-আরও দু'টাকা।
- ওহ, আরও দুই। তা'হলে, ওই টাকায় দুমড়োগড় হবে?
- তা'তে আপনার কী? রেলের টিকিট কাউন্টারে বসেছেন, ঘটাঘট টিকিট দেবেন। অত কথায় কাজ কী?
- দুমড়োগড় একই ভাড়া। তা'হলে দুমড়োগড় দিচ্ছি।
-হরিপোতা হবে?
- ইয়ার্কি পেয়েছেন?
- আরে ফেয়ার চার্টটা ঝুলিয়ে রাখবেন তো। নয়তো খামোখা এমন ইনকুয়েরি ফেস করতেই হবে।
- এতটুকুন তো গাঁয়ের স্টেশন। ডাউনের দিকে একটা ফেয়ার চার্ট ছিল, মাস-ছয়েক আগে কালবৈশাখীতে সে'টি উড়ে গেছে। তা'হলে হরিপোতা দিই?
-বিলখাজুলিপুর? হবে?
- না, ও;খান থেকে ভাড়া বেড়ে যাচ্ছে। আরও দু'টাকা।
- তা'হলে আমায় একটা হরিপোতার টিকিট দিন।
- এই যে। আসুন।
-ইয়ে, বলছিলাম, পরের ট্রেনটা কখন?
- দুপুর পৌনে তিনটে।
- সর্বনাশ। সে যে আরও সোয়া ঘণ্টা।
- পাড়াগাঁয়ের স্টেশন। সব ট্রেন তো দাঁড়ায় না। একটা ডেমু লোকাল যাবে এই আধঘণ্টার মাথায়, সে'টার স্টপ নেই।
-মহামুশকিলে পড়লাম তো মশাই।
- খুব ঝামেলার ব্যাপার থাকলে স্টেশন থেকে বেরিয়ে টোটো পেলেও পেতে পারেন। অবশ্য হরিপোতা খুব একটা কেউ যেতে চায় না, রাস্তার কন্ডিশন যা হয়েছে আজকাল।
- আরে টোটো বললেই টোটো নেওয়া যায় নাকি। ফশ্ করে শ'দুয়েক টাকা বেরিয়ে যাক আর কী।
- তা বটে। তবে ওর কমে তো হবে না। আপনি বরং স্টেশনেই খানিকটা জিরিয়ে নিন গে।
- আপনাদের এখানে কোনও ওয়েটিং রুমটুম আছে?
- প্ল্যাটফর্মটা বাঁধিয়ে দিয়েছে এই ঢের। এ'খানে আলাদা করে আর কোনও ওয়েটিং রুম নেই। গাঁয়ের লোক টুক করে ছুটে এসে ট্রেন ধরে। যার যা ওয়েট করার নিজের বাড়িতেই সেরে বেরোয়। একটা অ্যাসবেসটসের ছাত ছিল প্ল্যাটফর্মের ওই বেঞ্চিগুলোর ওপরে। সে'টাও গেছে।
- ওহ, সেই ঝড়ে উড়ে গিয়েছে?
- রেলের কাছে তাই রিপোর্ট করেছি বটে। তবে আপনি বাইরের লোক তাই বলতে বাঁধা নেই। এ গাঁয়ে বিস্তর চোরছ্যাঁচড়ের বাস, আর তাঁদের কাপ্তেন হলো মধু সামন্ত। অ্যাসবেসটস সেই হাতিয়েছে।
- ডেঞ্জারাস লোক তো মশাই আপনাদের মধু সামন্ত।
- ডেঞ্জারাস বলে ডেঞ্জারাস। এককালে হেঁজিপেঁজি পকেটমার ছিলো। দিনে দিনে রোয়াব বেড়েছে, ছিনতাই খুনখারাপি কোনোটাই বাকি রাখেনি। শিয়ালদা পর্যন্ত তাঁর রেপুটেশন পৌঁছে গেছে।
-অন্তত অ্যাসবেসটসের ছাত থাকলে একটু বেঞ্চির ওপর লম্বা হতে পারতাম। এখন যা রোদ্দুর...।
- গামছা আছে?
- আজ্ঞে?
- গামছা, গামছা আছে আপনার ওই বাক্সতে?
- আছে কিন্তু কেন বলুন তো...।
- ডাউনের দিকে খানিকটা এগোলে দেখবেন একটা টিপকল আছে। সে'খান থেকে গামছা ভিজিয়ে নিন। তারপর সে গামছা মুখে মেলে বেঞ্চিতে শুয়ে পড়ুন। টিপকলের ভেজা গামছা মশাই জোড়া-ফ্যানকে হার মানাবে। কোথায় লাগে অ্যাসবেসটসের শুকনো ছায়া।
-তারপর ভেজা গামছা আবার সুটকেসে ভরব কী করে?
-যা রোদ্দুর, ট্রেন আসার আগে শুকিয়ে যাবে।
-নাহ্। ব্যাপারটা সুবিধের নয়। আচ্ছা টিকিট-দাদা, স্টেশনের ধারেকাছে কোনও ভাতের হোটেল পাবো? খিদেটা বিশ্রী ভাবে চাগাড় দিয়েছে।
-মাইল চারেক হাঁটলে বহুধুলির হাট, সে'খানে চপ-মুড়ির দোকান-টোকান পেলেও পেতে পারেন। সমাদ্দারদের মিষ্টির দোকানও আছে সে'খানে, এখনও সে'খানে তিনটাকা পিস রসগোল্লা পাবেন। আহা, গত মাসে খেয়েছিলাম। তুলতুলে। সুমিষ্ট। আহা।
-অদ্দূর হেঁটে যাওয়া এ সময় চাট্টিখানি কথা নয়।
-তা বটে। ইয়ে, আমি আবার আমার টিফিনটা আজ একটু সকাল-সকাল সাফ করে ফেলেছি কিনা, নয়তো আপনাকে ঝিঙেপোস্ত আর চাট্টি ভাত খাওয়াতে পারতাম।
-ঝিঙেপোস্ত আর ভাত। সে সুখ কী আর কপালে আছে গো টিকিটদাদা।
-গামছা না শুকোনোর ভয়ে টিপকলে ভেজাতে পারছ না ভায়া, ও কপালে ঝিঙেপোস্ত ভাতের সুখ সহজে জুটবে না।
- দাদাগো, কী কথাটাই না বললে। বুকের ভিতরটা কেমন হুহু করে উঠলো। গামছা ভেজানোর ধক নেই এ'দিকে চলেছি সন্ন্যাস নিতে।
- অ্যাঁ! বলো কী হে। দিব্যি পেটাই চেহারার জোয়ান মানুষ, সংসার ছেড়ে সরে পড়লে? আর যেতে হলে পরিব্রাজক হয়ে মানস সরোবরে যাও, হেঁটে বর্মার জঙ্গল পেরিয়ে কম্বোডিয়ার দিকে যাও। শেষে কিনা হরিপোতা আর বিলখাজুলিপুরের রেলটিকিটের হিসেব কষে হদ্দ হচ্ছ? আরে লোকে হাসবে যে।
-গুরুদেবের আশীর্বাদ নিয়ে হুট করে বেরিয়ে পড়লাম। সন্ন্যাস নিতে হলে অত ভাবনা চিন্তা চলে না কিনা। কিন্তু বেরিয়ে দেখছি হিমালয় যেতে হাজার রকমের হ্যাপা। তাই ভাবছিলাম লোকাল-ট্রেন ধরে হালকা চালে এগোই আর কী...। এগোতে এগোতে দিন-তিনেকে এদ্দূর এসে পৌঁছলাম। ভাবছিলাম এই আজ বিলখাজুলিপুর কাল বখতিয়ারপুর হয়ে পরশু না হয় তরশু অন্তত রাজগির পৌঁছে যাওয়া যাবে আর কী।
**
- অ্যাই খোকা! অ্যাই!
- আহ বাবা, অত চিল্লিও না দেখি। কানে বেদনা হয়।
- ওরে আমার কান-বেদনার নবাব এলেন রে। শালা সন্ন্যাস নিবি হ্যান নিবি ত্যান নিবি কতরকম বাতেলা দিয়ে বেরোলি। হপ্তা না গড়াতেই আবার ফেরতও এলি! আর এখন তোর সুটকেস খুলে দেখি ভেজা গামছা শুকনো কাপড়ের সঙ্গে মুড়ে নিয়ে চলে এসেছিস?
- তুমি আমার সুটকেস খুলতে গেলে কেন শুনি?
- আরে ভাবলাম ট্রেনে করে ফিরলি, হয়তো দু'চার প্যাকেট বাদাম-টাদাম এনেছিস হয়তো। খুলেই দেখি সর্বনাশ! ভেজা গামছা সুটকেসে পুরে এনেছে। আচ্ছা আহাম্মক তো। সমস্ত কাপড়জামায় ছাতকুরা পড়ে যাবে যে।
- তোমার এই অ্যাটিচিউডের জন্যেই আমার সন্ন্যাস নেওয়া হচ্ছে না বাবা।
- যাচ্চলে, আমি আবার কী করলাম।
-আর তোমার সঙ্গে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। বলছিলাম, আজ একটু ঝিঙেপোস্ত করবে? ভাতটা না হয় আমি বসিয়ে দেব।
-ও বাবা। সন্ন্যাস ভুলে পোস্ত?
-কদ্দিন খাইনি।
- তা বটে। তাই হোক। তোর মা বড় ভালো রাঁধত পোস্তর আইটেম।
- গামছাটা দাও দেখি আমায়। বারান্দায় মেলে আসি।
No comments:
Post a Comment