২০০৩, হ্যারিসন রোড যে'খানে কলেজ স্ট্রীটকে কেটেছে, সে'খান থেকে শেয়ালদার দিকে আধ-মাইল হেঁটে গেলে বাঁ হাতে পড়বে এক চিলতে একটা গলি - সীতারাম ঘোষ স্ট্রীট। সে গলির মুখেই একটা বেসরকারি নার্সিংহোম, আর সে'টার পাশে দত্তবাবুর বাড়ি। বাড়িটা ঢাউস, তিনতলা, কিন্তু সাত-পুরনো। উত্তর কলকাতার অলিগলি জুড়ে তেমন বাড়ি-ঘরদোর অজস্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। অবশ্য কলকাতার চেয়েও সে ধরণের বাড়ি বেশি আছে ইনস্টাগ্রামে, কাজেই সে'টার বর্ণনা ফেঁদে কাজ নেই।
সে বাড়ির তিনতলায় থাকেন দত্তবাবুরা। আর দোতলার তিনটে ঘর আর খান-দশেক চৌকি জুড়ে রয়েছে কলেজ পড়ুয়া ছেলেদের মেস। দু'টো ঘর হ্যারিসনরোডমুখো, তাদের গায়ে ইয়াব্বড় মানুষ-সমান জানালা, সে জানালায় পুরনো কাঠের পাল্লা, লোহার শিক। তিনটে ঘরের মধ্যে যে'টা বড়, সে'টার রাস্তারদিকের দেওয়ালের গায়ে তিনটে তেমন বিশাল জানালা আর ঘরের মধ্যে চারটে চৌকি; মেসের ভাষায় 'বেড'। সেই ঘরের একটা জানালা ঘেঁষে তন্ময় মুখার্জির 'বেড'। সে বেডের ওপর একটা তোষক, তার ওপর চাদর, একটা বালিশ, একটা পাশবালিশ আর একটা আধ-ঝুলন্ত মশারি। খাটের নীচে একটা ভিআইপি সুটকেস আর একটা স্টিলের ট্রাঙ্ক। বেডের কাছেই একটা দেওয়াল আলমারি; তার দু'টো তাক জুড়ে বিভিন্ন জিনিস; টুথব্রাশ-পেস্ট, শেভিং বাক্স, বইখাতা, কলেজ স্ট্রিট থেকে সস্তায় কেনা পুরনো গল্পের বই। হয়ত মেসবাড়ির সে বেডের দলিল ছিল না, কিন্তু সে'টাই আমার প্রথম আস্তানা; একদম নিজস্ব, বড় আপন।
কখন বড় ক্লান্ত বোধ করলে স্রেফ চোখ বুঝতে হয়; সে'টুকুতেই কেল্লা ফতে। সিনেমার মত স্পষ্ট হয়ে ওঠে সেই মেসের কোণ। গরমের দুপুরগুলোতে জানালার ঝাঁপ নামানো থাকতো। চওড়া গাঁথনির দেওয়াল, ঘরের ভিতর তেমন গরম বোধ হত না। সে বয়সে অবশ্য শীতগ্রীষ্ম এত সহজে ঘায়েলও করতে পারত না। পৌনে তিনটা নাগাদ আমি আর মেসবন্ধু কবি দুপুরের খাওয়া সেরে সবে তিনতলা থেকে নেমে এসেছি। কবি নিয়ম মেনে সিগারেট ধরিয়ে মেসের খাটে ঠ্যাঙ লম্বা করে বসেছে। সিগারেটে যৌবনের ধার বাড়ে। আমি খাটের ওপর চিৎপটাং, আমার ফিলিপ্সের রেডিওতে লো ভল্যুমে আমার-এফএমে গান বাজছে। রোদ্দুরবিহীন ঘরে টিউবলাইট বন্ধ করে দিলে আবহাওয়াটা আরও জম্পেশ হয়। বলাই বাহুল্য রাতভর আড্ডার পর আমার আর কবির ঘুম ভেঙেছে বেলা এগারোটা নাগাদ, কাজেই ভাত-ঘুমের প্রশ্নই ওঠে না। ঝিমনো সুরে গল্প চলে। মেসের বাকিরা তখন কলেজে, আমি আর কবিই এই নিয়মিত কলেজ যাওয়ার ব্যাপারটা কখনও আয়ত্ত করে উঠতে পারিনি। মেসের বাকিরা যতক্ষণে এক এক করে ফিরবে; রোদ্দুরে তেজ কমে আসবে। তখন আমরা সবাই মিলে বেরবো 'টিফিন' করতে।
ওই যে দুপুরের আলস্য। আর সে আলস্য ভেদ করা "আজ বিকেলে চলো রবীন্দ্রসদন ঘুরে আসি" মার্কা অসাড় প্ল্যান। ও'টাই আমার বাড়ি।
আমি বাড়ি যাবো।
কদ্দিন বাড়ি ফেরা হয়নি।
কদ্দিন।
No comments:
Post a Comment