Sunday, March 16, 2025

ছোট আর বইমেলা



- ভূতের গল্প পড়ছিস বড়দা?
- না। হাড়কাঁপানো প্রেমের গল্প।
- ও। তা, ঘুমোবি কখন রে?
- কী চাই?
- বলছিলাম, কাল অফিসের পর বইমেলায় যাবি?
- আমি গেলে তোর কী লাভ ছোট?
- না মানে, আমিও ঘুরতাম তোর সঙ্গে। ও'দিকেই একটা টিউশনি ছিল। সে'খান থেকে বেরিয়ে না হয়..।
- ফার্স্ট ইয়ারের লায়েক ছোকরা। ইয়ারদোস্ত থাকতে আবার এই গোবেচারা বড়দাকে কী দরকার।
- ইয়ারদোস্ত তো আর বই কেনাকাটা স্পন্সর করে না।
- বেশ তো। আমি টাকা দিয়ে দেব। বই কিনিস পছন্দমত।
- তুই আমায় সাইড করছিস কেন বল তো? প্রেম করতে যাবি নাকি বইমেলা?
- কান ছিঁড়ে নেবো ডেঁপোমি করলে।
- যাচ্ছি কি আমরা বইমেলায়? সোজাসুজি বল।
- ঠিক আছে। পাংচুয়ালি সাড়ে পাঁচটায় চার নম্বর গেটের সামনে দেখা করবি। আর ঘোরার সময় বকবক কম করবি, দেখবি বেশি।
- কিপটেমো করবি না তো?
- পিঠের চামড়া গুটিয়ে নেব ছোট।
- আচ্ছা দাদা, বইমেলা ঘুরে কোথাও রুটি মাংস খেতে যাবি?
- এই দ্যাখো। বসতে দিলে শুতে চায়।
- চ' না রে। এত ভালো চাকরি করছিস। আজ বাবাকে দামী রেজার তো কাল মাকে কানের দুল কিনে দিচ্ছিস। আমার ব্যাপারেই যত হিসেব।
- আর কোনো ফরমায়েশ আছে?
- ট্যাক্সি করে বাড়ি ফিরব প্লীজ। রুটি মাংসের পর বই বোঝাই ব্যাগ হাতে বাস-ট্রাম ভালো লাগবে না।
- ছোট। তোর হাবভাব ভালো বুঝছি না।
- তা'হলে সে কথাই রইলো?
- এখন ভাগ। রাত অনেক হয়েছে।
***
ছোট ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বইটা বন্ধ করে খাটের পাশের টেবিলে রাখলেন সুবিমল। এখন কিছুক্ষণের অপেক্ষা। একটু পরেই ঘুম ভাঙবে। তখন এই টালিগঞ্জের বাড়ির পুরনো ঘরটা উবে গিয়ে নিউটাউনের ফ্ল্যাটের সবুজ দেওয়াল স্পষ্ট হবে। সামনের দেওয়ালে এখন যে মা তারা হার্ডওয়্যার স্টোর্সের ক্যালেন্ডার চোখে পড়ছে, তার বদলে দেখা যাবে ফটোর-ফ্রেমে বাবা-মা। ওদের ফটোর ডানদিকে ছোটর ফটো।
স্বপ্নটা এখন গা-সওয়া হয়ে গেছে সুবিমলের। মাঝেমধ্যেই ঘুরে ফিরে আসে। ছোটর সেই একই আব্দার। কত বছর আগে সেই অফিসের বিশ্রী একটা মিটিংয়ে আটকে গিয়ে বইমেলায় যাওয়া হয়নি সুবিমলের। তখন মোবাইল-টোবাইল ছিল না তাই ছোটকে জানানো হয়নি। সে বেচারি একাই ঘুরেছিল হয়তো বইমেলা, কিন্তু বড়দা না থাকায় বিশেষ কেনাকাটা করতে পারেনি। আর পারেনি বাড়ি ফিরতে; রাস্তা পেরোতে গিয়ে দুর্ঘটনা । সেই থেকে সে বারবার সুবিমলের স্বপ্নে ঘুরে ফিরে এসে ঝুলোঝুলি করে, "বইমেলা যাবি বড়দা"।
স্বপ্নটা দিব্যি চিনতে শিখেছেন সুবিমল। এই দু'ণ্ডের আব্দারটুকু এখন তাঁর অভ্যাস। স্বপ্নে ছোট অন্তত তাঁকে সেই পুরনো বাড়িতে এনে ফেলে বারবার। সে জগতে পাশের ঘরে বাবা-মা শুয়ে। অন্য ঘরে অঙ্ক করার অছিলায় ছোট রেডিওয় হিন্দী গান শুনছে। আর নির্ঘাৎ পরের দিন কী কী বই কিনবে তার ছক কষছে। প্রথমদিকে মনকেমন হত, এখন এ স্বপ্নের জগতটা উপভোগ করেন সুবিমল। মাঝেমধ্যে সন্দেহও হয়, নিউটাউনের ছোট-হীন জগতটাই আদতে স্বপ্ন নয় তো? কাল হয়তো সত্যিই বইমেলা যাওয়ার আছে?
বালিশে মাথা রেখে চোখ বুজে ছোটর রেডিওয় বেজে চলা সুরটা চেনার চেষ্টা করলেন সুবিমল। ছোটকে কাল বইমেলা ঘোরনোর পর পার্ক স্ট্রিটে নিয়ে গিয়ে চাইনিজ খাইয়ে চমকে দিলে কেমন হয়?

No comments: