও তাঁকে চেপে ধরলে; "বলো হে, কী ব্যাপার"। খানিকক্ষণ ঝোলাঝুলির পর মোহন দুঃসংবাদটা খোলসা করলে, "আমার প্রমোশনটা এ'বারেও আটকে গেল"।

আমরা সবাই চমকে উঠলাম। দোকানের মালিক বিমলদাও কাউন্টারের পিছন থেকে উঠে এসে আমাদের টেবিলের পাশে দাঁড়ালেন। অনিলদা সামনের রাখা চায়ের কাপটা সযত্নে সরিয়ে দিয়ে সামান্য ঝুঁকে পড়ে প্রশ্নটা করলেন, "তুই শিওর কী করে হলি মোহন? এখনও তো প্রমোশনের লিস্ট আসেইনি। এমডি সাহেবের টেবিলে রেকমেন্ডেশনগুলো পড়ে আছে শুনেছি"। নিতাই বয়সে আমাদের চেয়ে অনেক ছোট, অফিসে মোহনের ডিপার্টমেন্টেই একটা জুনিয়র পদে আছে। সেও টেবিল চাপড়ে বললে, "দিস ইজ সো আনফেয়ার, তোমার প্রমোশন তো গতবারেই হওয়ার কথা ছিল মোহনদা"। আমায় বলতে হলো যে শুধু গতবছর নয়, গত বছর তিনেক ধরে বাঁধা প্রমোশন ফসকে যাচ্ছে মোহনের, নানারকমের অজুহাতে। মাসখানেক আগে নতুন এমডি সাহেব যোগ দেওয়ায় আমরা সকলেই ভরসা পেয়েছিলাম যে এ'বারে অন্তত মোহনের একটা হিল্লে হবে। কিন্তু সেই নতুন এমডি সাহেবই নাকি আজ মোহনকে ডেকে জানিয়েছেন যে এ'বারেও তার প্রমোশনটা হচ্ছে না। মোহন যথেষ্ট কর্মঠ, বেশি কথা বলে ঠিকই; কিন্তু কাজের জায়গায় ওর মত দাপুটে কর্মী খুব কমই রয়েছে আমাদের অফিসে। কাজেই এই তিতকুটে খবর পাওয়ার পর আর সিনেমা-গানবাজনা-বইপত্রের গল্প চলে না। মোহনের কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলাম, "কী হলো বল তো মোহন, নতুন বসের সঙ্গে আবার ঝামেলা বাঁধিয়ে ফেলিসনি তো"?। মোহন ঘাড় নেড়ে জানালে যে তেমন কিছুই হয়নি। আজকের আড্ডাটার একপ্রকার অকাল মৃত্যুই ঘটলো। অবশ্য আমি জানি যে পরের বুধবারই সবার মেজাজ আবার ফুরফুরে হয়ে উঠবে। অফিস-কাছারির নিয়মই তাই।

আড্ডার পাট গুটিয়ে, মিনিবাসে চেপে লর্ডস মোড় পর্যন্ত এসে যখন হাঁটতে শুরু করলাম তখন রাত সোয়া নটা। ফোনটা অনেকক্ষণ ধরেই করব ভাবছিলাম, কিন্তু মিনিবাসের ভিড়ে দাঁড়িয়ে মোবাইলে কথা বলা ভারি ঝকমারি। মোড়ের মুখে শিবুর দোকান থেকে একটা মিঠে পান কিনে মুখে দিয়ে কল করলাম সুমন্তকে। মোহনের প্রমোশনের সুযোগটা কেটে যাওয়ার ফায়দাটা ওরই। মোহনের যে কোনও বিষয়ে এঁড়ে তর্কের অভ্যাস, সে'টা নতুন এমডি সাহেবের তেমন পছন্দ হয়নি সে'টা আমি আগেই আঁচ করেছিলাম। আর সেই বিরক্তিটাকেই গত মাসখানেক সযত্নে ধরে খুঁচিয়ে গেছি; অবশ্যই খুব সাবধানে করতে হয়েছে ব্যাপারটা। তা'তে ফল যে হয়েছে তা আজ দিব্যি টের পেলাম। সুমন্ত আর যাই হোক মোহনের মত কর্মদক্ষ নয়, কাজের বিষয়ে জ্ঞানগম্যিও ততটা গভীর নয়। কেরিয়ারের কথা যদি বলি, ভবিষ্যতে সুমন্ত আমার সঙ্গে তেমন পেরে উঠবে না। আর টানা বছর চারেক প্রমোশন খুইয়ে মোহন এ'বার অনেকটাই পিছিয়ে গেল আমার তুলনায়। এ'বার ঠাণ্ডা মাথায় সুমন্তকে একটা "কংগ্রাচুলেশনস" না জানালেই নয়।

No comments: