Sunday, March 16, 2025

এমার্জেন্সি ফান্ড



সুমন্তবাবুর ঘুম ভাঙলো সকাল সোয়া সাতটা নাগাদ। অফিসের জন্য রোজ সাড়ে ছ'টায় না উঠলে চলে না কিন্তু আজ রোব্বার, এই দিনটায় বাড়তি গড়িমসি চলতেই পারে। নীলা আর বুবুন হয়তো আরো মিনিট পনেরো-কুড়ি পরে উঠবে। ততক্ষণে সুমন্তবাবু ফ্রেশ হয়ে এক কাপ কফি বানিয়ে সোফায় এসে বসছেন। খবরের কাগজের ওপিনিওন সেকশনটার প্রতিই তাঁর যাবতীয় আগ্রহ। সে'খানে খানদুই প্রবন্ধ পড়ে-টড়ে চার্জার সরিয়ে মোবাইল হাতে নিলেন।

অনিল আর চন্দন ব্রাঞ্চ খাওয়ার জন্য ডেকেছে; জমজমাট আড্ডা হবে। কোস্টাল স্পাইস বলে একটা রুফটপ রেস্টুরেন্ট খুলেছে, সীফুড সে'খানকার স্পেশ্যালিটি, বিয়ার-টিয়ারও পাওয়া যায়। আড্ডাটা ভালোই জমবে, কিন্তু রেস্টুরেন্টের মেনুটা জোম্যাটোয় দেখে নিজের মাথা চুলকে মৃদু হাসলেন সুমন্ত। ঝটকা মেরে খরচ করাই যায়, কিন্তু সুমন্ত জানেন যে মাথার মধ্যে একটানা হিসেব চললে আড্ডা আর ব্রাঞ্চ কোনোটাই জমবে না। এর চেয়ে বরং পরের হপ্তায় দু'জনকে বাড়ি ডেকে নেওয়া যাক। কফি-পকোড়ার সঙ্গেও দিব্যি আড্ডা জমানো যায়। তা'ছাড়া ওল্ডমঙ্কের ব্যবস্থাও করা যাবে। পত্রপাঠ হোয়্যাটস্যাপে অনিল আর চন্দনকে বলে দিলেন যে আজ হচ্ছে না, পরের শনিবারের নেমন্তন্নও জুড়ে দিলেন। সুমন্ত জানেন যে মার্চের পর ব্যাঙ্ক ব্যালেন্সের চাপ একটু কমবে। তখন না হয়ে একটা হঠকারী ব্রাঞ্চ সেরে ফেলা যাবে অনিল আর চন্দনের সঙ্গে।

এরপর পায়ে কেডস গলিয়ে বেরিয়ে পড়লেন সুমন্তবাবু। ঘাম ঝরানো দ্রুততায় পাঁচ কিলোমিটার হন্টন। শেষ জানুয়ারির সকাল, রোদ্দুরে তেজ নেই, হাওয়ায় অল্প শীত। হাঁটা শেষ করে সবজি-বাজার ঘুরে যখন বাড়ি ফিরলেন ততক্ষণে বুবুনের ব্রেকফাস্ট হয়ে গেছে। বাপ-ব্যাটার একটা রবিবাসরীয় অঙ্কক্লাস বসে। থ্রি-তে পড়া বুবুন এখন ফ্র্যাকশন আর পার্সেন্টেজ নিয়ে ধ্বস্তাধস্তি শুরু করেছে, সুমন্ত বুবুনের অঙ্ক-কুস্তির কোচ। অঙ্ক করা শেষ হলে বুবুন গেল খেলতে আর সুমন্তবাবু বসলেন গল্পের বই নিয়ে।

