বেয়াল্লিশ বছরের জীবনে মনমোহন মিত্র একদিনের জন্যও চাকরী বা ব্যবসার মত ফেরেব্বাজিতে পা দেননি। মনমোহনের দাদুর বাবা ছিলেন বর্ধমান জেলার ইসমাইলপুর গ্রামের জমিদার। জমিদারি, পয়সাকড়ি, জমিজায়গা সবই অবশ্য মনমোহনের দাদুর আমলেই উবে যায়। মনমোহনের বাবা ও মিত্র পরিবারের ব্ল্যাকশিপ,চন্দ্রমোহন বনেদী বংশের মুখে কালি লেপে রেলের ক্লার্ক হয়ে চাকরীতে ঢুকেছিলেন, পরিবারসহ এসে উঠেছিলেন কলকাতার এক ঘিঞ্জি কোণার এক দেড়-কামরার বাড়িতে। মনমোহন অবশ্য বংশমর্যাদায় ছোপ পড়ে এমন কিছু করেননি। ঠ্যাঙের ওপর ঠ্যাঙ তুলে জীবন কাটিয়েছেন। স্কুলের অঙ্ক মাস্টার ক্লাস সেভেনে সামান্য অঙ্ক ভুলের জন্য কান মুলে দেওয়ায় আর স্কুল-মুখো হননি। দোর্দণ্ডপ্রতাপ জমিদারি বংশের রক্ত যার ধমনীতে বইছে, সে সামান্য স্কুলমাস্টারের মুখচোপা শুনতে যাবে কেন? আর শিক্ষা কি আর বইখাতা ডিগ্রিতে আছে নাকি, মনমোহন বিশ্বাস করেন স্রেফ চোখকান খোলা রাখাটাই যথেষ্ট।
সামাজিক দায়িত্ব বলতে মাঝেমধ্যে বালিগঞ্জের ছোটমামার বাড়িতে ঢুঁ মেরে থাকেন তিনি। ছোটমামা অজিত দত্ত ডাকসাইটে উকিল, অগাধ টাকাপয়সা। সবচেয়ে আনন্দের ব্যাপার হলো ছোটমামা বিয়ে-থা করেননি। তদুপরি নিশ্চিন্দির ব্যাপার হলো বড়মামা কলেজে পড়ার সময় তিন দিনের জ্বরে মারা গেছিলেন। কাজেই ছোটমামার তিনকুলে এক ওই মনমোহন ছাড়া আর কেউ নেই। বালিগঞ্জের বাড়ি, সিন্দুকের সোনাদানা, ব্যাঙ্কের টাকা পয়সা, শান্তিনিকেতনের ভিলা থেকে বাড়ির চাকরবাকর ও বাবুর্চি ননীরাম পর্যন্ত মনমোহনকেই পকেটস্থ করতে হবে। এ অবস্থায় চাকরী-ব্যবসার চিন্তা করা পাপ। আপাতত একটু হাতটান সামাল দিয়ে চলতে হয়, কারণ ছোটমামার থেকে পাওয়া মাসহারাটা তেমন পকেট-ভরা নয়। তবে ও নিয়ে সবিশেষ মাথা ঘামালে জমিদারিই আমেজ নষ্ট হয়। ছোটমামার হার্টের ব্যামো, ব্লাডশুগার চড়া, এ'ছাড়াও আরও নানাবিধ গোলমেলে রোগ লালনপালন করেছেন বহু বছর। বয়সও নয় নয় করে আশি পেরিয়েছে। এখন-তখন ব্যাপার হয়েই বহুদিন টিকে ভদ্রলোক। বালিগঞ্জের বাড়িতে এসে মামার শরীরের অবস্থা মাঝেমধ্যে যাচাই করে যায় মনমোহন। বুড়োর সঙ্গে খানিকক্ষণ খেজুরে আলাপও জুড়তে হয়, না হলে ননীরামের হাতের পোলাও, মাংস, বিরিয়ানি ইত্যাদি আদায় করা যায় না।
ভাদ্র মাসের এক শনিবার সন্ধেবেলা দু'পাত্তর চড়িয়ে রেডিওয় টপ্পা শুনতে বসেছিলেন। এমন সময় বালিগঞ্জ থেকে ছোটমামার আর্দালি মেহবুব এসে হাউমাউ রব তুলে খবর দিলে মামা আচমকা হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন। অমনি প্রফুল্ল চিত্তে একটা ভালো দেখে সুতীর পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়লেন মনমোহন। শ্মশানে বডির একটা হিল্লে করে নিজের বাসায় ফিরে এলেন ভোরের দিকে। আসার আগে অবশ্য মামার সেক্রেটারি অমরেশকে বলে এসেছেন শ্রাদ্ধটা রাজকীয় ভাবে সারতে হবে, অন্তত আড়াই হাজার লোক নেমন্তন্ন করে দেখাতে হবে যে অজিত দত্তর ভাগনে ভারি মামুলি চিজ নয়। বাড়ি ফিরে নিজের চৌকিতে গা এলিয়ে শ্রাদ্ধের আয়োজন নিয়েই জল্পনা-কল্পনা করছিলেন। কত চিন্তা, শ্রাদ্ধে নহবত বসালে লোকজন নিন্দে করবে কী না, মৎস্য-মুক্তির দিন একটা স্পেশ্যাল ইলিশ উৎসবের আয়োজন করাটা বাড়াবাড়ি হবে কিনা; এমন হাজারো চিন্তা। তা'ছাড়া এ'বার এই ভাঙাচোরা বাড়ি ছেড়ে বালিগঞ্জে গিয়ে উঠতে হবে, রাজ্যপাট বুঝে নিতে হবে। ভোর হলে স্নান করে বেরিয়ে কালীঘাটে পুজো দিয়ে এলেন, অনেকদিনের পুরনো মানত তাই দেরী করা চলে না।
দুপুরের দিকে ভাতেভাত খেয়ে একটু ঘুমের তাল করছেন এমন সময় অ্যাডভোকেট নরেন মণ্ডল এসে হাজির। প্রৌঢ় মানুষ, আর আপত্তিকর-ভাবে বিচক্ষণ। একসময় ছোটমামার জুনিয়র ছিলেন, দু'জনের মধ্যে ভারী দহরমমহরম ছিল। ভদ্রলোক মনমোহনকে পছন্দ করেন না। মনমোহন ভদ্রলোককে পাত্তা দেন না। নরেনবাবু আজ এসে ঘোষণা করলেন যে তিনি এসেছেন ছোটমামার উইলের ব্যাপারে বিশদে জানাতে। এ অবস্থায় খানিকটা মিঠে ব্যবহার না করে উপায় কী।
- বলুন নরেনকাকা, স্থাবর-অস্থাবর যা কিছু আছে, তা এই বেলা বুঝে নেওয়া ভালো।
- হ্যাঁ, তাই ভালো মনু।
- তাঁর আগে বলুন, চা খাবেন? আমার এই বাসায় অবশ্য চা বিস্কুটের বেশি কিছু নেই। কিন্তু বালিগঞ্জে গিয়ে একবার গুছিয়ে বসতে দিন। তারপর আপনি এলেই দামী ওয়াইন খাওয়াব। তা'ছাড়া ননীরাম চমৎকার কাবাব বানায়, নেহাত মামার বাতিকে ও'সব এদ্দিন হতো না...।
- সে'সব কথা থাক এখন। যা বলছিলাম...।
- হ্যাঁ, সম্পত্তির ব্যাপারটা এইবারে...।
- অজিতবাবুর উইল অনুযায়ী তুমি পেয়েছ এক ট্রাঙ্ক কাঁসার বাসনপত্র।
- ও'টা আবার আলাদা করে বলার দরকারটা কী, সবকিছুই যখন...।
- আলাদা? আলাদা কীসের। ও'টাই পেয়েছ তুমি। আর ইয়ে, তোমার মাসহারাটাও এ'বার বন্ধ হলো।
- মামা কি বাড়ি-ঘরদোর টাকা পয়সা সব আশ্রম-ফাশ্রম কোথাও দিয়ে গেছে?
- না, ওই কাঁসার বাসনের ট্রাঙ্ক ছাড়া যা কিছু স্থাবর-অস্থাবর সবই পাচ্ছে বিনোদিনী দাসী।
- বিনোদিনী দাসী? মামা গোপনে বিয়েথা করেছিলেন?
- না না। বিনোদকে অজিতবাবু হপ্তা-খানেক আগে বাড়ি এনেছিলেন নিউ মার্কেট থেকে। বিনোদিনী একটা দিশি টিয়াপাখি।
- মামা নিজের টাকাপয়সা সব একটা টিয়াপাখিকে দিয়ে গেছে?
- অল্পদিনের মধ্যে খুব ভালো বেসে ফেলেছিলেন। তাই গত শনিবার আমায় ডেকে এই উইল বানানোর ব্যবস্থা করে যান।
- কই, গতকাল বালিগঞ্জের বাড়িতে তো তাকে দেখলাম না।
- অজিতবাবু মারা যাওয়ায় তাঁর ভারী মনখারাপ কিনা, তাই সে দু'দিন সে বাইরের লোকের সামনে আসেনি।
জমিদারবাড়ির রক্ত বইছে মনমোহনের শরীরে, অল্পে ভেঙে পড়লে তাঁর চলবে কী করে। মাসহারাও যখন বন্ধ হলো, তখন সে টিয়াপাখির মন যুগিয়ে চলা ছাড়া আর উপায় কী। ফি শনিবার দুপুর নাগাদ দু'শো গ্রাম লাল লঙ্কা কিনে বিনোদের সঙ্গে দেখা করে আসেন মনমোহন। ননীরাম ভেজানো ছোলা দিয়ে যায় দু'জনকে; মনমোহনকে স্টিলের প্লেটে আর বিনোদিনীকে রুপোর বাটিতে।
বিনোদিনী মোটের ওপর গালগল্প চালিয়ে নিতে পারে। মাঝেমধ্যে একই কথা বারবার বলে চলে বটে কারণ তার শব্দের স্টক সে অর্থে মজবুত নয়। তবে রসবোধ আছে। পকেট ফাঁকা হলেও মনমোহনের মেজাজটা রহিস, কাজেই বিনোদের উপর কোনো রাগ পুষে রাখেনি সে। শুধু একটাই ছোট্ট সমস্যা। বিনোদিনী "হরি দিন তো গেল সন্ধে হলো" গাইতে পারে, "হরি হে মাধব" বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে পারে, ননীরামকে "রান্নায় মন নেই তোমার" বলে খোঁটা দিতে পারে; পারে না শুধু মনমোহন নামটা উচ্চারণ করতে। মনমোহন গেলেই সে বিগলিত সুরে বলবে, "রাস্কেলটা এসেছে, রাস্কেলটা এসেছে, রাস্কেলটা এসেছে"। ভারী অদ্ভুত, তবে ওই সামান্য ব্যাপারটা গায়ে মাখেন না মনমোহন।
No comments:
Post a Comment