মৃণালবাবুর একটা রাগের ডায়েরি আছে। রাগের ডায়েরি মানে ভাববেন না যে তা'তে সঙ্গীতের ছিটেফোঁটাও আছে। ভদ্রলোক নিজেকে গবেষক বলে ভাবতে ভালোবাসেন, আর আজীবন তাঁর গবেষণার বিষয় হলো রাগ; মানুষের রাগ। কাউকে রাগতে দেখলেই সে রাগের বহিঃপ্রকাশ সম্বন্ধে নিজের অব্জার্ভেশন নোট করে রাখেন মৃণালবাবু।
সেই ফার্স্ট ইয়ারে শুরু। মৃণালবাবুর প্রেমের চিঠিটা দলা পাকিয়ে ফাঁকা ক্লাসরুমের জানালার বাইরে ছুঁড়ে ফেলেছিল নয়না। ছুঁড়ে না ফেললেই পারত; সামান্য "না" বললেই ল্যাঠা চুকে যেত। কিন্তু ওই দাঁতে দাঁত চেপে চিঠিটা দলা পাকানোর মধ্যে একটা তলপেটে-ঘুষি মারার সমান ব্যাপার আছে, জানালার বাইরে সে কাগজের দলাটা ছুঁড়ে ফেলার মধ্যে একটা ঠাস-চড় আছে। "না" বলে ফিরিয়ে দেওয়ার মধ্যে সাদামাটা তথ্যই আছে, আগুন নেই। অবশ্য নয়নার রাগের কারণটা আজও ঠিক ধরতে পারেননি মৃণালবাবু। সম্ভবত ওরকম একটা ন্যালাক্যাবলা ছেলের থেকে প্রেমের চিঠি পাওয়া ব্যাপারটা বেশ অপমানজনক ঠেকেছিল নয়নার, তাও ওর স্মার্ট জনা-তিন বন্ধুর সামনে।
মায়ের রাগ ভারী অদ্ভুত ছিল। যার ওপরেই রাগ হোক, সমস্ত গজগজ গিয়ে পড়তো বাবার ওপর। আর বাবার রাগ মানে স্রেফ চুপ করে যাওয়া। সেই শান্ত নির্বাক বাবার চেহারাটা ভাবলে আজও মৃণালবাবুর বুক কেঁপে ওঠে।মেজমামার রাগও বেশ মনে পড়ে মৃণালবাবুর, রেগে গেলেই মামা হাইস্পিডে পায়চারী শুরু করতেন। কারণে-অকারণে রেগে যেতেন, অতএব যখন তখন পায়চারী, কাজেই যদ্দিন বেঁচে ছিলেন বেশ ছিপছিপে ছিলেন। সহকর্মী সমরেশ রেগে গেলেই অফিস মাথায় তুলতো চিৎকার-চ্যাঁচামেচি করে। দু'একবার ফাইলপত্রও ছুঁড়ে ফেলেছে রাগের চোটে। কিন্তু কী অদ্ভুত ব্যাপার, উচ্চপদস্থ কারুর সামনে কখনও সমরেশের সেই বিটকেল রাগটা বেরিয়ে আসেনি। সমরেশ বলতো সে'টাই হলো প্রফেশনালিজম, মৃণালবাবুর মনে হত ধান্দাবাজি। অবশ্য ধান্দাবাজির ব্যাপাটা কখনও সমরেশকে জানানোর সাহস হয়নি, স্রেফ নোটবুকে টুকে রেখেছেন।
পথে-ঘাটে কত রাগী মানুষ দেখেন মৃণালবাবু। সামান্য খুচরো আদানপ্রদানের গোলমালে বাসযাত্রী কন্ডাক্টরকে খামোখা গাল পাড়লেন। উত্তরে কন্ডাক্টর পেঁদিয়ে বৃন্দাবন দেখানোর আশ্বাস দিলেন। মানুষের জিনিসপত্র কেনাকাটি বাড়ছে, বাড়ছে কাস্টোমার কেয়ারে ফোন করে ঘ্যানঘ্যান করার তাগিদ। কাস্টোমার কেয়ারে বসে থাকা সাতপাঁচের খবর না রাখা সামান্য মাইনের ছেলে-মেয়েরা খদ্দেরদের রাগ-ঘেন্না হজম করছেন গোটা দিন ধরে। মানুষের যে কত রকমের চাপ। প্রতিবেশী অমিয়বাবু যেমন; অফিসে পিষে যাওয়া বাপ বাড়ি ফিরে নিজের ছেলের গ্রামার ভুল ধরে ভাঙচুর শুরু করছেন। ছোটছেলে দেবব্রত স্রেফ একটা চাকরীর হিল্লে না জোটাতে পেরে দিনে বারো ঘণ্টা জিম করছে; মৃণালবাবু জানেন যে দেবু ঠিক শরীরের সাধনায় মত্ত নয়, স্রেফ নিজের রাগ আর বিরক্তিটাকে সামাল দিতে পারছে না।
এখন সন্ধে পৌনে সাতটা। দেবু যথারীতি জিমে গেছে। বড়ছেলে দেবাঞ্জন ব্যাঙ্গালোরে চাকরী করে। মৌমিতা নেই বছর পাঁচেক হলো। এ'বার চেয়ার ছেড়ে উঠে বাড়ির আলোগুলো জ্বালতে হবে, পাম্প চালাতে হবে, চা বসাতে হবে। রাগের ডায়েরিটা পাশের টেবিলে রেখে খানিকক্ষণের জন্য চোখ বুজলেন মৃণালবাবু। মৌমিতার রাগ আবার ভারী সুরেলা এবং ধারালো ছিলো; সে'টাকে রাগ না বলে গোঁসা বলা ভালো। বড়ছেলে সে রাগের ধাত পেয়েছে।
গত চল্লিশ বছরে এই রাগের ডায়েরিতে অন্তত আড়াই হাজার মানুষের রাগের অভিব্যক্তির কথা লেখা আছে। বলাই বাহুল্য প্রায় প্রতি বছর নতুন ডায়েরি কিনতে হয়েছে। অথচ নিজের রাগ নিয়ে কোনো কথা লেখা হয়নি। তবে রাগ ব্যাপারটা নিয়ে এতটাই তলিয়ে দেখেছেন এত বছর মৃণালবাবু যে আদতকারণটা তিনি জানেন। মাথার ভিতরের চেপে রাখা বিষাক্ত ফনাটা ফস্ করে উঠলো। এত বছর ধরে সময়ে-অসময়ে ডায়েরিতে খসখসিয়ে লিখে যাচ্ছেন। যার তার সামনে, যখন তখন। অথচ পরিবার-পরিজন বন্ধু-বান্ধব কেউই কখনও সামান্য আগ্রহও প্রকাশ করেনি মৃণালবাবুর ডায়েরি লেখা সম্বন্ধে। কী এত লিখে যান, কী বিষয়ে লিখে যান; কেউ কোনোদিনও জানতে চায়নি। মৃণালবাবু কি এতটাই ম্যাড়মেড়ে? এতটাই অনাগ্রহের বস্তু? এ'সব ভাবতেই মাথাটা দাউদাউ করে জ্বলতে শুরু করলো।
ঘরের সমস্ত আলো জ্বেলে, জলের পাম্প চালিয়ে, তারপর রান্নাঘরে ঢুকে চায়ের জল চাপালেন মৃণলবাবু। রাগের ডায়েরি থেকে খানিকটা তফাতে এসে স্বস্তি বোধ করলেন ভদ্রলোক। রাগ-বিশারদ হিসেবে তিনি জানেন যে সবচেয় উচ্চমার্গীয় রাগ হলো নিখাদ অভিমান, সবচেয়ে বিষাক্তও বটে। হাইক্লাস অভিমানে ভাষা ও অভিব্যক্তি অচল। অতএব এ পৃথিবীর সবচেয়ে পেল্লায় রাগ-জার্নাল শ্রেষ্ঠ রাগের উল্লেখ থাকবে না। এ অপূর্ণতা যতটা ট্র্যাজিক, ততটাই কাব্যিক।
মৃণালবাবু ঠিক করলেন আজ দেবুর জন্য স্পেশ্যাল পেঁয়াজি ভাজবেন।
No comments:
Post a Comment