মধু মিত্র সিগারেট খান না ক্যানসারের ভয়ে।
পান খান না দাঁত নষ্ট হওয়ার ভয়ে।
আর লজেন্স খান না ব্লাড-শুগারের ভয়ে।
অতএব কী অছিলায় পান-দোকানে গিয়ে গল্প জুড়বেন সে'টা ঠাহর করতে পারছিলেন না। এ'খানে স্বাভাবিক ভাবেই আপনি জিজ্ঞেস করতে পারেন পান-বিড়ি এড়িয়ে চলা মানুষের দরকারটা কী পান দোকানে যাওয়ার। সে'টা আগে বুঝিয়ে বলি। মধু মিত্রকে ঠিক যুবক বলা চলে না, নয় নয় করে বয়স ছত্রিশ পেরিয়েছে। কিন্তু চেহারা দেখে যদি আপনি বেয়াল্লিশ-চুয়াল্লিশ বলে ভুল করেন তা'হলেও আপনাকে দোষ দেওয়া সম্ভব নয়। একটা প্রাইভেট ফার্মে ছোটখাটো চাকরী করেন। অনেক চেষ্টা করেও বিয়েটা করে উঠতে পারেননি, কাজেই একাই থাকেন। হাতে অঢেল পয়সা না থাক, মায়ের রেখা যাওয়া পেল্লায় এক বাক্স গয়না আছে; সে'টা বেচে নিশ্চিন্তে একটা ব্যাচেলর জীবন ফুর্তিতে কাটিয়ে দেওয়া যায়। অবসর সময়ে বই কেনেন আর মোবাইলে রিল দেখেন। সম্প্রতি একটা নতুন বাড়ি ভাড়া নিয়ে এ পাড়ায় এসে উঠেছেন। দিব্যি ছিমছাম ফ্ল্যাট, মারাত্মক সুন্দর একটা ব্যালকনি আর ইয়াব্বড় একটা ড্রয়িং রুম। আর আছে একটা পেত্নী, শর্মিলা নামে। শর্মিলা সদালাপী, প্রাণোচ্ছল। প্রথম আলাপের পর মনে মনে শর্মিলা সম্বন্ধে প্রাণোচ্ছল বিশেষণটা ব্যবহার করেই অবশ্য জিভ কেটেছিলেন মধু মিত্র। ভালো শোনায় না, আহা রে, শর্মিলা নিষ্প্রাণ না হতে পারে; তাই বলে জ্যান্তও তো নয়। শর্মিলা অল্প সময়ের মধ্যেই তাকে দাদা বানিয়ে ফেললে, এমন সরল-সিধে মেয়ে। আগামীকাল ভাইফোঁটা, তাই রান্নাঘরের ময়লার ডিবের থেকে মাছের আঁশগুলো পরিষ্কার করেনি মধু। এমনিতে তার শুচিবাই সাংঘাতিক, অপরিচ্ছন্নতা সে সহ্য করতে পারে না। কিন্তু ওই আঁশের গন্ধটা শর্মিলার ভারি পছন্দ। মেয়েটার জন্য একদিন এ জিনিস বরদাস্ত করাই যায়, রান্নাঘর ব্যবহার না করলেই হলো।
শর্মিলার প্রতি একটা কৃতজ্ঞতা বোধও আছে মধু মিত্রের। ও ছিল বলেই এত সুন্দর ফ্ল্যাটটা প্রায় জলের দরে ভাড়া পেয়ে গেল সে। তা'ছাড়া শনিবার দুপুরে ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে শর্মিলার গালগল্প শুনতে বেশ লাগে। সে আত্মহত্যা করেছিল আজ থেকে বছর কুড়ি আগে, তখন তার বয়স ছিল একুশ। সে অর্থে সে মধু মিত্রর চেয়ে বয়সে বড়। অথচ মারা যাওয়ার পর থেকে শর্মিলার বয়স বাড়ছে না; সে'দিক থেকে তাকে কচি খুকিও বলা চলে। শর্মিলা ছোট বোনের মতই আবদারের সুরে কথা বলে, দিব্যি লাগে মধু মিত্রের। বিশেষত ছুটির দুপুর মানেই শর্মিলা আড্ডার আসর জমাবেই। মধু মিত্র নিজে বিশেষ গল্প বলতে পারে না, তবে তাঁর মত ভালো শ্রোতা খুব কমই আছে। সে জন্যই হয়তো শর্মিলার তাঁর এই নতুন দাদাটিকে এত পছন্দ হয়েছে। সেই স্নেহের জোরেই আজ দুপুরে শর্মিলা মধু মিত্রকে নিজের এক টুকরো দুঃখ জানালে। নির্মলের প্রেমে পড়েছিল সে ক্লাস নাইন থেকে। কিন্তু নির্মল পড়াশোনায় তেমন সুবিধের ছিল না, ডানপিটে হিসেবে পাড়ায় তার সবিশেষ বদনামও ছিল। অথচ শর্মিলা ছিন শান্ত মিষ্টি স্বভাবের মেয়ে। পড়াশোনাতেও ব্রিলিয়ান্ট। মাধ্যমিকে থার্ড হলে, উচ্চমাধ্যমিকে ফিফথ। ফিজিক্স নিয়ে রিসার্চ করার খুব ইচ্ছে ছিল, সেই মত পড়াশোনাও শুরু করেছিল। ও'দিকে নির্মল তদ্দিনে পড়াশোনা শিকেয় তুলে বাবার দেওয়া পানের দোকানে গ্যাঁট হয়ে বসেছে। কিন্তু প্রেম ব্যাপারটা শর্মিলাকে বেশ কাবু করে এনেছিল। তার খুব ইচ্ছে ছিল নাকি নির্মলের দুর্দশা ঘোচানোর, এমন একটা কিছু করার যাতে নির্মল পান দোকান ছেড়ে একটা বড়সড় ব্যবসা ফেঁদে বসতে পারে। সে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতো নির্মলকে। কিন্তু ব্যাপারটা জানাজানি হওয়ায় গোলমেলে অবস্থা হয়, বাবা শর্মিলার গায়ে হাত তোলেন। সে দুঃখ কাটিয়ে উঠতে পারেনি শর্মিলা। সে গল্প শুনতে শুনতে মধু মিত্রের চোখে জল এসে গেছিল।
"এই যে তুই আমার সঙ্গে এত মিষ্টি ভাবে আলাপ জমালি শর্মিলা, তুই নির্মলের সঙ্গে রোজ কথা বলিস না কেন"?
"তুমি খানিকটা খ্যাপাটে, আমারই মত। তাই ভূত-পেত্নীতে ঘাবড়ে যাও না। সবাই কি ছাই তাই"?
"কিন্তু নির্মল তোকে ভালোবাসতো তো, সে তো তোর সঙ্গে গল্প করতে পারলে খুব খুশিই হবে"।
"ভালোবাসার মানুষ চলে গেলে তার ফটোর দিকে তাকিয়ে চোখের জল ফেলতে হয়। তার ভূত দেখলে প্রেম-মহব্বত হাওয়া হয়ে যায়। হা হা হা হা হা হা"।
শর্মিলার খ্যানখ্যানে হাসি আর যুক্তি কোনোটাকেই পাত্তা দেননি মধু মিত্র। তিনি নিশ্চিত যে নির্মল যদি জানতে পারে শর্মিলা এখনও তার আশেপাশেই ঘুরঘুর করছে, সে নিশ্চয়ই গল্প করতে চাইবে। স্মৃতি রোমন্থন করতে চাইবে। ভাইফোঁটায় শর্মিলাকে ঠিক কী উপহার দেওয়া উচিৎ সে সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র সন্দেহ রইল না মধু মিত্রের। তাই খানিকক্ষণ পর, যখন দেখলেন নির্মলের পানের দোকানে অন্য কোনো খদ্দের নেই, তিনি "জয় মা" বলে এগিয়ে গেলেন।
***
চাটুজ্জেদের ফেলে যাওয়া ফ্ল্যাটের নতুন ভাড়াটে ভদ্রলোক যে ছিটগ্রস্ত সে সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ ছিল না নির্মলের। কিন্তু ভদ্রলোক এইমাত্র যা যা বলে গেল তা'তে তো মনে হয় সে বদ্ধ পাগল। কিন্তু নির্মলের তবু মাথাটা কেমন গুলিয়ে গেল, কেমন একটা অস্বস্তি চেপে ধরলো তাকে। শর্মিলা আর তার ছোটবেলার কথাগুলো এমন নিখুঁত ভাবে এই মধু মিত্র ভদ্রলোক জানলেন কী করে? এমন কী গঙ্গার ঘাটের বিকেলটার খবরও তাঁর অজানা নয়। নাহ, মনের অস্বস্তিটা কাটাতে ভদ্রলোকের বাড়িতে একবার ঢুঁ মারা দরকার। এত করে ভদ্রলোক বললেন যখন, আজ রাত্রেই যাওয়া যাক। যদি ফেরেববাজ কেউ হয়, তা'হলে তাঁকে একটু ধমক দিয়ে আসতে হবে। এই ভেবে দোকানটা সাত-তাড়াতাড়ি বন্ধ করে সামনের আধ-ভূতুড়ে অ্যাপার্টমেন্টের চার তলার তিন নম্বর ফ্ল্যাটের সামনে এসে দাঁড়ালেন নির্মল।
খটকা লাগলো, মধু মিত্রর ফ্ল্যাটের দরজাটা অর্ধেক খোলা। পাশের দু'টো ফ্ল্যাট নির্ঘাত ফাঁকা। এ'দিক ও'দিক তাকিয়ে দু'একবার হাঁক পড়লেন নির্মল; "মধুবাবু আছেন নাকি"? কোনো সাড়া নেই। কেন জানি না নির্মলের পেটের ভিতরটা কেমন গুড়গুড় করে উঠলো। দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলেন নির্মল। একটা টিউব জ্বলছে, আর ফ্যানে গলায় দড়ি দিয়ে যিনি ঝুলছেন তিনি আধঘণ্টা আগে নির্মলের পানের দোকানে দাঁড়িয়ে গল্প করে গেছেন। সামনের টি-টেবিলের ওপর একটা ঢাউস বার্মা কাঠের বাক্স। তার ওপর দু'টো ভাঁজ করা কাগজ। ওপরের কাগজটা হাতে নিয়ে টিউব-লাইটের আলোয় মেলে ধরলেন নির্মল;
"নির্মলদা,
এ'টা মধু মিত্রবাবুর হাতের লেখায় লেখা। আর কোনো উপায় না পেয়ে ভদ্রলোককে দিয়েই লিখিয়ে নিতে হলো। আশা করি তুমি বুঝবে।
তুমি ভালো আছো?
ভালো আছো না ছাই! আমি নেই, তুমিও ভালো নেই। সে আমি খুব জানি।
শোনো, অনেক হয়েছে, এ'বার ওই পান-দোকান তোমায় ছাড়তে হবে। এই কাঠের বাক্সে প্রচুর গয়না আছে। এ'গুলো বেচে তুমি একটা বড় কোনো ব্যবসা শুরু করো। আমার কত স্বপ্ন তোমায় নিয়ে নির্মলদা, কত বড় গলায় বাবাকে বলে গেছিলাম জানো, "তুমি দেখো বাবা, নির্মল চিরকাল ওই পান-দোকানে আটকে থাকবে না"। আমার কথা ফেলতে পারবে না তুমি, বলে রাখলাম। এই চিঠিটা তুমি ছিঁড়ে ফেলো, পারলে গিলে ফেলো। পাশাপাশি আর একটা চিঠি রেখে গেলাম; মধুবাবুকে দিয়েই লেখানো। ও'টাকে রেখে যেও। পুলিশ পড়বে মধু মিত্রর সুইসাইড নোট।
তোমায় ভালোবাসি নির্মলদা, কেমন? ভালো না বেসে আমার যে কোথাও যাওয়ার নেই।
আমার কত স্বপ্ন তোমায় নিয়ে, সে'গুলো পূরণ না হলে আমি কোথায় যাই বলতে পারো!
ইতি তোমার শর্মি"।
(ছবি: জেমিনাই)
No comments:
Post a Comment