Tuesday, July 16, 2024

আপদবাজি ভূতের গল্প



আপদবাজি ভূতের নাম শুনেছ তোমরা? নির্ঘাত শোনোনি। কিন্তু মনে রেখো, তোমরা শোনোনি বলেই যে সে জিনিস সত্যি নয়, এমন হামবড়াই মনের মধ্যে পুষে না রাখাই ভালো। যখনই তেমন অহংকার মনের মধ্যে উঁকি দেবে, একটা মন্ত্র বত্রিশবার জপ করবে, তা'তেই সেই হামবড়া ভাব কেটে যাবে: "পৃথিবীটা বিপুলা, আমি জানি কাঁচকলা"। তুমি ফের বলবে "এ'টা কোনও মন্ত্র হলো? তা'ছাড়া ছন্দেও ভুল রয়েছে"। আমি বলব "পৃথিবীটা বিপুলা, তুমি জানো কাঁচকলা"।

যা হোক। আপদবাজি ভূতের কথা হচ্ছিল। আপদবাজি ভূতদের বাস গুড়বালি ডোবার ধারের বোঁদেপচা জঙ্গলে। গুড়বালি ডোবা আর বোঁদেপচা জঙ্গলের নাম শোনোনি? কী আর বলবো বলো। ইশকুলের বই আর কাঠ-কাঠ অ্যাটলাসের মধ্যে আটকে থেকে এই দশা হয়েছে আর কী। তা, বোঁদেপচা মানুষের কাছে জঙ্গল হতে পারে, ভূতের চোখ দিয়ে সে জঙ্গল যদি দেখতে পারতে তবে বুঝতে সে জঙ্গল আদতে সাজানো-গোছানো ছিমছাম একটা টাউনশিপ। বসতবাড়ি, ক্লাবঘর, বাজারঘাট, স্কুল; সবই রয়েছে। ওই যে বললাম, ভূতের চোখ থাকলে বুঝতে বোঁদেপচার কী রোয়াব।

তা এই আপদবাজিরা বড় মামুলি ভূত নয়; ভূতের জগতে তাদের স্থান প্রায় গন্ধর্ব-কিন্নরদের মত। সবচেয়ে বড় কথা, মানুষ মরে আপদবাজি ভূত তৈরি হয় না। কী, কেমন দিলাম! চমকে গেলে তো? যাও, গিয়ে এক গেলাস জল খেয়ে এসো। তোমাদের তো সেই বস্তাপচা সব ধারণা; ভূত তৈরি হবে মানুষ মরে। আর ধুর ধুর, মানুষ-ভরা ভূতেরা অতি নিকৃষ্ট, মানুষের মতই। বড় ছিঁচকে তাদের চিন্তাভাবনা, নিতান্তই পাতি তাদের কাজকারবার।

আপদবাজিদের ব্যাপারই আলাদা। মানুষ নয়, মানুষের বিপদ মরে গিয়ে আপদবাজি ভূতের তৈরি। যে সে মোটাদাগের বিপদ হলে চলবে না, একদম হাইক্লাস বিপদের মেঘ যখন কেটে যায়, তখন বোঁদেপচা আলো করে নতুন কোনও সদস্য ঢুকে পড়ে। এই যেমন ধরুন, ঘুপচি নামের আপদবাজি মেয়েটা জন্মেছিল অমল সাহার ঘুম ভাঙার পর। তোমাদের নিয়ে এই এক সমস্যা, সোজা কথা সোজাসাপটাভাবে শুনলেও হাজারটা প্রশ্ন তোমার মনে ঘুরপাক খায়। ঘুম আবার কী ধরণের বিপদ আর ঘুম-ভাঙাটাই বা বিপদের কেটে যাওয়া কী করে। আরে বাবা, অমলবাবু যে মেল ট্রেনের ড্রাইভার। টিকিয়াপাড়ার পর দিব্যি ট্রেনের ড্রাইভারের কেবিনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন, ঘুম ভাঙল বর্ধমান ঢোকার দু'টো স্টেশন আগে। আর দু'মিনিট এ'দিক ও'দিক হলেই একটা বিশ্রী কিছু হয়ে যেত। কিন্তু হলো না। তার বদলে আমরা পেলাম ঘুপচিকে। আর পাঁচটা আপদবাজির মতই ঘুপচির দিন কাটে কবিতা আউড়ে। ওহ হো। তোমাদের বলা হয়নি, আপদবাজিদের ওই এক গুণ, কথায় কথায় ছড়া কাটা। সমস্যা হলো, মানুষের কান দিয়ে শুনলে ছড়াগুলো শুনলে তোমার গা গুলিয়ে উঠতে পারে। কী আর করবে বলো, চাইলেই তো আর মানুষের কান ফেলে দিয়ে ভূতের কান লাগিয়ে নেওয়া যায় না। এই যেমন আজ মনের সুখে ছড়া আউড়াতে আউড়াতে ঘুপচি এ'গাছ থেকে ও'গাছ নেচে বেড়াচ্ছিল।

"যত ব্যাটা আছিস যে'খানে সব মর্‌,
হোক নিউমোনিয়া, হোক ডিসেন্ট্রি, হোক জ্বর
যত ব্যাটা আছিস যে'খানে সব মর্‌,
হোক অম্বল, হোক মাথাব্যথা, বুক ধড়ফড়
যত ব্যাটা আছিস যে'খানে সব মর্‌"।

তোমরা শুনেই ভাবলে কী বিশ্রী ছড়া এ'টা। ঠ্যাং নেই, মাথা নেই, ছাঁদ নেই, ছিরি নেই, ছন্দে লবডঙ্কা। ঘুপচির তা'তে বয়ে গেছে। হোঁচটবাবুর খুব ভালো লাগে ঘুপচির ছড়া কাটা। নিজের ঝোপের এক কোণে হেলান দিয়ে বসে তিনি মুগ্ধ হয়ে শোনেন ছোট্ট ঘুপচির ছড়া। মাঝেমধ্যেই বলে ওঠেন,

"আহা আমার ঘুপচি মামনির মনটা বড্ড নরম,
বোঁদেপচায় চির-পৌষ আর মানুষ-পাড়ায় বোশেখ গরম।
আহা আমার ঘুপচি মামনির মনটা বড্ড নরম"।

হোঁচটবাবুর বয়সের গাছ পাথর নেই। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে কোনও জমিদার গিন্নীর ওপর গোঁসা করে মিছরির সরবতসহ গেলাস ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন, জানতেও পারেননি সেই গেলাসে দুষ্ট নায়েব বিষ মিশিয়ে রেখেছিলেন। সে গেলাস ছুঁড়ে ফেলা মাত্র হোঁচটবাবু এই বোঁদেপচায় উদয় হন। বড়ই সাদামাটা ভূত হোঁচটবাবু। অবশ্য আপদবাজি মাত্রই সাদামাটা। এখানে গোলমেলে ভূত বলতে একজনই; বাবু বুকভার। বাবু বুকভারের আস্তানা হোঁচটবাবুর ঝোপের পাশেই। দুপুর-নাগাদ, যখন গোটা বোঁদেপচা ঝিমিয়ে পড়ে, বাবু বুকভার এসে হোঁচটবাবুর পাশে বসে। সবিশেষ গপ্প হয়না। বাবু বুকভার মোটেও গপ্পের মানুষই নয়। তবে বদ নন, তাই হোঁচটবাবু অপছন্দ করেন না তাঁকে। তবে গোলমেলে একটাই কারণে, ঠিক কী'রকম বিপদ কেটে যাওয়ার তিনি এ পাড়ায় এসেছেন, তা কেউ জানে না। একসময় হোঁচটবাবু খবর বের করার অনেক চেষ্টা করেছেন, এখন হাল ছেড়ে দিয়েছেন। গোটা বোঁদেপচায় বাবু বুকভারের সঙ্গে সখ্যতা শুধু ওই হোঁচটবাবুরই ।

দুপুরবেলাটা বিড়বিড় করে কতরকমের গল্প করে যান হোঁচটবাবু, বাবু বুকভার শুধু তার হিলহিলে স্প্রিংয়ের মত লম্বাটে গলার মাথায় বেঢপ সাইজের ডিমের মত মাথাটা নেড়ে সঙ্গত দিয়েই খালাস। বুকভারকে সবাই বোবা আপদবাজি বলেই ধরে নিত। যদি না সে মাঝেমধ্যে বিড়বিড়িয়ে বলে উঠত;
"ভোট দিন ভোট দিন,
ভোট দিন ভোট দিন"।

এই হাবিজাবি কথাগুলোর মানে ঠাহর করতে পারতেন না হোঁচটবাবু।
**
গল্পের পেটে গল্প লুকিয়ে থাকে, সে'টা শুনেছ তো? নাকি সে'টাও আমাকেই বলে দিতে হবে। আচ্ছা জ্বালা তো। যা হোক। শোনো।

খানিকক্ষণের জন্য বোঁদেপচা থেকে বেরিয়ে এসো। পিছিয়ে যাও কিছু বছর। চলে যাও মানুষের মধ্যে। কান পাতো, সাবধানে।
শুনতে পাবে একটা বুক ঠাণ্ডা করে দেওয়া কণ্ঠস্বর।
"একটা ভোটও যদি ও'পাশে যায়, জানবি, তোদের গাঁয়ের একটা বাড়িও আস্ত থাকবে না"।

ভোটের বেহাত হওয়া তবুও আটকানো যায়নি। কোনো এক ছোট্ট অদরকারী গ্রাম জ্বলে ছাই হয়ে গেছিল কোনো এক রাত্রে। চারদিকে লাশ, হাহাকার, আগুন, রক্ত, চিৎকার। সমস্ত বিপদ কি নির্বিবাদে কাটে? কিছু বিপদ কাটাতে বিস্তর কাঠখড় পোড়াতে হয়, পুড়ে যেতে হয়। একটা গ্রামভর্তি মানুষ এককাট্টা হয়ে আশপাশের কুড়ি-বাইশটা গ্রামকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন দস্যুদের কবল থেকে, ঘুচিয়ে দিয়েছিলেন আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের বিপদ; স্রেফ ভোট দিয়ে।

বাবু বুকভার যে'দিন বোঁদেপচায় উদয় হয়েছিলেন, তার কানে তখন বিশ্রী চিৎকার; "ভোট দিন ভোট দিন, ভোট দিন ভোট দিন"।

No comments: