রোব্বার দুপুর। অফিসের আরামদায়ক চেয়ারে আলতো গা এলিয়ে জুম কলে একটা রিভিউ নিচ্ছি। হায়দ্রাবাদে বসে থাকা সেলস-হেড রেড্ডি আর আমাদের গোরখপুরের ফ্যাক্টরি ইনচার্জ দত্তকে বেদম ডিজিটাল ধোলাই দেওয়ার মধ্যে একটা জমাট তৃপ্তি আছে, সে'টা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছি। আর্দালি পরিমল দরজার বাইরে টানটান ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে; মাঝেমধ্যে বেল বাজিয়ে তার স্পীড চেক করতেও বেশ লাগে। "পানি লাও", "কফি লাও", "ইডলি লাও", "এসি তেজ করো"; এমন রকমারি ফরমায়েশ ডাইভ দিয়ে লুফে নেওয়ার জন্য ও সদা-প্রস্তুত।
আমার টেবিলের উল্টো দিকে গোবেচারা মুখে বসে অপারেশনশের প্যাটেল আর ফিনান্সের সচদেব; ওরা জানে যে জুম মিটিং শেষ হলে ওদের কপালে আড়ং ধোলাই আছে। ওদের এই তটস্থ হয়ে থাকাটা জরুরী; এদের দমিয়ে না রাখলে মাথায় উঠে ড্যাংড্যাং করে নাচবে, কোম্পানির প্রফিটেবিলিটি কমবে। বিশেষত ছুটির দিনে কড়কাতে পারলে আউটপুট বেশ এনহ্যান্সড হয়। আগামী উইকেন্ডে যেমন অফিস ছেড়ে ফিল্ডে বেরোব। বিলাসপুর অফিসে গিয়ে সে'খানকার টীমের ওপর একটু তম্বি করে আসা যাবে, পাশাপাশি কিছু নতুন মানুষদের জী-হজৌরিও আদায় করা হবে।
জুম শেষ হলে পরিমলকে ক্যাপেচিনো দিতে বলে সচদেবের নিয়ে আসা ফাইল খুললাম। আড়চোখে দেখলাম সচদেব রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছলে। এসি ফেল পড়ছে ব্যাটার এমন নার্ভাসনেস। নাহ্, শক্ত হাতে এদের বেঁধে যে রাখতে পেরেছি, সে'টাই নিশ্চিন্দি। রিপোর্টে তেমন ভুল না পেয়ে ফন্ট সাইজ নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করলাম। সচদেব মারাত্মক ভেবড়ে গিয়ে সরিটরি বলা আরম্ভ করলো, আর সেই সুযোগে আমি অ্যাটেনশন টু ডিটেল আর এক্সেলেন্সের যোগাযোগ নিয়ে একটা ছোটখাটো লেকচার দিয়ে ফেললাম। সচদেব আর প্যাটেল এমন "বাহ্ বাহ্" শুরু করলে যেন আমি গজল গাইছি আর ওর তিন পেগ গিলে দুলে দুলে গান শুনছে।
দামী ক্যাপেচিনোতে চুমুক দিতে দিতে জ্ঞান ঝাড়তে ঝাড়তে মেজাজে একটা জেল্লা চলে এসেছে; এমন সময় ঝুমার ফোন এসে সব মাটি করলে। কানে রিসিভার ঠেকানো মাত্র ইলেক্ট্রিক শকের মত চিৎকার:
"রোব্বারের বিকেল হতে চললো অথচ বাড়ি ফেরার নাম নেই! বলি বাড়ির কাজকম্ম কিছু আছে না নেই"?
"আর বলো কেন, অফিসে এত প্রেশার! দিনে চল্লিশ ঘণ্টা কাজ করলে তবে..."। ঝুমা ছাত্র ঠ্যাঙানো দিদিমণি, যুক্তিনিষ্ঠ বিরক্তিকর মানুষ। বিয়ের এত বছর পরেও ওর দাবড়ানি শুনলে এখনও আমার বুক কেঁপে ওঠে।
"থামো! যত বাতেলা! তোমার শালা আসছে, কোথায় বাড়িতে বসে ঘর গোছাবে, ফ্যানের ঝুল সাফাই করবে, মাছ ধোবে, ময়দা মাখবে...তা নয়.."।
"আহা তুমি বুঝছো না ঝুমা.."।
"তুমি আধঘণ্টার মধ্যে ঘরে ফিরবে কিনা বলো..."
"ইয়ে আমার আরো ঘণ্টাখানেক লাগবে। আসলে একটা ক্রিটিকাল মিটিং শিডিউল করা আছে। সে'টা অ্যাটেন্ড না করলেই নয়"।
খট্। ঝুমা ফোন কেটে দিয়েছে। বাপর বাপ, কী তেজ। গলা শুকিয়ে এসেছে। পরিমলকে একটা বড় গ্লাস গোলাপজল মেশানো লস্যি দিতে বলে আর সচদেবকে বেধড়ক চাবকানি দিয়ে তবে পিলে সামান্য ঠাণ্ডা হলো। এরপর প্যাটেলকে বললাম ঝটপট একটা অল ইন্ডিয়া লেভেলের জুম মিটিং ডাকতে। প্যাটেল অবাক হলে না, সে জানে যে সন্ধে পেরিয়ে রাত না হলে আমার অফিস থেকে বেরোতে ইচ্ছে করে না; সে কী সোম আর কী রবি। বাড়ি গেলে তো সেই ঝুমার খটরমটর আর হাবিজাবি কাজ। তার চেয়ে ভালো আমার এই অফিসের জমিদারিই ভালো।
আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না বোকাপাঁঠা মানুষজন ছুটি চেয়ে হন্যে হয় কেন? এরা কি কেউ কোনোদিন এক্সেলেন্সকে চিনতে শিখবে না?
**
(ছবিটা এঁকেছে জেমিনাই)
No comments:
Post a Comment