এইমাত্র আমার বাঁ কানের দু'ইঞ্চি দূর দিয়ে শাঁ করে একটা বুলেট বেরিয়ে গেলো। বয়েই গেছে তা'তে আমার। যুদ্ধে নেমে বাঁচা-মরা নিয়ে অত ভাবনা চিন্তা করতে নেই। মাথার ঘিলু আজ আছে কাল নেই, যে ঠ্যাঙ সকালে থাকবে সে'টা বিকেলে খসে পড়বে। অত ভাবলে বেঁচে থাকা মুশকিল, আর টপাৎ করে মরে গেলে তো ল্যাঠাই চুকে গেল।
চিরকাল ভাড়াটে সৈনিক ছিলাম না। এককালে দিব্যি অ্যাকাউন্টান্টের চাকরী করতাম। দুপুর একটা থেকে দেড়টা পর্যন্ত লাঞ্চ, আমি বলতাম টিফিন-টাইম। বছর সাতেক আগে দেশে যুদ্ধ-টুদ্ধ লাগলো, চাকরী গেল, ঘরবাড়ি গেল। শুধু এই সাধের টিফিন-টাইমটাকে ধরে রেখেছি। অন্যদিনের মত আজও আমি টিফিন-টাইম শেষ না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ করব না।
একটু গাল চুলকে নিয়ে পিঠের ক্যানভাস বাগটা নামিয়ে আনলাম সামনে। সে'টার মধ্যে একটা মারাত্মক দামী জিনিস আছে। স্টিলের তোবড়ানো একটা বড়সড় টিফিনবাক্স। বাক্সটা হাতে নিয়ে খানিকক্ষণ উলটেপালটে দেখলাম। এমন সময় হাত-কুড়ি দূরে একটা গ্রেনেড এসে পড়লো; দড়াম! বাঁ কানে গত দু'হপ্তা ধরে তালা লেগে আছে, সে'টা একদিক থেকে বাঁচোয়া; গ্রেনেডের শব্দের চোট শুধু ডান কানেই পড়লো। যাক গে। আসল ব্যাপার হলো এই টিফিন বাক্সটা।
টিফিনবাক্সের ঢাকনাটা সেঁটে বসে আছে অনেকদিন হলো। রোজকার মতই এখন আমার কসরত শুরু হবে সে ঢাকনা খোলার। মাথার ওপর দিয়ে খান ছয়েক বোমারু বিমান উড়ে গেল, তাদের উড়ে যাওয়ার সুরে দুলে দুলে হেই সামালো বলে টিফিনবাক্সের প্যাঁচে জোর লাগালাম। আজও খুললো না। অগত্যা ব্যাগ হাতড়ে দু'টুকরো শুকনো পাউরুটি বের করলাম। অগত্যা বলছি বটে, এই টিফিন বাক্স আমি গত তিন বছরে খুলতে পারিনি। প্রথম হপ্তা-দুই একটা পচা গন্ধ বেরিয়েছিল। সম্ভবত রুটি-সবজির। কী সবজি কে জানে। মিরুস্কিয়াকে যে জিজ্ঞেস করে জানবো যে সবজিটা কীসের ছিল তারও উপায় নেই। যে'দিন এ টিফিন সে আমার ব্যাগে গুঁজে দিয়েছিল, সে'দিন আমাদের বাড়িতে বোমা পড়ে।
আমি যে ভাঙা বাড়ির চাতালে বসে আছি, তার উল্টোদিকে বাড়ির তিনতলার ব্যালকনি থেকে ঝুপ করে একটা সৈনিকের লাশ সোজা পড়লো সামনের রাস্তার ওপর। বাইনোকুলারে চোখ রেখে দেখলাম দু'সেকেন্ড। ওঁর নাম ব্রুক্রসভ, আমার চেয়ে বছর সাতেকের ছোট। আলুর পাইকারি ব্যবসা ছেড়ে স্নাইপিং ধরতে হয়েছিল তাঁকে। সামান্য খারাপ লাগলো বটে, তবে টিফিন-টাইমে এ'সব ব্যাপারে বেশি মাথা না ঘামানোই ভালো। ফের পাউরুটিতে কামড় দিলাম। সামান্য বাসি, তবে বাসি পাউরুটির একটা দিব্যি স্বাদ আছে। এর সঙ্গে একটু মাংসের ঝোল পেলে জমে যেত। মাংস রাঁধত বটে মিরুস্কিয়া। অবশ্য শুধু মাংস কেন, শাকপাতা যাই রাঁধত মনে হত অমৃত। ওর হাতে সত্যিই জাদু ছিল। ওর শেষ রান্নাতেও কী তুকতাক ছিল কে জানে, আজ পর্যন্ত টিফিনটা খুলতেই দিল না। রোজ দুপুরের টিফিন-টাইমে চেষ্টা করি, সে ঢ্যাঁটা স্টিলের টিফিনবাক্স কিছুতেই খোলে না।
ধড়াম! আমার থেকে বড়জোর দেড় ফুট দূরে একটা বড় কংক্রিটের চাঁই পড়লো।
হাসলাম, যদ্দিন স্টিলের টিফিনের ঢাকনা খুলছে না, তদ্দিন এ যুদ্ধ আমায় স্পর্শ করতে পারবে না। মিরুস্কিয়া যে জাদুতে এই টিফিন সাজিয়ে গেছে, সেই জাদুই আমায় বাঁচিয়ে রাখবে। যে'দিন ঢাকনা খুলবে, সে'দিন মিরুস্কিয়ার সঙ্গে আবার দেখা, ফের তাকে টিফিন সাজাতে বসতে হবে যে।
(ছবিঃ জেমিনাই)
No comments:
Post a Comment