নীলা বেলার দিকে এক কাপ চা খায়। নীলার চায়ে চুমুক, সুমন্তর গল্প পড়া আর দু'জনের খোশগল্প একই সঙ্গে এগিয়ে যায়। সেই গল্পে একটা জবরদস্ত ইভিনিং আউটিংয়ের প্ল্যান হলো। সিনেমা, থিয়েটারের পপকর্ন আর নাচোস, ফেরার পথে পিজ্জা আর ঘরে ঢোকার মুখে ডার্ক চকোলেট আইসক্রিম। দু'জনে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করলো প্ল্যানটা আর ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স নিয়ে খুব একচোট হাসাহাসি করে সে প্ল্যান বানচাল করলে। নীলা সুমন্ত দু'জনেই জানে এ'টা অভাব নয়, এ নিয়ে গলা শুকোনো অন্যায়। তবে পপকর্ন পিজ্জাকে টেক্কা দিতে প্ল্যান হলো বিকেলে পেঁয়াজি ভাজার, ওই জিনিসটা বুবুনের সবিশেষ প্রিয়। ডিনারে মুর্গির ঝোল না করে সুমন্তত স্পেশ্যাল চিলি চিকেন আর নীলার সেই দুনিয়াজয় করা এগ-সেজওয়ান ফ্রায়েড রাইস। অবশ্য একটা 'লাক্সারি' রাত্রের নতুন প্ল্যানে ঢুকেই পড়লো। ডিনারের পর স্কুটারে চেপে মিষ্টি পান খেতে যাওয়া। সুমন্তবাবু নিশ্চিত যে মার্চের পর যখন ফিনান্সিয়াল সিচুয়েশনটা একটু বাগে আসবে, তখন এই সিনেমা-নাচোস-পপকর্ন-পিজ্জা-আইসক্রিম প্ল্যানটা একদিন দিব্যি এক্সেকিউট করা যাবে। সুমন্তর মাথায় সে অঙ্কটা স্পষ্ট ছকে রাখা আছে।

দুপুরে অবশ্য শনিবারের রান্না ট্যাংরার ঝালই ক্যারি ফরওয়ার্ড হয়েছিল। তার সঙ্গে 'উম্ফ-ফ্যাক্টর' হিসেবে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল আলু ফুলকপি ভাজা আর ডিমের মামলেট। খাওয়া শেষ করে ফের সুমন্তর গল্পের বইয়ে ডাইভ, এইসময়টায় আর কোনো গল্প নয়। এই ঘণ্টাখানেক গল্পের বইতে ডুবে থাকাটাই সুমন্তর যোগনিদ্রা। দুপুর তিনটে নাগাদ অফিসের কিছু খুচরো কাজ নিকেশ করার জন্য ল্যাপটপ খোলা, বড়জোর একঘণ্টা কিন্তু এতে সোমবারের সকালটা একটু কম হুড়মুড়িয়ে কাটে। কাজ শেষ হলে আমাজনে ঢুকে কার্টটা দেখলেন। নীলা বেশ কিছু পছন্দের জিনিস কার্টে সাজিয়ে রেখেছে; বুবুনের জন্য কিছু দামী বই, ঘর-সাজানোর জিনিস, এইসব। মার্চের পর এগুলো আনানো যাবে'খন।

বিকেলের কফি-পেঁয়াজি খেয়ে আর এক রাউন্ড হাঁটতে বেরোনো, ফের পাঁচ কিলোমিটার মত, তবে এ'বার দুলকি চালে। কানে ইয়ারফোনে একের পর এক গজল। ফিরলেন যখন তখন সন্ধে সাতটা। নীলার মুখে সামান্য চিন্তা, সে'টা সহজেই আঁচ করতে পারেন সুমন্ত। নীলা জানালে দীপক ফোন করেছিল, নীলার পিসতুতো দাদা। সে একটা বিশ্রী বিপদে পড়েছে, বেশ কিছুটা টাকার দরকার। নীলার আর সুমন্ত মুখোমুখি বসে বেশ খানিকটা হিসেব করলেন। দীপকের বিপদটা সাজানো নয়, সত্যিই টাকার দরকার। নীলা-সুমন্তর একটা এমার্জেন্সি ফান্ড আছে, সে'টা দিয়েই এ যাত্রা দীপককে উতরে দেওয়া যাবে।

নীলা শুধু একবার মৃদুস্বরে প্রশ্ন করলো, "তুমি শিওর তো"? সুমন্ত উত্তমকুমারের স্টাইলে হাসার চেষ্টা করলে যে'টা করলে তাঁকে দেখে যে কেউ হেসে ফেলবেই, নীলাও হেসে ফেললো। সুমন্ত বুঝলেন যে অনিল-চন্দনের সঙ্গে ব্রাঞ্চ, সিনেমা-পিজ্জা আর আমাজনের কার্ট পরিষ্কার এই মার্চেও হচ্ছে না। অঙ্ক বলছে আগামী জুলাইয়ের আগে সে'দিকে বিশেষ সুবিধে করা যাবে না। তবে এর চেয়েও বড় ব্যাপার হচ্ছে, বুবুনের অঙ্কের ভয় আর সুমন্তর বাড়তি ওজনটা ক্রমশ কম চলেছে। হেমন্তের একটা সুপারহিট গান গুনগুন করতে করতে রান্নাঘরে ঢুকলেন সুমন্ত; হাইক্লাস চিলি চিকেন বানাতে হবে তো।

No comments: