২০২৪য়ে পড়াশোনা ব্যাপারটা কেমন হলো? দিব্যি। তবে সবচেয়ে বড় খবর হলো আমি আবার ফিকশনে ফিরতে পেরেছি। এই ব্যাপারটা যেমন আনন্দের তেমনই স্বস্তির। ইতিহাস, রাজনীতি, ফিলসফি ইত্যাদিতে ধার থাকলেও সে'গুলোর মধ্যে রয়েছে ওই জিমে গিয়ে ঘাম ঝরানোর মেজাজ। সমুদ্রের হাওয়া গায়ে লাগিয়ে হেঁটে বেড়ানোর সুখ রয়েছে ফিকশনে। জিমে গিয়ে শরীর মজবুত হয় হয়তো কিন্তু আয়ু বাড়ে ওই ফতুয়া-গায়ে সৈকত-বিহারে।
ফিকশনে ফিরতে পারার মূলে রয়েছে সেই মোক্ষম ওষুধ; শিশুসাহিত্য। ই বি হোয়াইটের শার্লটস ওয়েব দিয়ে শুরু করেছিলাম।ব্যক্তিগতভাবে সময়টা সুবিধের ছিল না, সেই সময় ও'রকম মনকেমন আর মনভালো মেশানো লেখার যে কী দরকার ছিল। ভালো লেখা পড়তে গিয়ে বয়সের হিসেব করাটা মুর্খামি। হাই-কোয়ালিটি শিশুসাহিত্য বুড়ো বয়সে পড়লেও হাই-কোয়ালিটিই মনে হবে; থাম্বরুল সে'টাই। বার্লি ডোহার্টির স্ট্রিট চাইল্ড ছোটোদের লেখা হলেও জাতে শার্লটস ওয়েবের ঠিক উল্টো। খানিকটা ডিকেন্সিয়ান, তবে তা'তে আলো অনেক বেশি। মন খারাপের গল্প, তবে মনখারাপটাই সে গল্পের শেষ কথা নয়। সে গল্প যুদ্ধজয়ের। এরপর আমাদের পুত্রের জন্মদিনে তার মা তাকে উপহার দিলে একটা রোল্ড ডালের সেট, তা'তে বাপ-ব্যাটা দু'জনেরই উপকার হলো। স্যাটাস্যাট পড়ে ফেললাম খান কয়েক বই যেমন জেমস অ্যান্ড দ্য জায়্যান্ট পীচ, চার্লি আর চকোলেট ফ্যাক্টরি, বিএফজি আর ম্যাটিলডা। আমি তিরিশ পেরিয়ে হ্যারি পটার পড়েছি। আর প্রায়-চল্লিশে ধরলাম রোল্ড ডালকে। ভদ্রলোক আমায় জাস্ট কিনে, প্যাকেটে মুড়ে, নিজের পকেটে রেখে দিয়েছেন। ডালবাবুর পকেট ছেড়ে আমি আর বেরোতেও চাইনা। জেমস, ম্যাটিলডা আর চার্লি অনবদ্য, সে নিয়ে বাড়তি কথা বলে আর হবেটা কী। শুধু বলি যে ওর বিএফজি বইটা আমি মাঝেমধ্যে খুলে পাঁচালির মত ভক্তিভরে পড়ি। সে জায়্যান্টের ভাষা আমার কানে গুলজার-প্রো-ম্যাক্স, আর ওই বই আমার চোখে আদত ইকিগাই।
হ্যারি পটারের কথা বললাম। তা সেই গোটা সিরিজটা নিয়ম করে বছর দু'আড়াই অন্তর পড়াটা একটা দায়িত্বের মধ্যে পড়ে গেছে। আমার ছেলের বয়স এখন ৮, ক্রমশ এই সিরিজটা হ্যারির চোখ দিয়ে নয়, বাপ-মায়ের চোখ দিয়ে অ্যাপ্রিশিয়েট করতে শুরু করেছি। প্রতিটা ধাপে যে কথাটা সবার আগে মনে হয় সে'টা হলো "আহা রে, ওর বাপ-মা নেই"। মিরর অফ এরিসেড তাই আরও বেশি মনখারাপের। ডাম্বলডোরের "আমার ভয় কীসের, তুমি সঙ্গে আছো যে হ্যারি" আরও বেশি সুমধুর। সিরিয়াস ব্ল্যাকের ডানপিটেমোর ওপর মিসেস উইজলির বিরক্তিটা যেন অনেক বেশি যুক্তিযুক্ত মনে হচ্ছে। আর ভাই, রোলিং যে কী মহাকাব্য লিখেছেন। ওই জিনিস পড়লে কোনও সিনেমা দেখার প্রয়োজন পড়ে না। ওই সিরিজের সাতটা বইয়ের মধ্যে কোনটা আমার সবচেয়ে বেশি প্রিয়? আলাদা একটা বই হিসেবে দেখতে গেলে নির্ঘাৎ প্রিজনার অফ আজকাবান। গবলেট অফ ফায়্যারটা আমার প্রথমবার পড়ে তেমন মারকাটারি মনে হয়নি, কিন্তু এদ্দিনে বইটা ক্রমশ বেশ জমাটি মনে হচ্ছে। তবে আমার নতুন ফেভারিট বোধ হয় অর্ডার অফ দ্য ফিনিক্স। কারণ ডলোরেস আম্ব্রিজের মত হাড়বজ্জাত চরিত্র আর নেই। এই এতবারের পর এ'বারেও পড়তে বসে আম্ব্রিজের প্রতি রাগের চোটে যে কতবার সোফা খামচেছি বা টেবিল আঁচড়েছি তার ইয়ত্তা নেই। আর ওই বইয়ের ক্লাইম্যাক্স - সে'টা লাখটাকার। ওহো, এ'খানে বলে রাখা ভালো যে হ্যারি পটার সিরিজ আজকাল আমি মূলত শুনি (আর কখনোসখনো পড়ি)। স্টিফেন ফ্রাইয়ের কণ্ঠ আমার হ্যারি পটারের এক্সপিরিয়েন্সের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। কী আশ্চর্য, ডাম্বলডোর থেকে হ্যাগ্রিড, জর্জ উইজলি থেকে নিম্ফাডোরা আর হার্মায়োনি থেকে বেলাট্রিক্স - সবার গল্প আমি জানি রোলিংয়ের ভাষায় কিন্তু তাঁদের পার্সোনালিটি আমি আত্মস্থ করেছি স্টিফেন ফ্রাইয়ের কণ্ঠস্বরের মধ্যে দিয়ে। আর আমি এমনিতেই ভদ্রলোকের ভক্ত। ওঁর পাঠ করা আর একটা বই অডিবেলে শুনেছি এ'বছর- ম্যাট হেগের "এ বয় কল্ড ক্রিস্টমাস"। স্টিফেন ফ্রাই পড়েছেন মানেই মোটের ওপর নিশ্চিন্ত যে গল্পটা দারুণই হবে। আর ম্যাট হেগের এই রূপকথার গল্পটা এত সুন্দর। শৈলেন ঘোষ টেমপ্লেটে লেখা যেন। ক্রেয়নে আঁকা ছবির মত অপরূপ, আর সেই আঁকার মধ্যে রয়েছে বাপ-ছেলের ভালোবাসার গল্প। বারবার পড়তে (শুনতে) ইচ্ছে করবে।
পুজোয় কাশ্মীর ঘুরতে গিয়ে লিডর নদীর পাশে মাদুরে শুয়ে পড়লাম কল্কেকাশির জিনিয়াস লেভেলের গোয়েন্দাগিরি। ব্রিলিয়ান্টত্বের একটা লিমিট থাকা উচিৎ কিন্তু শিব্রামের একটা বড় সমস্যা হলো যে তাকে নিয়মকানুন লিমিট-বেলিমিটে বাঁধা যায় না। পাঠকের খ্যাঁকখ্যাঁক হাসির চোটে লিডরের বয়ে যাওয়ার দাপুটে শব্দও চাপা পড়ে গেছিল বোধ হয়। কল্কেকাশির ক্লাসিক ছাড়াও নিয়ে গেছিলাম কিছু পুরনো বই: জোড়া জোড়ায় ডবল ফেলুদা আর ফেলুদা ওয়ান ফেলুদা টু। ফেলুদা ওয়ান আর ফেলুদা টুতে আছে নেপোলিয়নের চিঠি আর এ'বার কাণ্ড কেদারনাথে। জমজমাট, টানটান। কেদারনাথ পড়ে আবার টের পেলাম এ'টা আমার অন্যতম প্রিয় ফেলুগল্প। কিন্তু ইয়ে, ডবল ফেলুদাটা বড্ড নড়বড়ে। অপ্সরা থিয়েটার মামলাটা জাস্ট দাঁড়ায় না। ছদ্মবেশী ক্রিমিনালের মশলা খাওয়া দেখে তাঁকে চিনে নেওয়া রব নে বনা দি জোড়ির চেয়েও কাঁচা ব্যাপার। আর ভূস্বর্গ ভয়ঙ্করটা নিয়ে বেশি ভাবনাচিন্তা না করাই ভালো। কিছু ভালো না লাগলে তা নিয়ে না সাধারণত বলি-লিখি না, কারণ আমি ঠিক ক্রিটিক নই। ফেলুদা এত প্রিয় যে সে ভালোলাগার দাবী থেকেই এ'টা বলে দেওয়া গেল। এ বছরের পড়া সেরা ছোটদের বাংলা বই হলো টং লিং। সে একদম ছোটবেলার হাই-ক্লাস পুজোসং্খ্যার স্বাদ।লীলা মজুমদারের লেখা যে কী সুন্দর আর কী স্মার্ট; অনেক ভাগ্য করে জন্মালে ওই বাংলাভাষা পড়ার সুযোগ হয়। প্রায় টংলিং-য়ের মতই সুন্দর গল্প হলদে পাখির পালক। গোটা বছর আর কিছু না পড়ে যদি লীলা মজুমদারের ওই দুটো বই শুধু বই পড়তাম, তা'তেও বর্তে যাওয়া যেত।
তিনটে বাংলা গল্প-উপন্যাস, যা থেকে পরে সিনেমা হয়েছে, আমার দারুণ লেগেছে। প্রথমে শীর্ষেন্দুর গয়নার বাক্স। বইটার সারল্য, সৌন্দর্য আর হিউমর বোধহয় সিনেমায় ঠিকঠাক তুলে ধরা যায়নি। শীর্ষেন্দুর উইট ও হিউমর মারাত্মক ধারালো, সে'টায় এসে মিশেছে টানটান সোশ্যাল কমেন্ট্রি। ও জিনিস সিনেমায় ফুটিয়ে তোলা সহজ নয় (এ'টা সিনেমার ক্রিটিসিজম নয়)। এ'ছাড়া পড়লাম সুনীলবাবুর অরণ্যের দিনরাত্রি। সিনেমাটা অনবদ্য, নভেলটাও তাই। তবে দু'টোই সম্পূর্ণ আলাদা ওয়ার্ক অফ আর্ট। দু'টোর অ্যাপ্রিশিয়েশনও আলাদাভাবেই করতে হবে। সিনেমাটা দেখে নভেলটাকে বোঝা যাবে না। সুনীলবাবুর লেখা পড়েও সত্যজিতের সিনেমার কোয়ালিটি আঁচ করা যাবে না। উপন্যাসটা একটু বেশি ডার্ক, খানিকটা দমবন্ধ করা। বই চরিত্রগুলোও সিনেমার চরিত্রদের থেকে পুরোপুরি আলাদা; এবং সে'টা একটা পজিটিভ ব্যাপার। ভাগ্যিস বইটা পড়েছি। আর পড়লাম গিয়ে নারায়ণ সান্যালের "পাষণ্ড পণ্ডিত"। এই সিনেমাটা আমি দেখিনি। কিন্তু এ গল্পে সান্যালবাবুর ভাষা যে কী সুন্দর। আর পণ্ডিতের চরিত্র; ঠিক এই ধরণের চরিত্রকে চেনার জন্য অনায়াসে নভেল একটানা পড়ে শেষ করা যায়।
এ বছরের পড়ার মধ্যে থেকে থ্রিলারের স্বাদ মেশানো চমৎকার দুটো গোয়েন্দা উপন্যাস রেকমেন্ড করতে পারি। প্রথমটা অ্যান্থনি হরোউইটজের ম্যাগপাই মার্ডারস। দ্বিতীয়টা শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যর শেষ মৃত পাখি। দু'টো নভেলই দুর্দান্ত আর গড়পড়তা ডিটেকটিভ গল্পের গতে বাঁধা নয়। স্পয়লার না দিয়ে বলি, দু'টো নভেলেই রয়েছে প্যারালাল প্লট, পেশাদার গোয়েন্দার পাশাপাশি রয়েছেন পরিস্থিতির ফেরে এবং সৎ অবজার্ভেশনের মিশেলে তৈরি সত্যসন্ধানী । রয়েছে অজস্র সুতোর জট এবং সুচারু লজিক-নির্ভর জট ছাড়ানো। দুটো গল্পেই পুরুষ লেখক নারী প্রটাগনিস্টের হয়ে লিখেছেন। আর দু'টো বইই একবার ধরলে শেষ না করা পর্যন্ত থামা যায় না। শেষ মৃত পাখির মত উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে বিরল। বোনাস: বাংলা আধুনিক কবিতা ও সেই কবিতার জগতের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে সে গল্পে। আমার সাজেশন হবে দু'টো বই পর পর পড়ার। একই জাতের আর একটা বই এ বছর আমার বেশ ভালো লেগেছে; বেঞ্জামিন স্টিভেনসনের "এভ্রিওয়ান ইন মাইন ফ্যামিলি হ্যাস কিল্ড সামওয়ান"। নভেলের শিরোনাম যতটা ইন্টারেস্টিং, প্লট ও লেখনীও ততটাই টানটান। শুরুতেই প্রোটাগনিস্ট বুলেট পয়েন্টে বলে দিচ্ছেন আদর্শ গোয়েন্দা গল্প কেমন হওয়া উচিৎ (যে'গুলো আমার মতে দুর্দান্ত লিটমাস টেস্ট)। তারপর গল্প যত এগিয়েছে, প্রোটাগনিস্ট নিজের গল্পের কোয়ালিটি সেই সব লিট্মাস টেস্টের নিরিখে ক্রমাগত যাচাই করে গেছেন - একদম জবরদস্ত ট্রীটমেন্ট যাকে বলে।
এ বছর একটা বিটকেল এক্সপেরিমেন্ট করেছি। আমি এমনিতে বইপত্র ধীরেসুস্থে পড়ি এবং খানদুই-তিনেক বই প্যারালালি পড়ি। ক'দিন আগে কোরবা থেকে হাইওয়ে ধরে রায়পুর ফিরছিলাম, সন্ধের ফ্লাইটে মুম্বই ফেরার কথা। সঙ্গে লীলা মজুমদারের টংলিং আর শীর্ষেন্দুর ঘুণপোকা। সাধারণত প্যারালালি দু'টো বই পড়া মানে দুপুরে একটা পড়লে রাত্রে অন্যটা। কিন্তু সে'দিন কী ইচ্ছে হলো টংলিং আর ঘুণপোকা একসঙ্গে পড়া শুরু করলাম; কয়েক পাতা টংলিং আর কয়েকপাতা ঘুণপোকা। এ'দিকে টংলিং হলো ছোটদের মনভালো করা গল্প আর ঘুণপোকা অন্ধকার পচা-গলা এক টুকরো পৃথিবীর খবর। ঘুণপোকা অস্বস্তিকর কিন্তু ব্রিলিয়ান্ট, অ্যাবস্ট্র্যাক্ট অথচ গতিময়। টংলিং কেমন লেগেছে সে'টা আগেই লিখেছি। এ'বারে কয়েক-পাতা টংলিং কয়েক-পাতা ঘুণপোকা; এই লেফট-রাইট লেফট-রাইটের চক্করে ব্রেনে সর্দিগর্মি লেগে যাওয়ার উপক্রম হলো। তবে কখন যে রায়পুর পৌঁছে গেলাম তা টেরও পাইনি। গোটাবছরে শীর্ষেন্দুর অদ্ভুতুড়ে সিরিজ একটাও রিপীট না করে দু'টো নতুন লেখা পড়লাম; গয়নার বাক্স আর ঘুণপোকা দু'টোই সে অর্থে 'বড়দের'। দু'টোই মেজাজে আর লেখনীতে সম্পূর্ণ ভাবে আলাদা। দু'টোই অনবদ্য।
এ'বাদে গ্রেম সিমিসনের লেখা দ্য রোজি প্রজেক্ট বইটা আমার খুব ভালো লেগেছে। গল্পের নায়ক শেলডন কুপার গোছের একজন নম্বর-সর্বস্ব মানুষ, অতএব তাঁর ভালোবাসার খোঁজও 'স্ট্রিক্টলি স্ট্যাটিস্টিক্স ড্রিভেন'। কিন্তু এই গল্পে শেল্ডন্ত্বই মূল থীম হয়ে দাঁড়ায়নি, রয়েছে মাপা হিউমরে লেখা স্মার্ট রোম্যান্টিক গল্প (ইয়ে, রোম্যান্স লিখলাম তবে এ গল্প ঠিক প্রেমের গল্পও নয়)। রোম্যান্স প্রসঙ্গে বলি, বুদ্ধদেব গুহর বাবলি পড়লাম - হয়ত ওই ধরণের রোম্যান্টিক নভেল অ্যাপ্রিশিয়েট করার পাঠক আমি নই। অথচ বুদ্ধদেববাবুর লেখা কোজাগর আমার ভীষণ প্রিয়। ও'দিকে তোশিকাজু কাওয়াগুচির জাপানী উপন্যাস 'বিফোর দ্য কফি গেটস কোল্ড'য়ের ইংরেজি অনুবাদ পড়ে আমি মুগ্ধ। অ্যাবসার্ড টাইম ট্র্যাভেলের পটভূমিতে লেখা গল্পের কনসেপ্ট মেনে নিয়ে নভেলের মূল থীমে ফোকাস করতে পাঠক হিসেবে আমার একবারও হোঁচট খেতে হয়নি, এই ধরণের প্লটে সে'টা সবচেয়ে জরুরী। চরিত্রগুলো এত ইন্টারেস্টিং আর বিভিন্ন প্লটলাইনগুলো নিখুঁত ভাবে বোনা। এই সিরিজে আরও কয়েকটা বই আছে, পড়বো হয়তো সে'গুলো। ইয়ে, কী বলি; এদ্দিনে এসে জেফ্রি আর্চার ধরেছি। 'কেন অ্যান্ড অ্যাবেল' আর সে'টার সিকুয়েল 'দ্য প্রডিগাল ডটার' পড়লাম। ওরেব্বাবা, গতি কাকে বলে। আর একদম হলিউডি সুপারহিট মার্কা লেখা, প্রায় নেটফ্লিক্স সিরিজ দেখার স্টাইলে পড়ে যাওয়া যায়। প্রায় যেন রেডিমেড স্ক্রিপ্ট। পেল্লায় সাইজের উপন্যাস অথচ একটা প্যারাগ্রাফেও মনে হবে না "এই রে, এইবারে একটু ঝুলে গেলো"; হাইভোল্টেজ এন্টারটেনমেন্ট। তার পাশাপাশি বোনাস হলো বিংশ শতাব্দীর আমেরিকার উত্থানের রাজনৈতিক পটভূমি। ওই যে বললাম, ওয়েবসিরিজের মত বিঞ্জ করা যায়, থুড়ি; গোগ্রাসে গেলা যায়।
ও হ্যাঁ, এই প্রথম বোধ হয় আমি একটা হিন্দি বই পড়েছি (বলাই বাহুল্য পড়িনি, অডিওবুকে শুনেছি);মান্টোর এক্কিস শ্রেষ্ঠ্ কহানিয়া (শ্রেষ্ঠ একুশ)। ইংরেজিতে মান্টোর গল্পের অনুবাদ আগেও পড়েছি। তবে ভাগ্যিস এই বইটা এ'বারে শুনলাম। হয়তো আমার শোনা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বই এ বছর। গভীরতা আর অন্ধকার সত্ত্বেও স্মার্ট স্টাইল আর ডার্ক হিউমরের দিক থেকে মান্টোর লেখা আমার অনন্য মনে হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়তো সে অন্ধকার একটু বেশিই অস্বস্তিতে ফেলেছে, আর যাই হোক; মান্টোর সময় আর আমার রিয়ালিটির মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েইছে। সবচেয়ে বড় কথা আমার মধ্যে মান্টোর গভীরতার এক আনাও নেই যে। তবে ওঁর লেখা ছোটগল্পগুলো না পড়লেই নয়। "ঠাণ্ডা গোস্ত" পড়ে কেঁপে উঠবে না; এমন কোনও পাঠক এ দুনিয়ায় আছে বলে আমার মনে হয় না। এ বই একটানা পড়ে শেষ করার নয়। ধীরেসুস্থে এক-একটা গল্প, এক-একটা চরিত্র আর এক-একটা কথোপকথনকে আবিষ্কার করে এগিয়ে যেতে হয়। মান্টোয় তাড়াহুড়ো করলেই বোধহয় সব মাটি।
দু'টো বই আমায় বেশ হোঁচট খেয়ে খেয়ে পড়তে হয়েছে। কখনও বেশ খানিকটা বোর হয়েছি, মাঝপথে ছেড়ে দেব ভেবেছি। কিন্তু দু'টো বইই শেষ করে আমার মনে হয়েছে যে ভাগ্যিস পড়েছিলাম। বিশেষত বয়সের নিরিখে চল্লিশের ঘরে এসে এই বইদুটো হয়তো আমার চোখে জরুরীই বটে। স্বীকার করতে ক্ষতি নেই যে দু'টো ঠিক 'ব্রিজি রীড' নয়। একটা ফিকশন, একটা নন-ফিকশন। ফিকশনটা হলো রেচেল জয়েসের লেখা দ্য আনলাইকলি পিলগ্রিমেজ অফ হ্যারল্ড ফ্রাই। বৃদ্ধ ফ্রাই একদিন বাড়ি থেকে বেরলেন একটা চিঠি পোস্টবাক্সে ফেলবেন বলে। কিন্তু সে চিঠি আর পোস্ট করা হলো না; তিনি চিঠিটা পকেটে হেঁটেই এগিয়ে গেলেন। এবং তাঁর হাঁটা থামলো না। না, এতে ফরেস্ট গাম্প নেই। বড় দুঃখ আছে, সম্পর্কের টানাপড়েন আছে, হতাশা আছে, সমস্ত শেষ হয়ে যাওয়ার কষ্ট আছে। আর আছে এগিয়ে যাওয়ার সাহস। গল্পের প্লটে বিশেষ মারপ্যাঁচ নেই, অতএব স্পয়লার দিয়ে দেওয়ার ভয় নেই। তবে ওই হোঁচট খাওয়া সত্ত্বেও পড়ে যাওয়াটাই পাঠকের একমাত্র কর্তব্য। ভালো যে লাগবেই সে গ্যারেন্টি দেওয়া মুশকিল। তবুও এ বইটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। সে'রকমই গুরুত্বপূর্ণ আর একটা বই, এ'টা নন-ফিকশনঃ ইচির কিশিমি আর ফুমিতা কোগার বই 'দ্য করেজ টু বি ডিসলাইকড'। গোড়াতেই বলে দিই আমি ঠিক 'ডেভেলপমেন্টাল বই' পড়ার মানুষ নই। তবে এই বইটার শিরোনামই এই বইয়ের মূল বক্তব্য। ফ্রয়েডিয়ান সাইকোলজির প্যারালাল মত নিয়ে গড়ে ওঠা একটা কনভার্জেশন। ওই, এ'টাও আমায় হোঁচট খেয়ে এগোতে হয়েছে। মাঝেমধ্যে মনে হয়েছে একই জিনিস ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলা হচ্ছে। গোটা বইটাই একটা কাল্পনিক কথোপকথনের স্টাইলে লেখা আর আমার কখনও মনে হয়েছে যে এইবারে জাস্ট জোর করা কথা ঢোকানো হচ্ছে। তা সত্ত্বেও এই বইটা আমার কাছে ব্যক্তিগতভাবে জরুরী মনে হয়েছে - ভাগ্যিস পড়লাম এই "দ্য করেজ টু বি ডিসলাইকড"।
নন-ফিকশন প্রসঙ্গে যখন ঢুকেই পড়েছি, তখন আরও কয়েকটা বইয়ের খবর দিয়ে দিই। ভারতবর্ষের ইতিহাস নিয়ে বছরে অন্তত একটা বই পড়ার চেষ্টা করছি। এ বছর পড়েছি জন জুব্রিস্কির 'দ্য শর্টেস্ট হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া'। এক ট্রেনযাত্রায় সহযাত্রীর হাতে ওই বইটা দেখে গুডরীডসে সে'টার ব্যাপারে খানিকক্ষণ পড়ে তারপর এ'টাকে বেছে নিয়েছিলাম। দিব্যি লেখা, তরতরিয়ে এগোনো যায়, ভালোই লাগলো। সঞ্জয় বারুর লেখা নরসিমহা রাওয়ের ওপর বইটা (১৯৯১ঃ হাউ পি ভি নরসিমহা রাও মেড হিস্ট্রি) পড়েছিলাম গত ইলেকশনের সময়, 'এন্টারটেনমেন্টের জন্য'। আর পাঁচটা খেটেখুটে ডিটেইল ঘেঁটে লেখা রাজনৈতিক বইয়ের মতই এ'টাও মশলায় ভরপুর; অতএব নিখাদ এন্টারটেনমেন্ট। গত বছর পড়া মর্গান হাউসেলের দ্য সাইকোলজি অফ মানি আমার খুব কাজের বই মনে হয়েছিল। এ বছরের শুরুতে ওঁর লেখা 'সেম অ্যাস এভার' বইটা পড়েছিলাম। সাইকোলজি অফ মানির মত জমাট মনে হয়নি, কিন্তু কিছু খুব প্র্যাক্টিকাল কনসেপ্ট নিয়ে সহজ ভাষায় লেখা। বয়সের ধর্ম অনুযায়ী আজকা; সেভিংস ব্যাপারটা সম্বন্ধে একটু ফিলোসফিকাল ভাবনা-চিন্তা আজকাল মাথার মধ্যে ঢুকে পড়ে, সে'দিন থেকে এ বইটা পড়তে মন্দ লাগলো না। অডিবেলের ক্রেডিট ব্যাবহার করে পড়েছি ইয়ুভাল হারারির লেখা "নেক্সাস"। সোশ্যাল মিডিয়ার অ্যালগোরিদম আর আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কোন পর্যায় পৌঁছে যেতে পারে (এবং গেছে) সে নিয়ে একের পর গা-কাঁপানো গল্প বলে গেছেন হারারি। ভদ্রলোক গুছিয়ে গল্প বলতে পারেন, সে'দিক থেকে বইটা পড়তে বেশ লাগে। তবে ইদানীং ওঁর পডকাস্ট এত শোনা যায় যে বইয়ে পড়া অনেক আইডিয়াই মনে হয় যেন এইত্তো সে'দিন পডকাস্টে শুনলাম। তবে মোটের ওপর মন্দ লাগলো না। ও'দিকে সত্যজিৎ রায়ের "স্পীকিং অফ ফিল্মস"-য়ের অডিওবুকও রয়েছে অডিবেলসে, শুনে ফেললাম। এ আনন্দ অনেকটা শেন ওয়ার্নের বায়োগ্রাফিতে লেগস্পিন নিয়ে ওঁর অভজার্ভেশন পড়ার মত; থ্রিলিং! বিশেষত বাংলা সিনেমার ওপর যে দু'টো চ্যাপ্টার, সিনেমার সংলাপ নিয়ে লেখা একটা প্রবন্ধ আর চারুলতার ওপর যে লম্বা লেখাটা রয়েছে, ও'গুলো এত ভালো লাগলো যে বেশ বার কয়েক শুনতে হলো। সব ছাই বুঝেছি তাও হয়ত নয়, আমি সিনেমা আর কত দেখি। কিন্তু একজন জিনিয়াস তাঁর ভালোবাসার বিষয়ে কথা বলছেন; সে জিনিস যে অমূল্য। জিনিয়াস প্রসঙ্গে বলি; মুজতাবার আলির 'দেশে বিদেশে' পড়লাম (বহু আগে একবার পড়েছিলাম বটে)। বড় কপাল করে বাঙালি হয়ে জন্মেছি তাই মুজতাবার ভাষায় মুজতাবার অবজার্ভেশন আমি পড়তে পারি। এ বছর আফগানদের সম্বন্ধে দু'টো জরুরী বই পড়েছি, তার মধ্যে একটা এইটা।
আফগানিস্তান সম্বন্ধের আর একটা যে বই পড়েছি সে'টা আগাগোড়াই একটা রূপকথার গল্প। রূপকথা বললাম একটু চমক দিতে, আদতে নন-ফিকশন। কিন্তু গল্প হলেও সত্যি যদি কোনোদিন কোনও বইয়ের শিরোনাম হতে পারে তবে সে'টা এই বইটা। টিম আলবোনের লেখা "আউট অফ দ্য অ্যাশেস"। আমার পড়া এ বছরের সেরা ক্রিকেট বই; আফগানদের ক্রিকেট শেখা, বোঝা, ভালোবাসা এবং এগিয়ে যাওয়াঃ এ'টা যে কোনও গাছে-গরু-তোলা গল্পকে ছ'গোলে হারাবে। বছর তিরিশেক আগে আফগানরা ক্রিকেট পিচ-টিচ চিনতো না, তারপর দেশটার ওপর দিয়ে একটানা ঝড় বয়ে গেল। আর এত সব কিছুর মধ্যিখানে ক্রিকেট দুদ্দাড় করে এগিয়ে এগিয়ে; এগিয়ে এলেন রাশিদ-নবীরা। এ বই নিয়ে আর একটু বিশদে লেখার ইচ্ছে ছিল। তা না করে যাকেই পাই তাঁকে টেনে বলি, "এই বইটা পড়ুন প্লীজ"। আর একটা ক্রিকেট বইয়ের উল্লেখ না করলেই নয়, সে'টা হলো আর একটা ক্রিকেট পাগল দেশের ক্রিকেটীয় বায়োগ্রাফি; অ্যান আইল্যান্ডস ইলেভেন। শ্রীলঙ্কার ইতিহাসের সঙ্গে রাজনীতি, ধর্মের পাশাপাশি ক্রিকেট ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে। নিকোলাস ব্রুকসের লেখা এই বইটা শুধু ক্রিকেটের বই নয়, এ'টা ইতিহাসের সিলেবাসে ঢুকে যেতে পারে অনায়াসে। বইয়ের তিন ভাগের দু'ভাগ জুড়ে রয়েছে শ'দেড়েক বছরের ক্রিকেট (এবং অবশ্যই রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক) ইতিহাস; আশির দশকের শেষ পর্যন্ত। নব্বুই দশকের পরের ঘটনাগুলোও সবিস্তারে আছে তবে সে'টা হয়তো অনেকটা জানা বলেই সে'টা আমায় ব্যক্তিগতভাবে তেমন টেনে রাখেনি। কিন্তু দুর্দান্ত বই; ওই যাকে বলে "মাস্ট রীড"।
এ বছরে আমার পড়া সেরা বই কোনটা? দু'টো বইয়ের কথা বলা দরকার। এবং কী আশ্চর্য, এত ফিকশন পড়ে মুগ্ধ হলাম, তবে যে বই দু'টো সবচেয়ে ভালো লাগলো সে' দু'টোই নন-ফিকশন। একটা বাংলা আর একটা ইংরেজি। প্রমথনাথ বিশীর লেখা রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন গত জুলাই মাসে পড়ে ব্লগে সে বই ভালো লাগা সম্বন্ধে দু'চার কথা লিখে রেখেছিলাম। সে'খান থেকে কয়েকটা লাইনে এখানেও টুকে দিই: এ বই আত্মজীবনীমূলক৷ রসেবসে সামান্য মাত্রাযোগ ইতিউতি হয়ে থাকলে সে দায় প্রমথনাথের, কিন্তু বইটা আগাগোড়া সত্যি ঘটনাক্রমেই বাঁধা৷ ঘটনার ব্যাপারে বিস্তৃতভাবে জানতে হলে মানুষ খবরের কাগজ পড়বে। বইয়ে আশ্রয় নেওয়া সমস্ত ঘটনাদের 'ট্রীটমেন্ট' অন্যরকম হতে হবে; সে'খানে ঘটনাপ্রবাহের সত্যিটুকুকে আগলে রেখে রসালো গল্প ফেঁদে বসাটা লেখকের একটা জরুরি দায়িত্ব৷ সে'দিক থেকে, প্রমথনাথ একজন মডেল লেখক। সতেরো বছর শান্তিনিকেতনে থেকে পড়াশোনা করেছেন প্রমথনাথ। শান্তিনিকেতনের গোড়ার দিনগুলো স্বচক্ষে দেখেছেন, উপভোগ করেছেন৷ রবীন্দ্রনাথ আদর্শ শিক্ষা বলতে যে প্রসেসকে বুঝতেন, সেই প্রসেসের মধ্যে দিয়ে প্রমথনাথের চরিত্র ঘষামাজা হয়েছে৷ সে অর্থে, তাঁর কাছে রবীন্দ্রনাথ শুধু পেল্লায় একজন সাহিত্যিক নন, একজন মাস্টারমশাইও বটে৷ এই বইয়ে সেই মাস্টারমশাই রবীন্দ্রনাথের গল্প রয়েছে৷ আর রয়েছে শান্তিনিকেতনের শান্তিনিকেতন হয়ে ওঠার গল্প। একদিক থেকে সে'টাও রবীন্দ্রনাথেরই গল্প৷ রবীন্দ্রনাথ ভদ্রলোক যে কী 'খতরনাক', আর শান্তিনিকেতন যে কত বড় একটা বিপ্লব; সে কথা অনায়াসে লিখেছেন প্রমথনাথ৷ আর সে'সব তুলে ধরেছেন দুর্দান্ত সব গল্পের মাধ্যমে; সে'খানে মূলচরিত্র হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও উঠে এসেছেন অন্যান্য শিক্ষকরা, স্কুলের ছাত্ররা, অন্যান্য কর্মীরা, আর অতি অবশ্যই; বোলপুর৷ এই বইয়ের স্থান-কাল-পাত্র সমস্ত যদি কাল্পনিকও হত; তা'হলেও এ বই দর্শনের গভীরতা আর হিউমরের ধারে বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল রত্ন হয়ে টিকে রইত। বলাই বাহুল্য, এ বই সত্য-নির্ভর এবং একটি ঐতিহাসিক দলিল৷ নেহাত নিরুপায় পাঠকরা এ বই পড়তে পড়তে মাঝেমধ্যেই হে-হে করে উঠছে, তাই সমঝদার ক্রিটিকরা টুপি খুলে এই বইকে যোগ্য সেল্যুট জানাচ্ছেন না৷
এ বছরের অন্য যে বই আমার সবচেয়ে প্রিয় হয়ে রইল সে'টা হলো অ্যানে লামোটের "বার্ড বাই বার্ড"। এই বইটা আমি অফিস থেকে উপহার পেয়েছিলাম অন্তত বছর দুয়েক আগে। এদ্দিন বইয়ের তাকে অযত্নে পড়েছিল। আমার সবসময়ই আশঙ্কা যে অফিস-টফিস থেকে পাওয়া বই মানেই তা আমায় চুক্কি দিয়ে ডেভেলপমেন্টাল জিনিস পড়িয়ে নেওয়ার চক্রান্ত। হঠাৎ কী খেয়াল হলো একদিন সে বই হাতে নিয়ে ধুলো ঝেড়ে খানিকক্ষণ উলটে পালটে দেখলাম। কয়েক পাতা পড়লাম। তারপর স্রেফ মেঘের ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার মেজাজে পড়ে গেলাম। লেখালিখির বিষয়ে বই, কী'ভাবে লেখা উচিৎ। লেখকরা কী প্রসেসে ভাবেন। সে ভাবনা-চিন্তা কী'ভাবে কাগজে-কলমে ফুটে উঠবে। অতি সহজেই এ বই কেজো হয়ে উঠতে পারতো। হয়ে ওঠেনি কারণ অ্যানে লামোট গল্প বুনতে পারেন। নন-ফিকশন তাঁর হাতে পড়ে রসকষহীন জ্ঞান দেওয়া গালগল্প হয়ে ওঠে না। অতি সহজেই এ বই পড়ে শৈলেন-সঞ্জীব মার্কা ভালোলাগা বের করে আনা যায়। অথচ একটা লাইনও ঘোলাটে নয়। কোথাও ভাষার ওপর-চালাকি নেই। আর যে'টা প্রতিটা পাতায় উজ্জ্বল সে'টা হচ্ছে অ্যানের ধারালো অথচ ভালোবাসায় ভরপুর সেলফ-ডেপ্রেকেটিং হিউমর। লেখালিখি সম্বন্ধে বিস্তর জরুরী কথা বলেছেন তিনি, পড়তে পড়তে ইন্সপ্যায়ার্ড না হয়ে উপায় নেই। অথচ পড়তে গিয়ে এ'টাও স্পষ্ট যে ল্যামট টিউশনি ক্লাসে বসেননি, তিনি গল্প বলার আসর আলো করে বসে আছেন। নিজের আটপৌরে জীবন হাতড়ে একের পর এক দুর্দান্ত গল্প বের করে আনছেন অ্যান আর পাঠক হিসেবে আমরা সমৃদ্ধ হচ্ছি, হাসছি এবং লেখালিখির আইডিয়াটাকে ভালোবাসছি। লেখালিখির ব্যাপারে আগ্রহ না থাকলেও, স্রেফ গল্প শোনার প্রতি আগ্রহ থাকলে নির্দ্বিধায় এ বই পড়ে ফেলুন।
সবশেষে, একটা জরুরী ব্যাপার না বললেই নয়। বই, বইয়ের মধ্যে সেঁধিয়ে থাকা চরিত্ররা, এবং লেখক-লেখিকাতেই বইয়ের পরিচিত শেষ হয়ে যায় না। বেশিরভাগ বইই কোনও পরিচিত মানুষের মাধ্যমে আমাদের কাছে এসে পৌঁছয়। অমুক বই কারুর রেকমেন্ডেশন, তমুক বই কারুর উপহার। অমুক বইয়ের উল্লেখ কারুর সঙ্গে আলোচনার সময় শুনেছি, তমুক বই অন্যের হাতে দেখে আগ্রহী হয়েছে। আর কিছু ভালো লাগা বই আমরা হয়ত অন্য কাউকে গছিয়েছি আর উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করেছি এ'টা জানতে যে সে বইও তাঁদের ঠিক ততটাই ভালো লেগেছে কিনা। প্রায় প্রতিটা প্রিয় বইয়ের সঙ্গেই চেনাজানা মানুষের মুখ মিশে যায় আর সে'খানেই বইদের জীবনের সঙ্গে মিশে যাওয়া। অতএব যারা এ বছর আমায় বিভিন্ন বইয়ের কাছে টেনে নিয়ে গেছেন, তাঁদের বিগলিত 'থ্যাঙ্কিউ' না জানালে এ বইয়ের ফর্দ অসম্পূর্ণই থেকে যাবে।
No comments:
Post a Comment